জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার সনামধন্য মুহাদ্দিস ক্ষণজন্মা মনীষী আল্লামা হাফেজ আমীর হোসাইন (মীর সাহেব) (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম

সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী

পূর্বপ্রকাশিতের পর

এক অদ্ভুত স্বপ্ন ও মুফতি সাহেব (রহ.)-এর চমৎকার ব্যাখ্যা

হযরত মীর সাহেব (রহ.) একদিন এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে তিনি যেন কুরআন মজিদের ওপর প্রস্রাব করছেন! এ স্বপ্ন দেখে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁর শায়খ ও মুরশিদ, জামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুফতি আযীযুল হক (রহ.)-এর নিকট গেলেন এবং স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। তখন হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) মুসকি হেঁসে তাঁকে সান্তনা দিয়ে বলেন, এটি ভীত হওয়ার মতো কিছু না। এটি একটি সুসংবাদ। ইনশা আল্লাহ, আল্লাহ আপনার বংশে হাফেজে কুরআনের ধারা অব্যাহত রাখবেন। যেমন চমৎকার স্বপ্ন তেমন চমৎকার ব্যাখ্যা। হযরত মীর সাহেব (রহ.)-র সকল ছেলে হাফেজে কুরআন, বরং তাঁর নাতীরাও প্রায় হাফেজে কুরআন। আল্লাহ এই ধারা তাঁদের বংশে অব্যাহত রাখুক, আমীন।

এতীম-অনাথকে খাবার প্রদান

হযরত মীর সাহেব (রহ.) এতীম-অনাথ এবং দরিদ্র ছেলেদেরকে খুব বেশি আদর করতেন। জামিয়া পটিয়ায় তখন বাইর থেকে কিছু দরিদ্র ছেলে খাবার ভিক্ষা করার জন্য আসতো। শিক্ষক-ছাত্ররা অতিরিক্ত খাবারগুলো সেই দরিদ্র ছেলেদেরকে দিয়ে দিতেন। তাদের মধ্যে অনেকেই এতীম-অনাথ ছিলো। হযরত মীর সাহেব (রহ.) তাদের খবর নিতেন। অনেক সময় নিজে রোযা রেখে নিজের খাবারগুলো তাদেরকে দিয়ে দিতেন। অনেক সময় নিজে পটিয়া মুন্সেফ বাজারে গিয়ে কয়েক লিটার দুধ ক্রয় করে নিয়ে আসতেন। কিছু নিজে পান করতেন, অবশিষ্টগুলো সেই এতীম-অনাথ ছেলেদেরকে পান করাতেন। আবার কখনো কখনো কাপড়-চোপড় খরিদ করেও এতীম ও দরিদ্র ছাত্রদেরকে দান করতেন। কারণ, এতীম-অনাথ, সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র মানুষকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে খাদ্য দান করা জান্নাত লাভের অন্যতম সহজ উপায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি,

«يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصَلُّوْا وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُوْنَ الْـجَنَّةَ بِسَلَامٍ». رواه الترمذي

‘হে লোকেরা, তোমরা সালাম সম্প্রসারণ কর, মানুষকে খাবার দান কর, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ, এবং মানুষ যখন (রাতে) ঘুমিয়ে থাকে, তখন তোমরা (তাহাজ্জুদের) নামায পড়, তাহলে তোমরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সুনানে তিরমিযী: ২৪৮৫)

চলার পথে ইলমী আলোচনা

মাওলানা হাফেজ ফুরকান মাহবুব সাহেব (রহ.) বলতেন, যাতায়তের সময় ছাত্ররা সঙ্গী হলে তাদের সাথে হযরত মীর সাহেব (রহ.) ইলমী আলোচনা করতেন। অনেক সময় কিতাবের গুরুত্বপূর্ণ জটিল বিষয়গুলোর সুন্দর ও সহজভাবে উপস্থাপন করতেন। একদিন আমিও হযরতের সঙ্গী হয়েছিলাম। চলার পথে তাঁর কাছে বিভিন্ন ইলমী বিষয় জিজ্ঞাসা করছি। আর তিনি সহজভাবে তার সমাধান দিয়ে চলছেন। মনে হলো, এ মাত্র কিতাব দেখে এসেছেন। কোন ধরনের ইতস্ততা ছাড়া নির্বিঘ্নে জটিল বিষয়গুলো হৃদয়ঙ্গম করে দিয়েছেন।

