দীনী শিক্ষা ও জাগতিক শিক্ষা: একটি পর্যালোচনা
প্রশ্ন: আমরা (কওমী মাদরাসার ছাত্ররা) যখন বাড়িতে যায়, তখন আমাদেরকে কিছু কিছু জেনারেল শিক্ষিত লোকেরা চাকরি-বাকরির দোহায় দিয়ে বলে থাকেন যে, ‘তোমরা এই শিক্ষায় (দীনী শিক্ষা) শিক্ষিত হয়ে দেশের কোন উচ্চ পদে সমাসীন হতে পারবে না। তাই তোমাদের উচিত হলো, জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া।’ দেখা যায়, তাদের এমন কথায় প্রভাবিত হয়ে অনেক নির্বোধ ছাত্ররা হীনমন্যতার শিকার হয়। এমনকি অনেকেই দীনী শিক্ষা থেকে বিমুখ হয়ে পড়ছে।
অতএব মহোদয়ের নিকট বিনীত নিবেদন এই যে, এ ধরনের কথার প্রভাব থেকে আমরা কীভাবে মুক্ত থাকতে পারি? এবং তাদেরকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে আমাদের করণীয় কী? বিস্তারিত আলোচনা করলে চির কৃতজ্ঞ হবো।
মুহাম্মদ আরফাত হোসাইন আনোয়ারী
শিক্ষার্থী, জামাতে ছাহারুম
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
সমাধান: ইসলামে ইলম অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। ইলমের মাধ্যমেই মানুষ তার প্রভুকে চিনতে পারে, ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা এবং হক-বাতিলের পার্থক্য করতে পারে। উন্নতি-অগ্রতি এবং উভয় জাহানের শান্তি-সফলতা ও কামিয়াবির সোপানে আরোহণ করতে পারে। ইলমের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে রাসুল সা. ইরশাদ করেন, ‘দীনী ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরয।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ২২৪) এই হাদীসে উল্লেখিত ইলম দ্বারা ব্রিটিশের তৈরিকৃত সিলেবাস দ্বারা অর্জিত জাগতিক শিক্ষা উদ্দেশ্য নয়। কারণ যে শিক্ষা দ্বারা মানুষ নিজের রবকে চিনতে পারে না, যে শিক্ষা দ্বারা মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে পারে না, যে শিক্ষা মানুষকে গোনাহ থেকে বাঁচতে শিখায় না তাকে ইলম বলা হয় না। জাগতিক শিক্ষা তো দূরের কথা, দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরও কেউ যদি গোনাহ থেকে বেঁচে না থাকে, নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়তে না পারে, তা হলে তার শিক্ষাকেও শরীয়াতের দৃষ্টিতে ইলম বলা হবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে বলেছেন; ‘নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে কেবল আলেমগণই আল্লাহকে ভয় করে’ (সুরা ফাতির: ২৮) এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রকৃত আলেম তথা শিক্ষিত তারাই, যারা আল্লাহকে ভয় করে। অতএব, ইলম অর্জন তথা শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি হতে হবে খোদা ভীতির ওপর, দুনিয়াবি চাকরি-বাকরির ওপর নয়।
তবে ফরয পরিমাণ ইলম অর্জনের পরে কেউ যদি জাগতিক ইলম অর্জন করে, তাতে কোনো সমস্যা নেই; বরং শরীয়ত মোতাবেক চলে দীনের খেদমতের উদ্দেশ্যে যদি কেউ জাগতিক ইলম অর্জন করে, তাহলে তাতে সে সাওয়াবেরও আশা করতে পারে। কারণ হাদীসে এসেছে ‘কর্মের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভর করে।’ (সহীহ আল-বুখারী, হাদীস: ১)
কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমানে আমাদের স্কুল-কলেজে ফরয পরিমাণ ইলমে দীন শিক্ষা দেয়া হয় না এবং সেখানে শরীয়ত মোতাবেক চলতে উৎসাহিত করা হয় না; বরং সেখানে এমন অনেক মতবাদ শিক্ষা দেয়া হয় যা ঈমানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনেক স্কুলের পরিবেশই এমন যে, কেউ চাইলেও শরীয়ত মোতাবেক চলতে পারে না। এ অবস্থায় দুনিয়ার ৬০-৭০ বছরের যিন্দেগীর কল্পিত সুখ-শান্তির আশায় নিজেকে নৈতিকতা বিবর্জিত জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিত হবে, নাকি পরকালের অশেষ-অসীম যিন্দেগীর সুখ-শান্তি অর্জনের আশায় নিজেকে দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিত হবে? এই যৌক্তিক প্রশ্নটি তাদের সামনে রাখতে পারেন।
হয়ত তাদের নিকট দীনের সঠিক বুঝ না থাকার কারণে নিজের বুঝকে সঠিক মনে করে নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে দু- চার পয়সার লোভে কিংবা দুনিয়াবি সম্মানের আশায় দীনী ইলম ছেড়ে জাগতিক শিক্ষার নামে প্রচলিত ব্রিটিশদের তৈরি করা শিক্ষা কারিকুলাম পড়াচ্ছে এবং কেউ কেউ তো দীনী শিক্ষার ব্যাপারে তীর্যক মন্তব্য করতেও কুণ্ঠা বোধ করে না। অথচ কুরআন-হাদীসের ইলমের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করার কারণে ঈমান ধ্বংস হওয়ার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে।
তাদের স্মরণ রাখা উচিত, দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো লোক না খেয়ে মরেছে এর কোন প্রমাণ বা উদাহরণ তারা দেখাতে পারবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় বান্দাদেরকে না খাইয়ে মারেন না, বরং আল্লাহ তাদেরকে সম্মানের সাথে জীবন-যাপন করার তাওফীক দান করেন। তাদের রোজগারের পরিমাণ যদিও কম হয়, কিন্তু তা প্রয়োজন পুরণের জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে। কেননা ধন-সম্পদের প্রাচুর্যতা অনেক সময় মানুষকে আল্লাহ বিমুখ করে দেয়। তেমনি ধনক্ষয় আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণ হয়। তাই আমাদের আকাবিররা আল্লাহর নিকট ‘কদরে কেফাফ’ প্রয়োজনীয় রিযকের জন্য প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে ওলামায়ে কেরামের আর্থিক সঙ্কট দেখা যায় তা অনেকটা গ্রহণকৃত। যেন নিজের প্রয়োজনের কথা আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নেয়া যায়। এজন্য দেখা যায়, তাদের নিকট সম্পদের প্রাচুর্যতা না থাকলেও প্রয়োজন পুরণের জন্য আল্লাহ গায়বী পথ উন্মুক্ত করে দেন।
সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হলো, জাগতিক শিক্ষা অর্জন করে যদি কেউ দীন থেকে দূরে সরে যায় এবং সেই অবস্থায় সে মারা যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে? তা গভীরভাবে ভেবে দেখা একান্ত কর্তব্য।
মানুষ যাতে দীনী শিক্ষা ও দুনিয়াবি শিক্ষার পার্থক্য বুঝতে পেরে নিজেকে এবং নিজের সন্তানকে দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারে, সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিম্নে মুফতি মনসুল হক (হাফিযাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘দীনী শিক্ষা ও দুনিয়াবি শিক্ষার পার্থক্য’ প্রবন্ধ থেকে দীনী ও জাগতিক উভয় শিক্ষার বাস্তব কিছু পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর মহামানব তথা নবী-রাসুলগণের ওয়ারিশ অর্থাৎ তারা ‘নায়েবে নবী’। কেননা নবী-রাসুলগণ শুধু ইলমের ওয়ারিস বানান, অর্থ-কড়ির নয়। আর এরাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইলম শিখে, টাকা-পয়সার জন্য নয়। (মাজমাউয যাওয়িদ: ৫২৩)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার শিক্ষার্থীরা ঐ শিক্ষার সিলেবাস যারা তৈরি করেছে তাদের ওয়ারিশ। নবী-রাসুলগণের ওয়ারিশ নয়, কেননা তারা শিক্ষা অর্জনই করে টাকা-পয়সা কিংবা কোনো পদ হাসিলের জন্য।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদেরকে নবীগণের বাস্তব ওয়ারিশ বানানোর জন্য তাদেরকে ঈমান, আমল, দাওয়াত, তালীম, তাযকিয়া শিক্ষা দেওয়া হয়।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার শিক্ষার্থীদেরকে কীভাবে দুনিয়া উপার্জন করা যাবে তা শিক্ষা দেওয়া হয়। ঈমান-আমল সেখানে গুরুত্বহীন বিষয়।
- যারা দীনী শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয় তাদের সম্মানার্থে ফেরেশতারা নিজেদের নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৬৪১)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার ছাত্রদের ব্যাপারে ফেরেশতাদের পাখা বিছানোর কোনো হাদীস নেই।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা যেহেতু ইবাদত-বন্দেগী করে থাকে, তাই তাদের দ্বারাই আল্লাহ তাআলার দুনিয়াতে মানুষ পাঠানোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে। কেননা আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে মানুষ পাঠিয়েছেন তার ইবাদত করার জন্য। (সুরা আয-যারিয়াত: ৫৬)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার শিক্ষার্থীদের দ্বারা আল্লাহ তাআলার দুনিয়ায় মানুষ পাঠানোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ তারা সাধারণত আল্লাহর নির্দেশ মতো চলে না। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি ওলামায়ে কেরামের সুহবতে আসে বা দাওয়াতের কাজে জুড়ে থাকে সেটা ভিন্ন কথা।
