কওমি মাদরাসায় কেন পড়বো? এবং কীভাবে পড়বো?
আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী দা: বা:
[করোনাকালীন দীর্ঘ ছুটির পর বিগত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ আল–জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সকল বিভাগের ভর্তি কার্যক্রম আরম্ভ হয় এবং ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ তারিখ থেকে দরস আরম্ভ হয়। নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সোমবার বাদে যোহর জামিয়ার জামে মসজিদে ছাত্র–শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন জামিয়া প্রধান আল্লামা মুফতী আবদুল হালীম বোখারী দা: বা: । ঐতিহাসিক সে ভাষণের সারসংক্ষেপ প্রদত্ত হলো—সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি]
نحمده ونصلي علىٰ رسوله الكريم، أما بعد! فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمٰن الرحيم، [وَلٰكِنْ كُوْنُوْا رَبّٰنِيّٖنَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُوْنَ الْكِتٰبَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُوْنَۙ۰۰۷۹] {آل عمران: 79} صدق الله العظيم.
وَعَنْ أَنَسٍ، قَالَ: قَالَ لِيْ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: «يَا بُنَيَّ، إِنْ قَدَرْتَ أَنْ تُصْبِحَ وَتُمْسِيَ لَيْسَ فِيْ قَلْبِكَ غِشٌّ لِأَحَدٍ فَافْعَلْ»، ثُمَّ قَالَ لِيْ: «يَا بُنَيَّ وَذَلِكَ مِنْ سُنَّتِيْ، وَمَنْ أَحْيَا سُنَّتِيْ فَقَدْ أَحَبَّنِيْ، وَمَنْ أَحَبَّنِيْ كَانَ مَعِي فِي الْـجَنَّةِ».
رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বরং তোমরা রাব্বানী হয়ে যাও (অর্থাৎ তোমরা রবের গুণে গুণান্বিত হয়ে ইলাহী সাধক হয়ে যাও)। যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দিচ্ছ এবং কিতাব অধ্যয়ন করছ।’
(সূরা আলে ইমরান: ৭৯)
হাদীস শরীফের অর্থ: হযরত আনাস (রহ:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) আমাকে বলেছেন, ‘হে বৎস! তুমি যদি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমার অন্তরে কারও প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ না রেখে কাটাতে পারো তাহলে তাই করো।’ এরপর তিনি (সা:) বললেন, ‘হে বৎস! এটি আমার সুন্নত। যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে ভালোবাসে সে আমাকেই ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’
(সুনানে তিরমিযী: ২৬৭৮)
প্রিয় শিক্ষার্থীরা!
আমার অসুস্থতা সত্ত্বেও কিছু জরুরি আলোচনার জন্য আজ আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমাদের আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া একটি ব্যতিক্রমধর্মী দীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি আদর্শ ধর্মীয় মাদরাসা। আমাদের এ প্রতিষ্ঠানের অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। আপনাদেরকে সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে হবে এবং সেগুলো রক্ষা করে চলতে হবে। বস্তুত আমাদের দেশে আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কোনোটির নাম প্রাইমারি স্কুল বা প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোনোটির নাম হাইস্কুল বা উচ্চ বিদ্যালয়। কোনোটির নাম কলেজ বা মহাবিদ্যালয়। আবার কোনোটির নাম ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয়। সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করলে বড় বড় অফিসার হওয়া যায়। ডিসি সাহেব, এসপি সাহেব, ওসি সাহবে হওয়া যায়। মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়। মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা পাওয়া যায়। সরকারি গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কওমি মাদরাসাগুলো হলো এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আমাদের এ সকল কওমি মাদরাসায় পড়ালেখা করে সেগুলোর কোনোটিই পাওয়া যায় না। এখানে পড়ালেখা করে ডিসি হওয়া যায় না। এসপি হওয়া যায় না। মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়া যায় না। মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা পাওয়া যায় না। সরকারি গাড়ি-বাড়িরও মালিক হওয়া যায় না। তাহলে আমরা এখানে কেন পড়ালেখা করবো?
