জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গীবত মানুষের নেক আমল বিনষ্ট করে দেয়

আবদুল কাদির ফারূক

গীবত ও পরনিন্দা আমাদের সমাজে দুটি পরিচিত শব্দ। মারাত্মক দুটি ব্যাধি। দুটি খারাপ রোগ। এগুলো আমাদের জীবনের সকল নেক আমলকে ক্রমান্বয়ে খেয়ে ফেলছে, যা আমরা টেরও পাই না।মানুষের জীবনে যেমন কিছু নীরব ঘাতক থাকে, তেমনিভাবে গীবত ও পরনিন্দা আমাদের নেক আমলের জন্য নীরব ঘাতক। এদুটো বিষয় আমাদের জন্যে যে পরিমাণ ক্ষতিকর, আমরা এগুলো সম্পর্কে তারচেয়েও বেশি উদাসীন হয়ে বসে আছি। এ ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণভাবে অমনোযোগী হয়ে চলাফেরা করছি।

গীবত থেকে বাঁচতে হলে প্রথমেই জানতে হবে গীবত কাকে বলে। গীবতের পরিচয় সম্পর্কে হযরত আবু হোরায়রা (রাযি.)-এর সূত্রে বর্ণিত, একজন সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, গীবত হচ্ছে তুমি তোমার কোনো ভাইয়ের পশ্চাতে তার সম্পর্কে এমন কোনো দোষ আলোচনা করা, যা সে শুনলে অপছন্দ করবে। সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! যদি বাস্তবেই তার মাঝে সে দোষ থাকে (তবে কি গীবত হবে?) রাসূল (সা.) বললেন, যদি বাস্তবেই তার মাঝে সে দোষ থাকে তবে তো গীবত হবে আর যদি বাস্তবে তার মাঝে সে দোষ না থাকে তবে তা হবে বোহতান বা অপবাদ।

হযরত ইবনুল আমীর গীবতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তুমি তার দুর্নাম করলে যদিও তার মাঝে সে দোষ থাকে।

গীবতের এই সংজ্ঞা পাওয়ার পর আমরা আমাদের আলোচনার টেবিলগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারব, আমরা কী পরিমাণ গীবতের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। গীবতের মতো একটি মারাত্মক কবীরা গুনাহে আমরা নিমজ্জিত। গোলটেবিল থেকে নিয়ে খানার দস্তরখান পর্যন্ত, ছোট-বড় কোনো মজলিসই এ গীবত নামক মহামারি থেকে খালি না।

কুরআনের দৃষ্টিতে গীবত!

মহান রব আল কুরআনে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ ধারণা হতে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ এবং গোপনীয় বিষয় তালাশ করো না। তোমরা একে অপরের গীবত করো না, তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? অথচ তোমরা তা ঘৃণা কর।’ (আল-হুজরাত: ১২)

গীবতের ভয়াবহতা উপলব্ধির জন্য কুরআনের এই আয়াতটিই যথেষ্ট। কেননা এতে আল্লাহ তাআলা গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। এ উপমার সঙ্গে তিনটি নিন্দনীয় বিষয় রয়েছে, যা একটি অপরটির চেয়ে ঘৃণ্যতর। প্রথমত মানুষের গোশত, জেনে-বুঝে আমরা কখনও মানুষের গোশত খেতে পারব না। আমাদের স্বভাব ও রুচি ভীষণভাবে এটাকে ঘৃণা করে। দ্বিতীয়ত, ভাইয়ের গোশত, কোনো জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে যতই বাধ্য করা হোক না কেন তার পক্ষে নিজের ভাইয়ের গোশত খাওয়া কখনও সম্ভব হবে না। ক্ষুধার তাড়নায় মরণাপন্ন হলেও এমনকি প্রাণ যায় যায় মুহূর্তেও নিজ ভাইয়ের গোশত খাওয়াকে সকলেই অপছন্দ ও ঘৃণা করে। তৃতীয়ত, মৃত মানুষের গোশত, মানুষের গোশত যদিও সম্মানিত, কিন্তু খাওয়ার ক্ষেত্রে সবাই অপছন্দ এবং ঘৃণা করে।

‘প্রতিটি পরনিন্দাকারীর পশ্চাতে ও সম্মুখে দুর্ভোগ রয়েছে।’ (আল-হুমাযা: ১)