হযরতের সাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ শোয়াইব সাহেব বলেন, একদিন আব্বাজান আনোয়ারা থানার ইছামতিঘাট থেকে লঞ্চে আরোহণ করেন। লঞ্চ চট্টগ্রাম শহরের দিকে চলা আরম্ভ করলো। তখন তিনি কিছু যাত্রীদেরকে একত্রিত করে পবিত্র কুরআনের তাফসীর শুরু করলেন। সুরা আল-কাহাফের আয়াতগুলো মুখস্থ পড়ছেন এবং তাফসীর করছেন। এভাবে লঞ্চ ওমর আলী মার্কেট সংলগ্ন ঘাটে পৌঁছা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কুরআনের তাফসীর করলেন। পরে নিজেই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বলেন, আল-হামদুলিল্লাহ, এক আয়াতের পর অন্য আয়াত, এভাবে ধারাবাহিকভাবে মুখস্থ তাফসীর করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। আল্লাহ আমাকে তাওফীক দিয়েছেন। তাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, আল-হামদুলিল্লাহ।

তেমনি আরেকদিন আল্লাহর অনুগ্রহ প্রকাশার্থে বলেন, আমি আল্লাহর নিকট চির কৃতজ্ঞ। তিনি দয়া করে আমাকে হাফেজে কুরআন বানিয়েছেন। তিনি অনুগ্রহ করে আলেমে দীন বানিয়েছেন। তাঁরই কৃপায় ইলমে দীনের খেদমত করার সুযোগ হয়েছে। তিনি আমার সন্তান-সন্ততিকে হাফেজ-আলেম বানিয়েছেন, আল-হামদুলিল্লাহ। আমি এখন আর্থিকভাবেও স্বচ্ছল। এখন আমার কোন কিছুর অভাব নেই। আমি তো এদেশের প্রেসিডেন্টের চেয়েও বড়। কেননা, এ দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে তো কুরআন-হাদীসের ইলম নেই। দীন-ধর্মের জ্ঞান নেই। তাই আমি আল্লাহর নিকট চির কতৃজ্ঞ। তখন তিনি শেখ সাদী (রহ.)-এর নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করতেন,

اگر شکر حق تا بروز شمار
گزاری
نباشد یکے از ہزار

তাঁর সাদাসিধে জীবন-যাপন

মাওলানা হাফেজ ফুরকান মাহবুব (রহ.) বলেছিলেন, হযরত মীর সাহেব (রহ.) একজন সাদাসিধে আল্লাহঅলা ব্যক্তি ছিলেন। খাঁটি আল্লাহর অলী ছিলেন। তিনি বাজারে গিয়ে নিজ হাতে বাজার করতেন। বাজার ও ব্যবসায়ী সম্পর্কে ধারণা রাখতেন। তবে কারো ব্যাপারে ভুল ধারণা পোষণ করতেন না। সকলকে সাদাসিধে মনে করতেন। কিন্তু কখনো কখনো অসৎ ব্যবসায়ীরা হযরতকে না চিনে কৌশলে খারাপ জিনিস দিয়ে দিলে তিনি বলতেন, হয়ত এটি সেই ব্যবসায়ী ভুলে দিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো সে এমন কাজ করতে পারেনা। কেননা সে তো একজন মুমিন। আর মুমিন কি ধোঁকা দিতে পারে? সুতরাং তার মালগুলো ফেরত দিতে হবে না, বরং তা ঘরেই রেখে দিতেন, সুবাহানাল্লাহ!

আহ! কি সাদা অন্তর, কি চমৎকার ব্যাখ্যা! আমরা এখন কারো অনিচ্ছাকৃত ভুলকেও সহ্য করতে পারিনা। কারো জন্য কোন ওজর-অপারগতা তালাশ করি না। অন্যের দোষক্রটি বের করতে স্বাদ পাই। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষ-আকাবিরগণ মানুষের ধোঁকা-প্রতারণাকেও অপারগতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কতই না সুখী ছিলেন তাঁরা! কতই না সাদাসিধে ছিলো তাঁদের চরিত্র! যেন তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীসের বাস্তব মূর্তপ্রতীকالمؤمن غر كريم والفاجر خب لئيم (মুমিন ব্যক্তি সদয় ও ভদ্রস্বভাবের হয়ে থাকে আর পাপীষ্ট ব্যক্তি প্রতারক ও নীচু প্রকৃতির হয়ে থাকে)। [আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারী]

