আলী হাসান তৈয়ব
আল্লাহ তাআলা সবরকে এমন এক যন্ত্র দিয়েছেন যা কখনো ব্যর্থ হয় না, এমন তীর বানিয়েছেন যা লক্ষ ভ্রষ্ট হয় না, এমন বিজয়ী সৈনিক বানিয়েছেন যে কখনো পরাজিত হয় না, এমন সুরক্ষিত দুর্গ বানিয়েছেন যা কখনো ধ্বংস হয় না। এই সবর আর বিজয় দুই সহোদরের মতো। মানুষ তার দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়ে সবরের মতো এমন কোনো অস্ত্রে সজ্জিত হয় না, যা তার নফস ও শয়তানকে নিশ্চিতভাবে হারিয়ে দেয়। সেই বান্দার কোনো শক্তিই নেই, যার গুণাবলির মধ্যে সবর তথা ধৈর্য নেই। সেই বান্দা বিজয়ও ছিনিয়ে আনতে পারে না যে সবরকারী বা ধৈর্যশীল নয়। তাইতো আল্লাহ তাআলা কুরআন মজিদে ইরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার।’ [সুরা আলে ইমরান: ২০০]
এই সবর মুমিনের জন্য তার ভাইয়ের মতো। আপন ভাই অনেক সময় রাগ করে ছেড়ে যায়; কিন্তু বিপদের সময় সে-ই সবার আগে এগিয়ে আসে। এই সবর ঈমানের শাখা স্বরূপ, নালা না থাকলে ঈমানের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হবে। যার ধৈর্য নেই তার ঈমান নেই। সবর ছাড়া যদি ঈমান থাকেও, তবে তা বড় দুর্বল ঈমান। এমন ঈমানদার আল্লাহর ইবাদত করে দ্বিধা ও সংশয়ের সঙ্গে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সুন্দর বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর এবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে এবাদতের ওপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি।’ [সুরা আল-হজ: ১১]
এ ব্যক্তি আসলে সবর হারিয়ে শুধু তার দুর্ভাগ্যই কামাই করে যাবে। পক্ষান্তরে যে সবর করে। বিপদে ধৈর্য ধারণ করে সে ভাগ্যবান। পৃথিবীতে যারা সৌভাগ্যবান তারা কিন্তু সবর ও ধৈর্য গুণেই ভাগ্যবান। এরা দুঃসময় এলে ধৈর্য ধরে আর সুসময় এলে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে। এভাবে তারা জান্নাতের নেয়ামতের অধিকারী হয়। সত্যিই এরা সৌভাগ্যবান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা অগ্রে ধাবিত হও তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে, যা আকাশ ও পৃথিবীর মত প্রশস্ত। এটা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণের প্রতি বিশ্বাসস্থাপনকারীদের জন্যে। এটা আল্লাহর কৃপা, তিনি যাকে ইচ্ছা, এটা দান করেন। আল্লাহ মহান কৃপার অধিকারী।’ [সুরা আল–হাদীদ: ২১]
সবরেরগুরুত্ব
সবর বা ধৈর্য আল্লাহর পরিপূর্ণ মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা যাকে এই গুণ দেন; সেই এই গুণে সুসজ্জিত হয়। আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূল আলাইহিস সালামদের এই বিরল গুণে বিভূষিত করেছিলেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা নব্বই জায়গায় সবরের কথা বলেছেন। অতএব ভেবে দেখুন সবর কত গুরুত্বপূর্ণ! আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে সবরের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। নিচে তার কয়েকটি তুলে ধরা হল:
- আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে সাবের তথা ধৈর্যশীলদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদেরকে হিসাব ছাড়া প্রতিদান দেবেন বলে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্যে রয়েছে পুণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।’ [সুরা আয–যুমার: ১০]
- আল্লাহ তাআলা বলেছেন তিনি ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন, তাদের জন্য হেদায়েত ও সুস্পষ্ট বিজয় নিয়ে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রয়েছেন ধৈর্যশীলদের সাথে।’ [সুরা আল–আনফাল: ৪৬]