হাদীসের আলোকে গীবতের ভয়াবহতা

হযরত আনাস (রাযি.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে রাতে আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হলো তখন উর্ধ্বাকাশে আমি এমন একদল লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করি, যাদের নখ দ্বারা নিজ চেহারা, বক্ষদেশ খামচে খামচে ছিঁড়ছিল। আমি হযরত জিবরাইল আ.কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা ওইসব লোক যারা মানুষের গোশত ভক্ষণ করত অর্থাৎ গীবত করত এবং মানুষের ইজ্জতের ওপর হামলা করত। (আবু দাউদ: ৪৮৭৮)

হযরত আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, গীবত হলো ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক! সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, গীবত যিনার চেয়ে কীভাবে মারাত্মক? তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তি যিনা করার পর যখন তওবা করে, মহান রব তার তওবা কবুল করেন, কিন্তু গীবতকারীকে যার গীবত করা হয়েছে, সে যদি ক্ষমা না করে মহান রবও তাকে ক্ষমা করবেন না। (বায়হাকী শরীফ)

হযরত আনাস (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, কারো নিকট কোনো মুমিনের গীবত করা হলে কিম্বা কোনো দোষ চর্চা করা হলে যদি সে বাধা দেওয়ার শক্তি রাখে এবং বাধা দেয় তাহলে মহান রব তাকে উভয় জগতে সাহায্য করবেন। আর যদি বাধা দেওয়ার শক্তি থাকা সত্ত্বেও বাধা না দেয় তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তাআলা তাকে পাকড়াও করবেন। (মিশকাত: ৪৯৮০)

গীবতের ক্ষতিসমূহ

গীবত দ্বারা মানুষ ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

  1. গীবতকারীর দোয়া কবুল হয় না।
  2. নেক আমলসমূহ কবুল করা হয় না।
  3. গীবতের কারণে অন্যায় ও পাপ কাজের পরিমাণ বেড়ে যায়।
  4. গীবত করার দ্বারা সামাজিক যে বড় ক্ষতিটা হয়, তা হচ্ছে যার গীবত করা হয়, সমাজে তাকে হেয় প্রতিপন্ন, অপদস্ত ও লাঞ্ছিত করা হয়, যা ওই ব্যক্তির জন্য মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। কেননা অপমানের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।

আমাদের গুণীজনদের গীবতের ব্যাপারে সতর্কতা

আল্লাহঅলাগণ তাদের বৈঠক ও মজলিসে গীবতের দরজা বন্ধ করে রাখতেন, যাতে করে তাদের মজলিস গুনাহের মজলিসে পরিণত না হয়, কিন্তু আজকাল সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা আলেমদের মজলিসও গীবত মুক্ত থাকছে না। শয়তান সুকৌশলে আলেমদের মজলিসেও গীবতের বিষ ছিটিয়ে দিয়েছে। আর আলেমগণও নিজেদের অসাবধানতায় সে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

  1. হযরত ওয়াহাব ইবনে ওয়ারদ (রহ.) বলেন, আমার নিকট গীবত থেকে বেঁচে থাকা স্বর্ণের পাহাড় সদকা করার চেয়েও উত্তম।
  2. হযরত হাসান বসরী (রহ.) কারও গীবত করতেন না।
  3. ইমাম আবু হানিফা (রহ.) জীবনে কারও শেকায়াত করেননি।
  4. হযরত আবু হাফস কবীর (রহ.) বলেন, পূর্ণ একমাস রোযা এতটুকু জঘন্য নয় যতটুকু জঘন্য একজনের লোকের গীবত করা।
  5. হযরত ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহ.) বলেন, আজকের আলেমদের মহৎ গুণ হচ্ছে গীবত। এরা একে অন্যের নিন্দা করে বেড়ায় যাতে সমকালীন অন্যান্য আলেম, ইলম, আমলে, তাকওয়া ও পরহেযগারিতে মান ও সম্মানে তার চেয়ে প্রসিদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ না হয়ে যায়।

এখন আমাদের উচিত গীবতকে মৃত্যুর চেয়ে জঘন্য ও ভয়ংকর মনে করা। পাশাপাশি গীবত শোনা থেকে বিরত থাকা। কেননা গীবত শোনাও হারাম।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সবাইকে গীবত করা ও শোনা থেকে হেফাযত করুন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