মূল: সাইয়িদা সাদিয়া গজনভী
অনুবাদ: খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ
মানবসমাজে শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে মাদকের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত ছিলো এবং আছেও। আবহমানকাল থেকে মনুষ্য সমাজের একটি অংশ প্রথমে মানসিক যন্ত্রণা ভোলার জন্য এবং পরে অভ্যাসের বশে মাদক গ্রহণ করেই আসছে। এশিয়া মাইনর থেকে ভারতে আসা অভিবাসী লোকেরা সঙ্গে করে গাঁজা (Fermeted liquor) নিয়ে আসে।
তাদের চিরাচরিত রেওয়াজ ছিলো, মানসিক যন্ত্রণা ভুলে থাকার অজুহাতে নেশায় ডুব দিতো এবং পরে এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। গাঁজা ও আফিম মূলত চীন ও ভারতে উৎপাদিত হয়। মন্দিরের পুরোহিতগণ গাঁজার উৎসবমুখর আসরে গলা ডুবিয়ে পান করে এবং ভক্তদেরকে পান করায়। গ্রীষ্মের মৌসুমে উলঙ্গ হয়ে সারা শরীরের ছাই মেখে ভাঙ পান করতো। শীতকালে ‘ঠাণ্ডা থেকে বাছার জন্য’ সেবন করতো আফিম আর গাঁজা।
মাদক অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদেরও প্রাত্যহিক অভ্যাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি উপাসনায়সমূহে আঙুরের মদে রুটি ভিজিয়ে তবারক বিতরণ করা হতো। নিষ্ঠাবান ভক্তরা খুবই ভক্তির সঙ্গে তা আহার করে। আমেরিকার মেক্সিকো ও কলম্বিয়ায় মরু অঞ্চলে ক্যাকটাস আপনাআপনি জন্মায়। দক্ষিণ আমেরিকার লোকদের মাঝে এ-ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, এটি খুবই পবিত্র উদ্ভিদ। যে কারণে স্থানীয়ভাবে এর নাম দেওয়া হয় Secred Mushroom রাখা হয়। বরং এটাকে Gods Fleshও বলা হয়। এর রাসায়নিক উপাদান স্নায়ু শীতলকারক। কিন্তু এর উপাদানগুলো মিলিত ও প্রক্রিয়াজাত হবার তা অন্যান্য অ্যালকোহল থেকে আলাদা; বরং এটি সেবনের ফলে চোখের সামনে কল্পিত বস্তু ভেসে ওঠে এবং তার মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হয়। কাল্পনিক বিষয়াদি (বাস্তবের মতো ভেবে) আওড়ায়। এটা গ্রহণের পর বারবার এর স্বাদ গ্রহণের জন্য মন অস্থির থাকে। এ স্বাদ বস্তুত, একটি মস্তিষ্কসৃষ্ট ও কল্পিত বস্তু। যাকে হ্যালোসিনেশন বলা হয়। এ অবস্থার বারবার সৃষ্টি হওয়া মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ। এ ধরনের মাদক দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়। ক্যাকটাসকে আরবি ‘জাক্কুম’ বলা হয়। আমেরিকায় এটার বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে এলএসডি। যেসব মাদকসেবীর কাছে এর কদর বেশি তাদের মতে এ-মাদক মানুষকে কল্পনার এক অত্যুচ্চ জগতের এক রঙিন দুনিয়ায় নিয়ে যায়। কোকেন গ্রহণকারীদের অবস্থাও এমনটাই হয়। কলম্বিয়া, নিগারাগুয়াসহ দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য প্রদেশ ছাড়াও বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কোকেন চাষ হয়।
