জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছাত্র আন্দোলনে উৎকণ্ঠায় অভিভাবক

ছাত্র আন্দোলনে উৎকণ্ঠায় অভিভাবক

ছাত্রদের কাজ হলো নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা। ছাত্রত্ব বজায় রেখে লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া। ছাত্রের কাজ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা মেনে চলা। ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে দূরত্ব তৈরি না করা। ছাত্র এবং শিক্ষক একে অপরের সহযোগী। ছাত্র তার শিক্ষক থেকে প্রয়োজনীয় ক্লাসের দিক নির্দেশনা পাঠ অর্জন করবে। ছাত্র মনোযোগী হবে শিক্ষকের প্রতি। আর শিক্ষক তৈরি থাকবে ছাত্রকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান প্রদান করতে।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষক, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশিরভাগ জাতীয় এবং বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অভিভাবক মহল তার সন্তানদের পড়ালেখার খরচ যোগান দেন। একসময় পাড়া মহল্লায় লজিং টিউশনি করে ছাত্ররা পড়ালেখা করতো। অজপাড়া গাঁয়ে মানুষের মধ্যে একটা ভালোবাসা ছিলো শিক্ষার্থীদের প্রতি। শিক্ষার্থীরা ঘরে ঘরে টিউশনির মতো ছাত্র পড়িয়ে নিজদের পকেট খরচ নির্বাহ করতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে এভাবে উচ্চশিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করেছিলো। খরচও নির্বাহ করতো। আজকাল তথ্য-প্রযুক্তির যুগে লজিং প্রায়ই বলতে গেলে নেই বললেই চলা যায়। এখন সেই আগের যুগের মতো ছাত্রদের লজিং রাখা হয় না। বহু গ্রামে খবর নিয়ে দেখা গেছে লজিং প্রথা উঠে গেছে।

সেক্ষেত্রে এখন এলাকায় এলাকায় কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। যে ছাত্ররা বড়জন থেকে লজিংয়ের মাধ্যমে পড়াশুনা শিখতো এখন তারা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে আজ সে গ্রামের ছোটমণি ছেলেমেয়েরা কোচিং সেন্টার নির্ভর শিক্ষা অর্জন করছে। অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে টিউশন ফি দিয়ে শিক্ষা নিচ্ছে। বলা যায় লজিং প্রথা প্রায় বন্ধ। সেক্ষেত্রে কোচিং  এবং টিউশনি চালু হয়েছে। অবশ্য সেখানে অভিভাবককে প্রচুর অর্থ গুণতে হয়। পরিস্কারভাবে বলা যায়, অবস্থা দাঁড়িয়েছে অর্থ আছে যার শিক্ষা তার। অর্থ আছে যার চিকিৎস প্রাপ্তি তার। অর্থ ছাড়া শিক্ষা আর চিকিৎসা কিছুই পাওয়া যাবে না। অর্থ তার লাগবেই। একসময়ে ডাক্তারদের মধ্যে রোগীর প্রতি ভালোবাসা আর মানবিক কারণে দুর্বলতা দেখা যেতো। এখন সেটা নেই বললেই চলে। ডাক্তারের চাহিদামতো অর্থ প্রদান করেও ভুল চিকিৎসার  পত্রিকাই খবর হয়ে অনেক সময় দেখা যায়।

বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থায় যত ধরনের আধুনিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে সবগুলোতেই কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করতেই হচ্ছে। অর্থ খরচ ছাড়া প্রাইমারি লেভেল থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কোথাও শিক্ষা পাওয়া দূরের কথা। যার কাছে অর্থ নেই সে শিক্ষা নিতে পারবে না। তাহলে এ টাকাটা কে যোগান দিচ্ছে। নিশ্চয়ই অভিভাবক। কে সেই অভিভাবক, তিনি একজন কৃষক, তিনি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তিনি একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বেশিরভাগ মানুষের ব্যবসা আয়-ইনকাম হচ্ছে সীমিত। তবুও সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে জমি-জমা বিক্রি অথবা বন্ধক রেখে অনেকেই তার সন্তানকে উচ্চ-শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছায়। তার সন্তান লেখাপড়া করবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবে একদিন  সেখান থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে বের হবে। সে স্বপ্ন সকল অভিভাবক দেখে থাকে।

বের হয়ে একটা চাকরি খুঁজে নেবে তারপর পরিবারের কিছুটা হলেও সাহায্য সহযোগিতা আর্থিকভাবে করবে এমনটিই অনেক অভিভাবক মনে করে থাকেন। এর মধ্যেও অনেক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা আন্দোলন, ছাত্র সংঘাত-সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক কারণে অকালে মৃত্যুবরণ করে থাকে। সেটা এক কালো অধ্যায়। সেদিকে যাবো না, আমি পরিস্কার করতে চায় ছাত্র সে তার দায়িত্ব হলো লেখাপড়া করা। সে আন্দোলনে কেনো যাবে। তাকে দিয়ে কেন একটা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের ইস্যু তৈরি হবে। কেন আন্দোলন হবে কেনোই বা তাকে রাস্তায় নামতে হবে। এসব কিছুর জবাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রের নিকট প্রত্যাশা করছি। ছাত্রকে জিম্মি করে কোনো ইস্যু অভিভাবকমণ্ডলী চায় না। এসব নোংরামি বন্ধ করতে হবে।

এদেশের আম-জনতা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে তার প্রিয় সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে। কেউ কাউকে ৫ টাকাও দেয় না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেসরকারি ছাত্রদের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো অর্থ খরচ করে না। যারা অর্থ খরচ করে সন্তানদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সন্তানদের আন্দোলনমুখী করে যারা নোংরা রাজনীতি করছে অভিভাবক মহল তাদের ঘৃণা করে। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষাকেন্দ্রে রাজনীতি না করা। ছাত্রদেরকে রাজনীতিতে ঠেলে না দেওয়া। রাজনীতি করার সময় বয়স সুযোগ আসবে। কিন্তু ছাত্রত্ব বয়স শেষ হয়ে গেলে সে সময় আর ফিরে আসবে না। করোনার মধ্যে বলতে গেলে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান খোলা আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু চলছে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি অন্যান্য শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যমেলা মার্কেট সবই খোলা। সরকার কী ভেবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করছে সেটা আমি বলতে পারবো না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি সব ধরনের অফিস-আদালত বাণিজ্যমেলা মার্কেট চলতে পারে তাহলে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার কী কারণ আমি দেখছি না। গণপরিবহণের জন্য সরকারি রুলস জারি করা হলেও তারা সেটা না মেনে তাদের মতো করে সব ধরনের গণপরিবহণ চলছে। সবকিছু যদি ঠিকঠাক মতো চলে বিদ্যালয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখতে কী সমস্যা আছে সেটা খুঁজে পাচ্ছি না। আবার সরকারি উচ্চশিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মতো করে সবকিছু  চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে পরীক্ষা এবং শিক্ষা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এতে করে তারা সেশন জটের মধ্যে ধাবিত হচ্ছে। করোনা কি শুধু তাদের জন্যেই। সরকারের হিসেব মতে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ লেভেলের ৮০ পার্সেন্ট ছাত্র-ছাত্রী দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেছে। এই টিকা প্রদান এখন প্রাইমারী লেভেলে পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। তাহলে টিকা যখন ছোট-বড় সব বয়সের ছাত্রদের মধ্যে অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে তখন মহামারীর ভয়ে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কতিপয় পরীক্ষা এবং ক্লাস বন্ধ করার কী কারণ থাকতে পারে সেটাও অভিজ্ঞ মহলে জোর আলোচনা চলছে। সরকারকে একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি পরিকল্পনার মধ্যে চলা দরকার। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বয়স দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। চাকরির বয়স চলে যাবে। ছাত্র-অভিভাবক উভয়ের কপালে হাত ওঠবে। আফসোস আর হতাশার মধ্যে তাদের জীবনে নেমে আসবে অশান্তি আর ভোগান্তি। এর জন্য দায়ী কারা, শুধুমাত্র কোভিড-১৯-এর দোষ দিয়ে লাভ নেই। এর পিছনে অন্যকোনো কারণ বা হেতু আছে কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। ছাত্রদের জীবন নিয়ে কোনো অভিভাবক কাউকে খেলতে দেবে না। তাদের কাজ তাদেরকে করতে দিন।

ক্ষমতার পরিবর্তন অথবা কাউকে ক্ষমতায় উঠানো তাদের কাজ নয়। তাদের শিক্ষা জীবন সময়মতো শেষ করতে সকলকে সহযোগিতা করতে হবে এবং তারা যেনো সময়মতো কর্মজীবনে নিজদের মূল্যবান জীবন আত্মনিয়োগ করতে পারে সে সুযোগ তাদের জন্য করে দেওয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কর্মসংস্থান তৈরি করুন। ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন, বেকারত্ব দূর করবেন এমন প্রতিজ্ঞা আপনাদের ছিল। সেটা বাস্তবায়ন করুন। অহেতুক ছাত্রদেরকে ঝামেলার মধ্যে ছেড়ে দেবেন না। আর তাদেরকে আন্দোলনে মাঠে নামিয়ে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। অভিভাবকমণ্ডলী এসব মোটেও পছন্দ করে না। ছাত্রদেরকে ক্লাসে ফিরে যেতে সহযোগিতা করুন। তাদেরকে যেনো দেশের যেকোনো আন্দোলনের জন্য ইস্যু করা না হয়। আসুন আগামী দিনের সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠনে ছাত্রদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় এগিয়ে আসি।

মাহমুদুল হক আনসারী

লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