জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সদ্য প্রকাশিত কয়েকটি আরবি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

মাহফুয আহমদ

مصنفات شيخ الإسلام ابن حجر

এটি মূলত সহীহ আল-বুখারীর বিশ্ববিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীর রচয়িতা, যুগশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ, আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার (রহ.) (জন্ম: ৭৭৩ হি./মৃত্যু: ৮৫২ হি.) কর্তৃক রচিত ও সংকলিত গ্রন্থসমূহের বিশদ একটি তালিকা। ইবনে হাজারের দীর্ঘদিনের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত সুযোগ্য ছাত্র আল্লামা বুরহানুদ্দিন বিকায়ি (রহ.) (জন্ম: ৮০৯ হি./মৃত্যু: ৮৮৫ হি.) এটি তৈরি করেছিলেন আনুমানিক ৮৩৭ হিজরিতে। এতে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার কখন কোন কিতাব লিখেছেন, তাঁর কোন গ্রন্থটি মুসাওয়াদাহ আর কোনটি মুবাইয়াদ্বাহ ছিলো, কোন গ্রন্থটি তাঁর ইয়েমেন সফরের প্রাক্বালে সাগরে ডুবে গিয়েছিল ইত্যাদি কতেক চমৎকার তথ্য তিনি সন্নিবেশিত করেছেন।

বিকায়ী কর্তৃক প্রণীত এই সূচিটি পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত ছিলো নেদারল্যান্ডসের লাইডেন ইউনিভার্সিটির গ্রন্থাগারে। মাত্র ৬ পাতার এই পাণ্ডুলিপিতে কিন্তু ইবনে হাজারের সবকটি গ্রন্থের নাম ও তথ্য উল্লিখিত হয়নি। কেননা এটি তৈরি করা হয়েছিলো ইবনে হাজারের মৃত্যুর প্রায় ১৫ বছর পূর্বে। সেজন্য এটার ওপর কিছু কাজের প্রয়োজন ছিলো। আল-হামদুলিল্লাহ! সেই কাজটুকু করার সৌভাগ্য অধমের হয়েছে। সৌদিআরব থেকে অধমের একজন হিতাকাঙ্ক্ষী শায়খ আলী ইবনে সালিহ আস-সামআনী এই কাজের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

অধমের কাজ ছিলো এভাবে, শুরুতে ইবনে হাজারের নাতি কর্তৃক লিখিত তার নানার জীবনী একটি দুর্লভ ও অপ্রকাশিত (পাণ্ডুলিপি) গ্রন্থ থেকে সংযোজন করেছি। তারপর বিকায়ির জীবনী, এরপর বিকায়ির ছাত্র ইবনুল লাব্বুদি (যিনি এটি স্বীয় উসতায থেকে নাসখ বা কপি করেছিলেন) এর জীবনী, অতঃপর ইবনে হাজারের গ্রন্থ রচনার ইতিহাস ও পরিসংখ্যান, ইত্যাদি কতেক বিষয় আমার ভূমিকায় আলোচিত হয়েছে।

তাছাড়া গ্রন্থে উল্লিখিত প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে অধম সংযুক্ত করে দিয়েছি যে, বইটি প্রকাশিত না অপ্রকাশিত। প্রকাশিত হলে তার কতটি সংস্করণ রয়েছে; সেসবের তথ্য। আর অপ্রকাশিত থাকলে; সেটার পাণ্ডুলিপি বিশ্বের কোন লাইব্রেরিতে আছে তার সন্ধান। এছাড়া এক্ষেত্রে ইবনে হাজারের আরেক বিশিষ্ট শাগরেদ আল্লামা সাখাওয়ি তাঁর আল-জাওয়াহির ওয়াদ দুরার এ নতুন কিছু বলে থাকলে সেটাও সংযুক্ত করে দিয়েছি। বইয়ের শেষে অধম চারটি পরিশিষ্ট যুক্ত করেছি,

  1. আল্লামা বিকায়ি তাঁর অপর গ্রন্থ উনওয়ানুয যামান (যা তিনি ৮৪৬ হিজরিতে রচনা করেছেন, তথা আমাদের আলোচ্য গ্রন্থটি রচনার ৯ বছর পর) এ যেসব নতুন তথ্য উল্লেখ করেছেন; সেগুলো একত্রিত করেছি।
  2. বিকায়ী ইবনে হাজারের যেসব গ্রন্থের নাম মোটেই উল্লেখ করেননি; সাখাওয়ির গ্রন্থ থেকে সেগুলোরও তালিকা প্রণয়ন করেছি।
  3. রচনার তারিখ অনুসারে ইবনে হাজারের গ্রন্থগুলোর একটি সূচি সংযুক্ত করেছি।
  4. একাধিক আরবি পাণ্ডুলিপি থেকে ইবনে হাজার এবং বিকায়ির হস্তলিপির কয়েকটি নমুনা পেশ করেছি।

সবমিলিয়ে বইটি এখন ১১০ পৃষ্ঠার। আশা করছি, পাঠক বইটি পাঠ করে ইবনে হাজার সম্পর্কে অজানা বহু বিষয় জানতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। বইটি ছেপেছে বৈরুত (লেবানন)-এর উদীয়মান প্রকাশনী দারুর রাইয়াহিন।

المدخل إلىٰ كتاب الهداية

ফিকহে হানাফির অন্যতম একটি মৌলিক গ্রন্থ হলো আল-হিদায়া। যুগে যুগে দুনিয়া জুড়ে এই আঁকর গ্রন্থটি পঠিত ও চর্চিত হয়ে আসছে। শুধু মুসলিম শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের মাঝেই নয়, অনেক অমুসলিম গবেষকের নিকটও এটি মূল্যবান একটি উৎসগ্রন্থ। সেজন্য পৃথিবীর বহু ভাষায় বইটি ইতোমধ্যে অনূদিত হয়ে গেছে। এমনকি বাংলায়ও।

সেই আল-হিদায়ার ওপর অধমের একটি আরবি কাজ এটি। নাম দিয়েছি আল-মাদখাল ইলা কিতাবিল হিদায়া। অধমের স্বরচিত একটি বই সহ মোট ছয়টি আরবি বইয়ের সংকলন এটি। জর্ডানের অভিজাত আরবি প্রকাশনী দারুল ফাতহ বইটি ছাপাচ্ছে।

এই সংকলনটির পেছনের কাহিনীও একটু বলে রাখি। ১৪৩৩ হিজরি সনে সিলেটের আঙুরা মাদরাসা থেকে ফারিগ হওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতার সুযোগ লাভ করি। মাদরাসার স্বনামধন্য মুহতামিম, সদরে এদ্বারা ও জমিয়ত, উসতাযে মুহতারাম, শায়খ জিয়া উদ্দিন সাহেব হাফিযাহুল্লাহ প্রথম বছরই অধমের দায়িত্বে এই হিদায়ার প্রথম খণ্ড অর্পণ করেন। সে বছর মূল কিতাব পাঠদান শুরুর আগে ভূমিকা স্বরূপ হিদায়া গ্রন্থ এবং গ্রন্থের লেখক সংক্রান্ত কতগুলো বিষয় ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করি। পাশাপাশি সেগুলো নিজে আরবিতে নোট করে রাখি। ১৪৪০ হিজরির রমজানে ১০০ পৃষ্ঠার আমার সেই নোটটি দারুল ফাতহের সত্ত্বাধিকারী ড. ইয়াদ আল-গুজ সাহেবের সামনে পেশ করি। তিনি আমার ছোট্ট পুস্তকটি দেখে চমৎকার একটি পরামর্শ দিলেন। বললেন, আমার মনে হয় আপনার এই রিসালার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক সালাফের লিখিত আরও কয়েকটি রিসালা সংযুক্ত করে একসাথে ছাপালে বইটির ফলপ্রসূতা ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ।

ড. ইয়াদের পরামর্শ আমলে নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। আল্লাহর রহমতে একে একে মোট পাঁচটি রিসালা সংগ্রহ করি:

এক. আল্লামা হামিদ আল-ইমাদী (মৃত্যু ১১৭১ হি. রহ.)। হিদায়ার লেখক ইমাম মারগিনানী (রহ.)র জীবনীর ওপর তাঁর রচিত একটি বই হলো আল-ইকদুস সামীন। এই বইয়ের তিনটি হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করি। একটি মদিনার মাকতাবায়ে মাহমুদিয়্যাহ থেকে। বাকি দুটো দুবাইয়ের মারকাযু জুমুয়াহ আল-মাজিদ থেকে।

