পীরে কামেল আল্লামা হাফেজ মুফতি আহমদুল্লাহ
نحمده ونصلي ونسلم علىٰ نبيه الأمين، أما بعد! أعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمٰن الرحيم: [قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّٰى ۙ۰۰۱۴ وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهٖ فَصَلّٰىؕ۰۰۱۵ بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَيٰوةَ الدُّنْيَاٞۖ۰۰۱۶ وَالْاٰخِرَةُ خَيْرٌ وَّاَبْقٰى ؕ۰۰۱۷] {الأعلىٰ: 14 – 17}
সম্মানিত উপস্থিতি
আমরা মানুষ, মানুষ দুটি জিনিস দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। একটা হল মাটি, যেমন আমাদের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হাত-পা-মাথা শরীর ইত্যাদি। আরেকটা হল আত্মা যা অদৃশ্য। আপনারা একটু চিন্তা করলে দেখবেন দৃশ্যমান বস্তু থেকে অদৃশ্যমান বস্তুর দাম অনেক বেশি। যেমন আমরা দৃশ্য আর ফেরেশতা অদৃশ্য যারা আমাদের থেকে অনেক শক্তিশালী এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা সব থেকে বেশি অদৃশ্য তাইতো তিনি সবকিছুর ভারসাম্য রক্ষাকারী তাঁর অসীম শক্তি। এই আল্লাহ তাআলার ফেরেশতারা কখনো তার নাফরমানি করেনা তাদের খোরাক আল্লাহ তাআলার তসবীহ। তাই আল্লাহর বান্দা যখন তার যিকর তসবীহ বেশি পড়ে তখন তাদের মরতবা ফেরেশতা থেকে বেশি হয়ে যায়।
কারণ ফেরেশতার বিকল্প কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই পক্ষান্তরে মানুষের বিকল্প করার শক্তি রয়েছে তার পরেও যদি মানুষ বিকল্প রাস্তা পরিহার করে খোদাই রাস্তা গ্রহণ করে এবং যিকর দজ বেশি বেশি করে আদায় করে তখন সেই মানুষেরা ফেরেশতাদের কেউ ছাড়িয়ে যায়। এজন্যই তো হযরত আদম (আ.) মসজুদে মালাইকা হয়েছিলেন।
মানুষের মধ্যে দুইটি ক্ষমতা রয়েছে একটা হল পাশবিক ক্ষমতা আরেকটা হলো মানুষত্বের ক্ষমতা এ মানুষ যখন আল্লাহ তাআলার যিকর-তসবীহ এবং ইবাদত বেশি বেশি করে করে তখন তার থেকে পাশবিক ক্ষমতা লোপ পেয়ে মনুষ্যত্বের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় আর এই ক্ষমতার মাধ্যমেই মানুষ ফেরেশতাদের থেকেও অনেক বড় মর্যাদা লাভ করে। যেমনটা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে, আকাবিরে দীনকে ও অলী-আউলিয়াকে আল্লাহ তাআলা দান করেছেন।
আল্লাহ তাআলা মানুষ কি আর কি মর্যাদা দেবেন?! তিনি তো মানুষকে মখদুমে কায়েনাত বানিয়েছে। দেখেন সারা পৃথিবীতে যা কিছু আছে আলো-বাতাস পানি মাটি পশুপাখি সাগর-নদী আরও অন্যান্য সবকিছুই মানুষের খেদমতে নিয়োজিত مَا خَلَقْتَ هٰذَا بَاطِلًاۚ ۰۰۱۹۱। কোনো কিছুর জন্য মানুষের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু মানুষের জন্য সবকিছুর প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা সবকিছুই মানুষের কোনো না কোনো উপকারের জন্য বানিয়েছেন বর্তমানে এ তথ্য প্রযুক্তির যুগে সবার কাছে স্পষ্ট।
শরীর পরিচালক
উপস্থিত ভাইয়েরা! আমাদের শরীরে দুটি জিনিস আছে। একটি হল বাহ্যিক যেমন হাত-পা নাক-কান-গলা ইত্যাদি, অন্যদিকে আরেকটি হলো অভ্যন্তরীণ জিনিস যাকে আমরা রুহ বলে জানি। এ রুহ শরীর পরিচালক। যদি রুহ না থাকে তাহলে আমাদের কোনো মূল্য নেই। বরং তখন আমরা লাশ হয়ে যাই। এখন আমাদের বাহ্যিক শরীর ঠিক রাখার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন ঠিক তেমনি অভ্যন্তরীণ জিনিস অর্থাৎ ঠিক রাখার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। শরীরের খাদ্য তো আমরা সবাই জানি। রুহের খাদ্য কি এটা আমরা অনেক কম মানুষই জানি। রুহের খাদ্য হলো তসবীহ আল্লাহ তায়ালার যিকর এবং তাঁর ইবাদত। আমরা যদি বেশি বেশি যিকর করি এবং আল্লাহ তাআলার ইবাদত আদায় করি তাহলে আমাদের ভেতর থেকে পাশবিক চরিত্র দূর হয়ে যাবে এবং মানুষত্বের চরিত্র বৃদ্ধি পাবে যার দরুন আল্লাহ আমাদেরকে ফেরেশতাদের ওপর মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন।
অপরদিকে আমাদের শরীরের বাহ্যিক অংশে যেমন কিছু রোগ ব্যাধি আছে তেমনই রুহানিও কিছু রোগ বেরিয়েছে। যেগুলো বাহ্যিক রোগ ব্যাধি থেকে মারাত্মক। রোগ গুলো কি কি শায়খুল হাদীস আল্লামা জাকারিয়া (রহ.) এগুলোকে চিহ্নিত করেছেন, কিবির, হাসদ, কীনা, উজব ও বদযনী ইত্যাদি।
প্রথম হল কিবির, এটা আমার মতে সবচেয়ে মারাত্মক। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার অন্তরে যাররা বারাবার অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ অহংকার হলো অন্যকে নিজের তুলনায় ছোট মনে করে নিজেকে অন্যের থেকে ভালো ও বড় মনে করা।
এক সাহাবী রসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে রসুল (সা.)! আমি চাই আমার পোশাক-আশাক একটু ভালো হোক, খাওয়া দাওয়া একটু উন্নত হোক এটা কি অহংকার হবে? রসুল (সা.) বললেন, ‘না, এটা অহংকার নয়, এরা তো সুন্দর আল্লাহ তাআলার সুন্দর, আর তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।’
অহংকার হল অন্যকে ছোট মনে করা এবং নিজেকে অন্যের থেকে ভালো মনে করা। এমনকি কোনো কাফেরকেও ঘৃণা করা যাবে না হ্যাঁ তার কুফরি কে ঘৃণা কর। কারণ হতে পারে সে ইসলাম গ্রহণ করবে। তখন সে তোমার চেয়েও অনেক মর্যাদা পেয়ে যাবে।
একটি ঘটনা
আল্লামা কাসেম নানুতুবী (রহ.)-এর এক প্রতিবেশী ছিল কাফের। এমনিতেই তাদের মধ্যে যাওয়া-আসা ছিল। তিনি কোনো দিন ওনাকে দাওয়াত দেননি। হঠাৎ একদিন খবর এলো যে সে কাফের লোকটা মারা গেছে। কাসেম নানুতুবী (রহ.) একদিন স্বপ্নে দেখলেন তার ওই প্রতিবেশী কাফেরটা জান্নাতের মধ্যে তার থেকে এগিয়ে গেছে। তখন তিনি তাকে উদ্দেশ করে বললেন আপনি এখানে কিভাবে? তখন তিনি বললেন আমি মৃত্যুর আগে আমাদের গোপন জিনিসটা পড়েছিলাম (যা সাধারণত ব্রাহ্মণরা মানুষকে জানায় না) সেটার কারণেই আল্লাহ তাআলা আমাকে এত মর্যাদা দিয়েছেন। আর সেটা হল আমাদের কালিমায়ে শাহাদাত: আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসুলূহু।