খালেস দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কেউ বেকার থাকে না। তাদের কারণে দেশের বেকারত্ব বাড়ে না; বরং তারা একদিকে নিজ দেশে দীনের খেদমত করছেন অন্য দিকে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইমাম, মুয়ায্যিন, মাদরাসার শিক্ষক হয়ে কিংবা অন্য কোন খেদমত করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন, যার দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হচ্ছে।
- পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতদের অনেকেই বেকার থাকছে। কারণ দুনিয়াবি শিক্ষাটা হলো ‘কর্মমুখী শিক্ষা’ অর্থাৎ এ শিক্ষায় শিক্ষিতরা দুনিয়ার বিভিন্ন কর্ম করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে কর্মের সুযোগ কম থাকায় আর কর্মের প্রার্থী বেশি হওয়ায় অনেক বড় বড় ডিগ্রিধারীরাও বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ অবধি বেকারত্বের কারণে কেউ অর্থ উপার্জনের অনৈতিক পথ বেছে নিচ্ছে, আবার কেউবা ছিনতাই রাহাজানির মতো ভয়ংকর পথ বেছে নিতে দ্বিধা করছে না।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষাকেন্দ্র কওমী মাদারেসে দীনী শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজন পরিমাণ বাংলা, অংক, ইংরেজী ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া হয়। আর এখানে সরকারের কোন অনুদান নেয়া হয় না। যার কারণে সরকার নিজের খেয়াল-খুশি মোতাবেক এখানকার সিলেবাস পরিবর্তন করতে পারে না।
পক্ষান্তরে স্কুল-কলেজে প্রয়োজন পরিমাণ দীনী ইলম শিক্ষা দেওয়া হয় না। আর স্কুল-কলেজ সরকারী হওয়ায় বা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ সরকারের অনুদান গ্রহণ করায় সরকার চাইলেই নিজের খেয়াল-খুশি মোতাবেক সিলেবাস পরিবর্তন করতে পারে। আর এতে যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
- কওমী মাদারেসে ফরযে আইন এবং ফরযে কেফায়া উভয় প্রকারের ইলম শিক্ষা দেয়া হয়, যার দ্বারা এখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা থেকে বাঁচাতে পারে আবার সাধারণ মানুষকেও সিরাতে মুস্তাকীম এর ওপর পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার শিক্ষা কেন্দ্র স্কুল-কলেজে ইলমের কিছু তো নেই-ই; বরং তাদের সিলেবাসে ঈমান বিধ্বংসী অনেক মতবাদ রয়েছে। যার একটি মানাই ঈমান ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যেমন- জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের মূল সমস্যা বলে আখ্যায়িত করা।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃত অর্থে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদেরকে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, গুরুজন, প্রতিবেশী এমনকি প্রাণীর হকও শিক্ষা দেওয়া হয়। যার ফলে তারা প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে উঠে।
পক্ষান্তরে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় না। পত্রিকা খুললেই স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্রদের কীর্তি (?) দেখে চোখ ধাঁদিয়ে যায়। আজকাল তো তারা বিশেষভাবে শিক্ষকদের পিটাতে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে। তাছাড়া ওখানকার ছাত্ররাই তো পথে-ঘাটে ইভ-টিজিং করে বেড়াচ্ছে।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা নিজ পিতা-মাতার জানাযা নামায পড়ানোর যোগ্যতাও অর্জন করে এবং কেবল তারাই সহীহভাবে পিতা-মাতার রূহে সাওয়াব রেসানী করতে পারে।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত কোন লোকেরই এই যোগ্যতা নেই যে, সে ঐ বিদ্যা দিয়ে পিতা-মাতার জানাযা নামায পড়াবে বা তাদের রূহে সাওয়াব রেসানী করবে কিংবা তাদের মৃত্যুর পরের হকগুলো আদায় করবে।