জামেয়া ওয়েবসাইট

বৃহস্পতিবার-১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি-১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সিরিয়া সফর নিয়ে সংশয়ের অপনোদন

সাঈদুল মুর্তজা সাদী

ইসলামের অজেয় দূর্গে ফাটল খুঁজে বেড়ানোর অপচেষ্টা কোনকালেই বন্ধ ছিলো না। কুরআন ও হাদীসের মজবুত কাঠামোয় সুযোগ করতে না পেরে ইসলামবিদ্বেষীরা বেঁছে নেয় অপেক্ষাকৃত সহজ টার্গেট সীরাহ। যেহেতু সীরাতের অধিকাংশ বিবরণ দেখতে বহুলাংশে অরক্ষিত ও সনদ নির্ভর নয় তাই এই ক্ষেত্রটি চিরকাল ইসলামের শত্রুদের খুব প্রিয় একটি জায়গা।

নতুন করে আলোচনায় আসা সীরাতের এমন একটি অধ্যায় হলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সিরিয়া বা শাম সফর, যা ঘিরে আবারো বোনা হচ্ছে সন্দেহের বীজ। সংশয়বাদীদের বক্তব্য হলো:

রাসূলুল্লাহ (সা.) শৈশবে শাম সফরে গিয়ে পাদরি বাহীরার সাথে সাক্ষাৎ হওয়াটা ঐতিহাসিকভাবে ভুল ও অযৌক্তিক। কেননা এ ধরণের ঘটনা ঘটে থাকলে প্রাচ্যবিদদের দাবি সত্য হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। প্রাচ্যবিদদের দাবি হলো মুহাম্মদ (সা.) বাহীরার কাছে তাওরাত ও ইনজিলের দীক্ষা নিয়েছিলেন।

এর পিছনে মূলত বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক মডারেট কিছু মুসলিম স্কলার এই ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করার চেষ্টা করেন প্রাচ্যবিদদের আরেকটি জালিয়াতিকে পাশ কাটানোর জন্য। বিশেষ করে ইংরেজ প্রাচ্যবিদ রোনাল্ড বোডলি মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থে দাবি করেন, মুহাম্মদ (সা.) সিরিয়ার বাহীরা পাদরির নিকট তাওরাত ও ইনজিলের জ্ঞান লাভ করেন, যা পরবর্তীতে কুরআনের রূপে মানুষের সামনে প্রকাশ করা হয়। এই মিথ্যা বানোয়াট অপবাদটিকে দালিলিকভাবে খণ্ডন করার পরিবর্তে পশ্চিমা মুসলিম স্কলারদের অনেকে গোটা ঘটনাটিকেই অস্বীকার করার প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে দুইটি দাবি সামনে আনা হয়। হয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সিরিয়া গমন ঘটনাটিই অতিরঞ্জিত, নাহয় ‘বাহীরা’ নামের পাদরির চরিত্রটি কাল্পনিক।

আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া গ্রন্থ থেকে আমরা ঘটনাটি সংক্ষেপে দেখার চেষ্টা করি, ইবন ইসহাক বলেন, অতঃপর আবু তালিব বাণিজ্য উপলক্ষ্যে একটি কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া রওয়ানা হন৷ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যেই মাত্র তিনি রওয়ানা হন, ঠিক তখনি রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জড়িয়ে ধরেন৷ এতে তার প্রতি আবু তালিব বিগলিত হয়ে পড়েন এবং বলে ওঠেন, আল্লাহর শপথ! একে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব৷ আমিও তাকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করব না, সেও কখনো আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না৷

যা হোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সঙ্গে করে আবু তালিব রওয়ানা হন। কাফেলা সিরিয়ার বুসরা নামক এক স্থানে যাত্রা বিরতি করে৷ সেখানকার একটি গির্জায় এক পাদরি অবস্থান করেন। তার নাম ছিল বাহীরা৷

খ্রিস্টীয় ধর্মের তিনি বড় পণ্ডিত ছিলেন৷ পাদরিত্ব গ্রহণ অবধি তিনি ওই গির্জায়ই সব সময় থাকতেন৷ খ্রিস্টানদের ধারণা মতে, খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থে তিনিই ছিলেন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত৷ উত্তরাধিকার সূত্রে এই জ্ঞান তারা পেয়ে থাকেন৷