- আল্লাহ তাআলা সবর ও ইয়াকিন তথা ধৈর্য ও ঈমানের বদৌলতে মানুষকে নেতৃত্ব দেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।’ [সুরা আস–সাজদা: ২৪]
- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন সবরই মানুষের জন্য কল্যাণকর। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যদি তোমরা সবর কর, তবে তাই সবরকারীদের জন্য উত্তম।’[সুরা আন–নাহল: ১২৬]
- আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, কারও সাথে যদি সবর থাকে তাহলে যত বড় শত্রুই হোক তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছু ক্ষতি করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী।’ [সুরা আলে ইমরান: ১২০]
- আল্লাহ তাআলা বিজয় ও সফলতার জন্য সবর ও তাকওয়া অবলম্বনের শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’ [সুরা আলে ইমরান: ২০০]
- আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলকে ভালবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? ইরশাদ হয়েছে, ‘আর কত নবী ছিল, যার সাথে থেকে অনেক আল্লাহওয়ালা লড়াই করেছে। তবে আল্লাহর পথে তাদের ওপর যা আপতিত হয়েছে তার জন্য তারা হতোদ্যম হয়নি। আর তারা দুর্বল হয়নি এবং তারা নত হয়নি। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালবাসেন।’ [সুরা আলে ইমরান: ১৪৬]
- আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের তিনটি বিষয়ে সুসংবাদ দিয়েছেন, যার প্রতিটি পাবার জন্য দুনিয়াবাসী একে অপরের সঙ্গে ইর্ষা করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ [সুরা আল–বাকারা: ১৫৫–১৫৭]
- ধৈর্যশীলদের জন্য রেখেছেন জান্নাত লাভের কামিয়াবী আর জাহান্নাম থেকে মুক্তির সাফল্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমি তাদের ধৈর্যের কারণে আজ তাদেরকে পুরস্কৃত করলাম; নিশ্চয় তারাই হল সফলকাম।’[সুরা আল–মুমিনুন: ১১১]
- আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের চার চারটি স্থানে উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর নিদর্শনাবলি থেকে ধৈর্যশীল ও শুকরগুযার বান্দারাই উপকৃত হয় এবং এরাই সৌভাগ্যবান বটে। যেমন ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি কি দেখনি যে, নৌযানগুলো আল্লাহর অনুগ্রহে সমুদ্রে চলাচল করে, যাতে তিনি তাঁর কিছু নিদর্শন তোমাদের দেখাতে পারেন। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।’ [সুরা লুকমান: ৩১]
আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আর আমি মূসাকে আমার আয়াতসমূহ দিয়ে পাঠিয়েছি যে, ‘তুমি তোমার কওমকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আন এবং আল্লাহর দিবসসমূহ তাদের স্মরণ করিয়ে দাও।’ নিশ্চয় এতে প্রতিটি ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য রয়েছে অসংখ্য নিদর্শন।’ [সুরা ইবরাহীম: ৫]
আরও ইরশাদ করেছেন, ‘কিন্তু তারা বলল, ‘হে আমাদের রব, আমাদের সফরের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিন’। আর তারা নিজদের প্রতি যুলম করল। ফলে আমি তাদেরকে কাহিনী বানালাম এবং তাদেরকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিলাম। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ [সুরা আস–সাবা: ১৯]
অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তিনি যদি চান বাতাসকে থামিয়ে দিতে পারেন। ফলে জাহাজগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠে গতিহীন হয়ে পড়বে। নিশ্চয় এতে পরম ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।’ [সুরা আশ-শূরা: ৩৩]
সবর কী?
