ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
ব্যবহার মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য উপাদান। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে জগতের সব মানুষ পারস্পরিক সর্বোত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখে। সুন্দর ব্যবহারকে ইসলামে অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মানুষ নিজেকে অন্যের কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। সব মানুষেরই নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করার জন্য তার ব্যবহারকে অমায়িক করে গড়ে তোলা দরকার। কেননা, আচার-ব্যবহারের মধ্য দিয়েই মনুষ্যত্বের প্রকৃত পরিচয় ফুটে ওঠে। মানুষ ভালো কথাবার্তা ও আচার-ব্যবহার গঠনের মাধ্যমে নিজেকে শোভন, সুন্দর আর পরিশীলিত করে অন্যের প্রীতিভাজন হয়ে উঠতে পারে। সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন,
وَبِالْوَالِدَيْنِ۠ اِحْسَانًا وَّبِذِي الْقُرْبٰى وَالْيَتٰمٰى وَالْمَسٰكِيْنِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبٰى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْۢبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ١ۙ وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْؕ ۰۰۳۶
‘তোমরা পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকটতম প্রতিবেশী, দূরবর্তী প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে।’[1]
মানুষের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার ও ইসলামি শরীয়া পরিপালন পরস্পর সহধর্মী। তাই পরস্পরের প্রতি ভালো ব্যবহার মানবজীবনের অন্যতম ব্রত হওয়া উচিত। মানুষের শোভন ও সুন্দর হয়ে ওঠার জন্য জীবন চলার পথে সুন্দর আচার-ব্যবহারের মানসিকতা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। মানবসমাজে বংশের আসল পরিচয় তার আচার-ব্যবহার। তাই মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্য আচার-ব্যবহার সুন্দর হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। মানুষের সত্যিকার পরিচয় তার ব্যবহারেই ফুটে ওঠে। একজন মানুষ ভালো কি মন্দ, তা তার ব্যবহার দেখেই ধরে নেওয়া যায়। ভদ্রলোকের কথাবার্তা, আদব-কায়দা ও আচার-আচরণ থেকে সদ্ব্যবহার প্রকাশ পায়। একজনের ব্যবহার ভালো হলে সে সহজেই সবার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠতে পারে। যেমনভাবে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, ‘ভালো কথা ও সাদকা করা উত্তম কাজ। সুতরাং তোমরা দোজখের আগুন থেকে বেঁচে থাকো, একটি খেজুর দিয়ে হলেও। যদি তা না পাও, তাহলে মধুর ভাষা ও ব্যবহারের বিনিময়ে।’ (বুখারী শরীফ)
মানবসমাজে সবাইকে ভদ্রোচিতভাবে অন্যের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে কথায় ও কাজে আত্মসংযমী হতে হয়। মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, কাউকে কথা দিয়ে প্রতিশ্রুতি না রাখা, অবান্তর প্রশ্ন করা এবং অহেতুক রাগ-অনুরাগ বা হিংসা-বিদ্বেষ করা উচিত নয়। পরিচিত লোকজনের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করা, ছোটদের স্নেহ-ভালোবাসা, গুরুজনদের মান্য করা এবং অতিথিকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করা সবার দায়িত্ব। সালামের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে খুশিমনে সালামের জবাব দেওয়া অবশ্যকর্তব্য। সৎ মানুষকে সর্বোত্তম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। একে অন্যের সঙ্গে সব সময় হাসিমুখে কথা বলা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন এবং সর্বোত্তম পন্থায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন। তাই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
اُدْعُ اِلٰى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِيْ هِيَ اَحْسَنُؕ ۰۰۱۲۵
‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত (প্রজ্ঞা) ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করো সদ্ভাবে।’[2]
সুতরাং মানুষকে হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা নৈতিক দায়িত্ব। বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দ্বারা গ্রাহকদের অভ্যর্থনা দিতে হবে। একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষের সঙ্গে যে কেউ কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করলে তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও প্রশংসা লাভ করা যায়। ব্যবহার ভালো হলে সবাই তাকে ভালো বলে ও পছন্দ করে। ভালো ব্যবহার করলে অন্যের কাছ থেকেও সদ্ব্যবহার পাওয়ার আশা করা যায়। সুন্দর ব্যবহারই মানুষকে শান্তিপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে, জীবনে মহৎ কিছু করতে চাইলে অবশ্যই সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে হবে। সুন্দর ব্যবহারই মানুষকে সব দিক থেকে সুন্দর করে তোলে। মুমিনের সম্প্রীতিবোধ সম্পর্কে নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নম্র-বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে উচ্চাসনে আসীন করেন।’ (মিশকাত শরীফ)
সুন্দর ব্যবহার গড়ে তুলতে হলে মানুষের মন-প্রাণ উদার হতে হয়। আবার ব্যবহার সুন্দর হলে তার মন উদার ও মানবিক গুণাবলিতে ভরপুর হয়ে ওঠে। ভদ্র ও সংযমী আচরণের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সুন্দর ব্যবহার। কারও মধ্যে এসব সদ্বগুণের সমাহার থাকলে তা ধীরে ধীরে মানুষের ব্যবহারকে সুন্দর ও শোভন করে গড়ে তোলে। তাই ইসলামি জীবনাচার, আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার নিজের জীবনে পরিপালন করতে হবে। পরিপাটি হয়ে থাকা, মানানসই জামা-কাপড় পরিধান করা, পারস্পরিক সাক্ষাতে সালাম ও অভিবাদন দেওয়া, উত্তম আচরণ করা এবং অনুমতি নিয়ে কথা বলা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামে শিষ্টাচার বা আদবকে ইমানের অংশ বলা হয়েছে।
সর্বোত্তম ব্যবহার, বিনয়ী চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, আনুগত্য, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে মানবসেবা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। সে-ই সবচেয়ে আদর্শ মানুষ, যার স্বভাব পরিবারের কাছে সবচেয়ে ভালো বলে বিবেচিত। সে-ই পূর্ণ মুসলমান, যার আচরণ সর্বোত্তম। যে ব্যক্তি নিজের লেনদেন ও কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত, ওয়াদা পালন করে, দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে, মানুষকে ধোঁকা দেয় না, আমানতের খেয়ানত করে না, অন্যের হক বিনষ্ট করে না, ওজনে কম দেয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং সুদ-ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ রোজগার ও দুর্নীতি থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে, সে-ই হলো প্রকৃত মুসলমান। খাঁটি মুসলিম সে-ই, যার রসনা ও হাত থেকে মানবজাতি নিরাপদ। কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা চাইবে, তা অন্য ভাইয়ের জন্যও চাইবে।
সমাজকে এমন আলোকিতভাবে গড়ে তোলা দরকার, যাতে সহজেই সব মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সদ্বব্যবহার করার সুযোগ পায়। সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে মানবজীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করার পাশাপাশি চিরন্তন জীবনের মহাশান্তি লাভের পথ সুগম করা সম্ভব।
[1] আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা, ২:৩৬
[2] আল-কুরআন, সুরা আন-নাহল, ১৬:১২৫