ড. আল্লামা খালিদ মাহমুদ (রহি:) বহুমাত্রিক এক স্কলারের চিরবিদায়
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সংখ্যা)
বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামিক স্কলার, সাবেক বিচারপতি, শায়খুল হাদীস, লেখক ও গবেষক আল্লামা ড. খালিদ মাহমুদ ১৪ মে’২০ ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টারে ইন্তিকাল করেন (ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এ মনীষীর যোগ্যতা ও প্রতিভা ছিল বিস্ময়কর। দীনী ইলম ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়ে তাঁর জীবন গড়ে উঠে। মেধা ও মননের বহুমাত্রিকতাকে কাজে লাগিয়ে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে তিনি ইসলামের খিদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন পুরো জীবন। ইসলাম, মুসলমান, ইসলামের ইতিহাস ও আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সব প্রয়াসের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন এবং প্রতিপক্ষের সব চ্যালেঞ্জের বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব প্রদানে রীতিমত কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের কাসুর জেলায় ১৯২৫ সালের ১৭ অক্টোবরে তাঁর জন্ম। গুজরানওয়ালার মাদরাসায় পড়ালেখা শেষ করে তিনি লাহোর জামিয়া আশরাফিয়া হতে দাওরায়ে হাদীস ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিখ্যাত দীনী মাদরাসা ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন এবং বরেণ্য শিক্ষাবিদদের কাছে তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, ইলমে দীন হাসিল করেন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাটে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া তালিমুদ্দীনে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। উপমহাদেশের খ্যাতনামা আলিম বিশেষ করে শায়খুল হাদীস আল্লামা জাকারিয়া কান্ধলভী, আল্লামা সুলায়মান নদভী, আল্লামা শামশুল হক আফগানী, আল্লামা শাব্বির আহমদ ওসমানী, মাওলানা বদরে আলম মিরাঠী, মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ জালান্ধরী, মুফতি মুহাম্মদ শফি, মুফতি মুহাম্মদ হাসান ও আল্লামা ইদরিস কান্ধেলভী ছিলেন তাঁর খাস উস্তাদ। তিনি বহুদিন লাহোর জামিয়া আশরাফিয়ার শায়খুল হাদীস হিসেবে বুখারী শরীফের পাঠদান করেন। তিনি বেশ কিছুদিন শিয়ালকোটের মুরে (Murray) কলেজ, লাহোরের মাও (MAO) কলেজে অধ্যাপনা করেন।
আল্লামা ড. খালিদ মাহমুদ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরীয়া অ্যাপিলেট ডিভিশনের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নিষ্টার সাথে। হাদিস, ফিকহ, ইসলামি আইন, জুরিসপ্রুডেন্স, ইসলামের ইতিহাস, তর্কশাস্ত্র, হিন্দুমত, ইহুদিবাদ ও খ্রিস্টবাদের ওপর তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। প্রখর স্মৃতি ও মেধাশক্তির অধিকারী আল্লামা খালিদ মাহমুদ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সেমিনার, ওয়ায ও তাফসীর মাহফিলে কোন রকম নোট রাখতেন না। দলিল ও প্রমাণ দেয়ার সময় গ্রন্থের খণ্ড ও পৃষ্ঠা উল্লেখ করে দর্শক শ্রোতাদের সম্মোহিত করে রাখতে পারতেন।
১৯৭০ সালে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ওপর পিএইচ-ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান পরিচালক হযরত আল্লামা তৈয়ব সাহেবের পরামর্শক্রমে ম্যানচেষ্টারে ইসলামিক একাডেমি স্থাপন করেন এবং আমৃত্যু একাডেমির পরিচালক হিসেবে নানা গবেষণাধর্মী খিদমত আনজাম দেন।