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা নিজ পিতা-মাতার জন্য সদকায়ে জারিয়া স্বরূপ। অর্থাৎ পিতা-মাতা মৃত্যুর পরও কিয়ামত পর্যন্ত আলেম তথা নেক সন্তানের নেক আমলের সওয়াব পেতে থাকবে। (সুনানে তিরমিযী: ১৩৭৬)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেই নিজ পিতা-মাতার জন্য গোনাহে জারিয়া স্বরূপ। অর্থাৎ পিতা-মাতা মৃত্যুর পরও তাদের বদ আমলের ভাগীদার হতে থাকে। কারণ তারা তাদেরকে কোনো নেক আমল শিক্ষা দেয়নি এবং জীবিত অবস্থায় তাদেরকে গোনাহের কাজ করতে নিষেধ করেনি।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা দুনিয়ার মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার পথ দেখায় এবং জান্নাতের রাহবারী করে। এজন্যই তারা বিভিন্ন মাদরাসা-মসজিদে, মাঠে-ময়দানে কুরআন-হাদীসের কথা জনসাধারণকে শুনিয়ে থাকে।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেই মানুষকে জাহান্নামের পথ দেখায়। যেমন- তারা নাটক, সিনেমা ইত্যাদি তৈরি করে তা দেখার জন্য মানুষকে প্রেক্ষাগৃহে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। অনেকে লেখনীর মাধ্যমে নাস্তিক্যবাদ প্রচার করে। তাছাড়া আরও অগণিত উদাহরণ আপনি ভাবলেই পেয়ে যাবেন।
- হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা যখন শিক্ষা অর্জনের জন্য বসে তখন ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয় এবং তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল হয়। (জামিউ বয়ানিল ইলম: ৪৫)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনো ফযিলত নেই; বরং তারা তো শিখতে বসে ক্লাস রুমেও অনেক গোনাহের কাজ করে। যেমন- ছেলেদের মেয়েদেরকে দেখা, মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করা।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা ইসলাম ধর্ম টিকিয়ে রাখছে। কারণ ইলম শিক্ষার ধারা বন্ধ হয়ে গেলে ধীরে-ধীরে পৃথিবী থেকে ইসলাম উঠে যাবে। আর সাধারণ মানুষ যে যতটুকুই দীন পালন করছে বা দীনের চর্চা করছে তা এদের উসিলায় করছে।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজদের অনুকরণ করে এবং তাদের অর্থে পরিচালিত এনজিওগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে ইসলাম ধর্মের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতে সাহায্য করছে। বাংলাদেশে দিন দিন খৃষ্টানদের সংখ্যা বেড়ে চলাই এর প্রমাণ বহন করে। সামান্য অর্থের লোভে বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েরাই তো এসব এনজিওতে কাজ করছে।
- হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের শেষ পরিণাম কল্যাণকর হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা যার কল্যাণ চান তাকেই দীনের সঠিক বুঝ দান করেন। (জামিউ বয়ানিল ইলম: ৮০)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতদের শেষ পরিণাম অজানা; বরং বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাদের শেষ পরিণাম সুখকর হবে না। যারা আল্লাহর হুকুম মানবে না তাদের শেষ পরিণতি খারাব হওয়াই স্বাভাবিক।
- হাদীসের ভাষ্য মোতাবেক ‘দুনিয়ার গোটা সৃষ্টিজগত দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীর জন্য দুআ করে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৩৬৪১)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতরা এ দুআ থেকে বঞ্চিত থাকে।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা আল্লাহর বন্ধু। কারণ তারা আল্লাহর হুকুম মোতাবেক জীবন যাপন করে। আর তারা শয়তানের শত্রু কারণ তারা শয়তানের বিরুদ্ধাচরণ করে।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতরা যদি কোনোভাবে দীন না শিখে, চাই ওলামায়ে কেরামের সুহবতে এসে হোক কিংবা অন্য কোনোভাবে হোক, তাহলে এর বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। কারণ তখন তারা না জানার কারণে বা আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন না করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই শয়তানের পথে পরিচালিত হবে।