সবরের আভিধানিক অর্থ বাধা দেওয়া বা বিরত রাখা। শরীয়তের ভাষায় সবর বলা হয়, অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ করা থেকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গাল চাপড়ানো ও বুকের কাপড় ছেড়া থেকে বিরত রাখা। কারো কারো মতে, এটি হলো মানুষের ভেতরগত একটি উত্তম স্বভাব, যার মাধ্যমে সে অসুন্দর ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের এক আত্মিক শক্তি যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ্য ও সুরক্ষিত রাখতে পারে। জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.)-কে সবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘হাসি মুখে তিক্ততার ঢোক গেলা।’
জুন্নুন মিসরী (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে থাকা, বিপদের সময় শান্ত থাকা এবং জীবনের কুরুক্ষেত্রে দারিদ্রের কষাঘাত সত্ত্বেও অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা।’ কারও মতে, ‘সবর হলো সুন্দরভাবে বিপদ মোকাবিলা করা।’ আবার কারও মতে, ‘বিপদকালে অভিযোগ-অনুযোগ না করে অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করাই সবর।’ এক বুযুর্গ এক ব্যক্তিকে অন্যের কাছে তার সমস্যা নিয়ে অনুযোগ করতে শুনলেন। তিনি বললেন, ‘তুমি ভাই, স্রেফ যে দয়া করে না তার কাছে দয়াকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছো। এর বেশি কিছু করোনি।’ এ সম্পর্কে আরও বলা হয়, ‘তুমি যখন মানুষের কাছে অভিযোগ করো, তখন মূলত সদয়ের বিরুদ্ধে নির্দয়ের কাছেই অভিযোগ করো।’
অভিযোগ করাটা দুই ধরনের। একটি হলো, আল্লাহ তাআলার কাছে অনুযোগ করা। এটি সবর পরিপন্থী নয়। যেমন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বলেন, ‘সে বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’ [সুরা ইউসুফ: ৮৬]
অপরটি হলো, নিজের মুখের বা শরীরের ভাষায় মানুষের কাছে অভিযোগ করা। এটি সবরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এটি সবর পরিপন্থী।
সবরের প্রকার
সবর তিন প্রকার। যথা: প্রথম: আল্লাহ তাআলার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদত-বন্দেগি সম্পাদন করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। দ্বিতীয়: আল্লাহ তাআলার নিষেধ এবং তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে অটুট ধৈর্য রাখা। এবং তৃতীয়: তাকদীর ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে ধৈর্য ধরা।
এই তিন প্রকার সম্পর্কেই শায়খ আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) তাঁর ফুতুহুল গায়ব গ্রন্থে বলেন, ‘একজন বান্দাকে অবশ্যই তিনটি বিষয়ে ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিতে হবে: কিছু আদেশ পালনে, কিছু নিষেধ থেকে বিরত থাকায় এবং তাকদীরের ওপর।’ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত লুকমান আলাইহিস সালামের বিখ্যাত উপদেশেও এ তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’ [সুরা লুকমান: ১৭]
লুকমান আলাইহিস সালাম যে ‘সৎকাজের আদেশ দাও’ বলেছেন, তার মধ্যে নিজে সৎ কাজ করা এবং অপরকে সৎ কাজের উপদেশ দেওয়া—উভয়টি অন্তর্ভুক্ত। তেমনি অসৎকাজে নিষেধ করার মধ্যেও উভয়টি রয়েছে। এখানে ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’ শব্দই আমাদের এমন ধারণা দেয়। তাছাড়া শরীয়তের দৃষ্টিতেও ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’ বাস্তবায়িত হয় না, যতক্ষণ না আগে নিজে তা পালন করা হয়। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে। যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সবর করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিযক প্রদান করেছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভালো কাজের মাধ্যমে মন্দকে দূর করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের শুভ পরিণাম। আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে। যারা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না।’ [সুরা আর–রা’দ: ১৯–২২]