অলৌকিকভাবে সঙ্কট থেকে উত্তরণ

হযরতের সাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ শোয়াইব সাহেব বলেন, একদিন বৃহস্পতিবারে জামিয়া পটিয়া থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে হযরত মীর সাহেব (রহ.) একাকি রওয়ানা দেন। পটিয়া বাস স্টেশন থেকে একটি রিক্সায় করে বাটিখাইন স্কুল পর্যন্ত যান। রিক্সা থেকে নেমে পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, টাকা নেয়। ভুলে টাকা রুমে রেখে বের হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে কারো কাছ থেকে ধার নেওয়ার মতোও কেউ ছিলো না। তাই রিক্সাঅলাকে বললেন, আমি ভুলে টাকা ছাড়াই মাদরাসা থেকে বের হয়েছি। এখন আমার কাছে টাকা নেই। আমি আসার সময় তোমার টাকা দিয়ে দিব। সে কোন রকম তা মেনে নিলো না, বরং টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। তাকে বলা হলো, হয়ত তুমি আমাকে পুনরায় পটিয়া মাদরাসায় নিয়ে চলো, যাওয়া ও আসা উভয়ের ভাড়া এক সাথে দিয়ে দিব। যেহেতু সন্ধা হয়ে গেছে, তাই সে পুনরায় পটিয়া ফিরে আসতেও রাজি হলো না। তৎক্ষণাৎ ভাড়ার টাকা তলব করে। উভয়ের কথা কাটাকাটিতে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে গেল। অনেকেই উপহাস করতে লাগলো। হুযুর খুবই সঙ্কটে পড়ে গেলেন। কি করবেন, বুঝতে পারছেন না। হয়ত, মনে মনে দুআ করতে লাগলেন। এমন সময় হঠাৎ যেন আকাশ থেকে ফেরেশতা অবতরণ করলো। মাথায় টুপি ও গায়ে পাঞ্জাবি পরিহিত জামিয়া পটিয়ার দুইজন তালেবে ইলম উপস্থিত হলেন। তারা পকেট থেকে টাকা বের করে রিক্সাঅলার হাতে তুলে দিলেন।

হযরত মীর সাহেব (রহ.) সেদিন সেই দুষ্ট রিক্সা চালককে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আমি আজকে আটকে গিয়েছিলাম, কিন্তু আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন। তবে মনে রাখবে, হয়ত তুমি আটকে গেলে রক্ষাকারী পাবে কি না, সেটা একটু ভেবে দেখো। জানি না, তিনি কোন সঙ্কটের দিকে ঈঙ্গিত করেছেন। তবে মনে হয়, আখেরাতের সে সঙ্কটের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যা থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষ আলেম-ওলামার প্রতি মুখাপেক্ষি হবে। আর আলেম-ওলামারা আল্লাহর নিকট সুপারিশের মাধ্যমে তাদেরকে রক্ষা করবেন।

তাবীজের আজব প্রভাব

তৎকালিন সময়ে জামিয়া পটিয়ায় একজন স্বাস্থ্যবান ভালো ছাত্র ছিলো। সে জামিয়ার যে কোন কাজে স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ গ্রহণ করত। একদিন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সে কাজে ব্যস্ত ছিলো। হঠাৎ আরেক ছাত্র তার কাজ দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করে (মা শা আল্লাহ না বলে) বলল, তুমি তো দশের কাজ একাই সেরে ফেলতেছ! এভাবে বলার কারণে তার ওপর বদনজর পড়লো। তাই তার শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা ও গায়ে জ্বর অনুভূত হলো। অতঃপর সে হযরত মীর সাহেব (রহ.)-এর নিকট নিজের অসুস্থতার কথা বলেন এবং সেই ছেলের কথাটিও বললেন। তখন হুযুর বললেন, আহ! ওই ছেলেটি যদি ‘মাশা আল্লাহ’ বলতো, তা হলে তার বদনজর পড়তো না। অতঃপর হুযুর তাকে একটি তাবীজ দিলেন। তাতে সে অল্প দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে সে বলেছে, দীর্ঘ আট বছর পর্যন্ত ওই তাবীজ আমার কাছে ছিলো এবং আমি সুস্থ ছিলাম, বড় ধরনের কোন অসুস্থতা বোধ করিনি। দীর্ঘ আট বছর পর হঠাৎ ওই তাবীজটি হারিয়ে যায়। তাতে আমি খুবই মর্মাহত হলাম। মনে হলো, অনেক বড় সম্পদ যেন আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলো।

খোদাভীতির এক উত্তম দৃষ্টান্ত

হযরত মীর সাহেব (রহ.) ছিলেন তাকওয়া ও খোদাভীতির মূর্তপ্রতীক। যেমনি তিনি আল্লাহর হক আদায়ের প্রতি যত্নবান ছিলেন, তেমনি বান্দার হকের ব্যাপারেও ছিলেন অতি সচেতন। পটিয়া রেল স্টেশনের এক চা দোকান থেকে তিনি পার্সেল চা রুমে এনে পান করতেন। আর পার্সেল চা পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়ার প্রথা চালু ছিল। সে হিসেবে হুযুরের চায়েও পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়া হতো। হুযুর কয়েকদিন যাবৎ তা লক্ষ্য করলেন। তিনি ঐ অতিরিক্ত চায়ের মূল্য পরিশোধ করাও জরুরি মনে করলেন। তাই শুরু থেকে হিসেব করে অতিরিক্ত টাকা মালিকের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। তবে মালিক তা গ্রহণ করেননি। তিনি বললেন, ওই অতিরিক্ত চা আমরা স্বাভাবিকভাবে দিয়ে থাকি। তার মূল্য দিতে হয় না।