তাঁর লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। এর মধ্যে আসারুত তানযীল (২ খণ্ড), আসারুল হাদীস (২ খণ্ড), আসারুত তাশরীয়ী (২ খণ্ড), আছারুল ইহসান (২ খণ্ড), মুতালায়ে বেরলভিয়ত (৮খণ্ড) ও খুলাফায়ে রাশিদীন (২ খণ্ড), তাজাল্লিায়াতে আফতাব, তাজাল্লিায়াতে সাদাকাত, দারসে কুরআন, আকিদাতুল উম্মত, মিআরে সাহাবিয়ত, মাদারিকুল আযকিয়া ফি হায়াতিল আম্বিয়া, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী: আপনি আদাত পেশগুইউঁ আওর কিরদার কে আইনা মেঁ, শাহ ইসমাঈল মুহাদ্দিসে দেহলভী, মুনাযেরে ওয়া মুবাহেসে, তাকিয়া না কিজিইয়ে, বারাআত হযরত থানভী, সহীহ বুখারী কি আখেরি হাদিছ কা দরস পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে।
এছাড়া মাওলানা আহমদ আলী লাহোরীর যুগে সাপ্তাহিক ‘খুদ্দামুদ্দীন’, তানযিমে আহলে সুন্নাহর মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘দাওয়াত’, সাহিওয়ালের জামিয়া রশিদিয়ার ‘আর-রশিদ’, গুজরানওয়ালা থেকে প্রকাশিত ‘আল-আদল’, মুলতান থেকে প্রকাশিত ‘আস-সিদ্দিক’, দারুল উলুম দেওবন্দের মুখপত্র মাসিক ‘দারুল উলুম’ এবং মিসর থেকে প্রকাশিত ‘আয-যাহারাতুল খালিজ’-এ নিয়মিত আল্লামা খালিদ মাহমুদের গবেষণাধর্মী নিবন্ধ ছাপা হত।
তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ও ইসলামের ইতিহাসে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়ের কারণে ‘আল্লামা’ শব্দটি তাঁর নামের অংশ হয়ে যায়। তিনি তাঁর সময়কালে একজন তাত্ত্বিক বাগ্মী ও উলূমে ইসলামীর অথরিটি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ + যে শেষনবী ও রাসূল, তাঁর পরে আর কোন নবী ও রাসূল নেই। এই মহাসত্যটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি তাঁর জীবন যৌবন উৎসর্গ করে দেন। মহানবী +-এর হাতেগড়া সাহাবায়ে কেরামদের সংগ্রামী ও গেীরবময় জীবনের খুঁটিনাটি আলেখ্য শ্রোতা ও পাঠকদের তুলে ধরতে অধিকতর প্রয়াসী ছিলেন। মর্যাদাবান সাহাবাদের যারা অযথা সমালোচনা করে, দোষত্রুটি চর্চা করে এবং ত্যাগ ও গৌরবগাঁথা কর্মপ্রয়াসকে মিথ্যাচারে আড়াল করতে চায়, নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের দলিল দিয়ে তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব প্রদানে আল্লামা খালিদ মাহমূদের কৃতিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।
একটা মনে রাখা দরকার যে, একতরফা বা এক পক্ষের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে আসল সত্য অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়। পক্ষ, বিপক্ষ ও প্রতিপক্ষের লিখিত গ্রন্থাবলি পাঠের আওতায় আনতে পারলে আসল সত্য প্রকটিত হয়। ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলি গতানুগতিক নয় বরং অনুসন্ধানী, দলিলনির্ভর ও বিশ্লেষণধর্মী। প্রতিপক্ষের যুক্ত খণ্ডন করতে গিয়ে তিনি শালীনতা ও সৌজন্যতাবোধের সীমা অতিক্রম করেননি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সরল, অনাড়ম্বর ও সদালাপী। সর্বদা আল্লাহ তাআলার যিকিরে মশগুল থাকতেন। সারা জীবন তিনি সুন্নাতে রাসূলের পাবন্দ ছিলেন এবং তাঁর অনুসারীদেরকেও পাবন্দ করার প্রয়াসী ছিলেন। রুটিন মাফিক জীবন পরিচালনায় তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। দুনিয়াব্যাপী ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো ছিল তাঁর মিশন। রাতদিন পঠন পাঠন, অধ্যয়ন ও গ্রন্থরচনায় ব্যাপৃত থাকতেন। দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন। বাংলাদেশে দুই বার এসেছিলেন এবং চট্টগ্রামের পটিয়া আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়ার বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। আমরা আল্লাহ তাআলার দরবারে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গনি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম