তোহফা আযীয
চারদিকে ঘোর অনাচার, পাপাচার। রক্তারক্তি চলছে প্রতিনিয়ত। একত্ববাদের বদলে বহুত্ববাদের ছড়াছড়ি। যেন নিকষ কালো রজনি। সুবহে সাদিকের অপেক্ষায় পুরো জাতি, প্রকৃতি। ঠিক সেসময় এক সুবহে সাদিকে আগমন শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর। যেন সোনালি কিরণ উদিত হলো রাতের নিশ্ছিদ্র তমসা ভেদ করে, রবের রওশনি নিয়ে। জাহান্নামের কিনারা হতে লোকদের জান্নাতী বাগিচার অধিবাসী করতে।
হেরা গুহা হতে জাতির জন্য নিয়ে এলেন এক আলোকবর্তিকা। যার বিচ্ছুরণে অসভ্য জাতি পরিণত হলো শ্রেষ্ঠ জাতিতে। আকণ্ঠ পাপসাগরে ডুবে থাকা নির্দয় লোকগুলো পরিণত হলে যুগশ্রেষ্ঠ মানবে। তাঁর চলন-বলন, সমর্থন-মৌনতায় আমাদের জন্য রয়েছে অনুপম আদর্শ, জীবন, গড়ার পাথেয়। কিন্ত তা হয়তো আমাদের পিচ্ছিল তটে আঁকতে পারে না শিল্পিত আলপনা।
আমার নবীজি কেমন ছিলেন? কেমন ছিল তাঁর জীবনধারা? প্রাচুর্যতায় ঢাকা নাকি দরিদ্রতার যাঁতাকলে পেষা? সেই শ্রেষ্ঠ মানুষের অনাড়ম্বর জীবনের কিছু ঝলক, তাঁর চরিতের আংশিক আলপনা:
ইবাদাতে রাসূল (সা.)
তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, আল্লাহ যার আগের ও পরের সমস্ত পাপ মোচন করে দিয়েছেন। তবুও তার জীবনের রাত অতিবাহিত হতো কিয়ামুল লাইলে। একাগ্রচিত্তে রবের স্মরণে কাটত তাঁর নির্জন ক্ষণ। নবুওয়াত প্রাপ্তির আগ হতেই তিনি হেরা গুহায় আল্লাহর সান্নিধ্যে দিন কাটাতেন। সেই হেরা গুহা হতেই উম্মতের জন্য নিয়ে এলেন নূরের ঝলকানি, হেদায়তের বাণী।
তিনি এত দীর্ঘ সময় নামাজ আদায় করতেন যে, পা মোবারক ফুলে যেতো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ নাযিল করেন, হে নবী, কুরআন তো আপনার কষ্টের জন্য নাযিল হয়নি….। (সূরা তহা)
দীর্ঘ সময় ধরে সেজদায় পড়ে থাকতেন রবের কুদরতী কদমে। কুরআন পাঠে সর্বদা রসনা ছিল ভেজানো। রবের যিকির আযকারে জাগ্রত থাকত হৃদয়। তাহাজ্জুদ কখনো ছেড়ে দেননি। অথচ তিনি হলেন জান্নাতের সরদার। একদিন আম্মাজান আয়েশা (রাযি.) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি তো নিষ্পাপ, আপনার পূর্বাপরের সমস্ত পাপ তো মোচন করে দেওয়া হয়েছে, তবুও কেন আপনি এত ইবাদাতে মশগুল থাকেন? নবী (সা.) মৃদু হেসে কোমল কন্ঠে বললেন, আয়েশা!আমি তো আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে চাই! (বুখারী ও মুসলিম) তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়েও এত ইবাদাত করতেন, রোনাজারি করতেন!! উম্মতের জন্য তা শিক্ষার এক মোক্ষম বিষয়।
তিনি তো বলেই গিয়েছেন, তোমরা নামাজ আদায় করো সেভাবে যেভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখ। তাঁর জীবনের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে আমাদের জন্য অসংখ্য আলোর ঝিলিমিলি। দীনের প্রতিটি বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা করে সহজ করে দিয়েছিলেন উম্মতের জন্য।
মুআমালায়ে রাসূল (সা.)