তাই বলে বিপদ কামনা করার বিধান নেই
বিপদে ধৈর্য ধরার ফযীলত অনেক। তাই বলে শরীয়তে বিপদ কামনা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কারণ, মুমিন সচেতন ও বুদ্ধিমান। সে কখনো বিপদ প্রত্যাশা করতে পারে না। তবে বিপদ এসে পড়লে তাতে সে বিচলিতও হয় না; বরং ধৈর্য ধরে। বিপদের সময় দৃঢ়তা ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। যেমন বুখারী শরীফে আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যুদ্ধের দিনগুলোতে একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) অপেক্ষায় থাকলেন। যখন সূর্য ডুবে গেল তখন তিনি তাঁদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে লোকসকল, তোমরা শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখি হবার প্রত্যাশা করো না এবং আল্লাহ তাআলার কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করো। তবে যখন তোমরা তাদের মুখোমুখি হও, তখন ধৈর্য ধর এবং সবর করো। আর জেনে রেখো, জান্নাত তরবারির ছায়া তলে।’ [বুখারী: ২৯৬৫; মুসলিম: ৪৬৪০]
ইবনে বাত্তাল (রহ.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতকে শত্রু-সাক্ষাতের প্রত্যাশা করতে বারণ করেছেন। কারণ, সে জানে না সামনে কী ঘটবে আর বিপদে পরিত্রাণইবা পাওয়া যাবে কীভাবে। এ থেকে অপছন্দনীয় বিষয় প্রার্থনা করা এবং অপ্রিয় অবস্থা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ নিতে চাওয়ার নিষেধাজ্ঞা বোঝা যায়। এ জন্যই পূর্বসূরী নেককার ব্যক্তিগণ আল্লাহ তাআলার কাছে বিপদাপদ ও পরীক্ষা থেকে মুক্তি প্রার্থনা করেছেন। কেননা সবাই সবসময় ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখাতে পারে না।
আমরা তো সেই সাহাবীর কথা শুনে থাকবো যিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত অবস্থায় যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন! এ জন্যই কিন্তু আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) বলতেন, ‘সুস্থ থাকবো আর শুকরিয়া আদায় করবো—এটাই আমার কাছে প্রিয় বিপদে থেকে সবর করার চেয়ে।’ [তাবরানী, মু’জামুল কবীর: ১৭৬৬; বায়হাকী, শুঅবুল ঈমান: ৪১২১]
একজন প্রকৃত মুমিন কিন্তু সর্বাবস্থায় দৃঢভাবে এ কথা বিশ্বাস করে যে, সে যে অবস্থায় আছে, তাতে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যেমন মুসলিম শরীফে ছুহাইব ইবনে সিনান (রাযি.) থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনের অবস্থা কতইনা চমৎকার! তার সব অবস্থায়তেই কল্যাণ থাকে। এটি শুধু মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য যে, যখন সে আনন্দের উপলক্ষ পায়, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ফলে তা হয় তার জন্য কল্যাণবাহী। আর যখন সে কষ্টের সম্মুখীন হয়, তখন সবর করে এবং ধৈর্যে অটল থাকে। ফলে এটিও তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।’ [সহীহ মুসলিম: ৭৬৯২।]
বিপদ মুমিনের নিত্য সঙ্গী
আমাদের মনে রাখতে হবে, মুমিনের পুরো জীবনই পরীক্ষায় ভরা। আল্লাহ তাআলা যেমন ইরশাদ করেন, ’আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।’ [সুরা আল–আম্বিয়া: ৩৫]
আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান কে ধৈর্যশীল, কে মুজাহিদ আর কে সত্যবাদী। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জানেন নি তাদেরকে যারা তোমাদের মধ্য থেকে জিহাদ করেছে এবং জানেননি ধৈর্যশীলদেরকে।’ [সুরা আলে ইমরান: ১৪২]
তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি প্রকাশ করে দেই তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদকারী ও ধৈর্যশীল এবং আমি তোমাদের কথা— কাজ পরীক্ষা করে নেব।’ [সুরা মুহাম্মদ: ৩১]
অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমাদেরকে কোনো আঘাত স্পর্শ করে থাকে তবে তার অনুরূপ আঘাত উক্ত কওমকেও স্পর্শ করেছে। আর এইসব দিন আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন করি এবং যাতে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে জেনে নেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে শহীদদেরকে গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ যালিমদেরকে ভালবাসেন না।’ [সুরা আলে ইমরান: ১৪০]
আল্লাহ তাআলা আরও সুনির্দষ্ট করে বলেন, ’তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্রতিদান।’ [সুরা আত–তাগাবুন: ১৫]
রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে সাহাবীদের সবর শিক্ষা দিয়েছেন
রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং তাঁর শীষ্য ও সাহাবীদের সবর শিক্ষা দিয়েছেন। এটি বেশি করা হয়েছে মক্কী জীবনে। যেমন খুবাইব ইবনে আরাত (রাযি.)-এর হাদীসে আমরা এর চিত্র দেখতে পাই। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন কা’বার ছায়ায় বালিশে হেলান দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর কাছে অভিযোগ করলাম, কেন আপনি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সাহায্য চাইছেন না, আমাদের জন্য তাঁর কাছে দু’আ করছেন না। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে (এমন বিপদও এসেছে যে) কাউকে ধরা হতো। তারপর গর্ত খনন করে তাকে সেই গর্তে ফেলা হতো। এরপর করাত এনে তার মাথার ওপর রাখা হতো। অতপর তাকে দুই টুকরো করে লোহার চিরুনী দিয়ে তার শিরা-অস্থিসহ আচড়ানো হতো। তদুপরি তারা তাকে দীন থেকে ফেরাতে পারতো না। আল্লাহর শপথ! (এখন আমাদের পরীক্ষা চলছে) আল্লাহ এ দীনকে পূর্ণতা দেবেন। একদিন এমন আসবে যখন আরোহীরা সানআ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত যাবে। চিতা আর ছাগল নিরাপদে থাকবে। এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতে হবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছো।’ [সহীহ আল-বুখারী: ৩৬১২]
অর্থাৎ মক্কার মুশরিকদের আযাব অচিরেই দূর হয়ে যাবে। সুতরাং অতীতের উম্মতের মতো তোমরাও দীনের বিপদে একটু ধৈর্য ধরো।
সবরের ফযীলত–মর্যাদা
সবরের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহর বান্দা মাত্রেই সবর করতে হবে। কেননা কখনো আল্লাহর আদেশ মানতে হবে, তাঁর নির্দেশিত কাজ করতে হবে। আবার কখনো তাঁর নিষেধ মেনে চলতে হবে, বিরত থাকতে তা করা থেকে। আবার কখনো অকস্মাৎ তাকদীরের কোনো ফয়সালা এসে পড়বে। নেয়ামত দেয়া হবে, তখন শুকরিয়া আদায় করতে হবে। এভাবে নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে মুমিনের জীবন অতিবাহিত হয়। সুতরাং মৃত্যু পর্যন্ত এই সবরকে সাথে নিয়েই চলতে হবে। এজন্যই সবরের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
ক. উম্মে সালামা (রাযি.) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বিপদে পড়ে আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন অর্থাৎ إِنَّا لِلهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ পড়বে এবং বলবে, হে আল্লাহ, আমাকে আমার বিপদের প্রতিদান দিন এবং আমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছু দান করুন। আল্লাহ তাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু দান করবেন।’ উম্মে সালামা বলেন, আবু সালামা মারা গেল। আমি ভাবলাম, আবু সালামার চেয়ে উত্তম মুসলমান আর কে হতে পারে? তাঁর ঘরেই রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম হিজরত করেছেন। আমি মনে মনে এ কথা ভাবলাম আর আল্লাহ তাআলা আমাকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহকেই স্বামী হিসেবে দান করলেন।’১
খ. আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যার ভালো চান, তাকে বিপদ দেন।’২
গ. আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিনকে যেকোনো বিপদই স্পর্শ করুক না কেন আল্লাহ তার বিনিময়ে তার গুনাহ মাফ করে দেন। এমনকি (চলতি পথে) পায়ে যে কাঁটা বিঁধে (তার বিনিময়েও গুনাহ মাফ করা হয়।’৩
