জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিবিসি-এর সঙ্গে তিন নারীর সাক্ষাৎকার ‘আমরা কেন আর ফরাসি পণ্য ব্যবহার করছি না’

মিশিখান, লাতিফ ওজদেমির হিবা মুহাম্মদ মুসা

 

তুরস্ক থেকে বাংলাদেশ, জর্ডান থেকে মালয়েশিয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফরাসী পণ্য বয়কট করার আন্দোলন চলছে। এসব দেশের কিছু কিছু সুপার মার্কেটের শেল্ফ থেকে ‘মেইড ইন ফ্রান্স’ লেবেল লাগানো জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সোশাল মিডিয়াতেও বয়কট ফ্রেঞ্চ প্রডাক্টসের মতো হ্যাশট্যাগ শেয়ার করা হচ্ছে। ফ্রান্সে এক স্কুল শিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করার পর ইসলাম সম্পর্কে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁর মন্তব্যের জের ধরে মুসলিম দেশগুলোতে এ আন্দোলন শুরু হয়েছে। শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ক্লাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে পড়ানোর সময় ইসলামের নবীর কার্টুন দেখিয়ে ছিলেন। এরপরই তাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইসলামের সমালোচনা করে ‘কট্টর ইসলামের’ বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। মি. ম্যাক্রঁ বলেন, ওই শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে কারণ ইসলামপন্থিরা আমাদের ভবিষ্যৎ কেড়ে নিতে চায়। কিন্তু ফ্রান্স এসব কার্টুন প্রকাশ বন্ধ করবে না।

এর আগে ২০০৬ সালে শার্লি এব্দো ম্যাগাজিনে ইসলামের নবীর কিছু কার্টুন প্রকাশিত হলে তখনও সারা বিশ্বে বহু মুসলিম ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। পরে নিস শহরে একটি গির্জায় চালানো হামলায় আরও তিনজন নিহত হয় এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এই হামলাকেও ‘ইসলামপন্থিদের সন্ত্রাসী হামলা’ বলে উল্লেখ করেন। তবে বাংলাদেশসহ মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করে ফরাসি পণ্য বর্জনের ডাক দিচ্ছে।

বিবিসি তিন নারীর সঙ্গে কথা বলেছে যারা ফরাসি পণ্য আর না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মিশিখান

অভিনেত্রী, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান

আমি ফরাসি পণ্য ব্যবহার করতাম, বিশেষ করে ল’রিয়েল। এটা পাকিস্তানে খুব সহজে পাওয়া যায়। এখন আমি কিছু কেনার আগে তার গায়ে লাগানো লেবেল দেখে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করি যে সেটা ফ্রান্সের তৈরি কোন পণ্য নয়। ফরাসি পণ্যের বদলে আমি এখন পাকিস্তানি পণ্য ব্যবহার করছি।

কেন? কারণ একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করে একদিন জেগে ওঠে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অপমান করতে পারেন না। আমি সোশাল মিডিয়াতে সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি ফরাসি পণ্য বয়কট করার জন্য। আমার বিবেক অত্যন্ত পরিষ্কার, কারণ ইসলামের পক্ষে আমার অবস্থান তুলে ধরার জন্যই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমাদের ধর্ম ও নবীকে নিয়ে অনেকে মজা করেছে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। যারা ইসলামকে অপমান করেছে তাদেরকে আমরা ক্ষমা করে আসছিলাম কিন্তু এখন আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমার মনে হয় ম্যাক্রঁ উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা যেন কাউকে চিমটি কেটে, ‘এই তুমি কি ব্যথা পাচ্ছ’ এ রকম কিছু জিজ্ঞেস করার মতো। আমার মনে হয় এটা আরও বড় কিছুর অংশ আমার ধারণা তিনি ঘৃণা তৈরির চেষ্টা করছেন। তিনি লোকজনকে বিভক্ত করছেন এবং উস্কানি দিচ্ছেন।

তিনি অনিষ্টকর এবং তার বক্তব্য ইসলাম-বিদ্বেষকে আরও ছড়িয়ে দেবে। একটি দেশের প্রেসিডেন্ট যা বলেন সেটি তার দেশের জনগণকে প্রভাবিত করে। তার তো উচিত ছিল সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সবাইকে সমানভাবে সম্মান জানানো। আমি যখন প্রথম শার্লি এব্দোর কার্টুনগুলো দেখি, তখন নির্বাক হয়ে যাই। প্রথমে আমি এগুলো এড়িয়ে চলি কিন্তু পরে যখন দেখি আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। আমি কেঁদে ফেলি। আমি আল্লাহকে প্রশ্ন করি, ‘কেন আমি এমন জিনিস দেখতে গেলাম?’