মানুষের হক আদায়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। কখনো কারো সামান্যতম অধিকার খর্ব করেননি। বরং তিনিই তো পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন অধিকার আদায়ের মানদণ্ড। যারা মানুষের হক নষ্ট করে নবীজি তো তাদের নিঃস্ব বলে আখ্যায়িত করেছেন। একবার এক ইহুদি তার সাথে উচ্চবাচ্য করেছিল তাঁর অধিকার আদায়ে। কিন্ত তিনি একটুও আওয়াজ করেননি, বরং তাকে দ্বিগুন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন৷
তিনি অনুপম আচরণে সেই ইহুদির মন জয় করে নিলেন। সে এসেছিলো প্রশান্তির শামিয়ানার নিচে। এমন মহৎ মানুষের সান্নিধ্যে গড়েছিলো নিজেকে। তাঁর এমন সৎ গুণাবলির কারণেই লোকের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো তাঁর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা। সম্মান লুটোপুটি করেছিল তাঁর কদমে। উম্মতের জন্যও রেখে গিয়েছেন সেই মহান শিক্ষার ঝলক। কিন্ত হায় আফসোস! আমরা বড়ই উদাসীন!কত অসচেতন!
তিনি এ ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করে বলে গিয়েছেন, কেয়ামতের দিন তোমরা পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া এক পাও সামনে এগোতে পারবে না। এর মধ্যে একটি হলো মানুষের হক সম্পর্কে।
মুআশারাতে রাসূল (সা.)
শরীয়তে নামাজ-রোজার প্রতি যেমন গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তেমনি উন্নত চরিত্রগঠনের প্রতিও অসীম গুরুত্বারোপ করেছেন। অন্যের সাথে কথা-বার্তা, আচার-আচরণ এমনভাবে করা যেন তার সামান্যতমও অস্বস্তি, কষ্ট বা মানসিক চাপ না হয়। আমাদের নবীজিও তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে উম্মতের জন্য রেখে গিয়েছেন বিরাট শিক্ষা। বাতলে দিয়েছেন উত্তম চরিত্রে ভূষিত হওয়ার উপায়। তিনি শুধু নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীর নবী ছিলেন না, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য ছিলেন। দুজাহানের সরদার ছিলেন তথাপি তাঁর চাল-চলনে ছিল সাদাসিধা, জীবনে ছিল অনাড়ম্বরতা। স্ত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ প্রেমিক পুরুষ। স্ত্রীদের সাথে একি লেপের নিচে ঘুমাতেন, তাদের খাওয়া পানি পান করতেন। এমনকি ছোট্ট আয়েশার খেলার সাথীও ছিলেন তিনি। একবার কিশোরী আয়েশাকে খেলা দেখানোর জন্য নিজের কাঁধের পিছনে দাঁড় করিয়ে যতক্ষণ আম্মাজানের খেলা দেখা শেষ হয়নি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। প্রতিদিন স্ত্রীদের সাথে দেখা করতেন, তাদের খবরা-খবর নিতেন। কখনো নবুওয়তী শানে তাদের সাথে আলাপ করতেন না। সহধর্মিণীদের প্রতি রাসূলের আচরণ ছিলো সহানুভূতির, সম্প্রীতির। তিনি পত্নীদের অভিমান ভাঙ্গাতেন, প্রয়োজন পূরা করতেন, হাসি মশকরা করতেন, সাংসারিক কাজে তাদের সাহায্যও করতেন। জাগতিক শক্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও তিনি নিজ কাজ নিজে করতেন। সাহাবাদের সাথেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতেন। আহযাবে খন্দক খননে তিনিও সাহাবাদের সাথে সাথে কাঁধে মাটি বহন করে নিয়ে যেতেন। ভরা মজলিসে তিনি এতই সাধারণভাবে থাকতেন যে, অপরিচিত কেউ পরিচয় দেওয়া ছাড়া চিনতে পারত না। এমনই সুন্দর ছিলো তাঁর স্বভাব, এমনই নিরহংকার ছিলেন তিনি।
আখলাকে রাসূল (সা.)
