আরবি ভাষার গুরুত্ব
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
একটি জাতির সার্বিক উন্নতিতে যেসব বিষয় সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তার মধ্যে ভাষা অন্যতম। ভাষা শুধু মনের ভাব প্রকাশের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি দেশ বা জাতির অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিকাশেও অগ্রণী ভূমিকা রাখে। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে আরবি ভাষার অবস্থান ষষ্ঠ নম্বরে। পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে। যার মধ্যে প্রধানত সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো উল্লেখযোগ্য। গোটা পৃথিবীতে বর্তমানে ২২টি দেশের রাষ্ট্রভাষা আরবি। অন্য মুসলিম দেশগুলোতেও আরবি ভাষার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ওআইসিসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিশিয়াল ভাষা আরবি। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠালগ্নে দাপ্তরিক ভাষা ছিল পাঁচটি। পরে আরব নেতাদের প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে আরবিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সর্বশেষ আরবি ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১২ সালের অক্টোবরে ইউনেসকো নির্বাহী পরিষদ বৈঠকের ১৯০তম অধিবেশনে ১৮ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে এ দিনটি ‘আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
এ দিবসটি আরব বিশ্বে গুরুত্ব ও জাঁকজমকভাবে পালন করা হলেও আমাদের দেশে দুবছর ধরে পালিত হচ্ছে। কুরআন-সুন্নাহ আরবি ভাষায় বর্ণিত হওয়ায় এর গুরুত্ব সর্বকালে প্রায় সমান। আরবি ভাষা ইসলামি জ্ঞানচর্চা ও মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
اِنَّاۤ اَنْزَلْنٰهُ قُرْءٰنًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ۰۰۲
‘আমিই আরবি ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছি। যেন তোমরা উপলব্ধি করতে পারো।’[1]
ভাষার সর্বজনীনতা
আরবি ভাষার সঙ্গে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের আত্মার সম্পর্ক। এ দেশের আপামর জনসাধারণ আরবি ভাষাকে পরম শ্রদ্ধা করে। আরবি ভাষার যেমন রয়েছে ধর্মীয় গুরুত্ব, তেমনি রয়েছে বৈষয়িক প্রয়োজনীয়তা। পৃথিবীর প্রায় ৪৫ কোটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা আরবি। ২৫ কোটি মানুষ আরবিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। ২৫টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা আরবি।
অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিবেচনায় আরবি ভাষা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্ব রাখে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি ধরা হয় রেমিট্যান্সকে। এ রেমিট্যান্সের সিংহভাগই অর্জিত হয় আরবি ভাষার দেশসমূহ থেকে। এ দেশের জনগণ যখন আরব দেশে যায়, তখন তারা ভাষা না জানায় বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে। তারা যদি ভালোভাবে আরবি ভাষা জানত, তবে লোকগুলো আরব দেশে নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারত। তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা আরও বেশি আদায় করে নিতে পারত। তাই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরও চাঙ্গা করার লক্ষ্যে হলেও আরবি ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
ভাষাচর্চার ইতিহাস
হিজরি প্রথম শতাব্দীর কথা। বাণিজ্যের সূত্রে আরব-অনারবদের জীবনধারায় সংমিশ্রণ ঘটে। তা ছাড়া আরবি ভাষার বিধিবদ্ধ নিয়ম তখনো ছিল না। ফলে বিশুদ্ধ আরবি ভাষাচর্চা এবং কুরআনের নিগূঢ় রহস্য উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়ে। মূলত তখন থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরবি চর্চা শুরু হয়। আল্লামা ইবনে খলদুন (রহ.) সে সময়ের প্রেক্ষাপটের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন,
فلمّا جاء الإسلام وفارقوا الحجاز لطلب الملك الّذي كان في أيدي الأمم والدّول وخالطوا العجم تغيّرت تلك الملكة بما ألقى إليها السّمع من المخالفات الّتي للمستعربين. والسّمع أبو الملكات اللّسانيّة ففسدت بما ألقي إليها ممّا يغايرها لجنوحها إليه باعتياد السّمع. وخشي أهل العلوم منهم أن تفسد تلك الملكة رأسا ويطول العهد بها فينغلق القرآن والحديث على المفهوم فاستنبطوا من مجاري كلامهم قوانين لتلك الملكة مطّردة شبه الكلّيّات والقواعد يقيسون عليها سائر أنواع الكلام.
‘ইসলাম আগমনের পর আরবের অনেকে হেজাজ ছেড়ে অনারবদের সঙ্গে মেলামেশা আরম্ভ করে। ফলে নবাগত আরবদের কথা শুনতে থাকায় প্রকৃত আরবদের শ্রবণশক্তিতে পরিবর্তন ঘটে। অথচ শ্রবণশক্তি ভাষা শেখার অন্যতম একটি উপকরণ। তখন বিজ্ঞজনরা ভাবলেন, এমন অবস্থা দীর্ঘ হতে থাকলে আরবদের শ্রবণশক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। এতে কুরআন-হাদীস বোঝাও কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে তারা নিজেদের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে ভাষা শেখার মূলনীতি প্রণয়ন করেন। বিভিন্ন নিয়মনীতির আলোকে ভাষার সব শব্দ ও বাক্যকে অন্তর্ভুক্ত করে নেন।’[2]
কুরআন-হাদীসের মাধ্যম
কুরআন-সুন্নাহ বোঝার চাবিকাঠি হিসেবে আরবি ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নিগূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব উপলব্ধিতে আরবি অদ্বিতীয় মাধ্যম। এজন্য যুগে যুগে আলেমরা আরবি শেখার প্রতি উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হজরত ওমর (রাযি.) বলেন,
تَعَلَّمُوا الْعَرَبِيَّةَ؛ فَإنَّهَا مِنَ دِيْنِكُمْ.
‘তোমরা আরবি ভাষা শেখো। তা তোমাদের দীনের অংশ।’[3]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আরবি ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। আর প্রিয় নবী (সা.)-কে আরবি ভাষায় কুরআন-সুন্নাহ প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। দীনের প্রথম অনুসারীরা ছিল আরবি ভাষী। তাই দীনের গভীর জ্ঞানার্জনের জন্য এই ভাষা আয়ত্তের বিকল্প নেই। আরবি চর্চা করা দীনেরই অংশ ও দীনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক।’ (মাজমুউল ফতোয়া: ৮/৩৪৩)
সুস্পষ্টতা
পৃথিবীর যেকোনো ভাষার প্রধানত তিনটি বৈশিষ্ট্য। তা চিন্তাজগতের প্রথম সিঁড়ি, জ্ঞানজগতের আধার এবং যোগাযোগ, ভাষণ-বক্তব্য ও আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আরবি ভাষায় অহি অবতীর্ণ করায় সব ভাষার মধ্যে আরবি এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী। আরবি ভাষায় সহজে পুরোপুরি সুস্পষ্ট ভাব বর্ণনা করা যায়। আরবি ভাষার এ বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি রয়েছে পবিত্র কুরআনেও। আল্লাহ তাআলা বলেন,
بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُّبِيْنٍؕ۰۰۱۹۵
‘সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি।’[4]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আবুল হুসাইন আহমদ ইবনে ফারিস (রহ.) বলেন,
فوصَفه جلّ ثناؤه بأبلغ مَا يوصَف بِهِ الكلام، وهو البيان.
‘আল্লাহ কুরআনকে বয়ান বা সুস্পষ্ট শব্দ দিয়ে অভিহিত করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, অন্য ভাষায় এ বৈশিষ্ট্য নেই এবং মান-মর্যাদায় আরবি ভাষা সব ভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’[5]
[1] আল-কুরআন, সুরা ইউসুফ, ১২:২
[2] ইবনে খালদুন, তারীখু ইবনি খালদুন, দারুল ফিকর লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৮ হি. = ১৯৮৮ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৭৫৪
[3] মারআ আল-কারমী, মাসবূকুয যাহাব ফী ফাযলিল আরব ওয়া শারফিল ইলমি আলা শারফিন নাসব, মাকতাবাতুর রাশাদ লিন-নাশর ওয়াত তাওযী’, রিয়াদ, সৌদি আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪১১ হি. = ১৯৯০ খ্রি.), পৃ. ৬৩
[4] আল-কুরআন, সুরা আশ-শুআরা, ২৬:১৯৫
[5] ইবনে ফারিস, আস-সাহিবায় ফিল ফিকহিল লুগাতিল আরাবিয়া ওয়া মাসায়িলিহা ওয়া সুনানিল আরবি ফী কালামিহা, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৮ হি. = ১৯৯৭ খ্রি.), পৃ. ১৯