মক্কার এই বণিক কাফেলা এর আগেও বহুবার এ পথ চলাচল করেছে৷ কিন্তু পাদরি বাহীরা এতকাল পর্যন্ত কখনো তাদের সঙ্গে কথাও বলেননি এবং তাদের প্রতি ফিরেও তাকাননি৷ কিন্তু এ যাত্রায় কাফেলা পাদরির গির্জার নিকটে অবতরণ করলে পাদরি তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেন৷ কাফেলার লোকজনের ধারণা মতে, পাদরি তার গির্জায় কিছু একটা লক্ষ্য করেই এমনটি করেছিলেন৷ তাদের ধারণা, পাদরি কাফেলার মাঝে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখে ফেলেছিলেন৷ ফলে তখন একখণ্ড মেঘ দলের মধ্য থেকে শুধু রাসুলুল্লাহ (সা.)-কেই ছায়া দিচ্ছিল৷ কাফেলার লোকেরা আরও সামনে অগ্রসর হয়ে পাদরির কাছাকাছি একটি গাছের ছায়ায় অবস্থান নেয়৷ পাদরি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে মেঘের ছায়া প্রদান এবং তার প্রতি গাছের ডাল-পালা ঝুকে থাকছে লক্ষ করেন। এসব দেখে পাদরি তার গির্জা হতে বেরিয়ে আসেন৷ এদিকে তার আদেশে খাবার প্রস্তুত করা হয়৷ এবার তিনি কাফেলার নিকট লোক প্রেরণ করেন৷ কাফেলার প্রতিনিধি দল পাদরির নিকট উপস্থিত হলে পাদরি বলেন, ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছি৷ আমার একান্ত কামনা তোমরা প্রত্যেকে আমার এই আয়োজনে উপস্থিত হবে, বড় ছোট,গোলাম-আযাদ সকলে৷ জবাবে একজন বলল, আজ আপনি ব্যতিক্রম কিছু করছেন দেখছি৷ ইতিপূর্বে কখনো তো আপনি আমাদের জন্য এ রকম আয়োজন করেননি৷ অথচ এর আগেও বহুবার আমরা এই পথে যাতায়াত করেছি৷ আজ এমন কি হলো বলুন তো? ‘বাহীরা’ বললেন, ঠিকই বলেছ! তোমার কথা যথার্থ৷ ব্যাপার তেমন কিছু নয়৷ তোমরা মেহমান৷ একবেলা খাবার খাইয়ে তোমাদের মেহমানদারি করতে আশা করেছিলাম আর কি৷

কুরাইশ বণিক কাফেলার সকলেই পাদরির নিকট সমবেত হন৷ বয়সে ছোট হওয়ার কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) গাছের নিচে তাদের মালপত্রের নিকট থেকে যান৷ পাদরি যখন দেখলেন যে, কাফেলার সব লোকই এসেছে৷ কিন্তু তিনি যে গুণ ও লক্ষণের কথা জানতেন, তা কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে না৷ তখন তিনি বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়৷ আমার খাবার থেকে তোমাদের একজনও যেন বাদ না যায়। লোকেরা বলল, হে বহীরা! আপনার নিকট যাদের আসা উচিত ছিল, তাদের একজনও অনুপস্থিত নেই৷ কেবল বয়সে আমাদের সকলের ছোট একটি বালক তাঁবুতে রয়ে গেছে৷ পাদরি বলল, না, তা করো না৷ ওকেও ডেকে পাঠাও, যেন সেও তোমাদের সঙ্গে এই খাবাবে শরীক হতে পারে। বর্ণনাকারী বলেন এর জবাবে কাফেলার এক কুরাইশ সদস্য বলে ওঠল, লাত-ওজ্জার শপথ! মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব এই খাবারে আমাদের মধ্য থেকে অনুপস্থিত থাকা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যই বটে৷ অতঃপর সে উঠে গিয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে কোলে করে এনে সকলের সঙ্গে আহারে বসিয়ে দেয়। বাহীরা তাকে দেখে গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং তার দেহে সেসব লক্ষণ দেখার চেষ্টা করেন, যা তিনি তার কিভাবে ইতোপুর্বে পেয়েছিলেন৷

আহার পর্ব শেষে সকলে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল৷ এই সুযোগে বাহীরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে বালক! আমি তোমাকে লাত-ওজ্জার শপথ দিয়ে জানতে চাচ্ছি, আমি তোমাকে যা জিজ্ঞাসা করবো, তার যথার্থ জবাব দিবে কি? বাহীরা লাত-ওজ্জার নামে এজন্যই কসম খেয়েছিলেন যে, তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্প্রদায়কে এ দুই নামের শপথ করতে অভ্যস্ত বলে শুনেছিলেন৷ যা হোক, জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আপনি আমাকে লাতওজ্জার নামে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না৷ আল্লাহর শপথ! আমি এই দুটোর মত অন্য কিছুকেই এত ঘৃণা করি না৷ ‘বাহীরা’ বললেন, আল্লাহর শপথ৷ আমি তোমাকে যা যা জিজ্ঞাসা করবো, তার যথাযথ জবাব তুমি দিবে কি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আপনার যা ইচ্ছে হয় জিজ্ঞাসা করুন৷ ‘বাহীরা’ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তার ঘুম, আকার-আকৃতি ইত্যাদি সববিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক এক করে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন৷ তার প্রদত্ত সব বিবরণ বাহীরার পুর্ব থেকে জানা নবীর গুণাবলির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়৷ তারপর বাহীরা তার পিঠে দৃষ্টিপাত করে পুর্ব থেকে জানা বিবরণ অনুযায়ী তার দুই কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুওতের মহর দেখতে পান৷

পাদরি বাহীরা এবার নবীজির চাচা আবু তালিব-এর দিকে ফিরে বললেন এই বালক আপনার কী হয়? আবু তালিব বললেন, আমার পুত্র৷ বাহীরা বললেন, না এ আপনার পুত্র নয়৷ এই বালকের পিতা জীবিত থাকতে পারে না৷ আবু তালিব বললেন, ও আমার ভাতিজা৷ পাদরি বললেন, ওর পিতার কি হয়েছে? আবু তালিব বললেন, ও যখন তার মায়ের গর্ভে তখন ওর পিতা মারা যান৷ পাদরি বললেন, ঠিক বলেছেন৷ ভাতিজাকে নিয়ে আপনি দেশে ফিরে যান৷ আর ওর ব্যাপারে ইহুদিদের থেকে সতর্ক থাকবেন৷ আল্লাহর শপথ! ইহুদিরা যদি ওকে দেখতে পায় আর আমি ওর ব্যাপারে যা কিছু বুঝতে পেয়েছি, যদি তারা তা বুঝতে পারে, তাহলে ওরা ওর অনিষ্ট করবে৷ আপনার এই ভাতিজাটি ভবিষ্যতে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হবেন৷ আপনি ওকে নিয়ে শীঘ্র দেশে ফিরে যান৷ আবু তালিব সিরিয়ার বাণিজ্য শেষ না করে রাসুলূল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে তাড়াতাড়ি মক্কায় ফিরে আসেন।[1]

প্রথমত, ইসলামিক সোর্স ছাড়াও বাহীরার ইতিহাস-অস্তিত্ব সংবলিত তৎকালীন বায়জেন্টীয় তথ্য পাওয়া যায় যেখানে তার প্রকৃত নাম উপাধিসহ গির্জার অবস্থান এবং তার কাজ কর্মের বিবরণ আছে। তার প্রকৃত নাম ছিলো ‘সার্জিউস’ অথবা ‘জর্জিউস’[2],   তার গির্জাটি ছিলো শামের পথে মসুলের পথের ধারে যেখানে বিভিন্ন কাফেলা যাত্রাবিরতি করতো। তিনি মানুষকে বিশুদ্ধ একত্ববাদের দিকে আহ্বান করতেন, খ্রিস্টবাদের মধ্যে মিশ্রিত ত্রিত্ববাদের বিরোধিতা করতেন, তিনি তাওরাত ও ইনজিলের গভীর জ্ঞান রাখতেন।[3]

অন্যদিকে ইসলামি উৎসগুলো বরাবরের মতোই একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ আনার পরিপ্রেক্ষিতে সীরাত গ্রন্থগুলোতে এই ঘটনার কয়েক রকমের বর্ণনা পাওয়া যায়। বর্ণনাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু বেশি অতিরঞ্জিত হওয়ার কারণে ইমাম যাহাবীদের মতো কিছু সালাফগণ বর্ধিত বিবরণ অস্বীকার করেছেন। এছাড়া তিরমিযী, ইবনে আবু শায়বা ও মুস্তাদরাকে হাকেমের মতো হাদীস গ্রন্থগুলোতেও এই ঘটনার বিবরণ এসেছে। প্রাচীন ও আধুনিক উলামাগণ এসব বিবরণ গবেষণা করে এর সত্যতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। ইসলামি পণ্ডিতদের অধিকাংশের মত হলো উল্লিখিত ঘটনাটি নিঃসন্দেহে সত্য ও বিশুদ্ধ।

