হোছাইন মুহাম্মদ নাঈমুল হক
একজন শ্রদ্ধেয় মুফতি সাহেব লিখেছেন, পবিত্র কুরআনের কাব্যানুবাদ জায়েয নেই। এর স্বপক্ষে তিনি বেশকিছু কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আসল ব্যাপার হল, পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরামের কিতাব দেখলে আমরা পাই যে, তাঁদের অনেকে পবিত্র কুরআনের শুধু কাব্যানুবাদ নয়, কোনো ধরনের অনুবাদই জায়েয মনে করতেন না। বিষয়টি যেহেতু পবিত্র কুরআন সম্পৃক্ত তাই সবিস্তারে আলোচনার দাবি রাখে। তারপরও সংক্ষেপে কিছু বলে রাখি।
আমাদের পূর্ববর্তী আলেমগণের মাঝে ‘পবিত্র কুরআনের অনুবাদ’ শীর্ষক পরিভাষা নিয়ে দ্বিমত ছিল। তাঁদের অনেকে মনে করতেন, পবিত্র কুরআনের অনুবাদ মানে কুরআনের সব গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যসহ অনুবাদ করা। যেহেতু পবিত্র কুরআন আল্লাহ তাআলার কালাম এবং তার ভাষা মুজিয বা অলৌকিক। তাই পবিত্র কুরআনের ভাষাগত সবদিক সমানভাবে লক্ষ্য রেখে অনুবাদ করা অসম্ভব। যেমনটি ইবনে কুতায়বা দায়নাওয়ারী (রহ.) তাঁর তাওয়ীলু মুশকিলিল কুরআন গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু সব বৈশিষ্ট্যসহ কুরআন অনুবাদ করা সম্ভব নয়। তাই তাঁদের মতে এর কোনো ধরনের অনুবাদই জায়েয নেই।
পক্ষান্তরে যারা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ জায়েয মনে করেন তাঁরা নিজেদের মতকে স্পষ্ট করে বলেন, আসলে ‘কুরআনের অনুবাদ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআনের মূল বিষয় বস্তু বা থিম ভিন্ন আরেকটি ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করা। যেহেতু পবিত্র কুরআন পৃথিবীর সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর হিদায়েত হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে তাই পবিত্র কুরআনের মূল থিম সকলের জানা উচিত। সে লক্ষ্যে কুরআনের অনুবাদ হওয়া জরুরি। তাই তাঁরা কিছু শর্তারোপ করে পবিত্র কুরআনের অনুবাদ জায়েয দিয়েছেন। হিজরী অষ্টম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ইমাম, ইমামুল মাকাসিদ আবু ইসহাক আশ-শাতিবী (রহ.) তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ আল-মুওয়াফাকাতে এ দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয় করে লিখেন,
لِلُّغَةِ الْعَرَبِيَّةِ مِنْ حَيْثُ هِيَ أَلْفَاظٌ دَالَّةٌ عَلَىٰ مَعَانٍ نَظَرَانِ: أَحَدُهُمَا: مِنْ جِهَةِ كَوْنِهَا أَلْفَاظًا وَعِبَارَاتٍ مُطْلَقَةً، دَالَّةً عَلَىٰ مَعَانٍ مُطْلَقَةٍ، وَهِيَ الدَّلَالَةُ الْأَصْلِيَّةُ. وَالثَّانِيْ: مِنْ جِهَةِ كَوْنِهَا أَلْفَاظًا وَعِبَارَاتٍ مُقَيَّدَةً دَالَّةً عَلَىٰ مَعَانٍ خَادِمَةٍ، وَهِيَ الدَّلَالَةُ التَّابِعَةُ… وَإِذَا ثَبَتَ هَذَ، فَلَا يُمْكِنُ مَنِ اعْتَبَرَ هَذَا الْوَجْهَ الْأَخِيْرَ أَنْ يُتَرْجِمَ كَلَامًا مِنَ الْكَلَامِ الْعَرَبِيِّ بِكَلَامِ الْعَجَمِ عَلَىٰ حَالٍ، فَضْلًا عَنْ أَنْ يُتَرْجِمَ الْقُرْآنَ وَيَنْقُلَ إِلَىٰ لِسَانٍ غَيْرِ عَرَبِيٍّ… وَقَدْ نَفَىٰ ابْنُ قُتَيْبَةَ إِمْكَانَ التَّرْجَمَةِ فِي الْقُرْآنِ -يَعْنِيْ: عَلَىٰ هَذَا الْوَجْهِ الثَّانِي- فَأَمَّا عَلَى الْوَجْهِ الْأَوَّلِ، فَهُوَ مُمْكِنٌ، وَمِنْ جِهَتِهِ صَحَّ تَفْسِيرُ الْقُرْآنِ وَبَيَانُ مَعْنَاهُ لِلْعَامَّةِ وَمَنْ لَيْسَ لَهُ فَهْمٌ يَقْوَى عَلَىٰ تَحْصِيلِ مَعَانِيهِ، وَكَانَ ذَلِكَ جَائِزًا بِاتِّفَاقِ أَهْلِ الْإِسْلَامِ، فَصَارَ هَذَا الْاِتِّفَاقُ حُجَّةً فِيْ صِحَّةِ التَّرْجَمَةِ عَلَى الْـمَعْنَىٰ الْأَصْلِيِّ.