নবী (সা.) ছিলেন সবচেয়ে নান্দনিক চরিত্রের অধিকারী। সর্বকালের এই সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, দরিদ্রদের সাহায্য আর আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার্থে ছিলেন কঠোর। আরবযুগের যত তফাৎ আর অন্যায় রুখে ছিলেন কঠোরহস্তে। সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিল তার চেহারা। সবার অভিযোগ শ্রবণ করতেন, সমাধান দিতেন। ইরশাদ করা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আপনিই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কলাম)
নবুওয়তী জিন্দেগির পূর্ব হতেই এত সততা আর উত্তম চারিত্রিকতা ছিলো যে আরবের লোকের কাছে তিনি ছিলেন আল-আমীন। সেই অন্ধকার যুগের সবধরণের খুন খারাবি আর অনৈতিক কাজ হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সন্তর্পণে।
তিনি ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, চিন্তা চেতনায় সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর, বুদ্ধি ছিল তীক্ষ্ণ, রসিকতা ছিল শালীন। সাহাবাদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো সহজ। তিনি তাদের বলতেন, তারাও তাঁকে বলতেন, তিনি তাদের কথা শুনতেন আর মুচকি হাসতেন। এমনই ছিলো এই মরুর দুলালের ব্যবহার। এত অমায়িক! হৃদ্যতাপূর্ণ!
হযরত আনাস (রাযি.) দশ বছর নবীজির খেদমত করেছেন। তিনি বলেন, নবীজি কোনদিন আমাকে ধমকও দেননি, মার তো আরও দূরের ব্যাপার। কখনো বলেন নি যে, এমন কেন করেছ কিংবা এমন কেন করনি? (মুসলিম: ২৩১০)
হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা তিনি তো আপন পিতার সঙ্গের চেয়ে নবীজির সান্নিধ্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। পিতার স্নেহ-মমতা উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছিলো প্রিয় নবীজির ভালোবাসাকে। নবী যে তাকে ভালোবাসতেন আপন সন্তানের মতো!!
তাঁর হৃদয় যে ছিলো পবিত্রতায় মোড়ানো, দয়ার সফেদ আকাশ যে ছিলো তাঁর বুকে, আরব-আজমী যার এমন অসাধারণ ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলো। আধুনিক চিন্তাবিদ জে. এইচ. ডেনিসন বলেছেন, ‘সমগ্র পৃথিবীর পূর্ব থেকে দক্ষিণ, হারকিউলেস স্তম্ভ থেকে দূরবর্তী ভারত এবং মঙ্গোলিয়ার বৃক্ষহীন প্রান্তরকে একই মহান ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন এই মানুষটি (হযরত মোহাম্মদ সা.) ৷’
সৌভাগ্যক্রমে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে একটি নিখুঁত প্রতিকৃতি মানবজাতিকে উপহার দিয়েছেন। সেই প্রতিকৃতি অনুসরণের মাঝেই রয়েছে চূড়ান্ত সফলতা। তিনি তাঁর ৬৩ বছরের জীবনে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন এক অনুপম আদর্শের ডালি। সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈবাহিক সর্বক্ষেত্রে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন সুন্দর সুখময়, আদর্শ জীবন গড়ার দৃষ্টান্ত।
তিনি যেমন ছিলেন দাওয়াতের ময়দানে আল্লাহর একজন গুরুগম্ভীর রাসূল, যুদ্ধের ময়দানে একজন লড়াকু, বীর সিপাহসালার, তেমনি দাম্পত্যজীবনে ছিলেন একজন আদর্শ, নমনীয়, প্রেমময় জীবনসঙ্গী।