- প্রকৃত দীনী শিক্ষার প্রকৃত শিক্ষার্থীরা মুসলমানদের সর্বক্ষেত্রে ইমাম হওয়ার (নেতৃত্ব দেয়ার) যোগ্যতা রাখে।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতরা মুসলমানদের প্রতি দিনের আমল পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের ইমামতীটুকু করার যোগ্যতা রাখে না।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা দুনিয়ার অর্থের লোভে নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় না।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতরা এক দুই টাকার লোভেও নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে কুণ্ঠা বোধ করে না। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের বারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হওয়াই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা আল্লাহ তাআলার নির্বাচিত বান্দা (সৈনিক)। এদের মাধ্যমে তিনি নিজ দীনের হেফাজত করছেন।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতরা ইংরেজদের মানস সন্তান। কারণ তারা তাদের চিন্তা-চেতনাই লালন করে।
- হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী, হক্কানী আলেম-ওলামা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। কারণ গোমরাহীর অন্ধকারে মানুষ তাদের মাধ্যমে সুপথ পেয়ে থাকে। (মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ৪৮৯)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতদের কোনো ফযিলত নেই; বরং তাদের কারো কারো মাধ্যমে পৃথিবী গোমরাহীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। তবে কেউ ব্যক্তিগতভাবে দীনদার হলে সেটা ভিন্ন কথা।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের উসিলায় আল্লাহ তাআলা সারা দুনিয়ার মানুষকে রিযিক দিচ্ছেন, খাওয়াচ্ছেন এবং পরাচ্ছেন। (তাহযীবে তারীখে দিমাশক, ৫/ ৪৩৮)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্য থেকে অনেকের ভয়ানক গোনাহের কারণে দুনিয়ার মানুষকে আযাবে এবং দুর্ভিক্ষে পড়তে হয়।
- খালেস দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা (কওমী মাদরাসার ছাত্ররা) ইসলামের ইউনিফর্ম পরে থাকে। যেকেউ তাদেরকে দেখলেই খাঁটি মুসলিম মনে করতে বাধ্য হয়।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতরা বিধর্মীদের ইউনিফর্ম পরে থাকে। ফলে সে মুসলিম না কাফের বাহ্যিকভাবে তা বুঝার কোনো উপায় থাকে না।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর ‘হায়াত’। যত দিন তারা দীন চর্চায় লিপ্ত থাকবে ততদিন আল্লাহ তাআলা দুনিয়াকে বহাল রাখবেন। কিয়ামাত ঘটাবেন না। (সহীহ মুসলিম: ১৪৮)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতরা যত বড় ডিগ্রিধারীই হোক না কেন, তাদের কারণে আল্লাহ তাআলা দুনিয়াকে টিকিয়ে রাখবেন না; বরং দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা যত বাড়বে পৃথিবী ততই কিয়ামাতের দিকে এগিয়ে যাবে।
- দীনী শিক্ষায় শিক্ষিতরা মৃত্যু পর্যন্ত দীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে থাকেন, অবসর গ্রহণ করেন না।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতদের অনেকে তো চাকুরিই পায় না। আর পেলেও ৩০-৩৫ বছর পর অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
- দীনী শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে হাশরের ময়দানে প্রচন্ড রোদের মাঝে যখন আল্লাহ তাআলার আরশের ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে না, তখন তাদেরকে আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দেওয়া হবে। (সুনানে তিরমিযী: ২৩৯১)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য এ ধরনের কোনো ওয়াদা বা আশ্বাস কুরআন-হাদীসের কোথাও বর্ণিত হয়নি; বরং তারা সংশোধন না হলে, হাশরের ময়দানে তাদেরকে ভয়ানক অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।
