মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
এক. বেশি খাওয়া এবং ভালো খাবারের প্রতি লোভী হওয়া
বেশি খাওয়া এবং উদর পূর্তি করে খাওয়া অসংখ্য গোনাহের মূল। এ কারণে হাদীসে ক্ষুধার্ত থাকার অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মানুষের জন্য পূর্ণ করার ক্ষেত্রে পেটের তুলনায় খারাপ কোনো পাত্র নেই (বুখারী শরীফ: ৪৩৪৩)।’
খাবার কম খাওয়ার উপকারিতা
- অন্তরে স্বচ্ছতা সৃষ্টি হয়,
- দিল নরম হয় এবং মুনাজাতে স্বাদ অনুভূত হয়,
- অবাধ্য নফস অপদস্থ ও পরাজিত হয়,
- নফসকে শাস্তি দেওয়া হয়,
- কুপ্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়,
- বেশি নিদ্রা আসে না এবং ইবাদত কষ্টকর হয় না,
- দুনিয়াবি চিন্তাভাবনা কমে আসে এবং জীবিকা নির্বাহের বোঝা হালকা হয়ে যায়।
বর্তমান জমানার লোকেরা পূর্বের তুলনায় অনেক কমজোর হওয়ায় তাদের খাবারের মুজাহাদার ব্যাপারে হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী (রহ.) লিখেছেন, ‘এ জমানায় খাবারের মুজাহাদার অর্থ হলো, পেট পূর্ণ হতে দুই-চার লোকমা বাকি থাকাবস্থায় খাবার শেষ করা এবং নফস বা শরীরের মাধ্যমে খুব কাজ নেওয়া (খুতুবাতে হাকীমুল উম্মত)।’
দুই. অধিক কথা বলা
জবান হলো অন্তরের দূত। অন্তরের যাবতীয় নকশা ও কল্পনাকে জবানই প্রকাশ করে। এ কারণে জবানের ক্রিয়া বড় মারাত্মক হয়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ اِلَّا لَدَيْهِ رَقِيْبٌ عَتِيْدٌ۰۰۱۸
‘তোমাদের প্রত্যেকটা কথাই সংরক্ষণ করা হয়।’[1]
রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«مَنْ يَضْمَنْ لِيْ مَا بَيْنَ لَـحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ، أَضْمَنْ لَهُ الْـجَنَّةَ».
‘যে ব্যক্তি নিজের লজ্জাস্থান এবং জিহ্বার ব্যাপারে আমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবে আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেবো।’[2]
কথা বেশি বলার ক্ষতিসমূহ
- মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়া,
- পরনিন্দা বা অন্যের দোষচর্চায় জড়িয়ে পড়া,
- অনর্থক ঝগড়া-বিবাদ করা,
- অতিরিক্ত হাসাহাসি করা, যার ফলে দিল মরে যায়,
- অন্যের অযাচিত প্রশংসা করা।
চুপ থাকার উপকারিতা
- মেহনতবিহীন ইবাদত,
- সাম্রাজ্যবিহীন দাপট,
- দেয়ালবিহীন দূর্গ,
- অস্ত্রবিহীন বিজয়,
- কিরামান কাতিবীনের শান্তি,
- আল্লাহভীরুদের অভ্যেস,
- হেকমতের গুপ্তধন,
- মূর্খদের উত্তর, ৯. দোষসমূহ আবৃতকারী,
- গুনাহসমূহ আচ্ছাদনকারী।
তিন. অহেতুক গোস্বা করা
রাগ বা গোস্বা অত্যন্ত খারাপ একটি আত্মিক ব্যাধি। রাগ দোজখের আগুনের একটি টুকরো। এজন্য রাগান্বিত ব্যক্তির চেহারা লাল হয়ে যায়। এর কারণে মারামারি ঝগড়া-ঝাটি, গালাগালি, এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত সংঘটিত হয়। এমনকি অনেকে বৃদ্ধবয়সে এসে তুচ্ছ ঘটনায় বিবিকে তিন তালাক দিয়ে পস্তায়। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন,
«لَيْسَ الشَّدِيْدُ بِالصُّرَعَةِ، إِنَّمَا الشَّدِيْدُ الَّذِيْ يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ».