কিন্তু এসব বর্ণনার মধ্যেও যে অতিরঞ্জন তা হলো ঘটনাটির মধ্যে আবু বকর ও বিলাল (রাযি.) উভয়ের উপস্থিতির কাহিনী। আর এই অসামঞ্জস্যতাকে কেন্দ্র করেই মডারেট স্কলাররা পুরো ঘটনাটিকেই নাকচ করার চেষ্টা করে থাকেন। অথচ ইমাম ইবনে হাজর আসকলানী ও মোল্লা আলী কারী উভয়েই দীর্ঘ গবেষণার পর জানিয়েছেন, উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্তভাবে গ্রহণযোগ্য, তবে মূল বর্ণনায় আবু বকর তাদের সাথে থাকার অংশটি অন্য কোনো হাদীস থেকে খণ্ডিতভাবে অনুপ্রবেশ করে থাকবে যা নিশ্চয়তার সাথে বলা যায়।

ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও দালিলিকভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শৈশবে সিরিয়া সফর ছিলো সম্পূর্ণ বাস্তব ও বিশুদ্ধ। পাদরি বাহীরার সাথে তার সাক্ষাৎও ছিলো ইতিহাসের একটি সত্য অধ্যায়। কিন্তু এই সফরের কারণে এ কথা বলা অযৌক্তিক যে তিনি শৈশবে এ ক্ষণিকের সাক্ষাতে তাওরাত ইনজিলের যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করে নিয়েছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় দুইবার সিরিয়া গমন করেছেন। একবার ১২ বছর বয়সে চাচার সাথে, পরেরবার ২৫ বছর বয়সে খাদীজার (রাযি.) ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে। যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শৈশবের সিরিয়া সফর নিয়ে সন্দেহের মেঘ তৈরি করে তারা সহীহ বুখারীর স্পষ্ট হাদীস থাকা সত্ত্বেও পরেরবারের সিরিয়া সফর নিয়েও সংশয় প্রকাশ করে। এ থেকে বুঝা যায় এসকল প্রাচ্যবিদ-শিষ্য মডারেটগণের মূলত দলিলে সমস্যা নয়, সমস্যা অন্যখানে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সিরিয়া সফরে খ্রিস্টান পাদরিদের সাথে সাক্ষাৎ থেকে প্রাচ্যবিদরা অপবাদ দিতে শুরু করে যে, মুহাম্মদ (সা.) খ্রিস্টান পাদরিদের কাছে আসমানী জ্ঞানের তালীম নিয়েছেন। অথচ এই অভিযোগের উত্তর দিতে গোটা ঘটনাটিকে অস্বীকার করার প্রয়োজন পড়ে না। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত সহকারে এই অভিযোগের খণ্ডন করেছেন মুসলিম গবেষকগণ।

R V C Bodley তার লিখিত The Messenger; the Life of Mohammed বইয়ে এই সংশয়ের উত্থাপন করেন। পরে প্রাচ্যবিদদের প্রভাবপুষ্ট বিভিন্ন ইসলামি স্কলার যেমন ড. ইয়াসির কাদি, হুসাইন হায়কাল,  মুহাম্মদ রেজা  ও  উস্তায আবদুর রঊফ আল-মিসরির  মতো ব্যক্তিরা এখন ইতিহাস প্রসিদ্ধ ও প্রমাণিত এই সত্য ঘটনাগুলো সরাসরি অস্বীকার করার মিশনে নেমেছেন এবং এর প্রচার-প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন।

এসব অপপ্রচার ও অভিযোগের কড়া খণ্ডন করে অসংখ্য মুসলিম বিশেষজ্ঞরা প্রতি-উত্তর লিখেছেন। এর মধ্যে ইমাম আবু যুহরা, শায়খ আলবানী, আল্লামা যুরকানী, সাইয়িদ কুতুব প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি আহলে কুরআন নামক ফিরকার দাপট বাড়তে থাকায় নতুন করে এক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মুজিযা সম্পর্কিত কোনো সীরাত বা হাদীসে বিশ্বাস করে না। এবং এ দাবির পক্ষে জোর প্রচারণাও চালাচ্ছে।

অথচ একজন মিসরীয় খ্রিস্টান গবেষক ড. নজমি লুকা অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে সেই বাহীরা পাদরির দেখা নাও হতো তারপরেও তিনি স্বীয় যোগ্যতা, মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও হেদায়েতের কারণে পয়গম্বর হওয়ার সুযোগ রাখেন।’  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো, যারা দাবি করে রাসূলুল্লাহ (সা.) পাদরি বাহীরা থেকে তাওরাত-ইনজিলের জ্ঞান কপি করেছেন তারা নিজেরাই সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে প্রমাণ করতে পারেনি সেই পাদরি কি আদৌ খ্রিস্টান ছিলো নাকি ইহুদি ছিলো? তার নাম কি বাহীরা ছিলো নাকি নাসত্মুরা ছিলো নাকি হাখাম ছিলো? খোদ কুরআন খ্রিস্টানদের ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আয়াত বহন করছে, ইহুদিদের অন্তরের নোংরামি সম্পর্কে অবহিত করছে, কিভাবে একজন পাদরি বা রাব্বির পক্ষে এমন শিক্ষা দেয়াটা সম্ভব?

এ সম্পর্কে ইমাম আবু যুহরার আলোচনা যুগান্তকরী হিসেবে বিবেচিত থাকবে চিরকাল: ‘এ বিষয়ে যত বর্ণনা আছে তার মূল ফোকাস নবী (সা.) এর সাথে বাহীরার সাক্ষাৎ কিংবা সেই পাদরির নাম ধামের মধ্যে নিহিত নয়, এবং এই ঘটনার মধ্যে অবাক হওয়ার মতো খুব একটা কারণও নেই। কারণ মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত ও রিসালাতের পূর্বাভাস ও সুসংবাদের বর্ণনা আহলে কিতাবদের তাওরাত ও ইনজিলে আগে থেকেই ছিলো। বরং রাসূলের জন্মগ্রহণের পর থেকে প্রতিটি ঘটনা এর সাক্ষ্য বহন করছিলো, যাদের অভ্যাসই হলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বস্তুগত প্রমাণ ছাড়া কোনকিছু বিশ্বাস না করা তাদের কাছে সীরাতের প্রতিটি মুজিযার বর্ণনায় অপ্রাসঙ্গিক। তবে এতদসত্ত্বেও তারা রাসূলুল্লাহর পিঠে অঙ্কিত ‘মোহরে নবুয়ত’ কখনোই অস্বীকার করতে পারে না। বাহীরার ঘটনায় অন্যসব কিছু বাদ দিলেও শিশু মুহাম্মদের কাঁধের মোহর নিশ্চিতভাবেই তিনি দেখেছিলেন। এটার কি উত্তর দিবেন তারা? এর পাশাপাশি তাওরাত ও ইনজিল বিকৃত করার পরেও সেখানে রয়ে যাওয়া শেষ নবীর চিহ্নসমূহও বিদ্যমান ছিলো, যা সুস্পষ্টভাবে তাঁর সাথেই মিলছিলো। সুতরাং সন্দেহ করে কি এসব ঢেকে রাখা যায়?’

এখন আমরা চলমান মডারেটদের আতঙ্কের বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করতে চাই যারা এই ঘটনার দরুন ইসলামি মৌলিকত্বের উপর আপতিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খায়।

শায়খ আলবানী (রহ.) বলেন, ‘এখন যারা এ ধরণের প্রশ্ন তুলছে যে মুহাম্মদ (সা.) বাহীরার কাছ থেকে ইসলামের শিক্ষা নিয়েছে, তাদের কথা তো সেই মক্কার মুশরিকদের কথারই প্রতিধ্বনি যাদের ব্যাপারে কুরআন সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন,

وَلَقَدْ نَعْلَمُ اَنَّهُمْ يَقُوْلُوْنَ اِنَّمَا يُعَلِّمُهٗ بَشَرٌ١ؕ لِسَانُ الَّذِيْ يُلْحِدُوْنَ اِلَيْهِ اَعْجَمِيٌّ وَّهٰذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُّبِيْنٌ۰۰۱۰۳ اِنَّ الَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ بِاٰيٰتِ اللّٰهِ١ۙ لَا يَهْدِيْهِمُ اللّٰهُ وَ لَهُمْ عَذَابٌ اَلِيْمٌ۰۰۱۰۴

‘আমরা তো ভালোভাবেই জানি যে, তারা বলেঃ তাকে জনৈক ব্যক্তি শিক্ষা দেয়। যার দিকে তারা ইঙ্গিত করে, তার ভাষা তো আরবি নয় এবং এ কুরআন পরিষ্কার আরবি ভাষায়। যারা আল্লাহর কথায় বিশ্বাস করে না, তাদেরকে আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেন না এবং তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। মিথ্যা কেবল তারা রচনা করে, যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না এবং তারাই মিথ্যাবাদী।’ (আননাহল: ১০৩-১০৪)

এখানে প্রকৃতই প্রাচ্যবিদদের অভিযোগের জবাব দেয়া যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে তা ঘটনাটিকে বাস্তব মেনে নিয়েও জবাব দেয়া সম্ভব। কিন্তু ড. হায়কালদের মতো প্রাচ্যবিদ প্রভাবিত ব্যক্তিরা সহিহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণীত রাসূলের বক্ষ বিদারণের মতো ঘটনাকেও অস্বীকার করেন যা প্রমাণ করে আসলে দলিলের বিশুদ্ধতা নিয়ে তাদের মূল আপত্তি না, বরং রাসূলের মুজিযা নিয়েই তাদের যত আপত্তি। আর হায়কাল ও রশিদ রেজার মতো যারা এই ঘটনা গ্রহণ না করার পক্ষে দালিলিক প্রমাণের সমস্যা নিয়ে আলাপ তুলে আমরা দেখি তারা নিজেরাই এর উৎস নিয়ে নতুন কোন দিগন্ত উন্মোচন না করে প্রাচীনদের দেয়া রেফারেন্স দিয়েই দায়সারা গোছের আলাপ করে। এ থেকে প্রমাণ হয় তাদের আগ্রহ দলিলের খণ্ডনে নয়, বরং সন্দেহের বীজ বপনে।

এ পর্যায়ে আমরা গোটা অভিযোগের খণ্ডন করবো আল্লামা যুরকানীর বক্তব্য থেকে।

  1. সম্পূর্ণ অপবাদটিই দলিলহীন এবং ভিত্তিহীন। এ ধরণের অভিযোগ নির্ভুল প্রমাণ ছাড়া কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। অভিযোগ উত্থাপনকারীদেরকে প্রমাণ দিতে হবে মুহাম্মদ (সা.) বাহীরা থেকে ঠিক কি কি শুনেছিলেন, কবে এবং কোথায় ও কিভাবে?
  2. সিরিয়া সফরের ক্ষেত্রে ইতিহাস রাসূলুল্লাহর কৈশোর ও যৌবনে মোট দুইবার সফরের বর্ণনার বাইরে আর কিছুই নথি রাখেনি। দুইবারই ঘটনার সাক্ষী হিসেবে তাঁর সাথে অনেকেই ছিলেন। বিশেষত প্রথম সফরে চাচা আবু তালেব, ও দ্বিতীয় সফরে মায়সারা পুরো ঘটনার সাথেই ছিলেন। তারা উভয়েই পাদরিরা মুহাম্মদ সম্পর্কে কি বলেছেন তা উল্লেখ করেছেন। যদি সত্যিই পাদরিদের থেকে রাসূলুল্লাহ কিছু জ্ঞান অর্জন করেই থাকতেন তাহলে সেই সাক্ষীরা তা নির্দ্বিধায় বলতেন কারণ তখনো মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত অর্জিত হয়নি যে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
  3. ঘটনা সংশ্লিষ্ট সব বর্ণনা প্রমাণ করে বাহীরার পক্ষে মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করা তাঁর নিজের নীতিরই বিরুদ্ধে যায়। কারণ যে ব্যক্তি শিশু মুহাম্মদের ভবিষ্যৎ নবুয়তের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে তাঁর পক্ষে সেই প্রতীক্ষিত নবীর শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া নিজের সাথে প্রতারনার শামিল। কারণ এই নবীই বরং অচিরেই সকল উস্তাদদের উস্তাদে পরিণত হতে যাচ্ছেন, আল্লাহর রাসূল মনোনীত হতে যাচ্ছেন যা অন্যান্যদের চেয়ে বাহীরা খুব ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন।
  4. আসন্ন ইসলামের প্রবাহধারা যদি বাহীরা থেকেই প্রবাহিত হবে তাহলে তিনিই বরং নবী হওয়ার জন্য অধিকতর উপযুক্ত হতেন এবং এর জন্য মনোনীত হতেন।
  5. এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক যে, একজন বালক মাত্র দুই দুইবার পুরোহিতের সান্নিধ্যে ক্ষণিকের জন্য এসে রাতারাতি মানবজাতির শিক্ষকে পরিণত হবেন। আবার যে দুইবার তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে এর প্রথমবারে বালক না ছিলেন শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রস্তুত, দ্বিতীয়বার ছিলেন ব্যবসায়ীক আমানতের গুরু দায়িত্ব পালনে চিন্তাক্লিষ্ট।
  6. তাওরাত ও ইনজিলের বিকৃতি ঘটে যাওয়ার পর সেই ধর্মের অনুসারী হিসেবে বাহীরার পক্ষে কুরআনের আনিত বর্ণনা সরবরাহ করাটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ কুরআন নিজেই তৎকালীন তাওরাত ইনজিলের বিকৃত শিক্ষাকে জাহালাত হিসেবে আখ্যায়িত করে তা সংশোধনের নির্দেশনা বাতলে দিয়েছে। এর আকীদা বিশ্বাসকে গোমরাহী অভিহিত করে তা পরিশুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। নিশ্চয় অন্ধকারাচ্ছন্ন ব্যক্তি আলোর দিশা দিতে পারেন না।
  7. যদি অভিযোগকারীদের কথা সত্যই হতো তাহলে এই সুযোগটা সর্বাগ্রে গ্রহণ করতো তৎকালীন সময়ের ইসলামবিরোধীরা। তারা নানান অভিযোগ এনেছিলো, মুহাম্মদ (সা.) জিন থেকে বার্তাপ্রাপ্ত হয়, মুহাম্মদ (সা.)-কে কেউ একজন শেখায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারা যদি নিশ্চিত হতোই যে বাহীরা থেকে মুহাম্মদ (সা.) জ্ঞান লাভ করেছে তাহলে আমরা হাতের লাগালে এ ধরণের বক্তব্যই পেতাম যেখানে মক্কার মুশরিকরা সরাসরিই বাহীরার নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করে অপপ্রচার চালাতো। কিন্তু এ ধরণের তিলমাত্র বক্তব্য ইতিহাস আমাদের জন্য নথিভূক্ত করেনি।

পরিশেষে আমরা কুরআনের ভাষায় উপসংহার টানতে পারি,

وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْۤا اِنْ هٰذَاۤ اِلَّاۤ اِفْكُ ا۟فْتَرٰىهُ وَاَعَانَهٗ عَلَيْهِ قَوْمٌ اٰخَرُوْنَ١ۛۚ فَقَدْ جَآءُوْ ظُلْمًا وَّزُوْرًاۚۛ۰۰۴ وَقَالُوْۤا اَسَاطِيْرُ الْاَوَّلِيْنَ اكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلٰى عَلَيْهِ بُكْرَةً وَّاَصِيْلًا۰۰۵ قُلْ اَنْزَلَهُ الَّذِيْ يَعْلَمُ السِّرَّ فِي السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ١ؕ اِنَّهٗ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا۰۰۶

কাফেররা বলে, এটা মিথ্যা বৈ নয়, যা তিনি উদ্ভাবন করেছেন এবং অন্য লোকেরা তাঁকে সাহায্য করেছে। অবশ্যই তারা অবিচার ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। তারা বলে, এগুলো তো পুরাকালের রূপকথা, যা তিনি লিখে রেখেছেন। এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর কাছে শেখানো হয়। বলুন, একে তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের গোপন রহস্য অবগত আছেন। তিনি ক্ষমাশীল, মেহেরবান। (আল-ফুরকান: ৪-৬)

———————————–

[1] আল-বিদায়া অয়ান-নিহায়া, ২/৫১৫-৫১৭

[2] মুহাম্মদ রেজা প্রণীত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত (১৯৭৫/১৩৯৫), পৃ. ৩৫

[3] মুহাম্মদ রেজা প্রণীত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত (১৯৭৫/১৩৯৫), পৃ. ৩২

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