আল্লাহু আকবার! একদিকে মীর সাহেব (রহ.)-এর সতর্কতা, অপরদিকে মালিকের ভদ্রতা। আল্লাহ উভয়ের কবরকে জান্নাতের বাগানে পরিণত করেন, আমীন।

আযানের শব্দ শোনার সাথে সাথেই নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। খুবই গভীরভাবে আযানের শব্দগুলো শ্রবণ করতেন এবং আযানের জবাব দিতেন। একদিন আযানের শব্দ শুনে এমন এক বিকট চিৎকার দিলেন যে, অনেক ছাত্ররা হযরতের রুমে জড়ো হয়ে গেল। সকলেই জিজ্ঞাসা করছে, কী হয়েছে? কী হয়েছে? পরক্ষণে জানা গেলো, হযরত মীর সাহেব (রহ.) আযানের শব্দ শুনেই অনিচ্ছাকৃতভাবে এ বিকট শব্দের আওয়াজ করেছেন, তখন সকলে আপন আপন গন্তব্যে ফিরে যায়।

মূলত এটি ছিলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালবাসার অন্যতম নিদর্শন। যেমনটি হযরত বেলাল রা. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তিকালের পর আযান দিতে গেলে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ বলার সাথে সাথে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তেমনি কখনো কখনো আল্লাহ প্রেমিক বান্দারা ‘আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ’ বলার সাথে সাথে তাঁদের অন্তরে মহব্বতের এক অবর্ণনীয় আবেগ সৃষ্টি হয়, যা কখনো কখনো এ ধরনের অস্বাভাবিক শব্দেও প্রকাশিত হয়। আসল কথা হলো, প্রেম-ভালবাসার রহস্যই ভিন্ন হয়ে থাকে।

میان عاشق ومعشوق رمزیست
کراماً کاتبیں را ہم خبر نیست

গাড়ি থেকে নেমে নামায আদায়

হযরত মীর সাহেব (রহ.) একদিন ঢাকা থেকে গাড়ি করে চট্টগ্রামে ফিরেন। পথে গাড়িতে নামাযের সময় হয়ে যায়। তখন তিনি ড্রাইভারকে নামাযের বিরতীর জন্য অনুরোধ করেন। ড্রাইভার সেদিকে কোন কর্ণপাত করেনি। হযরত খুবই দুঃখ পেলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, যে কোনোভাবেই নামায পড়তে হবে। তাই গাড়ি যখন ‘বার আউলিয়া’ পর্যন্ত পৌঁছে, তখন মাজারে টাকা দেওয়ার জন্য গাড়ি থামালো, সে সুযোগে হুযুরসহ কয়েকজন যাত্রী একসাথে নামাযের জন্য নেমে পড়েন। অতঃপর ড্রাইভার বাধ্য হয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করে। নামায শেষ করে ওই গাড়ি করেই তারা চট্টগ্রামে পৌঁছেন।

মূলত হিম্মত করে কাজ আরম্ভ করে দিতে হয়। সাহায্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। তিনি যখন দৃঢ় সংকল্প করে বসলেন যে, আমাকে নামায পড়তেই হবে, তখন আল্লাহ ব্যবস্থা করেই দিলেন। আমরা অনেক সময় সামান্য উদাসীনতার বশিভূত হয়ে নামায কাজা করে দেই। অথচ, একটু সচেতন হলেই নামায কাজা হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আমাদের আকবীরের আমল এটাই প্রমাণ করে। আল্লাহ আমাদেরকে যথাসময়ে নামায আদায় করার তাওফীক দান করেন, আমীন।

নফল রোযার অভ্যাস

হযরত মীর সাহেব (রহ.) খুব বেশি নফল রোযায় অভ্যস্ত ছিলেন। বিশেষত সাপ্তাহিক সোমবার-বৃহস্পতিবারের রোযা, আইয়ামে বীজ (চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোযা) ও অন্যান্য নফল রোযা কখনো ছাড়তেন না। খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেহরী গ্রহণ করতেন। মূলত ইসলামে নফল রোযার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক বস্তুর যাকাত আছে, শরীরের যাকাত রোযা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযান মাস ছাড়া অন্য সময় আল্লাহ তাআলার জন্য একটি রোযা রাখবে, দ্রুতগামী ঘোড়া ১০০ বছরে যতদূর রাস্তা অতিক্রম করতে পারে, দোযখ তার কাছ থেকে তত দূরে অবস্থান করবে। (সুনানে তিরমিযী)