‘আরবি ভাষা নির্ধারিত অর্থবোধক কিছু শব্দ সমষ্টির নাম। এ দিকটি লক্ষ্য রাখলে আরবি ভাষাকে দুইভাবে দেখার সুযোগ আছে। প্রথম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আরবি ভাষা এমন কিছু সাধারণ শব্দ ও বাক্য সমষ্টির নাম। যা তার নির্ধারিত অর্থ প্রকাশ করে থাকে। (ভাষা হিসেবে) এটিই হল তার মৌলিক দিক। আবার আরবি ভাষার শব্দ ও বাক্যাংশের এমন কিছু বিশেষায়িত ব্যবহার আছে। যা তার শব্দাবলি ও বাক্যাংশের বিশেষায়িত অর্থ দিয়ে থাকে। যেটা তার সহযোগী দিক। এটা সাধারণত অন্য কোনো ভাষায় পাওয়া যায় না… (উপরের আলোচনা যদি স্পষ্ট হয় তবে) এই দাবি সত্য হয় যে, দ্বিতীয় দিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখে আরবি ভাষার কোনো কথাই অন্য ভাষায় অনুবাদ করা সম্ভব নয়। কুরআন অনুবাদের বিষয়টি তো অনেক দূরের কথা এবং ঠিক এ অর্থেই ইবনে কুতায়বা কুরআন অনুবাদ অসম্ভব বলে মত দিয়েছিলেন। তবে আমরা যদি আরবি ভাষার প্রথম দিকটি লক্ষ করি, তবে (পবিত্র কুরআনকে অন্য যেকোনো ভাষায় অনুবাদ করা) সম্ভব এবং ঠিক এই দিকটি লক্ষ্য রেখেই সাধারণ মানুষ, যারা সরাসরি কুরআন বুঝে না, তাদের সুবিধার্থে কুরআনের ব্যাখ্যা ও তাফসীর করা বিশুদ্ধ বলে (আলেমগণ) মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। (উম্মাহর) এ ঐকমত্যের ভিত্তিতে পবিত্র কুরআনের মর্মানুবাদও জায়েয দেওয়া হয়েছে…।’ (মুওয়াফাকাত: ২/১০৫-১০৭)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রথমদিকে কোনো কোনো আলেম কুরআনের কোনো ধরনের অনুবাদই জায়েয মনে করতেন না। পরবর্তীতে জরুরতের কারণে আলেমগণ মর্মানুবাদ করা জায়েয বলে ফতওয়া দেন। একপর্যায়ে তা ঐকমত্যপূ্র্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। সে হিসেবে অনুবাদের সব শর্ত পূর্ণ করার শর্তে পবিত্র কুরআনের কাব্যানুবাদেও কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা দেখা গেল ভিন্ন।
কেউ হয়তো বলবেন, ইমাম শাতিবী (রহ.) তাঁর আলোচনায় সাধারণভাবে আরবি থেকে কুরআনের অনুবাদ জায়েয হওয়ার বিষয়ে উম্মতের ঐকমত্যের কথা বলেছেন। অনুবাদ জায়েয হলেই কাব্যানুবাদের জায়েয হওয়া জরুরি নয়। কারণ তা একটি বিশেষায়িত অনুবাদ।
উত্তরে আমরা বলব, ইমাম শাতিবী (রহ.) দেখিয়েছেন পবিত্র কুরআনের সাধারণ মর্মানুবাদ জায়েয হওয়ার বিষয়ে আলেমগণের মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। এতে কাব্যানুবাদ ও গদ্যানুবাদ দুটিই অন্তর্ভুক্ত। কারণ (الترجمة) শব্দটি عام বা ব্যাপক শব্দ। আর উসূলুল ফিকহের সাথে সম্পৃক্তদের জানা আছে যে, আম শব্দগুলো তার সকল সদস্যকে একই সময়ে অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। আমাদের হানাফী উসূলুল ফিকহ হিসেবে সাধারণ আম শব্দাবলি তার সকল সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি অকাট্য। যাতে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই। সে হিসেবে তরজমা বা অনুবাদ জায়েয হওয়ার হুকুমে কাব্যানুবাদও অন্তর্ভুক্ত। তাকে আমের হুকুম থেকে বের করতে চাইলে الدليل المخصِّص (মুখাসসিস দলিল) থাকা জরুরি। যা আলোচ্য বিষয়ে অনুপস্থিত। তাই আমরা কুরআনের তরজমা জায়েযের হুকুমে কাব্যানুবাদকেও অন্তর্ভুক্ত মনে করি। আমার প্রবল ধারণা, ঠিক এ কারণে দারুল উলুম দেওবন্দ, কাতার ধর্মমন্ত্রণালয় পরিচালিত ইসলাম ওয়েবসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও মুফতি সাহেবগণ পবিত্র কুরআনের কাব্যানুবাদ জায়েয বলেছেন। কাতার ধর্মন্ত্রণালয়ের ফতওয়ায় বলা হয়েছে,
لا فرق في الحقيقة بين ترجمة معاني القرآن وبين نظم هذه الترجمة شعرًا. فالنظم في الحقيقة ليس لألفاظ القرآن وإنما لمعانيه.