- দীনী শিক্ষায় শিক্ষিতদের লকব বা সনদ চিরস্থায়ী। বেহেশতে প্রবেশ করেও তারা এ উপাধিতে ভূষিত হবেন।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিতদের সনদ একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। অবসর গ্রহণের পরই তাদের সনদ অনেকাংশে অকেজো হয়ে পড়ে। আর মরার পর কবরে ও হাশরে এ সনদের কোনো মূল্যায়নই হবে না।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের পিতা-মাতা বা অন্য যে কেউ যত টাকা খরচ করে তাতে সে বে-হিসাব সাওয়াব পায়। (সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৬২৯)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার শিক্ষার্থীদের জন্য টাকা খরচ করলে সাওয়াব হবে এমন কোনো কথা কুরআন-হাদীসে নেই; বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের পিছনে টাকা ব্যয় করলে গোনাহ হয়। যেমনঃ অভিনয়, নাচ-গান, প্রাণীর ছবি আঁকা ইত্যাদি শিখার ক্ষেত্রে যে টাকা ব্যয় করা হয় তাতে গোনাহ হয়।
- দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থী যদি ইলম শিক্ষা করা অবস্থায় ইন্তেকাল করে তাহলে সে শহীদের মর্যাদা লাভ করে। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৬৪১)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার শিক্ষার্থী শিক্ষাকালীন অবস্থায় মারা গেলে এ মর্যাদা পাবে না; বরং গোনাহের কোনো কিছু শিক্ষারত অবস্থায় মারা গেলে খারাব পরিণতির আশংকাই প্রবল।
- হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা মহান আল্লাহ তাআলার পরিবারের সদস্য। সুতরাং পরকালে তাদের বিশেষ পাওয়ার থাকবে। (মুসনদে আহমদ: ৩/১২৮)
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার শিক্ষার্থীরা আল্লাহর পরিবারের সদস্য হওয়া তো দূরের কথা তারা অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহর শত্রু সাব্যস্ত হয়ে যায়।
- সর্বোপরি দীনী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মাঝে খোদাভিরুতা, নম্রতা, ভদ্রতা, এবং চারিত্রিক উৎকর্ষতার গুণ থাকার কারণে তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং বিভিন্ন ফেতনায় জর্জরিত সমাজকে জাহিলিয়াতের অতল গহবর থেকে উঠিয়ে হেদায়েতের আলোকে উদ্ভাসিত করতে পারে। আদর্শ, সুশীল সমাজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। যা দেশ ও জাতির জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষণ।
পক্ষান্তরে দুনিয়াবি শিক্ষার শিক্ষার্থীদের দ্বারা অসামাজিক কার্য-কলাপ। যেমন- হত্যা, লুণ্ঠন, রাহাজানি, ধর্ষণ, ইভ-টিজিং, গাড়ি ভাংচুর, মারা-মারি, কাটা-কাটি, নেশা-মদ্যপান ইত্যাদি জঘন্য কর্মকান্ড সংঘটিত হওয়ার কারণে আদর্শ সমাজও বর্বর যুগের অসভ্য সমাজে পরিণত হতে বাধ্য। আজ নৈতিকতা বিবর্জিত, ধর্মহীন শিক্ষার কারণেই দেশজুড়ে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তারপরও কি আমরা সন্তানদেরকে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত করার দুঃসাহস দেখাতে পারি!
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার এবং নিজ অধীনস্থদের উক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
ঘোষণা
(সমস্যা নিয়ে আর নয় অস্থিরতা, সমাধানই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা)
শিক্ষার্থী বন্ধুরা, আপনাদের সহযোগিতা ও দিক-নির্দেশনার লক্ষ্যে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মুখপাত্র, ইসলামী গবেষণা ও সৃজনশীল সাহিত্য পত্রিকা মাসিক আত-তাওহীদে নিয়মিত বিভাগ ‘শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পমার্শ’ চালু করা হয়েছে। উক্ত বিভাগে একদিকে থাকবে আপনাদের জন্য নিয়মিত দিক-নির্দেশনামূলক প্রবন্ধ। অপরদিকে থাকবে আপনাদের সমস্যা-সমধান নিয়ে শিক্ষা পরামর্শ।
অতএব এখন থেকে সমস্যা নিয়ে আর নয় অস্থিরতা, সমাধানই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা’ শ্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাবো উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে। সুতরাং শিক্ষা বিষয়ক যে কোন সমস্যা আমাদের নিকট লিখুন এবং টেনশানমুক্ত জীবন গড়ুন। আমরা আপনার সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকবো এবং অতিদ্রুত সময়ে যথার্থ সমাধান পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহই তাওফীকদাতা।
যোগাযোগের ঠিকানা
বিভাগীয় সম্পাদক
শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগ, মাসিক আত-তাওহীদ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
ই-মেইল: hmsalimuddin22@gamil.com