জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাতপাতা ইসলামে ঘৃণ্য কাজ

মাহমুদুল হাসান

ভোরে কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠলাম। যাত্রীদের উঠা সবেমাত্র শুরু হলো। আমি টিকিট নিয়ে যথাস্থানে বসে যাই। খানিক বাদেই ট্রেন ঢাকার পথে যাত্রা করবে। হয়তো মিনিট দশেক সময় বাকি রয়েছে ট্রেন ছাড়ার। এ সময় উঠলেন একজন পাঞ্জাবি টুপি পরা লোক। তার হাতে একটি রশিদ বই। লোকটি মাদরাসার জন্য দান কালেকশন করছেন। আমি তখন দৈনিকের পাতায় হাত বুলাচ্ছিলাম।

পাঞ্জাবি টুপি পড়া লোকটি ধীরে ধীরে আমার পর্যন্ত আসলে আমি তাকে সালাম মুসাফাহ করে কালেকশন এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। কিসের কালেকশন? কেন? কোন মাদরাসার জন্য?

প্রশ্ন শুনে লোকটি ছটফটানি দিয়ে উঠে। উত্তরে নান্দাইল পাঠান পাড়ায় অবস্থিত একটি মাদরাসার জন্য তিনি দান কালেকশন করছেন বলে জানান।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ওই স্থানে এই নামের কোন মাদরাসা নেই। বুঝতে আর বাকি রইল না, তিনি ধোঁকাবাজ। পরবর্তী সময়ে আমি তার কাছে মাদরাসার পরিচালকের নাম্বার চাইলে আমাকে একটি সুইচ অফ নাম্বার দিয়ে দ্রুত চলে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন লোকটি। তবে ট্রেন ছেড়ে দেয়ার সাইরেন বাজানোর মুহূর্তে তিনি তার চেষ্টায় সফল হয়ে পালিয়ে যান।

চলার পথে প্রায়শই এমন দান সংগ্রহকারীর মুখোমুখি হতে হয় আমাদেরকে। সরলপ্রাণ অনেকে বিশ্বাস করে এদেরকে দানও করেন। আর এদেরকে দান করার কারণেই বেড়ে চলেছে এসব প্রতারকের সংখ্যা। এর বাইরে রয়েছে একটি ব্যবসায়ী ভিক্ষুক শ্রেণি। যারা ভিক্ষাবণিজ্য চালান নির্লজ্জভাবে। চরম অলসতা ও কর্মবিমুখতার কারণে অভাবী এসব হতভাগ্য বিনা পুঁজির মাধ্যম হিসেবে নির্লজ্জভাবে বেছে নেয় ভিক্ষাবৃত্তি।

কৃত্রিমভাবে ভিক্ষুক সৃষ্টির বিষয়টিও প্রায়ই আসে মিডিয়ায়। বিকলাঙ্গ শিশু, প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ কোনো ব্যক্তিকে মাধ্যম বানিয়ে চালিয়ে যান ভিক্ষা বাণিজ্য। ধোঁকাবাজির মাধ্যমে আবার সিন্ডিকেট করে এক শ্রেণির লোক একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। যেখানে ভিক্ষা করাটাও একটা চাকরি। একজন ভিক্ষুক সারাদিন ভিক্ষা করে যা উপার্জন করে সেটা দিয়ে দিতে হয় মালিককে।

ইসলামের লেবাস কিংবা অনুভূতিকে পূঁজি করে বিচিত্র আর নানা কৌশলে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে এরা। অথচ ইসলামে ভিক্ষা কিংবা কারও কাছে হাত পাতা একটি ঘৃণ্য কাজ। পৃথিবীর ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলামই ভিক্ষা কিংবা কারও কাছে হাত পাতার বিষয়ে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে। হযরত সামুরা ইবনে জানদুব (রাযি.) থেকে বর্ণিত মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ভিক্ষাবৃত্তি হলো ক্ষত স্বরূপ; এর দ্বারা মানুষ মুখমণ্ডলকে ক্ষতবিক্ষত করে’ (সুনানে নাসায়ী: ৫/৯৭)। তাই তো রসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবীদেরকে কারও কাছে হাত না পাতার ব্যাপারে শপথ করিয়েছেন।

হযরত আউফ ইবনে মালিক (রাযি.) বলেন, ‘আমরা রসুলুল্লাহ (সা.) দরবারে নয়জন, আটজন কিংবা সাতজন ছিলাম। তিনি আমাদের বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রসুলের হাতে বায়আত গ্রহণ করবে না? অথচ আমরা মাত্রই আকাবায় বায়আত গ্রহণ করেছি। আমরা বললাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমরা তো আপনার হাতে বায়আত গ্রহণ করেছি। তিনি আবার বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রসুলের হাতে বায়আত গ্রহণ করবে না? আমরা তখন হাত বড়িয়ে দিয়ে বললাম, হে রসুল! আমরা তো বায়আত গ্রহণ করেছি। এখন আবার কিসের বায়আত? তিনি বললেন, ‘এই মর্মে শপথ নাও, কেবল আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, আমিরের কথা মেনে চলবে। তারপর তিনি নিচু স্বরে একটি গোপন কথা বললেন, আর মানুষের কাছে কোনো কিছু চাইবে না’ (মুসলিম শরীফ: ২/৭২১)

অন্যদিকে অভাব ছাড়া যদি কেউ কারও কাছে হাত পাতে তাহলে ইসলাম একে নিষিদ্ধ করে এর জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা করেছে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অভাব ব্যতিত ভিক্ষা করল সে যেন জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করলো (মুসনদে আহমদ: ২৯/৫১)

কিছু লোক আছে যাদের সম্পদ থাকা সেত্ত্বেও তারা তাদের সম্পদ বাড়ানোর জন্য অন্যের কাছে হাত পাতে। রসুলে করীম (সা.) তাদেরকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য কারও কাছে ভিক্ষা চায় সে তো জাহান্নামের আগুন ভিক্ষা চায়। তার ইচ্ছা, সে চাইলে জাহান্নামের আগুন কম ভিক্ষা করতে পারে বেশিও ভিক্ষা করতে পারে (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১/৫৮৯)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কারও কাছে কিছুই না চাওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা করবে ইসলামে তার জন্য শুভ সংবাদ।

হযরত সাউবান (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি এই মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে যে সে অন্যের কাছে হাত পাতবে না, আমি তার জান্নাতের জিম্মাদারি গ্রহণ করবো (ইবনে মাজাহ: ১/৫৮৮)। একান্ত অভাবে পড়েও কারও কাছে হাত না পেতে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজ হাতে উপার্জন করা ইসলামের শিক্ষা। ইসলামই বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছে এই শ্লোগান, ‘নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা’। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কারও নিজ পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করা কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। তাকে (প্রার্থীকে) সে কিছু দিক বা না দিক’ (বুখারী শরীফ: ২/৫৩৫)

হিজরতের পর হযরত আলী (রাযি.) মদিনায় তীব্র অভাবে পড়েন। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারছিলেন না। তবুও তিনি কারও কাছে হাত পাতলেন না। বরং হাত পাতা ত্যাগ করে শহরতলির দিকে কাজের সন্ধানে বের হয়ে পড়েন। এক জায়গায় একটি মেয়েকে মাটি জমা করতে দেখে তিনি ভাবলেন, হয়তো মেয়েটি মাটি ভিজাবে। ওই মেয়েটির কাছে গিয়ে তিনি একেকটি খেজুরের বিনিময়ে একক বালতি পানি কূপ থেকে তুলে দিলেন। পর্যায়ক্রমে ১৬ বালতি পানি ১৬টি খেজুরের বিনিময়ে উঠিয়ে দিলেন। এমনকি তার হাতে ফোসকা পড়ে গেল। মেয়েটির কাছ থেকে ১৬টি খোরমা পারিশ্রমিক নিয়ে তিনি চলে এলেন রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে। নবীজির কাছে সবিস্তার ঘটনাটি বললেন। কারও কাছে হাত না পেতে কর্মের পথ অবলম্বন করায় নবীজি (সা.) এতটাই খুশি হলেন যে হযরত আলী (রাযি.)-এর সঙ্গে খেজুর খেয়ে এ কাজটিকে স্বাগত জানালেন।

কারও কাছে হাত না পেতে উপার্জনের জন্য শ্রমে লিপ্ত থাকাকে তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ বলে উল্লেখ করেছেন। হযরত কা’ব ইবনে উজরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এক লোক রসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট দিয়ে গমন করলে সাহাবায়ে কেরাম লোকটির শক্তি, স্বাস্থ্য ও উদ্দীপনা দেখে বলতে লাগলেন, এই লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে থাকত! রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যদি লোকটি তার ছোট ছোট সন্তান অথবা তার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য উপার্জন কিংবা নিজেকে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর পথেই রয়েছে (হায়সামী: ৪/৩২৫)

কেউ যদি অভাবের কারণেও সাহায্য চায় তবুও ইসলাম তা অপছন্দ করেছে। কারও দ্বারস্থ না হয়ে কর্মের প্রতি তাকে উৎসাহিত করেছে। মানুষের কাছে হাত না পেতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে হালাল উপার্জনের চেষ্টায় ব্রতী হলে আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত করে দেবেন, আল্লাহর করুণার প্রাচুর্য দান করবেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রসুলে করীম (সা.)-এর কাছে কিছু আনসার লোক সাহায্য চাইল, তিনি তাদেরকে কিছু দান করলেন। তারা পূণরায় প্রার্থনা করলে নবীজি (সা.) তাদেরকে দান করেন এবং তার সঞ্চয় শেষ হয়ে যায় অতপর তিনি বলেন, আমার নিকট গচ্ছিত আর কোনো সম্পদ নাই। যে ব্যক্তি অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকবে আল্লাহ তাকে পবিত্র এবং অমুখাপেক্ষী করবেন। যে ব্যক্তি অভাবের কথা মানুষের কাছে প্রকাশ করবে তার অভাব দূর হবে না এবং যে ব্যক্তি তা আল্লাহর করছে নিবেদন করবে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট (মুসলিম শরীফ: ২/৭২৯)

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