এর সহজ উত্তর হলো, স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করে পার্থিব উন্নতি-অগ্রগতি হয়তো অর্জন করা যায়। কিন্তু সেখানে আখেরাতের অনেক কিছু পাওয়া যায় না। বিশেষত সেখানকার পড়ালেখা দ্বারা আল্লাহ তাআলাকে পাওয়া যায় না। সেখানে দুনিয়াবি মান-মর্যাদা থাকলেও সেখানে আল্লাহ থাকে না। আর স্মরণ রাখবে, যাদের কাছে আল্লাহ থাকে না, তাদের কাছে যেন কিছুই নেই। তারা হলো প্রকৃত সর্বহারা। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,
عَنْ أَبِيْ مُوْسَىٰ h، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ ﷺ: «مَثَلُ الَّذِيْ يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِيْ لَا يَذْكُرُ مَثَلُ الْـحَيِّ وَالْـمَيِّتِ». رواه البخاري.
অর্থ: হযরত আবু মুসা আল-আশআরী (রদ্বি:) হতে বর্ণিত, নবী কারীম (সা:) বলেন, ‘যে আল্লাহর যিকর করে আর যে যিকর করে না, উভয়ের উদাহরণ মৃত ও জীবন্ত মানুষের মত।’ (বুখারী: ৬৪০৭)
অর্থাৎ যাদের কাছে আল্লাহ আছে এবং আল্লাহর যিকর আছে, তারা হলো জীবিত প্রাণী। আর যাদের কাছে আল্লাহ নেই এবং আল্লাহর যিকর নেই, তারা হলো মৃত শরীরের ন্যায়। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ভাষায় তারা হলো মৃত। আর আমরা হলাম প্রকৃত জীবিত।
কওমি মাদরাসায় পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য:
সেই প্রকৃত জীবন অর্জন করার লক্ষ্যেই আমাদেরকে এসব কওমি মাদরাসায় আসতে হয়। এখানে ভর্তি হলে, এখানে পড়ালেখা করলে, এখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করলে আল্লাহঅলা হওয়া যায়। খোদাভীরু হওয়া যায়। আর আল্লাহঅলা হওয়া এবং খোদাভীরু হওয়াই আমাদের পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلٰكِنْ كُوْنُوْا رَبّٰنِيّٖنَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُوْنَ الْكِتٰبَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُوْنَۙ۰۰۷۹
অর্থাৎ তোমরা যা পড়াবে এবং যা পড়বে; যা শেখাবে এবং শিখবে;সবকিছুর উদ্দেশ্য হলো, তোমরা যেন রব্বানী হয়ে যাও। আল্লাহঅলা হয়ে যাও। এখানে রবের দিকে সম্বোধন করা হয়েছে। সুতরাং আমাদের মাদরাসায় পড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আল্লাহঅলা হওয়া। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। কবি বলেন,
تو کجا وازکجا وکیستی؟
তুমি কোথায় ছিলে? তুমি কোথায় থেকে এসেছো? তুমি কে? তুমি কেন এসেছো? এসব কি তোমার খবর আছে?!
আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা আল্লাহঅলা হওয়ার জন্যই এই জামিয়ায় ভর্তি হয়েছি। এই দীনী প্রতিষ্ঠানে এসেছি। এখন বছরের শুরু। এখনই আমাদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ করে নিতে হবে। এজন্যই ইমাম বুখারী (রহ:) বুখারী শরীফের প্রথম হাদীস এনেছেন,
«إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ».
অর্থাৎ সকল আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আমরা এখানে এসেছি একমাত্র আল্লাহকেই সন্তুষ্ট করার জন্য। একথা আমদেরকে সবসময় স্মরণ রাখতে হবে।
আল্লাহ কীভাবে সন্তুষ্ট হবেন?
এখন আমাদেরকে জানতে হবে, আল্লাহ তাআলা কীভাবে সন্তুষ্ট হবেন? নিঃন্দেহে আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করতে হলে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর প্রয়োজন রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ভালোবাসার প্রয়োজন আছে। রাসূলের মাধ্যমে এবং রাসূলের ভালোবাসার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করা সহজ হবে। এজন্য আল্লাহর এক আরেফ বলেন,
محمد از تو میخوہم خدا را
خدایا از تو حب مصطفیٰ را
অর্থ: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে চাই, যেন আল্লাহকে পাই। ওগো আল্লাহ! আমাদের মধ্যে তোমার রাসূলের মহব্বত দিয়ে দাও।
রাসূলের মহব্বত কীভাবে অর্জিত হবে?
এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহর রাসূলের মহব্বত কীভাবে অর্জিত হবে? রাসুল্লাহ (সা:)-এর মহব্বত-ভালোবাসার জন্য তাঁর সুন্নতকে ভালোবাসতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেন,
«وَمَنْ أَحْيَا سُنَّتِيْ فَقَدْ أَحَبَّنِيْ، وَمَنْ أَحَبَّنِيْ كَانَ مَعِي فِي الْـجَنَّةِ».
অর্থ: ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে ভালোবাসে সে আমাকেই ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’ সুতরাং আমাদেরকে সুন্নতের ওপর আমল করার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মহব্বত-ভালোবাসা অর্জন করতে হবে এবং রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ভালোবাসার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
প্রিয় শিক্ষার্থীরা!
মাদরাসা শিক্ষার্থী হিসেবে আপনাদের সকল কার্যক্রম সুন্নত অনুযায়ী হতে হবে। প্রত্যেক ছাত্রের লেবাস-পোশাক সুন্নত মতে হতে হবে। আপনাদের চাল-চলন সুন্নত মতে হতে হবে। মাথা থেকে নিয়ে পা পর্যন্ত আপদমস্তক সুন্নতে ভরপুর হতে হবে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিটি কাজকে যাচাই করবে যে, আমার কাজ-কর্ম, কথাবার্তা ও আচার-ব্যবহার; সবকিছু সুন্নত অনুযায়ী হলো কি-না?
প্রিয় ছাত্ররা!
তোমারা তোমাদের চুল-দাড়ি সুন্নত অনুযায়ী রাখবে। চুল মুণ্ডিয়ে নেব অথবা সমান করে কেটে ফেলবে। ইংরেজি স্টাইলে চুল রেখে টুপি দিয়ে কেউ লুকানোর চেষ্টা করবে না। সুন্নত মতো যদি চলতে কারও ভালো না লাগে, তা হলে স্কুল-কলেজে চলে যাও। সেখানে তো টুপিও পরিধান করতে হবে না। শার্ট-প্যান্টও পরিধান করতে পারবে। যেমন ইচ্ছা চলতে পারবে। এখানে সেই সুযোগ নেই। তেমনি কেউ দাড়িতে কখনো হাত দেবে না। দাড়ি কাটবে না। মনে রাখবে, দাড়ি এক মুষ্টি পর্যন্ত লম্বা করা ওয়াজিব। এর পূর্বে দাড়ি মুণ্ডানো কিংবা দাড়ি কাটা কবীরা গোনাহ। এমন গোনাহ থেকে সকলকে বেঁচে থাকতে হবে। অনুরূপভাবে লুঙ্গি-পায়জামাও সুন্নত অনুযায়ী পরিধান করতে হবে। এগুলো টাখনুর ওপর পরিধান করবে। টাখনুর নীচে কাপড় পরিধান করা যাবে না। এটিও কবীরা গোনাহ।
মোটকথা স্কুল-কলেজের কোনো ড্রেস মাদরাসায় পরিধান করা যাবে না। মাদরাসার ছাত্রদের জন্য মাদরাসার ড্রেস, বিশেষত সুন্নতী লেবাসই পরিধান করতে হবে।
প্রিয় ছাত্ররা!
আমাদেরকে সালামের প্রচার-প্রসার করতে হবে। অনেক ছাত্রকে দেখা যায়, হুযূরদেরকেও সালাম করে না। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘তোমরা সলামের প্রচার-প্রসার করো। সালামের পরিবেশ গড়ে তুলো।’
মিসওয়াকের অভ্যাস গড়ে তুলবে
সবসময় মিসওয়াক করবে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,
«تَفْضُلُ الصَّلَاةُ الَّتِيْ يُسْتَاكُ لَـهَا عَلَى الصَّلَاةِ الَّتِيْ لَا يُسْتَاكُ لَـهَا سَبْعِيْنَ ضِعْفًا».