দুই. আল্লামা মুহাম্মদ হোসাইন সিন্ধী (মৃত্যু ১২১১ হি. রহ.)। (তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আবিদ সিন্ধী (রহ.)র চাচা। ) তিনি পুরো হিদায়া থেকে ৪৭০ টি উসূল বা মূলনীতি চয়ন করেছেন; যেগুলো থেকে শাখাগত প্রচুর মাসয়ালা বের করা সম্ভব। এ বইটির লেখকের স্বহস্তে লিখিত কপি পড়ে রয়েছিলো মদিনার মাকতাবায়ে মাহমুদিয়্যায়। সেটিও আল্লাহর রহমতে সংগ্রহ করেছি।

তিন. আল্লামা আবদুল হাই লাখনৌবি (মৃত্যু ১৩০৪ হি. রহ.)। তিনি হিদায়া গ্রন্থের ওপর দুটি ভিন্ন সময়ে পৃথক দুটি মুকাদ্দিমা বা ভূমিকা রচনা করেছেন। যেগুলোতে হিদায়া সংক্রান্ত অত্যন্ত জরুরি কতগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি অবশ্য আগে থেকেই হিন্দুস্তানি নুসখার সঙ্গে যুক্ত ছিলো। কিন্তু আরব পাঠকদের অনেকেই এ সম্পর্কে বেখবর ছিলেন। তাছাড়া তুরস্কের সফরে অনেক আহলে ইলমের সঙ্গে কথা বললে তাঁরাও নতুনভাবে এটির ওপর কাজ করতে তাগিদ দিলেন। তাই এটিও এই সংকলনে যুক্ত করে দিলাম; প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে। (প্রসঙ্গত মাওলানা শব্দের ব্যবহার সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধও সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রবন্ধটি রচনা করেছেন এখানকার উদীয়মান তরুণ আলেম মুফতি ইউসুফ শাব্বির সাহেব হাফিযাহুল্লাহ।)

চার. আল্লামা মাহমুদ হামযাওয়ি (মৃত্যু ১৩০৫ হি. রহ.)। তিনি হিদায়া গ্রন্থে লেখকের কিছু রীতিনীতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করেছেন। এটি অবশ্য খুবই ছোট্ট একটি পুস্তিকা।

পাঁচ. মিসরের জামিয়া আযহারের শায়খ বাখিত আল-মুতিয়ি (মৃত্যু ১৩৫৪ হি. রহ.)। তিনি আযহারে হিদায়া পড়াতেন। তাঁর নিয়ম ছিলো, প্রতিবছর হিদায়া পাঠদান শেষে একটি বিশেষ দারস দিতেন। সেই বিদায়ী দারসের আলোচনাগুলোই পরবর্তী সময়ে বুগইয়াতু আহলিদ দিরায়া মিন খাতমি কিতাবিল হিদায়া নামে ছাপিয়েছেন। চমৎকার একটি বই।

তো আমি এইসব গ্রন্থ সংগ্রহ করে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। প্রতিটি বইয়ের শুরুতে ভূমিকা সংযুক্ত করেছি। ভূমিকায় বইয়ের লেখকের জীবনী এবং তার বই সম্পর্কিত বিবিধ তথ্য উপস্থাপন করেছি। তাছাড়া প্রতিটি বইয়ের নীচে অধম জরুরি টীকাটিপ্পনীও সংযোজন করেছি প্রয়োজনমতো। আর আমার নিজের লিখিত মাবাহিস আনিল ইমাম মারগিনানি ওয়া কিতাবিহিল হিদায়াতে হিদায়া গ্রন্থে বিবৃত হাদীসগুলোর মান নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। সবমিলিয়ে ৫৯২ পৃষ্ঠার এই সংকলনটি পাঠকদের জন্য উপকারী একটি বই হিসেবে কাজ দেবে বলে আমি দৃঢ় আশাবাদী। আল্লাহ তায়ালা নাচিজের এই সামান্য শ্রমটুকু কবুল করে নিন- এই দুআ করছি।

منار الإصطفا في بيان

أسماء حلاق المصطفىٰ

বইটির নাম থেকেই বিষয়বস্তু একেবারে স্পষ্ট। বস্তুত নবীজি (সা.) জীবনে কখন, কোথায় ও কতবার স্বীয় মাথা মোবারকের চুল কেটেছিলেন এবং সেই সৌভাগ্যবান সাহাবিগণের নামই বা কী; যাঁরা নবীজির চুল মোবারক হলক বা কাটার মহত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছিলেন—এরকম কতগুলো প্রশ্নের চমৎকার উত্তর বিবৃত হয়েছে এই বইয়ে। আমাদের জানামতে, এবিষয়ে এটিই সর্বপ্রথম কোনো স্বতন্ত্র বই।

মাত্র চার পাতার মূল আরবি পাণ্ডুলিপিটি ইস্তাম্বুল থেকে আমার সংগ্রহে আসে মাসকয়েক পূর্বে। ব্যস্ততার কারণে কাজে হাত দিতে একটু দেরি হয়েছে। মূল পাণ্ডুলিপি সংকলন করেছেন আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আত-তাফিল্লাতী (মৃত্যু ১১৯১ হি. রহ.)। তিনি মসজিদে আকসা এর গ্র্যান্ড মুফতি ছিলেন দীর্ঘকাল। মরক্কো তাঁর জন্মভূমি হলেও তিনি পৃথিবীর বহু দেশে সফর করেন এবং অবশেষে ফিলিস্তিনেই অবস্থান করেন।

কয়েকশত বছরের পুরনো এই পাণ্ডুলিপির ওপর কিছুটা কাজ করতে হয়েছে। শুরুতে মুকাদ্দিমা সংযোজন; সেখানে বইয়ের গুরুত্ব ও আলোচ্য বিষয়, লেখকের জীবনী এবং পাণ্ডুলিপি সংক্রান্ত বিষয়াদি আলোচনা করা হয়েছে। আর বইয়ে উপস্থাপিত প্রতিটি তথ্যের মূল উৎসগ্রন্থের রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সম্পূরক কতগুলো তথ্য যুক্ত করা হয়েছে টীকাটিপ্পনীতে৷ সবমিলিয়ে পৃষ্ঠাসংখ্যা হয়েছে অর্ধশত। বইটি ছেপেছে জর্ডানের অভিজাত আরবি প্রকাশনী দারুল ফাতহ। আল-মাদখাল ইলা কিতাবিল হিদায়া এবং মানারুল ইসতিফা; উভয়টিই একসঙ্গে লাইব্রেরিগুলোতে এসে পৌঁছাবে ইনশাআল্লাহ।

كتاب الرضاع

রমজানের পূর্বে, এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে দারুল হাদীস আল-কাত্তানিয়ার সত্ত্বাধিকারীগণের একজন, শায়খ মুহাম্মদ আশ-শাআর অধমকে এই কাজটি করার ফরমায়েশ করেন। তখন ছিলো লকডাউন! সেই সুযোগ কাজে লাগাতেই আমি সাদরে তা গ্রহণ করে নেই।

তারা মূল আরবি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত প্রাচীনতম গ্রন্থাগার মুরাদ মুল্লা থেকে। এটি রাযা বা দুগ্ধপান বিষয়ক শরয়ি বিধিবিধান সংক্রান্ত একটি মৌলিক গ্রন্থ। মূলগ্রন্থটি রচনা করেছেন ইমাম আবু বকর আল-খাসসাফ (মৃ. ২৬১ হি. রহ.)। ফিকহে হানাফির অনুসারী এই প্রাজ্ঞ আলেম মূলত ইমাম বোখারি এবং ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসের সমসাময়িক। বস্তুত একাধিক শায়খ থেকে হাদীস শিখার ক্ষেত্রে তাঁরা ছিলেন সহপাঠী।