জুমার দিনের বিশেষ আমল

 জুমাবারসপ্তাহের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ দিন। এই দিনের ফযীলত সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থগুলোতে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এই দিনে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনে তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। (সহীহ (মুসলিম

তাই হযরত মীর সাহেব (রহ.) জুমার দিনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি আযানের অনেক পূর্বেই মসজিদে গমণ করতেন। বাড়ির মসজিদে প্রথমে গিয়ে মসজিদ পরিষ্কার করতেন। মসজিদে ঝাড়ু দিতেন। আযানের পর সালাতু তাসবীহ পড়তেন। এই আমলটি হযরত মীর সাহেব (রহ.) প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত করার চেষ্টা করতেন।

ছবির ব্যাপারে কঠোরতা

ইসলামে ছবি নিষিদ্ধ। তবে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ছবি উঠালে গোনাহ হয় না। যেমন হজ-ওমরা পালনের জন্য ছবি উঠালে ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, তাতে গোনাহ হবে না। কিন্তু আমাদের আকাবিররা ‘রুকসত’ নয়, আযীমতের ওপরই আমল করার চেষ্টা করতেন। তাই শেষবার যখন তিনি ওমারায় যাওয়ার ইচ্ছে করেন, তখন পাসর্পোটের জন্য ছবির প্রয়োজন হয়। তখন তিনি মাওলানা মমতাজুল করীম সাহেব (প্রকাশ বাবা হুযুর, সাবেক উস্তাদ জামিয়া পটিয়া, বর্তমান শিক্ষক দারুল উলুম হাটহাজারী)-কে কয়েক দফা সৌদি দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দেন। যেন, যে কোনভাবে ছবি ছাড়া ওমরায় যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু তিনি অনেক চেষ্টা করার পরও সফল হননি। পরে যখন ছবি তুলতে বাধ্য হলেন, তখন তিনি খুবই অপছন্দনীয় অবস্থায় ছবি তুলতে যান। এলোমেলোভাবে পাসপোর্টের জন্য একটি ছবি তুলেছিলেন।

কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর হযরতের যোগ্য সাহেবযাদা মাওলানা কাসেম সাহেব (রহ.) পাসপোর্ট থেকে সেই ছবি তুলে নষ্ট করে ফেলেন। ছবিকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে কখনো মানুষের সম্মান হয় না। এটি ইসলামের শিক্ষা। তাই নিজ পিতার ছবি হলেও তা নষ্ট করতে একজন প্রকৃত মুসলমান কখনো দিধা করে না।

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, বর্তমানে মোবাইলে ছবি তোলা, বিশেষত ডিজিটাল ছবি তোলাকে মানুষ গোনাহও মনে করছে না। অথচ ফুকাহায়ে কেরাম প্রিন্ট ছবির মতো ডিজিটাল ছবি তোলাও বিনা প্রয়োজনে না জায়েয বলেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ القِيَامَةِ الْـمُصَوِّرُوْنَ».

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যারা ফটো বানাবে, কিয়ামতের দিন তাদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।’ [সহীহ আল-বুখারী: ৫৯৫০]

আমাদের আকাবির ওলামায়ে কেরাম হজ-ওমরার জন্যও ছবি তোলা থেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন, আর বর্তমানে অনেক মুসলমান অনর্থক ফেইসবুকে ছবি আপলোড করে, এগুলো দেখে খুবই মর্মাহত হতে হয়, হৃদয়ে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়! আফসোস! আমারা কি সুবোধ ফিরিয়ে পাবো?! হে আল্লাহ, দয়া করে আপনি আমাদেরকে আকাবিরের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন, আমীন।

শাসন সংশোধন

হযরত মীর সাহেব (রহ.) ছাত্রদের তরবিয়তের জন্য শাসন করতেন। তবে তিনি শাস্তি দিয়ে সংশোধন করার চেয়ে নসীহত ও বুঝিয়ে সংশোধন করাকে বেশি উপকারী মনে করতেন। শারিরিক শাস্তির মাধ্যমে ছাত্রদের যতটুকু সংশোধন হয় না, এর চেয়ে অনেকগুণ বেশি সংশোধন হয় বুঝিয়ে, শুধরিয়ে তাদেরকে সংশোধনের মাধ্যমে। হযরত মীর সাহেব (রহ.) এই নীতিকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিতেন। এমনকি শাস্তির ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করাকে তিনি কখনো পছন্দ করতেন না। একজন ছাত্র পরীক্ষার হলে অনিয়ম করেছে। তৎকালিন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তাকে মাত্রাতিরিক্ত শাস্তি করেছেন। তখন তিনি বললেন, শরীয়ত শাস্তির সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সীমা লংঙ্গন করে কখনো কাউকে শাস্তি দেওয়া বৈধ হবে না।

ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বিশেষ নসীহত

হযরত মীর সাহেব (রহ.) ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা করতেন। ছাত্রদেরকে নসীহত পেশ করতেন। বিশেষত ইলম ও ইলমের উপকরণ; শিক্ষকমণ্ডলী, কিতাবাদি ও খাতা-কলম ইত্যাদির যথাযথ আদাব বজায় রক্ষা করার প্রতি তাগিদ দিতেন। কোথাও কোন কাগজ পড়ে থাকতে দেখলে তিনি তাকে সেটাকে অপছন্দ করতেন। বিশেষত আরবি লিখিত কাগজকে খুবই সম্মান করতেন। নিজেই তা তুলে নিতেন এবং ছাত্রদেরকে তা খুড়িয়ে নিতে আদেশে দিতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছাত্রদেরকে হযরত বিশরে হাফি (রহ.)-এর ঘটনা শোনাতেন।

বাগদাদে এক বুযুর্গ ছিলেন। তার নাম আবু নসর বিশর ইবনুল হারিস হাফী (রহ.)। জীবনের প্রারম্ভে তিনি ছিলেন একজন শরাবখোর। সারাদিন শরাবখানায় মাতাল হয়ে থাকতেন। আজেবাজে কাজ করতেন। একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লিখিত একটি কাগজ মাটিতে পড়ে আছে। ওটা দেখে হযরত বিশর হাফী (রহ.) মনে মনে চিন্তা করলেন, সারা জীবন তো পাপ করেছি। নেক কাজ তো করতে পারিনি। আজকে একটি ভালো কাজ করার চেষ্টা করি। আল্লাহর পবিত্র কালাম এভাবে মাটিতে পড়ে থাকা উচিত নয়, এটাকে তুলে নিতে হবে। তাই তিনি কাগজটি তুলে নিলেন। ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে আতর-গোলাপ মেখে তার ঘরের উঁচু স্থানে রেখে দিলেন। এরপর তিনি আবার শরাবখানায় চলে গেলেন। ওই এলাকায় একজন আল্লাহঅলা লোক ছিলেন। তিনি রাতে স্বপ্নে দেখলেন, উনাকে স্বপ্নে বলা হচ্ছে, তুমি বিশরকে গিয়ে সংবাদ দাও, হে বিশর, তুমি আল্লাহর নামের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করত সেটিকে যেভাবে সুগন্ধময় করেছ, তেমনি আল্লাহও তোমার নাম দুনিয়া ও আখিরাতে উজ্জ্বল ও সুগন্ধময় করে দেবে।

ওই বুযুর্গ ব্যক্তি তাড়াতাড়ি সংবাদ দেওয়ার জন্য তার বাড়িতে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, বিশর কোথায়? বাড়ি থেকে বলা হলো, তিনি তো এখানে নেই, তিনি শরাবখানায়। বুযুর্গ ব্যক্তি শরাবখানায় গিয়ে সে সুসংবাদ দিলেন। তখন হযরত বিশর হাফী আনন্দে আত্মহারা হয়ে বন্ধু-বান্ধবদেরকে বলেন, হে বন্ধুরা! আজ থেকে বিদায়। আল্লাহ পাক আমাকে কবুল করে নিয়েছেন এবং সুসংবাদ প্রেরণ করেছেন। আমি আর এখানে থাকবো না। তিনি চলে গিয়ে সে যামানার বড় বড় আল্লাহঅলাদের সোহবত বসে একজন খাঁটি আল্লাহর অলী হয়েছিলেন। তাঁর মর্যাদা এতো বেড়ে গেলো যে, তাঁকে হাফী বলা হতো। হাফী শব্দের অর্থ, যে খালি পায়ে (জুতাবিহীন) চলে। তিনি খালি পায়ে বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায় চলা-ফেরা করতেন, কিন্তু তাঁর পায়ে কোন ময়লা-আবর্জনা লাগতো না। এটি ছিলো আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ মর্যাদা।