رَوَاهُ الْبَيْهَقِيّ فِيْ «شعب الْإِيمَان»
‘মিসওয়াক করে যে নামায আদায় করা হয়, সে নামাযে মিসওয়াকবিহীন নামাযের তুলনায় সত্তর গুণ বেশি ফযীলত রয়েছে।’
(শুআবুল ঈমান: ২৫১৯)
এখন তো দোকানে যায়তুন গাছের মিসওয়াক পাওয়া যায়। আমাদের সময় তো সেগুলো পাওয়া যেত না। আমাদেরকে নিম গাছের ডালি এবং কেরুম গাছের শিকড় দিয়ে মিসওয়াক করতে হতো। আমাদের সময় ভালো কোনো স্যানিটারি পায়খানার ব্যবস্থা ছিলো না। খোলা পায়খানায় প্রয়োজন পূরণ করতে হতো। অনেক সময় পায়খানার কীট-প্রতঙ্গ শরীরে উঠে যেতো। তা সত্ত্বেও ছাত্ররা ঢিলার সুন্নত আদায় করতো। জুমাবারে মাটি দিয়ে ঢিলা বানাতো। এখন তো ঢিলা বানাতে হয় না। বাজারে টিস্যু পেপার পাওয়া যায়। সেগুলো দিয়ে সহজে ও শান্তিতে ঢিলা করা যায়। এতে অনেক সময়ের সাশ্রয় হয়। তারপরও যদি পড়াশোনা না হয়, তা হলে খুবই পরিতাপের বিষয় হবে।
শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়বে
প্রিয় ছাত্ররা! শেষ রাতে আল্লাহর রহমত নাযিল হয়। এ সময় জেগে কয়েক রাকআত তাহাজ্জুদ পড়ুন। অতঃপর অধ্যয়নে মনোনিবেশ করুন। তাহাজ্জুদ পড়নেঅলাদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা:)।
عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ يَزِيدَ، عَنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ قَالَ: «يُحْشَرُ النَّاسُ فِيْ صَعِيْدٍ وَاحِدٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَيُنَادِي مُنَادٍ فَيَقُولُ: أَيْنَ الَّذِيْنَ كَانَتْ تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْـمَضَاجِعِ، فَيَقُوْمُوْنَ وَهُمْ قَلِيْلٌ، يَدْخُلُوْنَ الْـجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ، ثُمَّ يُؤْمَرُ بِسَائِرِ النَّاسِ إِلَى الْـحِسَابِ». رَوَاهُ الْبَيْهَقِيُّ فِيْ «شُعَبِ الْإِيمَان»
অর্থ: হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ রাসূলুল্লাহ (সা:) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি (সা:) বলেছেন, কিয়ামতের দিন মানবমণ্ডলীকে একটি ময়দানে একত্রিত করা হবে, তখন একজন ঘোষক এ ঘোষণা করবে, সেসব লোকেরা কোথায়? যারা (রাতে) আরামের বিছানা থেকে নিজেদের পার্শ্বকে দূরে রেখেছিল, তখন অল্প কিছুসংখ্যক লোক উঠে দাঁড়াবে এবং তারা বিনাহিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতঃপর অবশিষ্ট সকল মানুষ থেকে হিসাব নেওয়ার নির্দেশ করা হবে।’
(শুআবুল ঈমান: ৫৫৬৫)
তাই এলাকায়ী নাজেম ও দায়িত্বশীলদের নিকট অনুরোধ করবো, আপনারা নিজ নিজ এলাকায় ছাত্রদেরকে তাহাজ্জুদের সময় উঠিয়ে দেবেন। কেবল উঠিয়ে দিয়ে ক্রান্ত হবেন না, বরং হাঁটতে থাকবেন। তাতে আপনাদের শারীরিক ব্যায়ামও হবে ছাত্রদের নেগরানিও হবে। মনে রাখবেন, আমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেক দায়িত্বশীলকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। আমি দায়িত্বশীলদের নিকট আশা করবো, আপনারা ছাত্রদেরকে যথাযথ নেগরানি করবেন।
ছাত্ররা একেবারেই মোবাইল ব্যবহার করবে না