ইমাম আবু বকর আল-খাসসাফ (রহ.) একজন বিচারপতিও ছিলেন। সেজন্য ইসলামি শিক্ষার আলোকে বিচারকার্য সম্পাদন করার নিয়ম-পদ্ধতি নিয়েও তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রায় বিশটি মহামূল্যবান গ্রন্থের সংকলক এই মনীষীর এযাবৎ মাত্র চারটি গ্রন্থ ছাপা হয়েছে। আমাদের এই কাজটি পঞ্চম হবে ইনশাআল্লাহ।

অধম পাণ্ডুলিপি নিরীক্ষণের সৌভাগ্য অর্জন করেছি। শুরুতে লেখক, বইয়ের বিষয় এবং পাণ্ডুলিপি সংক্রান্ত বিবিধ জরুরি প্রসঙ্গ নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটি ভূমিকা সংযোজন করেছি। তাছাড়া গ্রন্থে উদ্ধৃত সবগুলো হাদীসের তাখরিজ বা সূত্র উল্লেখ করেছি। প্রয়োজনমতো টীকাটিপ্পনীও যুক্ত করেছি বইয়ের একাধিক জায়গায়। সবমিলিয়ে ১৬৪ পৃষ্ঠার এই বইটি গবেষকদের জন্য একটি রেফারেন্স বুক হিসেবে কাজ দেবে বলে আমি দৃঢ় আশাবাদী।

المدخل إلىٰ معرفة كتاب الإكليل

বাংলাদেশ থেকে কিতাবটি হাদিয়া পাঠিয়েছেন প্রিয় ভাই মাওলানা ফয়েজ আহমদ। আমি তাঁর এমন অমূল্য হাদিয়ার শুকরিয়া জানাচ্ছি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। মাওলানা ফয়েজ আহমদ এর সঙ্গে দেখা বা কথা কিছুই হয়নি। অনলাইনে যা কিছু একটু পরিচয়। তবে তাঁর সম্পর্কে শুনে মুগ্ধ হয়েছি। একজন পরিশ্রমী ও প্রতিভাধর উদীয়মান তরুণ আলেম তিনি। বিজ্ঞজনের স্নেহধন্য এই জ্ঞানপিপাসু আগামী সময়ে মিশর যাচ্ছেন আরও ইলম অর্জন করতে, জ্ঞান ও অভিজ্ঞানে আরও সমৃদ্ধ হতে। মাখতুতাত বা প্রাচীন আরবি ইসলামি পাণ্ডুলিপি তাহকিক বা নিরীক্ষণ কাজে তাঁর বেশ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।

এই যে কিতাব তিনি পাঠিয়েছেন সেটা মূলত একটি আরবি পুস্তিকা এবং একটি উর্দু নিবন্ধের যৌথ সংকলন। মাওলানা ফয়েজ আহমদ এবং মাওলানা উবায়দুল্লাহ যৌথভাবে সংকলনটির ওপর কাজ করে ছাপানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।

এক. ইমাম আবু আবদিল্লাহ আল-হাকিম (রহ.)-এর আল-মাদখাল ইলা মারিফাতি কিতাবিল ইকলিল নামক গ্রন্থটি উলুমুল হাদীস বিষয়ে রচিত প্রথমদিককার গ্রন্থসমূহের অন্যতম। আরবি এই বইটি কলেবরে ছোট হলেও তার উপকারিতা শাস্ত্রজ্ঞদের নিকট স্বীকৃত। যদিও ইতোমধ্যে মূল্যবান এই কিতাবটির একাধিক সংস্করণ বের হয়ে গেছে, কিন্তু সেগুলোতে মুদ্রণপ্রমাদ এবং অন্যান্য ভুল ছিলো উল্লেখযোগ্য। সেজন্য মাওলানা ফয়জ আহমদ এবং তার সহযোগী মাওলানা উবায়দুল্লাহ নতুনভাবে কিতাবটির ওপর কাজ করে নির্ভুলভাবে ছাপাতে উদ্যোগী হন। তারা শুরুতে লেখক ইমাম হাকিম এর জীবনী উল্লেখ করেন, কিতাবের অন্যান্য নুসখা বা কপির বিশ্লেষণ করেন, প্রয়োজনমত একাধিক জায়গায় আরবিতে টীকাটিপ্পনী সংযুক্ত করেন।

