জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হিজাবধারী ছাত্রীর ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি: ঈমানী চেতনাকে শাণিত করেছে

ভারতে হাজার বছরের বহুমাত্রিক সমাজের ঐতিহ্য ও রেওয়াজ ভেঙে পড়ার উপক্র মহয়েছে। ভারতবর্ষ বহুধর্ম, জাতি, ও নৃগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের ধর্মবিশ্বাস, ভাষা, সংস্কৃতি,  উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য একটি অপরটির থেকে পৃথক। ব্রিটিশ আমল থেকে এ পর্যন্ত বহু শতবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও যুবা প্রাণ হারিয়েছেন। তা সত্ত্বেও সম্প্রদায়গত সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পরিবেশ বজায়রা খার চেষ্টা হয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ হতে। ইন্দো-মুসলিম সভ্যতা নির্মাণে বৃহৎ দুই ধর্মালম্বীদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলিম জনগণ যে ত্যাগ ও কুরবানি দেন তা ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে উৎকীর্ণ রয়েছে। ভারত প্রায় ৭৬৬ বছর মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। বর্তমান শতকের ভারতে এখন সেই পর্বটাকেই ম্লান করে দেওয়ার সচেতন প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। আর স্পষ্টতই এর পেছনে আছে ধর্মীয় বিষোদগার ও ক্ষমতার রাজনীতির সমীকরণ। ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতার মাত্রাবৃ দ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পড়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। অবস্থা এভাবে চলতে থাকলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দ্বারা জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হতে পারে। এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে ‘হিজাব-বিতর্ক’। দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্ণাটক রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ড্রেস কোডের বাধ্যবাধকতা জারি করে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশে বাধা দেওয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে দেশজুড়ে। উদুপি জেলার একটি গার্ল সকলেজে গেরুয়া উত্তরীয় গলায় ঝুলিয়ে একদল যুবকের প্রতিবাদের মুখে হিজাব পরা মুসকান নামের এক ছাত্রী শ্রেণিকক্ষে ঢুকতে না পেরে ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিতে থাকে। এর ভিডিও গোটা দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। মুসলিম এক প্রভাষককে প্রিন্সিপাল হিজাব ত্যাগ করতে বলায় তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। হিজাব-বিতর্কের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। কর্নাটকের বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ছে মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গেও। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রদেশের দাতিয়া জেলার এক সরকারিকলেজেবিশ্ব হিন্দু পরিষদের মহিলা মোর্চা ‘দুর্গা বাহিনী’র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের হিজাব পরিধান নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আনন্দবাজার জানায়। দুর্গা বাহিনীর দাবি কলেজ ক্যাম্পাসে মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরে আসতে পারবেন না। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হল নতুন বিতর্ক।

যেসব মুসলিম মেয়েরা হিজাবের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কর্ণাটক হাইকোর্টে আবেদন করেছে তারা যুক্তি দিয়েছে যে, হেডস্কার্ফ পরা বিশ্বাসের একটি নির্দোষ অনুশীলন এবং নিছক ধর্মীয় জিঙ্গোইজম প্রদর্শন নয়। এটি তাদের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। ‘লাইভ-ল’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, কর্ণাটক হাইকোটেরসিনিয়র আইনজীবী অধ্যাপক রবি বর্মা কুমার আদালতে বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্কৃতিকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রদর্শনের অনুমতি দেয় ভারতেরবহুত্ববাদ।’ ইদানীং শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণেই মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। হিজাব কেন? এটি কি শুধুমাত্র তাদের ধর্মের কারণে? মুসলিম মেয়েদের প্রতি বৈষম্য সম্পূর্ণরূপে তাদের ধর্মের ওপর ভিত্তি করে এবং এই বৈষম্যমূলক আচরণ সংবিধানের ১৫ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে।’ তিনি বলেন, শিখ পুরুষদের সশস্ত্র বাহিনীতে পাগড়ি পরতে দেওয়া হয়। যা একটি স্বীকৃত প্রথা। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের হিজাব পরায় বাধা কোথায়? (নয়াদিগন্ত অনলাইন ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।

কারওয়ার জেলার রাম কৃষ্ণ আশ্রমের প্রধান পুরোহিত স্বামী ভবেশানন্দ বলেন, ‘স্কুল ও কলেজগুলোয় মুসলিম নারী শিক্ষার্থীদের পোশাক বিধি নিয়ে অপ্রয়োজনীয় এক আলোচনা চলছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এ বিষয়ে একটি তুমুল বিতর্কের সাক্ষী হয়ে আমি ব্যথিত। সমাজে শান্তিও সম্প্রীতির স্বার্থে এটা অবশ্যই ভালো কোনো বিষয় নয়।’

এ ব্যাপারে মুসলিম বিম্বকে নজর দিতে হবে। ভারতের সচেতন নাগরিক ও সুশীল সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। নইলে ধর্মোম্মদনার আগুনের লেলিহান শিখার উত্তাপ ভারতের সীমা ছাড়িয়ে উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। অসহিষ্ণুতার উম্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা মানবতার অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে। মিথ্যা অহমিকা, ক্ষমতার রাজনীতি ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ভারতকে অন্ধকারের পথে ঠেলে দিচ্ছে। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ আর কান্না ও আর্তনাদ শুনতে চায় না। দেখতে চায় না ধ্বংসযজ্ঞ। পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে উপমহাদেশের মানুষ বাঁচতে চায়।

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