প্রিয় ছাত্রররা! জামিয়ায় ছাত্রদের জন্য মোবাইল ব্যবহার একেবারেই নিষেধ। মোবাইল ব্যবহার, বহন ও সংরক্ষণ ছাত্রদের জন্য বহিষ্কারযোগ্য অপরাধ। বিশেষত স্মার্টফোন ছাত্রদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি এখন অবৈধ খেলাধুলার সরাঞ্জামে পরিণত হয়েছে। ইমাম বুখারী (রহ:) একটি অধ্যায় রচনা করেছেন, باب كسر آلة اللهو অর্থাৎ অবৈধ খেলাধুলার সরাঞ্জাম ভেঙে ফেলা। স্মার্টফোন বর্তমানে অবৈধ খেলাধুলার সরাঞ্জামে পরিণত হয়েছে। অতএব কোনো ছাত্র এগুলো রাখবে না। কোনো ধরণের মোবাইল ফোন ব্যবহার করবে না। যদি কারও নিকট মোবাইল পাওয়া যায়, তাহলে هٰذَا فِرَاقُ بَيْنِيْ وَبَيْنِكَ١ۚ ۰۰۷۸ হয়ে যাবে। অর্থাৎ কোনো ছাত্রের নিকট মোবাইল পাওয়া গেলে, তাকে জামিয়ায় রাখা যাবে না।
সর্বক্ষেত্রে আদাব-সিষ্টাচার অবলম্বন করবে
আমাদের উস্তাদ জামিয়ার শায়খুল হাদীস আল্লামা ইমাম আহমদ (রহ:) (প্রকাশ-ইমাম সাহেব) বলতেন,
طريق العشق كلها آداب
أدب النفس أيها الأصحاب
অর্থাৎ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার যে রাস্তাগুলো রয়েছে, প্রত্যেক রাস্তা হলো আদবের রাস্তা। হে সাথীরা! নিজেকে আদাব শিক্ষা দাও। অতএব ছাত্ররা ভক্তি-শ্রদ্ধার মাধ্যমে উস্তাদের আদব, জামিয়ার সরাঞ্জাম সংরক্ষণের মাধ্যমে মাদরাসার আদব রক্ষা করবে। ইলমের আদব রক্ষা করতে হবে। তেমনি ইলমের আসবাবেরও আদব রক্ষা করতে হবে। গতবছর কিছু ছাত্রদের আচরণে আমরা খুবই কষ্ট পেয়েছি। সারা বছর যেসব টুলে বসে বসে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ পড়েছে, বছরের শেষে তারা টুলগুলো ভেঙে ফেলেছে। এসব কি আদব? যারা এ কাজগুলো করেছে, তাদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না। এটি আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি। তাই কোনো ছাত্র এ ধরণের বেআদবিমূলক কোনো আচরণ করবে না। তাতে দীনী এবং দুনিয়াবি উভয়কে নষ্ট করবে। আল্লাহ সকলকে হেফাজত করুন।
মাদরাসার জীবন কষ্ট-মেহনতের জীবন
মানুষের জীবনের দুটি বিভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগে কষ্ট-মেহনত করতে হয়। আর দ্বিতীয় ভাগে সুখ-শান্তি অর্জিত হয়। মনে রাখবে, প্রথম ভাগে যারা কষ্ট-মেহনত করে, তারাই দ্বিতীয়ভাগে উন্নতি-সফলতা লাভ করতে পারে। তাদের জীবন সুন্দর ও সমৃদ্ধ হয়। এটিকে জীবনের ‘ফুতুহাত’ (বিজয়-সফলতার ধারা) বলা হয়।
মাদরাসার জীবন হলো কষ্ট-মেহনতের জীবন। পড়ালেখার জীবনে বিলাসিতা করা যায় না। প্রয়োজনীয় খাবার-দাবারের ওপর তুষ্ট থাকতে হবে। এ সময়ে যারা খাবারের স্বাদ ও ভোগ-বিলাসী হবে, তারা পড়ালেখার স্বাদ থেকে মাহরুম হবে। ছাত্র জীবনে মজার মজার খাবার তালাশ করা যায় না। ছাত্রজীবনে অল্পতুষ্টি ও প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ করে পড়ালেখা সমাপ্ত করতে হয়। খুবই সামান্য খাবার গ্রহণ করে জীবন কাটাতে হয়। তারপর কর্ম জীবনে আল্লাহ সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করবেন। ভবিষ্যতে এত বেশি খাবার গ্রহণ করতে হবে যে, খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে যাবে। এত অধিক খাবারের ব্যবস্থা থাকবে যে, অনেক সময় অধিক খাবার গ্রহণের কারণে ডায়াবেটিকসও হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ পাক সকলকে রক্ষা করুন।
সুহৃদ শিক্ষার্থীরা!
এখন মেহনতের সময়। এ সময় খাবারের স্বাদ ছেড়ে দিতে হয়। ইমাম বুখারী (রহ:) বলেন, আমি হাদীস অর্জন করার জন্য দেশ-দেশান্তর সফর করেছি। একদিন আমি বিদেশের এক সফরে ছিলাম। সেখানে একজন মুহাদ্দিসের কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করছিলাম। ইতিমধ্যে আমার অর্থ-কড়ি পুরিয়ে যায়। এমনকি তিনদিন পর্যন্ত খাবারের কোনো ব্যবস্থাই ছিলো না। আমি ঘাস খেয়ে খেয়ে জীবন ধারণ করছিলাম। তবে এমন করুণ পরিস্থিতিতেও হাদীসের দরস ত্যাগ করিনি। আল্লাহর অশেষ মহিমা, তিনদিন পর এক অপরিচিত ব্যক্তি এসে আমাকে একটি স্বর্ণমুদ্রার থলে দিয়ে যান। আর সেগুলো দিয়ে আমি আমার প্রয়োজন পূরণ করি।
তেমনি ইমাম বুখারী (রহ:) বলেন, আমি ৪০ বছর যাবৎ তরকারি ছাড়া শুধুমাত্র রুটি খেয়েছি। তরকারি দিয়ে রুটি খাওয়ার সুযোগ ছিলো না। ইত্যবসরে আমি একটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে যাই। তখন ডাক্তারের নিকট একটি বোতলে করে কিছু পেশাব পাঠানো হয়। ডাক্তার সাহেব পেশাব দেখেই বলেন যে, এটি তো কোনো পাদ্রীর পেশাব হবে। যিনি দীর্ঘদিন যাবৎ সাধনা করার জন্য তরকারি গ্রহণ করেননি। যখন এই সংবাদ ইমাম বুখারী (রহ:)-নিকট পৌঁছলো, তখন তিনি বলেন, ডাক্তার সাহেব ঠিকই বলেছেন। আমি ৪০ বছর যাবৎ তরকারি খাইনি, সুবহানাল্লাহ। মূলত এমন মেহনতের পরেই ইমাম বুখারী (রহ:) ইমাম বুখারী হয়েছেন।
প্রিয় ছাত্ররা!
এজন্যই বলছি যে, তোমাদেরকে এখন অনেক মেহনত করতে হবে। খাবারের মজা বাদ দাও। তাহলেই পড়ার মজা পাবে। গতবছর কিছু ছাত্রকে দেখা গেলো, তারা নিজেরাই ভাত-তরকারি পাক করেছে। দেখে খুবই আফসোস হলো। কারণ তোমরা যদি এভাবে পাক-শাক করতে থাকো, তাহলে পড়াশোনা করবে কখন? আমরাও তো এই জামিতেই পড়াশোনা করেছি। জামিয়ার পক্ষ থেকে যে ডাল-ভাত দেওয়া হতো, সেগুলো খেয়েই পড়াশোনা করেছি। সকালবেলা যে নাস্তা করতে হয়, সেটাও আমরা জানতাম না। বিকালের উচ্ছিষ্ট খাবার (পানতা ভাত) খেয়েই সকালবেলা অতিবাহিত করেছি। খুবই নিম্নমানের চাউল দেওয়া হতো। এমনকি অনেক সময় সেখানে কীট-পতঙ্গও পাওয়া যেতো। সেগুলো পনিতে পরিষ্কার করে খেয়ে নিতাম। এমন কষ্টের বিনিময়ে আমরা পড়ালেখা করেছি। এখন তো অনেক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্যানিটারি পায়খানার ব্যবস্থা আছে। বিদুৎ-পানির ব্যবস্থা আছে। থাকা-খাবারের সুব্যবস্থা আছে। তাই কোনো ছাত্র রান্নাবান্নায় সময় নষ্ট করবে না। কারও জন্য জামিয়ার ক্যাম্পাসে গ্যাস সিলিন্ডার কিংবা অন্য কোনো চুলা রাখার অনুমতি নেই। যারা সদকার উপযুক্ত তাদেরকে জামিয়ার পক্ষ থেকে খাবার দেওয়া হবে। আর যারা সদকার উপযুক্ত নয়, তারা নিজ টাকা দিয়ে জামিয়ার বোর্ডিং থেকে আম খানা কিংবা খাস খানা জারি করে খাবে।
প্রিয় নতুন ছাত্ররা!
আপনারা এখানে নতুন ভর্তি হয়েছেন। জামিয়ার নিয়মনীতি মেনে চলবেন। লক্ষ্য রাখবেন যে, আমাদের জামিয়ার ঐতিহ্য হলো এখানে ছাত্ররা পাঁচওয়াক্ত নামাযে মসবুক হয় না। কিন্তু ইদানীং কিছু ছাত্রকে নামাযে মসবুক দেখা যায়। এটি জামিয়ার ঐতিহ্য বিনষ্ট করবে। তাই আমি আমাদের জামিয়ার নাজেমে দারুল ইকামা হযরত মাওলানা আবু তাহের নদভী ¡-কে বলবো, আপনি জামিয়ার মুঈনে মুহতামিমও। আপনার প্রচেষ্টায় জামিয়ার মসজিদে মসবুক হওয়া বন্ধ হয়েছিলো। এখনো আপনি উদ্যোগ গ্রহণ করুন। যেন কোনো ছাত্র মসবুক হতে না পারে। আযানের পর ২৫ মিনিট সময় থাকে। বড় বড় হুযূররা প্রথম কাতারে উপস্থিত হয়ে যান। অথচ তাঁরা মাযুর-অসুস্থ। তাঁরা তো মসবুক হয় না। আপনারা যুবক ছাত্র হয়ে কেন মসবুক হবেন? সাবেক (অগ্রগামী) হও। মসবুক হয়ো না। নাজেম সাহেবকে আমি অনুরোধ করবো, এলাকায়ী নাজেদের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করুন। মসবুক হওয়া ছাত্রদের তালিকা পেশ করুন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে তাদেরকে বহিষ্কার করা হবে। এমন ছাত্র আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। একজনও যদি ভালো ছাত্র বের হয়, তাহলে আমরা কামিয়াব। অধিক ছাত্র নয়, ভালো ছাত্রই আমাদের প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে না যে, তোমাদের জামিয়ায় ছাত্র অধিক ছিলো কি-না? আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন, ভালো ছাত্র ছিলো কি-না? আল্লাহঅলা ছাত্র ছিলো কি-না? সুন্নত অনুযায়ী আমল করনেঅলা ছাত্র ছিলো কি-না?
সুহৃদ শিক্ষার্থীরা!
জামিয়ার বাইরে বের হয়ে ঘুরাঘুরি করা যাবে না। আমাদের জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতী আজীজুল হক (রহ:) বলতেন, ‘বাবারা! চার দেয়ালের বাইরে বের হয়ো না। আমি দেখছি যে, তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শয়তান দলবল নিয়ে বাইরে অবস্থান করছে। বের হলেই তারা হামলা করবে।’ তাই পারতপক্ষে, জামিয়া থেকে বের হবে না। কোনো প্রয়োজন হলে, সকাল ৯টা থেকে ১০টা ৩০ মিনিটের মধ্যে এবং আসরে পর থেকে মাগারিব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে। এশার পর কোনো ছাত্র বের হবে না। এটি তো জামিয়া আকিলিয়া নয়, এটি জামিয়া দিরাসিয়া (পড়ার জামিয়া, খাবারে জামিয়া নয়)। সুতরাং সবসময় খাবার আর খাবার, এই চিন্তা পরিহার করতে হবে। আমাদের জামিয়ার নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। ছাত্রদেরকে এগুলো মেনে চলতে হবে। এগুলোর মাধ্যমেই ছাত্ররা অদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠবে, ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে আমাদের সকল শিক্ষকমণ্ডলীর দৃষ্টি আর্কষণ করছি। আমদের যাদের দারুল ইকামার যিম্মাদারি নেই তারাও ছাত্রদের নেগরানির প্রতি লক্ষ্য রাখবো। আমাদের মাদরাসাগুলোতে শিক্ষকদের জন্য দুইবেলা খাবারেরও ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের মুরব্বিরা বলেন, এটি মূলত ছাত্রদের নেগরানির জন্যই দেওয়া হয়। আল্লাহ পাক সকলকে আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।
সংকলন: সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমি
শিক্ষক: আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া