‘বাস্তবিক পক্ষে কুরআনের (মূল) অর্থের গদ্যানুবাদ এবং কাব্যানুবাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ দিনশেষে সেটা কুরআনের মর্মানুবাদ। শব্দানুবাদ নয়। (ফতওয়া: ১২৬৪৬৪, প্রকাশের তারিখ: ১২ রমজান ১৪৩০ হিজরী = 1লা সেপ্টেম্বর ২০০৯ ইংরেজি)
এ বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের ফতওয়াটি আমার কাছে আরও স্পষ্ট ও সূক্ষ্ম মনে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,
جس طرح قرآن کا منثور ترجمہ جائز ہے، اسی طرح منظوم ترجمہ بھی جائز ہے بہ شرطیکہ مترجم، منثور یا منظوم ترجمہ کی صحیح اور واقعی صلاحیت رکھتا ہو؛ البتہ چوں کہ منظوم ترجمہ میں عام طور پر قرآنی کلمات کی ترتیب وغیرہ کا لحاظ نہیں ہوپاتا، اسی طرح بعض مرتبہ افعال کا ترجمہ اسما سے اور اسما کا افعال سے کیا جاتا ہے اور بعض الفاظ کا ترجمہ بر بنائے ضرورت ترک کردیا جاتا ہے وغیرہ وغیرہ؛ اس لیے اسے ترجمہ کے بجائے ترجمانی کہنا چاہیے۔ نیز قرآن کریم کی منظوم ترجمانی، اشاعت سے قبل کسی مستند ومعتبر اور باریک بین مفسر کو بھی دکھانی چاہیے؛ تاکہ اگر ترجمانی میں مفہوم کا کچھ رد وبدل وغیرہ ہوگیا ہو تو اس کی اصلاح ہوجائے۔
‘কুরআনের গদ্যানুবাদের মতো কাব্যানুবাদও জায়েয। তবে অনুবাদকের মধ্যে পবিত্র কুরআন তরজমা করার বিশুদ্ধ যোগ্যতা থাকা জরুরি। তবে যেহেতু কাব্যানুবাদে সাধারণভাবে কুরআনের শব্দাবলির ক্রমবিন্যাসসহ অনেক কিছুর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় না। তাই এটাকে তরজমা বা অনুবাদ না বলে তরজুমানি বা মর্মানুবাদ বলা উচিত। এ ধরনের মর্মানুবাদ প্রকাশের আগে কোনো দক্ষ মুফাসসিরকে দেখানো জরুরি। যেন উক্ত তরজুমানিতে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকলে তা শুধরে নেওয়া সম্ভব হয়।’ (ফতওয়া: ১৭৬৮০৪, প্রকাশের তারিখ: ৫ এপ্রিল ২০২০)
উপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, পবিত্র কুরআনের গদ্যানুবাদ যেমন জায়েয। ঠিক তেমনি কাব্যানুবাদও জায়েয। তবে উভয় ক্ষেত্রে কুরআন অনুবাদের শর্তাবলি পূর্ণরূপে উপস্থিত থাকা জরুরি। সবগুলো শর্ত পূর্ণভাবে পাওয়া গেলে অনুবাদটি গ্রহণযোগ্য। অন্যথায় নয়। হোক তা গদ্যানুবাদ কিংবা কাব্যানুবাদ। অর্থাৎ শর্তের উপস্থিতি বিবেচ্য। অনুবাদের মাধ্যম খুব বেশি বিবেচ্য নয়। তবে কাব্যানুবাদের ক্ষেত্রে ভুল ত্রুটির সম্ভাবনা বেশি থাকায় তাতে অধিক সতর্কতা কাম্য। আল্লাহু তাআলা আ’লাম।
পরিশেষে বলব, আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করে সঠিকভাবে ইসলামের হুকুম আহকাম মেনে চলার তওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়