কিতাব অধ্যয়নের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ

হযরত মীর সাহেব (রহ.) কিতাবের পোকা ছিলেন। তিনি কিতাব অধ্যয়নের মাধ্যমেই শান্তি ও স্বস্তি লাভ করতেন। তাই জামিয়ার ছাত্র-শিক্ষককেও তিনি মুতালায়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। এমন কি কোন শিক্ষকমণ্ডলী হযরতের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি তাদেরকে জামিয়ার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে অধ্যয়ন করতে বলতেন। তিনি বলতেন, যদি কুতুবখানার কিতাবগুলো অধ্যয়ন করা না হয়, তা হলে এতগুলো কিতাব এখানে জমা করার ফায়দা কী? এগুলো তো অধ্যয়ন করার জন্যই খরিদ করে আনা হয়েছে। তিনি বলতেন, আমি তো প্রায় সময় কুতুবখানায় সময় ব্যয় করি। সেখানো আপনাদেরকে কেন দেখা যায় না? মনে রাখবে, এখনই অধ্যয়ন করার সুবর্ণ সুযোগ। অধ্যয়ন করে নিজের ইলম ও যোগ্যতা বৃদ্ধি করো। আমরা তো চিরদিন বেঁছে থাকবো না। আমাদের পর আপনাদেরকেই হাল ধরতে হবে। এখন থেকেই অধিক অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তুলোন। তাতেই আগামীতে আপনাদের মাধ্যমে দেশ ও জাতি উপকৃত হতে পারবে।

দাওরায়ে হাদীসের ছাত্রদেরকে বিশেষ আপ্যায়ন

হযরত মীর সাহেব (রহ.) ছাত্রদেরকেও আপ্যায়ন করতেন। বিশেষত আর্থিক স্বচ্ছলতা আসার পর দাওরায়ে হাদীসের ছাত্রদেরকে মৌসূমী ফল-মূল খাওয়াতেন। বাজারে যখন তরমুজ পাওয়া যেতো তখন তিনি দাওরায়ে হাদীসের সকল ছাত্রকে তরমুজের দাওয়াত করতেন। হযরতের ইন্তিকালের পর তাঁরই যোগ্য ও প্রিয় শিষ্য হযরতুল আল্লামা সুলতান যওক নদভী (হাফিযাহুল্লাহ) ছাত্রদেরকে তরমুজ খাওয়ায়েছেন।

এক অদ্ভূদ ঘটনা। হযরত মীর সাহেব (রহ.)-এর মরসিয়া অনুষ্ঠানে হযরত যওক সাহেব (হাফিযাহুল্লাহ) অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু তিনিও হযরতের বিয়োগ ব্যথায় শোকগাথা রচনা করেছেন। তিনি ‘ব্যথার দাস্তান’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ শোকগাথা লিখেছেন। তাঁর শোকগাথাটি দাওরায়ে হাদীসের ছাত্রদের সামনে নিজেই আবৃত্তি করে শোনান। কয়েক লাইন আবৃত্তি করতেই তিনি আবেগ-আপ্লোত হয়ে যান। চক্ষুদ্বয় অশ্রু সিক্ত হয়ে যায়। তিনি নিজেও কাঁদছেন আর ছাত্ররাও কাঁদেছে। এক আবেগময় পরিবেশ তৈরি হয়। এক পর্যায়ে কয়েকজন ছাত্র বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায়।

বৃদ্ধ বয়সে তাবলীগে সময় দেওয়া

তা’লীম ও তাবলীগে দীনের দুই গুরুদায়িত্ব। দীনের প্রচার-প্রসার করাকে তাবলীগ এবং কুরআন-হাদীসের পাঠদান করাকে তা’লীম বলে। একজন আলেমের জন্য তা’লীম যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তাবলীগও গুরুত্বপূর্ণ। হযরত মীর সাহেব (রহ.) জীবনের সিংহভাগ দরস-তাদরীসের মাধ্যমে তা’লীমের যিম্মাদারী আদায় করেছেন। জীবনের শেষ ভাগে এসে তিনি দীনের প্রচার-প্রসারের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্যে রমযানের ছুটিতে জামিয়া থেকে বের হয়ে পড়েন। আপন সাহেবযাদা মাওলানা হাফেজ কাসেম সাহেব (রহ.)-কেও সঙ্গে নিয়ে যান। তাঁরা উভয়ে চট্টগ্রাম থেকে তাবলীগি কাজ করতে করতে কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছেন। রমযানের ছুটিতে তাঁরা তাবলীগে সময় ব্যয় করেন। পরিশেষে যখন অসুস্থ হয়ে যান তখন বাড়িতে ফিরে আসেন।

হযরত মাওলানা হাফেজ শোয়াইব সাহেব বলেন, আমি ওই বছর তাবলীগি এজতেমায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু আব্বাজান অসুস্থ হওয়ার কারণে আমার বড়ভাই মাওলানা হোসাইন সাহেব আমাকে এজতেমায় যেতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওনাকে রেখে এজতেমায় যাওয়া যাবে না। তখন আমি এ কথা আব্বুকে জনালাম যে, আমি এজতেমায় যাওয়ার জন্য টাকা-পয়সা জমা করে দিয়েছি, কিন্তু বড়ভাই আমাকে যেতে নিষেধ করছেন। তখন তিনি বড়ভাইকে ডেকে বললেন, শোয়াইবকে এজতেমায় আমি পাঠাচ্ছি। সে সেখানে গিয়ে বড় জামায়াতে নামায পড়বে, দুআ করবে। তুমি তাকে বাধা দিও না।