লাতিফ ওজদেমির

ছাত্রী, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক

আমি প্রায় প্রতিদিনই কিছু ব্র্যান্ডের জিনিস ব্যবহার করতাম। তার মধ্যে রয়েছে গার্নিয়ে, লাকুম ও বিআইসি। কিন্তু এই ঘটনার পর আমি এসব পণ্যের কোনটাই আমি আর কিনবো না। ফরাসি পণ্য আমি বয়কট করছি, কারণ আমি বলতে চাই যে আমরা এটা আর গ্রহণ করবো না। আমি ফ্রান্সের ইসলাম-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই। মুসলিম হিসেবে এ বিষয়ে কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা অনেকদিন হল চুপ করে আছি। ঠিক এখন আমরা যেটা করতে পারি তাহল পণ্য বর্জন করা।

শার্লি এব্দো আরেকটি আক্রমণাত্মক কার্টুন প্রকাশ করেছে যাতে আমাদের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে দেখানো হয়েছে যে তিনি প্যান্টপরেননি, শুধু একটি টি-শার্ট পরে আছেন। তার এক হাতে বিয়ার এবং আরেক হাত দিয়ে হিজাব পরিহিত মুসলিম এক নারীর স্কার্ট তুলে ধরেছেন। যারা হিজাব পরেন তাদেরকে এই কার্টুন আহত করবে।

আমার মতো মুসলিম নারীরা প্রতিদিনই ইসলামের ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে সংগ্রাম করছেন। সমাজে তারা আর সকলের সমান একটা অবস্থান গড়ে তুলতে চায়। চায় তাদেরকে যেন গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এই কার্টুন দেখলে মনে হয় ইউরোপ কখনোই আমাদেরকে একজন অমুসলিম নারীর সমান করে দেখবে না, যা আমাদের জন্য সত্যি দুঃখজনক। কার্টুন এবং স্যাটায়ার গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক এবং চিন্তাকে উস্কে দেয়। কিন্তু ইউরোপ মুসলিমদের গৎবাঁধা চিত্র তুলে ধরছে। এ ধরনের কার্টুন এঁকে প্রতিবারই আগুনে আরও বেশি করে তেল ঢালা হচ্ছে। আমরা কি এ রকম কিছু চাই যে এই বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমরা একে অপরকে আক্রমণ ও ঘৃণা করবো?

হিবা মুহাম্মদ মুসা

ছাত্রী, নুয়াকচট, মৌরিতানিয়া

ফ্রান্সে যা হচ্ছে তার প্রতিবাদে বিক্ষোভে আমি আমার পরিবার ওব ন্ধুদের নিয়ে যোগ দিয়েছি। ফরাসি অর্থনীতি ধসেপ ড়বে এই আশায় আমরা ফরাসি পণ্য বয়ক টকরছি। আশা করছি যে ম্যাক্রঁ ঘৃণাসূচক বক্তব্য দেওয়ার জন্য দুশো কোটি মুসলিমের কাছে ক্ষমা চাইবেন। লাফিংকাউচিজের বদলে আমরা এখন তুর্কি পণ্য ক্রয় করছি। আমার কাছে লাকোস্টের মতো কিছু ফরাসি পারফিউম ছিল। এসব বোতল শেষ হয়ে গেলে আমি এটা আর কিনছি না।

প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ যাতে ক্ষমা চান এই দাবি জানিয়ে আমি তাকে একটি চিঠি লিখেছি। চিঠিতে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি, যদি তার শিক্ষক সম্মান জানানোর মতো মানুষ হন, তাহলে আমাদের নবীদের বেলায় কী হবে, তারাও তো শিক্ষক! আমাদেরকে যেটা সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ করেছে তাহল তারই সলাম-বিদ্বেষী বক্তব্যে ইসলামকে বর্বর তার সঙ্গে তুলনা করা। এটা অন্যায় এবং উস্কানি যা আমরা আর সহ্য করতে পারবো না।

ফ্রান্সের মতো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট এমন ছবির পক্ষে কথা বলতে পারেন না যা একটি জনগোষ্ঠীর জন্য অপমানজনক। এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। বরং এটা হচ্ছে বিশেষ একটি ধর্মীয় গ্রুপের ওপর আক্রমণ। এটা খুবই সস্তা একটি বিষয়। এর মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় কিছু অর্জন করতে চান। শার্লি এব্দোতে প্রথম কবেই ইসলামের নবীর কার্টুন প্রকাশ করা হয়েছিল সেটা আমি মনে করতে পারি না। আমি খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু ওই ম্যাগাজিনের অফিসে হামলার কথা আমার মনে আছে। সোশাল মিডিয়াতে সবাই তাদের প্রোফাইল ছবি বদলে সেখানে তুলে ধরছিল ‘আমিই শার্লি’ এ ধরনের বক্তব্য। সে সময় আমি ওই কার্টুনগুলো দেখা এড়িয়ে চলি। কিন্তু পরে আমি টুইটারে সেসব দেখতে পাই। সেসময় আমি অপমানিতবোধ করি। ইসলামকে কেন ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মের মতো সম্মান করা যায় না?

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