‘সেই ব্যক্তি বাহাদুর নয়, যে যুদ্ধের ময়দানে দুশমনকে নিচে ফেলে দেয়; বরং সেই ব্যক্তি বাহাদুর, যে রাগের মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।’[3]
গোস্বার চিকিৎসা
দুইভাবে গোস্বার চিকিৎসা করা যায়:
- ইলমি বা জ্ঞানগত পদ্ধতিতে,
- আমলি বা কার্যগত পদ্ধতিতে।
ইলমি চিকিৎসা: গোস্বার সময় চিন্তা করতে হবে, গোস্বা কেন আসে? গোস্বা আসার কারণ তো এটাই, যে কাজটি আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে, সে কাজটি আমার মনের মোতাবেক কেন হয়নি? কেন এটা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হলো? তার মানে আমি আল্লাহর ইচ্ছেকে আমার ইচ্ছের অনুগত বানাতে চাই? (নাউযু বিল্লাহ)। এভাবে চিন্তা করলে গোস্বার বদঅভ্যেস দূর হয়ে যাবে।
আমলি চিকিৎসা: গোস্বা এলে
- اَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّيْطٰنِ الرَّجِيْمِ পড়া।
- নিজ অবস্থা পরিবর্তন করা অর্থাৎ দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়া, বসে থাকলে শুয়ে পড়া।
- যার প্রতি গোস্বার উদ্রেক হয়েছে, তার সামনে থেকে সরে পড়া।
- তারপরও গোস্বা ঠাণ্ডা না হলে অজু করা।
- নিজ গালকে মাটিতে লাগিয়ে দেওয়া।
এভাবে আমল করলে গোস্বা দূর হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
চার. হিংসা করা
কোনো ব্যক্তিকে আরাম আয়েশ বা প্রাচুর্যপূর্ণ অবস্থায় দেখে তার সে নেয়ামত দূরীভূত হয়ে নিজের জন্য হাসিল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করাকে হিংসা বলে। হিংসা অত্যন্ত জঘন্য একটি ব্যাধি। আল্লাহ তাআলা হাদীসে কুদসীতে বলেন, ‘আমার বান্দার ওপর নেয়ামত দেখে হিংসাকারী কেমন যেন আমার সেই বণ্টনের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট, যা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে করেছি (ইয়াহইয়াউ উলূমিদ্দীন: ৩/২৯২)।’
রসুল (সা.) ইরশাদ করেন,
«إِيَّاكُمْ وَالْـحَسَدَ، فَإِنَّ الْـحَسَدَ يَأْكُلُ الْـحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْـحَطَبَ».
‘হিংসা নেকিসমূহকে এমনভাবে জ্বালিয়ে দেয়, যেমন আগুন শুকনো লাকড়িসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়। অবশ্য অন্যের কোনো নেয়ামত দেখে সেটা তার মধ্যে বহাল থেকে নিজের জন্য হাসিল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা, যাকে গিবতা বা ঈর্ষা বলে, সেটা বৈধ।’[4]
পাঁচ. কৃপণতা ও সম্পদের মোহ
সম্পদের মোহই মূলত কৃপণতার মূল। আর সম্পদের প্রতি ভালোবাসা মানুষকে দুনিয়ার দিকে আকৃষ্ট করে। ফলে আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালোবাসা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণেই কুরআনে করীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللّٰهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ١ؕ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ١ؕ سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ١ؕ وَلِلّٰهِ مِيْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ١ؕ وَاللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌؒ۰۰۱۸۰
‘আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে যা দান করেছেন, তাতে যারা কৃপণতা করে, এই কার্পণ্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পণ্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কেয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে পরানো হবে। আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও জমিনের স্বত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।’[5]
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,
«وَاتَّقُوا الشُّحَّ، فَإِنَّ الشُّحَّ أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ».