সেকেন্ড ফ্রয়েড প্রথম ব্যক্তি যিনি আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতিতে কোকেন চোখের যখম উপশমের জন্য কোকেনের ব্যবহার করেন কিন্তু তিনি একটা মন্দ কাজের সূচনা করেছেন জিনিসটি তার বন্ধুর ওপর শক্তিবর্ধক ওষুধ হিসেবে এক্সপেরিমেন্ট করে। তার বন্ধুকে এভাবে তিনি কোকেনের নেশায় আসক্ত করে দিলেন। চোখের আঘাত উপশমে এটি উপকারী মেডিসিন হলেও কিন্তু মানবদেহে প্রবেশ করার পর এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুধরনের প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে। মানসিক অবসাদ দূর করার জন্য এটি প্রথম ও অদ্বিতীয় ওষুধ। মনের ভাবনাকে নতুনভাবে বিন্যাস ও সুগঠিত করে অধিকন্তু মস্তিষ্কের পরিশ্রম করে এমন লোকদের জন্য এটি অসাধারণ শক্তিবর্ধক। বৃটিশ ঔপন্যাসিক ড. আর্থার কোনন ডয়েল তার অসাধারণ সৃষ্টি শার্লক হোমস এ দেখিয়েছেন কোকেনের নেশা করে জীবনে সফল হওয়া যায়। এর ফলে মানুষ (পাঠক) ব্যাপকভাবে উৎসাহিত হয় আর সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। অথচ কোনন ডয়েল যা লিখেছেন তা পাঠককে বিণোদিত করার কৌশল ছিলো। বৃদ্ধ লোকদের শক্তি বাড়ানোর টনিক হিসেবে কোকেনের পাতা চিবানো উপকারী। বিশ শতক থেকে ঊঢঞজঅঈঞ ঈঙঈঅ কে শক্তির উপকরণ বিবেচনা করা শুরু হয়। কোকেনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সেবনকারীদের নাকের মধ্যে ছিদ্র হতে দেখা গেলো। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে কোকেন সেবনের কারণে মস্তিষ্ক বিকৃতি যাকে হ্যালুসিনেশন বলা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এটাকে মেন্টাল ইউপোরিয়া বলে থাকেন। এই রোগী কল্পনার জগতে নিজের স্বপ্নরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বাস্তবতা থেকে ছিটকে পড়ে। ফলে সে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ নয় বরং মানসিক রোগীতে পরিণত হয়।
ক্রমাগত হজম ও দুর্বলতা মস্তিষ্কের দুর্বলতা ফলে এক পর্যায়ে পাগল হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
গাঁজা, আফিম ও ভাঙ …..ও তার সম্মিলিত উপকরণ ছাড়াও আজকল আফিম থেকে গৃহীত রাসায়নিক পদার্থ মারফিন দ্বারা হিরোইন ইত্যাদি মাদক তৈরির প্রবণতা বেড়েছে। এর পেছনে মাদক ব্যবসায়ীদের বড়সড় ভূমিকা রয়েছে। ওরা ভালো পরিবারের ছেলেদের জন্য স্কুলগুলোতে বিনামূল্যে এটা পরিবেশন করে। এটি গ্রহণের পর তার অভ্যাস গড়ে উঠতে সময় লাগে না। বিষন্নতা ছাড়াও দ্রুত শরীরের ওজন কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শারীরিক অক্ষমতার দিকে ঠেলে দেয়।
একসময় নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য তারা ঘর থেকে জিনিসপত্র চুরি, ছিনতাই, হাইজাক ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। মাদক ব্যবসায়ীদের এরূপ বাড়ন্ত উৎস থেকে মুনাফা বেশ পছন্দের! যেমন পাকিস্তানে যে হিরোইন এক কেজি চল্লিশ রুপিয়া, ভারতে তা দুইলাখ রুপি আর আমেরিকায় বিশ লাখ টাকারও বেশি। এ-অভিশপ্ত উপার্জন সঙ্গে জড়িয়ে অনেক মেধাবী ও প্রতিষ্ঠিত লোক লাখলাখ টাকার এই উৎসের বেলায় লোভ সামলাতে পারছেন না। হিরোইনের স্মাগলিং এ ধরা খেয়ে সমাজের ওপর তলার অনেক লোক মান সম্মান খুইয়েছেন। কেউ জেল-জরিমানা থেকে বাঁচলেও অপমান রেহাই পাইনি।
ইতিহাসের প্রতিটি যুগে বিভিন্ন চেহারায় সমাজের মাদকের উপস্থিতি ছিলো। কখনও বলা হতো মনের কষ্ট মুছে ফেলার জন্য মাদক গ্রহণ করতে হয়, কখনও চাউর করা হয়েছে মুড ভালো করার জন্য আবার কতিপয় লোক বলতে চান, পরিমিত মাত্রার মাদক গ্রহণ মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। যেমন কোনো আসরে কবিতা আবৃত্তি, গান পরিবেশন বা বক্তৃতার আগে এক প্যাক হুইস্কি মন থেকে ভীতি দূর করতে সাহায্য করে। পাকিস্তানে নাট্য শিল্পীরা মঞ্চে বা টেলিভিশনের স্টুডিওতে যাওয়ার আগে গাঁজা সেবনের অভ্যাস ব্যাপক।
যদি মাদক গ্রহণের ফলেই যদি আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় অথবা একবার যখন এমনটি মনে হয়েছে তবে প্রত্যেকবারই তা গ্রহণের অভ্যাস গড়ে উঠবে। অন্যভাবে বললে, মাদক, গাঁজা ইত্যাদি গ্রহণ ছাড়া কবিতা, সংগীত পরিবেশন ও বক্তৃতা করাই যেতো না।
ইউরোপীয় দেশগুলোতে যুদ্ধ চলাকালে সৈন্যদেরকে মদ সরবরাহ করা হয়। তাদের ধারণা হলো, মদ পান করার পর তাদের মধ্যে ভয়ভীতি থাকে না। অথবা এভাবে বলতে চায় যে, মদ্যপান করার পর সৈন্যদের মস্তিষ্ক ভালোমন্দের হিসেব করতে পারে না। তারা হিতাহিত জ্ঞান ছাড়াই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিভিন্ন দেশের দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলের জমিদারগণ তাদের কর্মচারীদের মদ পান করিয়ে এমন লোকদের বিরুদ্ধে তাদেরকে লেলিয়ে দেয় যাদের সঙ্গে এই কর্মচারীদের কোনো শত্রুতা নেই। সহজ কথায় নেশা করার পর মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে।
ইউরোপীয় দেশ বরং বর্তমানে দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে মদের আড্ডা হয় না। গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি লোক মদ পান করে এবং এটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক অনুষ্ঠান-উৎসবে মদ পান করা না হলে ব্যক্তিত্ব চুরমার হয়ে যায়। জনজীবনে মাদকদ্রব্যের প্রভাব নতুন কিছু নয়। কিন্তু ড. আইওন বালুখ তার বিখ্যাত গ্রন্থ অল লাইফ অব আওয়ার টাইমস-এ মানুষের নৈতিক চরিত্রকে মাদক কীভাবে প্রভাবিত করে তার সামগ্রিক চিত্র এঁকেছেন। সেখানে তিনি একটি চমৎকার গল্প বর্ণনা করেন, ‘বার্লিনে যখন ওয়ার্ল্ড মেডিকেল কংগ্রেস অনুষ্ঠানে গোটা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসকগণ অংশ নেন। সেখানে অধিকাংশ মধ্যবয়স্ক লোক শারীরিক প্রতিবন্ধী বা পঙ্গু। জার্মানি ভ্রমণের সময় মিউনিখের মিনিসিপ্যাল কমিটি তাঁদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করে। খাওয়া-দাওয়া শেষে তারা (বিনামূল্যে পরিবেশিত) মদ এত বেশি পরিমাণে পান করেছে কারো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। রাস্তায় বের হওয়ার পর চোর-ছেচ্চর, ছিনতাইকারী, নিশাচরেরা তাদের পকেট খালি করে দেয়। অথচ তাঁদের অধিকাংশই স্বাভাবিক জীবনে এরূপ উচ্ছৃঙ্খল ও বল্গাহীন কাণ্ডকারখা পছন্দ করেন না। পরদিন সকালে কোনো ডাক্তারের পকেটে টাকা নেই, কারো হাতঘড়ি হাওয়া!
অনেকের অবস্থা ছিলো আরও শোচনীয়! কারও গায়ের শার্ট, কোট ইত্যাদি নেই। সড়কে ও পার্কে কনকনে শীতে কাঁপছিলো। শেষে জার্মানির মেডিসিন কোম্পানিগুলো তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক-পরিচ্ছদ ও জিনিসপত্র সরবরাহ করে এবং একটি বৈশ্বিক চিকিৎসক সম্মেলন থেকে তারা লজ্জা ও অপমান নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলো।