মুহাম্মদ আবদুল্লাহ
তাঁর নাম হচ্ছে, আলী বিন সুলতান মুহাম্মদ। উপনাম: আবুল হাসান। উপাধি: নুরুদ্দীন। তিনি একাধারে ফিকহবিদ, মুহাদ্দিস ও কারী। বাসস্থানের বিবেচনা থেকে তাঁকে হারাবি ও মক্কী বলা হয়। তিনি ‘মোল্লা আলী কারী’ নামে সুপরিচিত। তাঁকে কারী উপাধি দেওয়া হয়েছে; যেহেতু কুরআনের ভিন্ন ভিন্ন পঠনপদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। খোরাসানের প্রধান শহর ‘হারাত’-এর বাসিন্দা হিসেবে তাঁকে ‘হারাবী’ বলা হয়। খোরাসান বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। তাঁকে মক্কী বলা হয় যেহেতু তিনি মক্কায় সফর করেছেন, মক্কার আলেমদের থেকে ইলম অর্জন করেছেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেছেন।
তিনি ৯৩০ হিজরি সালের দিকে হেরাত শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন। সেখানেই বড় হয়েছেন এবং জ্ঞানার্জন করেছেন। কুরআন মুখস্থ করেছেন। তাজবিদ শিখেছেন শায়খ মঈন উদ্দীন ইবনে হাফেয যায়নুদ্দীন আল-হারাবীর নিকট। সে সময়কার আলেমদের কাছ থেকে তিনি ইলমে দীন অর্জন করেছেন। এরপর তিনি মক্কায় সফর করেছেন এবং মক্কাতে থেকে সেখানের আলেমদের কাছে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইলমে দীন অর্জন করেছেন। এভাবে ইলম অর্জনের মাধ্যমে তিনি মশহুর আলেমে পরিণত হয়েছে। তিনি হানাফি মাযহাবের আলেম ছিলেন। তার গ্রন্থাবলি ও জীবনী থেকে সেটাই জানা যায়। হানাফি মাযহাবের অনেক মাসয়ালা নিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর পক্ষে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।
তিনি দীনদার, তাকওয়াবান ও পবিত্র চরিত্রের অধিকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজ হাতে কাজ করে খেতেন। তিনি ছিলেন দুনিয়ার প্রতি মোহহীন, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও অল্পে তুষ্ট। মানুষের সাথে কম মিশতেন। ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। তিনি সুন্দর হস্তাক্ষরে প্রতি বছর একটি করে কুরআন লিখতেন। লিখিত কুরআন শরীফের পার্শ্বটীকাতে কিরাআত ও তাফসীর লিখতেন। সেটি বিক্রি করে যা পেতেন তা দিয়ে তাঁর বছর চলে যেত। তিনি মনে করতেন শাসকদের নিকটবর্তী হওয়া এবং তাদের উপঢৌকন গ্রহণ করা ইখলাস ও তাকওয়ার পরিপন্থী। তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ আমার পিতার প্রতি রহম করুন। তিনি বলতেন, আমি চাই না যে, তুমি আলেম হও; এই আশংকায় যে, তুমি আমীর-ওমরাদের দরজায় ধরনা দেবে।’ (মিরকাতুল মাফাতীহ: ১/৩৩১)
ইলম, আমল ও নেকীর কাজে ভরপুর জীবন কাটিয়ে তিনি ১০১৬ হিজরীতে মতান্তরে ১০১০ হিজরীতে মক্কাতে মৃত্যুবরণ করেন। তবে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী তিনি ১০১৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন এবং মুয়াল্লা নামক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন, ইবনে হাজার আল-হায়সামী আল-ফকীহ, আলী মুত্তাকি আল-হিন্দী, আতিয়া বিন আলী আল-সুলামী, মুহাম্মদ সাঈদ আল-হানাফী আল-খোরাসানী, আবদুল্লাহ আল-সিন্দী, কুতুবুদ্দীন আল-মক্কী।
তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন, আবদুল কাদের আল-তাবারী, আবদুর রহমান আল-মুরশিদী, মুহাম্মদ বিন ফাররুখ আল-মাওরাবী।
লোকেরা তাঁর ভূয়শী প্রশংসা করেছেন, আল-হামাবী খুলাসাতুল আসার গ্রন্থ (৩/১৮৫)-এ বলেন, ‘তিনি ইলমের কর্ণধার, যুগের অনন্য, মতামত বিচার-বিশ্লেষণে অতুলনীয়, তাঁর প্রসিদ্ধি তাঁর গুণ বর্ণনার জন্য যথেষ্ট।’
আল-ইসামী সামতুন নুজুম গ্রন্থ (৪/৪০২)-এ বলেন, ‘আকলি ও নকলি (বর্ণনানির্ভর ও যুক্তিনির্ভর) উভয় জ্ঞানের ভান্ডার। হাদীসে রাসূলের পূর্ণ সুধা পানকারী। মুখস্থ শক্তি ও বোধশক্তির জন্য প্রসিদ্ধ ও নামকরা একজন ব্যক্তিত্ব।’
লাখনাবি তাঁর আত-তালিক আল-মুমাজ্জাদ গ্রন্থে বলেন, ‘অত্যুজ্জ্বল ইলম ও স্বনামধন্য মর্যাদার অধিকারী।’
এরপর তিনি তাঁর লিখিত বেশ কিছু গ্রন্থ উল্লেখ করে বলেন, এগুলো ছাড়াও তাঁর লিখিত আরও অগণিত পুস্তিকা রয়েছে; সবগুলো মূল্যবান।
নোমানী তাঁর আল-বিজাতুল মুযজাত গ্রন্থ (পৃ. ৩০)-এ বলেন, ‘তিনি ছিলেন সমকালীন আলেমদের মধ্যে সেরা। প্রসিদ্ধ ইমাম, আল্লামা। আকলি ও নকলি অনেক জ্ঞানের আধার ছিলেন তিনি। হাদীস, তাফসীর, ক্বিরাআত, উসুলে ফিকহ, আরবি ভাষা, ভাষাবিজ্ঞান ও বালাগাত ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন।’
ইবনে তায়মিয়া (রহ.) ও ইবনুল কাইয়িম (রহ.)-কে তিনি যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। তাঁদের দুজনের ওপর আরোপিত অভিযোগগুলো তিনি খণ্ডন করতেন তিনি হানাফি-মাতুরিদি আলেমগণের মাযহাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আল্লাহর গুণাবলি সংক্রান্ত আয়াতগুলোর ক্ষেত্রে তিনি পরবর্তী আলেমদের নীতি গ্রহণ করেছেন অথবা আল্লাহর গুণাবলিকে ভিন্নার্থে ব্যাখ্যার নীতিতে চলেছেন। (দেখুন: আস-শামস আল-আফগানী লিখিত ‘আল-মাতুরিদিয়া ১/৩৫০ ও ১/৫৩৭-৩৪০)
তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলো হচ্ছে, তাফসীরুল কুরআন, মিরকাতুল মাফাতীহ, শারহু নুখবাতুল ফিকার, আল-ফুসুল আল-মুহিম্মা, শারহু মুশকিলাতুল মুয়াত্তা, বিদাআতুস সালিক, শারহুল হিসনিল হাসীন, শারহুল আরবায়িন নাবাবিয়া, জাওউল মাআলি, শাম্মুল আওয়ারিদ ফি যাম্মির রাওয়াফিয, ফায়যুল মুয়িন, রিসালা ফির রাদ্দ আলা ইবনি আরাবি ফি কিতাবিহি আল-ফুসুস ওয়া আলাল কায়িলিনা বিল হুলুল ওয়াল ইত্তিহাদ, এছাড়াও আরও অনেক গ্রন্থ।