ঘ. আবু মুসা আল-আশআরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হয় অথবা সফর করে, তার জন্য সে সুস্থ্য ও ঘরে থাকতে যেরূপ নেকি কামাই করতো অনুরূপ নেকি লেখা হয়।’৪
ঙ. এক বুযুর্গ বলেন, ‘যদি দুনিয়ার বিপদাপদ না থাকতো তাহলে আখিরাতে আমরা রিক্ত অবস্থায় উপনীত হতাম।’৫
চ. সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.) নিচের আয়াত: ‘আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।’ [সুরা আস–সাজদা: ২৪]-এর ব্যাখ্যায় বলেন, যেহেতু তারা সকল কৌশলের মূল তথা ধৈর্য অবলম্বন করেছে তাই আমি তাদেরকে নেতা বানিয়ে দিলাম।৬
ছ. উরওয়া ইবন যুবায়ের (রাযি.) যুদ্ধে আহত হবার পর যখন সাহাবীরা তার পা কাটতে উদ্যত হলেন, তারা বললেন, আমরা কি আপনাকে কিছু খাইয়ে দেবো যাতে আপনি কষ্ট অনুভব না করেন? তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে আমার ধৈর্য দেখার জন্যই এ বিপদে ফেলেছেন। আমি কি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারি?!৭
জ. ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (রহ.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ তাআলা কোনো নেয়ামত দিয়ে তা ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং তার স্থলে তাকে সবর দান করেছেন, তো এই ব্যক্তি থেকে যা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তার চেয়ে সেটাই উত্তম যা তাকে দান করা হয়েছে।’৮
ঝ. আবু বকর (রাযি.) অসুস্থ হলে তাকে দেখতে গিয়ে সাহাবীরা বললেন, ‘আমরা কি আপনার জন্য চিকিৎসক ডেকে আনবো না? তিনি বললেন, চিকিৎসক আমাকে দেখেছেন। তারা বললেন, চিকিৎসক আপনাকে কী বলেছেন? তিনি বললেন, বলেছেন, ‘আমি যা চাই তা-ই করি।’৯
শেষকথা
জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে আমাদেরকে সবর ও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে প্রতিবেশির আচরণে। তার দেয়া কষ্ট অম্লান বদনে সহ্য করতে হবে। থাকতে হবে তার কল্যাণে সদা সচেষ্ট। আত্মীয়দের কথা যদি বলেন, তারাও কষ্ট দেবে আপনাকে। এতে সবর করুন আর নেকির প্রত্যাশায় থাকুন। আপনার অধীনস্ত যারা আছে তারাও আপনাকে ত্যক্ত-বিরক্ত করবে। তাদের আচরণেও আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। মনে রাখবেন, পৃথিবীটা কিন্তু আপনার-আমার নিয়ম মাফিক চলবে না। জগতের সবাই নিয়ম রক্ষাও করতে পারবে না। স্বামী হলে স্ত্রীর ব্যবহারে আপনাকে সহিষ্ণুতা ও সবরের স্বাক্ষর রাখতে হবে। তার মন্দ দিকগুলো যখন ফুটে হতে থাকে, তখন আপনি তার ভালো ও প্রশংসনীয় গুণগুলো সামনে আনবেন। একইভাবে আপনি যদি স্ত্রী হন, তবে আপনাকেও ওই সবরের দ্বারস্থ হতে হবে। স্বামীর সব কিছুতেই অভিযোগ আনবে চলবে না। তার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন। ঘরের বাইরে তিনি যে কষ্ট-যাতনা সহ্য করেন তার দিকে তাকিয়ে আপনি ঘরের ভেতরে তার অপছন্দনীয় জিনিসগুলো সহনীয় হিসেবে গণ্য করুন।
মানুষের আচরণে সবর করতেই হবে। সবাই তার দায়িত্ব সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে পারে না। সব মানুষের আখলাক-চরিত্রও একরকম নয়। একেকজনের স্বভাব একেকরকম। অতএব সবরের কোনো বিকল্প নেই। সবর করুন আর এর সুফলের কথা মাথায় রাখুন। কারণ, সবরকারী তার সবরের বদৌলতে প্রভূত কল্যাণ অর্জন করেন। যার সবর নেই, সবখানেই তিনি কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সবরের মতো মহৎ গুণের অধিকারী বানান। আমাদেরকে ধৈর্যশীল বান্দা হবার তাওফীক দিন। আমীন।
তথ্যসূত্র
- মুসলিম: ২১৬৫
- বুখারী: ৫৬৪৫; আহমদ, মুসনদ: ৭২৩৪
- বুখারী: ৫৬৪০; মুসলিম: ৬৭৩০
- বুখারী: ২৯৯৬; আহমদ, মুসনদ: ১৯৬৯৪
- শায়খ মুনাজ্জিদ, ইলাজুল হুমূম
- ইবনে কসীর: ৬/৩৭২
- আল-মারযু ওয়াল-কাফফারাত, ১/১৩৯
- বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান: ৯৫৬৫; মুসান্নাফ, ইবন আবী শাইবা: ৩৬২৪২
- আহমদ, আয-যুহদ: ২/১০৪