দুই. আল্লামা আবদুর রশিদ নোমানি (রহ.) এর তাবসেরাহ বর আল-মাদখাল জ্ঞানগর্ভ দীর্ঘ একটি উর্দু প্রবন্ধ। সেখানে তিনি উপর্যুক্ত ইমাম হাকিমের আল-মাদখাল কিতাবের ওপর বিশদ পর্যালোচনা করেন। এটি ছিলো আল্লামা নোমানির লেখা প্রথম কাজ। প্রবন্ধটি বিদ্বানমহলে বেশ সমাদৃত হয়েছিলো। প্রথম ছাপা হয় আল-বুরহান ম্যাগাজিনে ৬ কিস্তিতে। পরবর্তী সময়ে পুস্তিকাকারে ছাপা হলেও এখন আর তা সহজলভ্য নয়। তাই তরুণ এই দুই আলেম পুনরায় কিতাবটি ছাপানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে বইয়ের শুরুতে আল্লামা আবদুর রশিদ নোমানী (রহ.)-এর জীবনী আলোচনা করেছেন আরবিতে। কিতাবের অনেক জায়গায় অনুসন্ধিত টীকাটিপ্পনী সংযুক্ত করেছেন উর্দুতে, আবার কোথাও আরবিতে।

উদীয়মান এই তরুণ দুই আলেম তাদের কাজের ওপর মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য। তারা অনেক সময় ও শ্রম দিয়েছেন এর পেছনে। উন্নত ছাপা আর ঝকঝকে কাগজ সংকলনটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। তাছাড়া সংযোজিত নির্ঘণ্টগুলো পাঠকদের জন্য উপকৃত হওয়ার পথ সহজ করে দিয়েছে। চমৎকার প্রচ্ছদে দুইশত পৃষ্ঠার এই সংকলনটি ছেপেছে ঢাকার দারুল মুসান্নাফাতিল ইলমিয়্যাহ। ঢাকার মাকতাবাতুল আযহার, মাকতাবাতুল হাসান প্রভৃতি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে এটি সংগ্রহ করা যাবে।

তবে আমার বড় আকাঙ্ক্ষা হয় যে, তারা যদি একটু কষ্ট করে আল্লামা নুমানী (রহ.)-এর উর্দু প্রবন্ধটি আরবিতে রূপান্তর করে দিতেন। এতে ইমাম হাকিম (রহ.) এর পর্যালোচনায় লিখা নোমানি এর ওই ইলমি নিবন্ধ থেকে আরব পাঠকগণও লাভবান হতে পারবেন এবং সংকলনটি আরবেও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। আশা করি, পরবর্তী সংস্করণে তারা সেটা বিবেচনায় রাখবেন।

تلخيص إعلاء السنن

পাক-ভারত উপমহাদেশে তো বটেই, আরব বিশ্বেও হানাফি ফিকহ অনুসারীদের নিকট ইলাউস সুনান গ্রন্থটি বেশ পরিচিত ও সমাদৃত। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে কিতাবটি সংকলন করেন তাঁরই সুযোগ্য ভাগিনা আল্লামা যফর আহমদ উসমানী (রহ.)। হানাফি ফিকহের দলিলের জন্য এটাকে হাদীস বিষয়ক একটি বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। হাদীসের মতন (পাঠ), তথ্যসূত্র ও বর্ণনাসূত্র উল্লেখ করত সেগুলো নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা করা হয়েছে। আরবের বহু বিদগ্ধ হাদীসবিদ কিতাবটির প্রশংসা করেছেন। শুরুতে আছে বিস্তারিত দুটি ভূমিকা। একটি হাদীস ও উসূলে হাদীস বিষয়ক; যা পরবর্তী সময়ে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) এর মূল্যবান তাহকিকসহ ‘কাওয়াইদ ফি উলুমিল হাদীস’ শিরোনামে পৃথকভাবে ছাপা হয়েছে। আর ওপরটি ফিকহ বিষয়ক; যা পরবর্তী সময়ে আল-ইমাম আবু হানিফা ওয়া আসহাবুহুল মুহাদ্দিসুন নামে আলাদাভাবে ছাপা হয়েছে। শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানি সাহেব হাফিযাহুল্লাহ তাঁর কর্মজীবনের সূচনালগ্নে কিতাবটির ওপর সংক্ষিপ্ত কিছু টীকাটিপ্পনীও সংযুক্ত করেছিলেন। এ যাবত বিশাল এই গ্রন্থের একাধিক সংস্করণ বের হয়েছে। আরব ও অনারব উভয় জায়গা থেকে। খণ্ড সংখ্যা সংস্করণ অনুপাতে বেশকম হলেও গড়পড়তা ২০ বলা যায়।

২০ খণ্ডের বৃহৎ এই গ্রন্থ সংগ্রহ করা এবং তা পাঠ করে উপকৃত হওয়া সকলের জন্য সহজ নয়। সেজন্য এর একটি সারসংক্ষেপের প্রয়োজন বোধ হচ্ছিল বহুদিন থেকে। আলহামদুলিল্লাহ! সিলেটের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া দরগাহ এর সম্মানিত মুহাদ্দিস মাওলানা আতাউর রহমান সাহেব হাফিযাহুল্লাহ এই গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন। তিনি তালখিসু ই’লায়িস সুনান শিরোনামে কিতাবটির একটি আরবি সারনির্যাস তুলে দিচ্ছেন। ২০১৪ সালে তাঁর এই কাজের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। আর এবছর দ্বিতীয় খণ্ড ছাপা হলো।

হযরত মাওলানা আতাউর রহমান সাহেব শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি সাহেব হাফিযাহুল্লাহর আস্থাভাজন শিষ্য। তাঁর এই কর্মের স্বীকৃতি দিয়ে প্রশংসা করেছেন স্বীয় উসতায আল্লামা উসমানিসহ বরেণ্য কয়েকজন আলেম। কিতাবটি প্রকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বার্মিংহাম মুসলিম সোসাইটি। টাইপিং ও অঙ্গসজ্জার কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়েছেন প্রতিভাবান তরুণ আলেম মাওলানা হাফিয আবদুল্লাহ আল-ফাহিম।

تذكرة الأعلام السود

সদ্য ছাপা হওয়া মূল্যবান এই আরবি বইটি হাদিয়া পাঠিয়েছেনএর লেখক, ইংল্যান্ডের উদীয়মান মুফতি, ব্লাকবোর্ন মাদরাসার উসতাযুল হাদীস, মাওলানা মুফতি ইউসুফ শাব্বির সাহেব হাফিযাহুল্লাহ। ২১৪ পৃষ্ঠার এই চমৎকার গ্রন্থে বিজ্ঞ লেখক এমন ১০১ জন মনীষীর জীবনী আলোচনা করেছেন; যাদের রঙ ছিলো কালো৷ নির্ভরযোগ্য উৎসগ্রন্থ থেকে তিনি সেসব মনীষী সংক্রান্ত দুর্লভ বহু তথ্য এতে সন্নিবেশিত করেছেন৷

সবচেয়ে বড় কথা হলো, বইটির সপ্রশংস ভূমিকা লিখে দিয়েছেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি সাহেব হাফিযাহুল্লাহ। ভূমিকায় তিনি বলেন, বইটি আমি আদ্যোপান্ত পড়েছি বুদাপেস্টের একটি সফরে, গাড়িতে বসে। আর ভূমিকাটি লিখেছি বুদাপেস্ট থেকে ফেরার পথে, বিমানে বসে।

পাঠকমুগ্ধ এই গ্রন্থটি ছেপেছে তুরস্কের দারুস সাম্মান। প্রকাশকের সঙ্গে লেখকের প্রথম পরিচয়ের ক্ষেত্রে অধম ছিলাম সামান্য একটা মাধ্যম। আজ সম্মানিত লেখক নিজ বদান্যতায় হাদিয়াস্বরূপ গ্রন্থটি পাঠিয়ে দিলেন অধমের ঠিকানায়। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে উত্তম বিনিময় দান করুন। বাংলাদেশের আগ্রহী পাঠকগণ বইটি ঢাকার মাকতাবাতুল আযহার থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। আর ইংল্যান্ডের আগ্রহী পাঠকগণ যাকারিয়া বুকশপ (অনলাইন) থেকে অর্ডার করে নিতে পারেন।

লেখক: উসতাযুল হাদীস, মাদানী মাদরাসা, লন্ডন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