হাফেজ শোয়াইব সাহেব বলেন, আমি যেদিন এজতেমার উদ্দেশ্যে রওনা দেই, সেদিনই আব্বুজানের অসুস্থতা বেড়ে যায়। তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। এ সংবাদ পেয়ে আমি বাড়িতে ফিরে আসি। প্রায় ২৭দিন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অতঃপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন।

মৃত্যুর ঘটনা ও তারিখ

হযরত মীর সাহেব (রহ.) মৃত্যু ও মৃত্যুপূর্ব ঘটনা জামিয়ার শায়খুল হাদীস আল্লামা আইয়ুব (রহ.) অত্যন্ত হৃদয়বিদারকভাবে চিত্রায়ন করেছেন। কিছুটা পরিবর্তনসহ নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো। হযরত মীর সাহেব (রহ.) মৃত্যুর পূর্বে দীর্ঘদিন যাবৎ চট্টগ্রাম সম্মিলিত মিলিটারি হসপিটাল (সিএমএইচ)-এ চিকিৎসাধীন ছিলেন। হযরতের সেবা-শুশ্রূষার জন্য সেখানে তাঁর সুযোগ্য সন্তান মাওলানা হাফেজ শোয়াইব সাহেবসহ অন্যান্য সন্তানরা নিয়মিত থাকতেন। পাশাপাশি জামিয়া পটিয়ার তৎকালীন দাওরায়ে হাদীসের দু’জন ছাত্র প্রতিদিন পালাক্রমে উপস্থিত হতেন। এ ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও পঙ্গপালের মতো হাসপাতালে ছুটে যেতো। জামিয়া প্রধান হযরত আলহাজ্ব মাওলানা ইউনুস (রহ.) ও সহকারী পরিচালক হযরত মাওলানা মুফতি আবদুর রহমান (রহ.)-সহ অন্যান্য শিক্ষকমণ্ডলী সেবাযত্নের দেখ-ভাল ও চিকিৎসা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া-সহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকেন। কিন্তু العبد يدبرو الله يقدر অর্থাৎ বান্দা চেষ্টা-তদবীর করে কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। পরিশেষে ১৭ জুমাদুল উলা, ১৪০৪ হিজরী, মোতাবেক ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ সোমবার সকল নয় ঘটিকার সময় তিনি পরকালের অভিযাত্রী হন।

সেদিন জামিয়া পটিয়ায় দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে ছিলো। এ দুঃসংবাদ শোনামাত্রই তাদের হাত থেকে কলম ঝরে পড়লো। আকাবির-মাশায়িখের হৃদয়-জগতে বিষাদের তাণ্ডব, ছাত্র-শিক্ষক সকলের নয়নে অশ্রুবন্যা। যেনো সকলের মাথায় বজ্রপাত হলো অথবা কোন ভারী পর্বত ধ্বসে পড়লো! বিদ্যুৎ গতিতে এই বেদনাদায়ক খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো। শুধুমাত্র আত্মীয়-স্বজন নয়, হাটহাজারী-জিরি মাদরাসাসহ অন্য মাদরাসাসমূহের ছাত্র-শিক্ষকগণ ও সাধারণ মানুষ জামিয়া পানে পাগলের মতো ছুটে আসেন। নিমেষেই জামিয়া পটিয়া শোকগৃহে রূপ ধারণ করলো এবং লোকে লোকরণ্য হয়ে গেল। দালানকোঠা, গাছপালা যেনো শোকে মুহ্যমান। দুটার দিকে যখন হযরত মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) লাশ মুবারক নিয়ে পৌঁছান, তখন রোনাজারির রোল পড়ে যায়। নামাযে জানাযায় জামিয়ার ঐতিহাসিক বিশাল ময়দানে তিল ধারনের স্থান ছিলো না। জানাযার নামাযে ইমামতি করেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরব্বী উস্তাদ, শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা আহমদ (রহ.) (ইমাম সাহেব হুযুর)। জানাযা শেষে মাকবারায়ে আযীযীতে ইলম ও মা’রেফাতের অনুপম ব্যক্তিত্বকে স্বীয় উস্তাদ ও মুরশিদ হযরত মুফতি আযীযুল হক (রহ.)-এর পৈথানে দাফন করা হয়। ইকবালের ভাষায় বলি, আসমান তাঁর কবরে শিশির ঝরাক

آسماں ان کی لحد پر شبنم افشانی کرے۔

শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