হককে অস্বীকার করা
মক্কার কাফেররা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিজের ছেলেদের চেয়ে বেশি চিনত যে, তিনি আল্লাহ তাআলার রসুল এবং তারা আরবিও জানতো। তা সত্ত্বেও তারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহর দীন ইসলামকে অস্বীকার করেছেন। এটা একটা কিবিরের প্রকার। তারা মনে করে যে, আমাদের ধর্ম আগে এসেছে, এজন্য আমাদেরটি ভালো, অন্যটা খারাপ।
একইভাবে বর্তমান সমাজে যারা মাযারপূজারী আছে তারাও সবকিছু জানে যে আমরা ভুল পথে আছি, তা সত্ত্বেও তারা সঠিক বিষয়টাকে মানুষের সামনে প্রকাশ করে না। মক্কার কাফেররা যেমন বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে ইসলামকে স্বীকার করত না, এরাও বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে হককে স্বীকার করে না। কারণ তারা ভয় করে যদি আমরা হককে স্বীকার করে ফেলি তাহলে আমাদের কর্তৃত্ব চলে যাবে আর আমাদের উপার্জনও ব্যাহত হবে।
দেখুন আমরা যে গিবত করি, গিবত হল কারো অনুপস্থিতিতে তার কোনো এমন বাস্তব দোষ বয়ান করা যার দ্বারা সে কষ্ট পাবে। আর যদি মিথ্যা হয় তাহলে তার নাম হলো বুহতান, এটা আরও মারাত্মক। কুরআন শরীফে আছে, ‘গিবত জিনা থেকেও বেশি শক্ত ও সমাজবিধ্বংসী খারাপ কাজ ‘ তার কারণ হলো গিবতের মধ্যে অহংকার আছে আর জিনার মধ্যে অহংকার নেই। কারণ যে গিবত করে সে নিজেকে অন্যের থেকে ভালো মনে করে এবং অন্যকে খারাপ মনে করে। পক্ষান্তরে যে জিনা করে সে মনে মনে একথাটা জানে যে আসলে আমি খারাপ কাজ করছি আমি আল্লাহ তাআলার নিষেধকৃত কাজ করছি।
উজব
অন্যের থেকে নিজের কাজ, নিজের রায়কে ভালো মনে করা যদিও তা ভালো ও সঠিক না হয়।
মূর্খতা
ধর্মীয় বিষয়ে অজ্ঞতা এটা সাধারন মানুষের মধ্যে বেশি। যারা তাবলীগের কাজ করে তারা যখন সেই সাধারণ মানুষদের কাছে দাওয়াত নিয়ে যায় তারা বলে তাদের থেকে আমি অনেক বেশি জানি। অথচ তাকে যদি সুরা ফাতেহা জিজ্ঞাসা করা হয় সে সবকিছু উলট-পালট করে ফেলে। এরা জাহেল নয় বরং জাহেলে মুরাক্কাব আর এদের নসিবে কোনো হেদায়েত নেই।
আপনারা বলুন তো আমি যদি নামাজ পড়ি কিন্তু আমার কোরান অশুদ্ধ, তাহলে কি আমি আল্লাহর রহমত পাবো? আমারতো নামাজেই শুদ্ধ হবে না রহমত তো দূরের কথা।
«رُبَّ قَارِئٍ لِلْقُرْآنِ وَالْقُرْآنُ يَلْعَنُهُ».
কুরআন রহমতের জিনিস কিন্তু সে এখানে গুনাগার হচ্ছে। আমাদের এই দেশে আলেম-ওলামার মাধ্যমে পাড়ায় পাড়ায় শহরে শহরে মাদরাসা-মসজিদ হয়েছে কাল কেয়ামতের দিন বাংলার মানুষরা আল্লাহর দরবারে ছাড় পাবে না। কারণ তার সুরা কেরাত ভুল তার আশেপাশে হাজার হাজার আলেম-হাফেজ থাকা সত্ত্বেও সে শুদ্ধ করেনি।
হিংসা
কারো কোনো নিয়ামত দেখে তা তার থেকে চলে গিয়ে নিজের জন্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা। আরেকটা হল ঈর্ষা যখন নিয়ামত দেখে শুধু নিজের জন্যও তা পাওয়ার আশা করা এটা হারাম নয়।
(এরপর পৃ. ১৩-এর ৩য় কলামে দেখুন)