‘তোমরা লোভকে নিয়ন্ত্রণ করো। কারণ এটা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে ধ্বংস করেছে।’[6]
বাস্তবিকপক্ষে সম্পদের মোহ মানুষকে আল্লাহ তাআলা থেকে উদাসীন করে দেয়। এই সম্পদ মুসলমানদের জন্য ভয়াবহ এক ফিতনা। অবশ্য শুধু সম্পদ কোনো নিন্দনীয় ব্যাপার নয়; বিশেষত যদি সে সম্পদ দীনি কাজে ব্যয় করা হয়। নতুবা প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ থাকলে কোনো অসুবিধে নেই, যাতে কারও কাছে ভিক্ষার হাত বাড়াতে না হয় এবং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা যায়।
ছয়. খ্যাতি ও পদের মোহ
খ্যাতি ও পদের মোহ অত্যন্ত নিকৃষ্ট একটি আত্মিক ব্যাধি। এর দ্বারা অন্তরে নেফাক সৃষ্টি হয়। এজন্য নিজেকে সবসময় লুকিয়ে রাখা চাই। খ্যাতির পেছনে পড়া অনুচিত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
تِلْكَ الدَّارُ الْاٰخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لَا يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْاَرْضِ وَلَا فَسَادًا١ؕ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ۰۰۸۳
‘এই পরকাল আমি তাদের জন্যে নির্ধারিত করি, যারা দুনিয়ার বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না।’[7]
রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যদি কোনো বকরির পালের মধ্যে দুটি নেকড়ে প্রবেশ করে, তাহলেও সেটা এত ক্ষতি করে না, যতটা সম্পদ ও পদের মোহ দীনদার মুসলমানদের দীনের ক্ষতি করে।’ (তিরমিযী: ২৩৮১, মুসনদে আহমদ: ১৫৭৯০)
অবশ্য যদি কামনা-বাসনা ছাড়াই আল্লাহ তাআলা কাউকে সুখ্যাতি দান করেন, সেটা দোষণীয় নয়। যেমন- নবীগণ (আ.), সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.), তাবিয়ী ও তবে তাবিয়ীগণ (রহ.)-এর প্রত্যেকেরই দুনিয়াতে খ্যাতি ছিলো। কিন্তু তাঁরা কেউ পার্থিব খ্যাতি কামনা করেননি।
সাত. দুনিয়াপ্রীতি
দুনিয়াপ্রীতি শুধু সম্পদ ও পদের মোহকেই বলে না, বরং ইহজীবনে যেকোনো অবৈধ কামনাকে পূর্ণ করার প্রচেষ্টা ও খায়েশকেই দুনিয়াপ্রীতি বলে। অবশ্য দীনের ইলম, মারেফাতে এলাহি এবং সৎকর্ম—যেগুলোর ফলাফল মৃত্যুর পর পাওয়া যাবে, সেগুলো যদিও দুনিয়াতেই সংঘটিত হয়; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এসবের মুহাব্বতকে দুনিয়ার মুহাব্বত বলে না, বরং এগুলো হলো আখেরাতের মুহাব্বত। দুনিয়ার জীবনের নিন্দাবাদ করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَمَا الْحَيٰوةُ الدُّنْيَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الْغُرُوْرِ۰۰۱۸۵
‘দুনিয়ার জীবনের সবকিছুই ধোঁকার সামান।’[8]
অন্য আয়াতে এসেছে,
اِعْلَمُوْۤا اَنَّمَا الْحَيٰوةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَّلَهْوٌ ؕ ۰۰۲۰
‘দুনিয়ার সামানপত্র রং-তামাশা ও খেলাধুলা ছাড়া আর কিছুই নয়।’[9]
দুনিয়ার ভোগ-বিলাসকে উদ্দেশ্য না করে দুনিয়াকে আখেরাতের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যবহার করা চায়।
আট. অহংকার করা
তাকাব্বুর বা অহংকারের অর্থ হলো প্রশংসনীয় গুণাবলির মধ্যে নিজেকে অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করা এবং অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, হক ও সত্যকে অস্বীকার করা। যখন মানুষ নিজের ব্যাপারে এরূপ ধারণা পোষণ করে এবং আল্লাহর দেওয়া গুণসমূহকে নিজের কৃতিত্ব মনে করে, তখন তার নফস ফুলে ওঠে। এরপর কাজে-কর্মে এর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ রাস্তায় চলার সময় সঙ্গীদের আগে আগে চলা, মজলিসে প্রধানের স্থানে বা সম্মানিত স্থানে বসা, অন্যদেরকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখা বা আচরণ করা অথবা কেউ আগে সালাম না দিলে তার ওপর গোস্বা হওয়া, কেউ সম্মান না করলে তার ওপর অসন্তুষ্ট হওয়া, কেউ সঠিক উপদেশ দিলেও নিজের মর্জির খেলাফ হওয়ায় সেটাকে অবজ্ঞা করা, হক কথা জানা সত্ত্বেও সেটাকে না মানা, সাধারণ মানুষকে এমন দৃষ্টিতে দেখা, যেমন গাধাকে দেখা হয় ইত্যাদি।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অনেক আয়াতে ‘অহংকার’-এর নিন্দাবাদ করা হয়েছে। অহংকারের কারণেই ইবলিস বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়েছে। অহংকারের ফলেই আবু জাহেল মহানবী (সা.)-কে সত্য জেনেও অস্বীকার করেছে। এর আগে বহু সম্প্রদায়কে অহংকারের কারণে ধ্বংস করা হয়েছে। সুতরাং অহংকার শব্দটিকে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, তা সর্বাবস্থায় হারাম এবং এর পরিণাম হলো ধ্বংস ও জাহান্নাম। মহান রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,
وَاعْبُدُوا اللّٰهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْـًٔا وَّبِالْوَالِدَيْنِ۠ اِحْسَانًا وَّبِذِي الْقُرْبٰى وَالْيَتٰمٰى وَالْمَسٰكِيْنِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبٰى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْۢبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ١ۙ وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرَاۙ۰۰۳۶
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তার সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না। আর সদয় ব্যবহার করো মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম, মিসকিন, আত্মীয়-প্রতিবেশী, অনাত্মীয়-প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীর সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক ও অহংকারী।’[10]
হযরত লোকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তার বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْاَرْضِ مَرَحًا١ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍۚ۰۰۱۸
‘তুমি অহংকারবশত মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না। আর জমিনে দম্ভভরে চলাফেরা কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’[11]
রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ করেন,
قِيْلَ ادْخُلُوْۤا اَبْوَابَ جَهَنَّمَ خٰلِدِيْنَ فِيْهَا١ۚ فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِيْنَ۰۰۷۲
‘অহংকারীদের বলা হবে, তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ করো; চিরকাল অবস্থানের জন্য। কতোই না নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল।’[12]
নয়. আত্মতুষ্টি
আত্মতুষ্টি বা নিজেকে নিজে সঠিক মনে করা মূলত অহংকারেরই ভূমিকা বা প্রাথমিক রূপ। পার্থক্য শুধু এতটুকু, অহংকারের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় নিজের নফসকে বড় মনে করা হয় আর আত্মতুষ্টির মধ্যে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা ছাড়াই স্বীয় নফসকে নিজ খেয়ালে পূর্ণাঙ্গ মনে করা হয়। আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতসমূহকে নিজের হক মনে করা হয়। অর্থাৎ এটাকে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ মনে করা হয় না। সেটা যেকোনো মুহূর্তে ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে, সে ব্যাপারে শঙ্কাহীন হয়ে পড়া। এটাকেই তাসাউফের পরিভাষায় ‘উজব’ বা ‘খোদপসন্দি’ বলে। এর চিকিৎসা করা না হলে এটাই কিছুদিন পরে অহংকারে পরিণত হয়ে বান্দাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
দশ. লোকদেখানো (রিয়া বা প্রদর্শনী)
রিয়া বলা হয় নিজ ইবাদত ও ভালো আমলের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে বড়ত্ব ও মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা করা। এটা ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপার। কেননা ইবাদতের দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এখন যেহেতু এই আমলের উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্য শরিকও চলে এসেছে, তাই একে ‘শিরকে আসগার’ বা ছোট শিরক বলা হয়। ইরশাদ হচ্ছে,
وَمَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِيَعْبُدُوا اللّٰهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ١ۙ۬ ؕ۰۰۵
‘মানুষকে কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত করার হুকুম করা হয়েছে।’[13]
রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে তিন শ্রেণির ব্যক্তিকে অধোমুখে করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তারা সবাই হবে রিয়াকার।’ (মুসলিম শরীফ: ১৯০৫)
তারা সারা জীবন দীনের পথে থেকেও অন্তরের একটি রোগের কারণে সবার আগে জাহান্নামে যাবে। রিয়াকে ‘শিরকে খফী’ বা গোপন শিরকও বলা হয়।
[1] আল-কুরআন, সুরা কফ, ৫০:১৮
[2] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. 8, পৃ. 100, হাদীস: 6474
[3] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. 8, পৃ. 100, হাদীস: 6474
[4] আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. 276, হাদীস: 4903
[5] আল-কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ৩:১৮০
[6] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪ হি. = ১৯৫৫ খ্রি.), খ. 4, পৃ. ১996, হাদীস: 2578
[7] আল-কুরআন, সুরা আল-কিসাস, ২৮:৮৩
[8] আল-কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ৩:১৮৫
[9] আল-কুরআন, সুরা আল-হাদীদ, ৫৭:২০
[10] আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা, ৪:৩৬
[11] আল-কুরআন, সুরা লুকমান, ৩১:১৮
[12] আল-কুরআন, সুরা আয-যুমার, ৩৯:৭২
[13] আল-কুরআন, সুরা আল-বাইয়িনা, ৯৮:৫