মুহাম্মদ আবদুল আলিম
আমরা আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের উম্মত। ইসলাম আমাদের ধর্ম। মুসলিম আমাদের পরিচয়। আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরয হলো আকীদা-বিশ্বাস পরিশুদ্ধ করা। ইসলামী আকীদাসমূহ সংশয়হীন চিত্তে ও নিশ্চিত সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং সবধরণের কুফরী, শিরকী ও বিদআতী আকীদা থেকে মুক্ত হয়ে সহীহ আকীদার ওপর অটল ও অবিচল থাকাই হলো আকীদা-বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি। ইসলামের অন্যতম আকীদা হলো, হালাল (বৈধ) ও হারাম (অবৈধ)-এর আকীদা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত হালালকে হালাল আর হারামকে হারাম বলে মেনে নেওয়ার নামই হলো ঈমান। হালাল-হারাম সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বান্দার কোনো এখতিয়ার নেই। পক্ষান্তরে হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল সাব্যস্ত করা ও তার বাস্তবায়ন একটি কুফরী কর্ম; যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়।
সম্পূর্ণ অবয়বসহ যেকোন প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও ভার্স্কয-প্রতিকৃতি নির্মাণ শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ। সম্পূর্ণ হারাম। এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) কর্তৃক সাব্যস্তকৃত স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান। আজকের আলোচনায় আমরা প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও তার ভার্স্কয নির্মাণ শরীয়তের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়ার বিধানটি কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত তথা উম্মাহর ঐকমত্যের আলোকে তুলে ধরতে সচেষ্ট হবো ইনশাআল্লাহ।
১. প্রাণীর প্রতিকৃতি-ভার্স্কয নির্মাণের অবৈধতা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান। কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে এ প্রসঙ্গে যেশব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো মূর্তি ও ভার্স্কযদুটোকেই নির্দেশ করে।
এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের স্পষ্ট নির্দেশ,
فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْاَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِۙ۰۰۳۰
‘তোমরা পরিহার করো অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার করো মিথ্যা কথন। (সূরা হজ: ৩০)
আয়াতে ‘আওসান’ (أَوْثَان) শব্দটি বহুবচন। একবচন হলো ‘ওয়াসান’ (وثَن)| বোঝা যাচ্ছে, আয়াতে সবধরণের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সকল কর্মকাণ্ড বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আরও লক্ষণীয় যে, আয়াতে সবধরণের মূর্তিকে ‘রিজস’ (رجس) শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রিজস’ অর্থ নোংরা, ঘোলাটে বিষয় ও অপবিত্র বস্তু। বোঝাই যাচ্ছে, মূর্তি ও মূর্তিসংশ্লিষ্ট জিনিসের সংশ্রব পরিহার করা পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রুচিবোধের পরিচায়ক। আর ভার্স্কয পূজিত না হলেও সেটি যে মূর্তিসংশ্লিষ্ট বিষয় তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
এছাড়াও ‘ওয়াসান’ শব্দের তাফসীর করা হয়েছে ‘তিমসাল’ (تمثال) দিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে,
الْوَثَنُ: التِّمْثَالُ مِنْ خَشَبٍ أَوْ حَدِيْدٍ أَوْ ذَهَبٍ أَوْ فِضَّةٍ وَنَحْوِهَا.
‘ওয়াসান হলো কাঠ, লোহা, স্বর্ণ বা রৌপ্য ইত্যাদির প্রতিমা।’ (তাফসীরে কুরতুবী: ১২/৫৪)
অন্য আয়াতে কাফের সম্প্রদায়ের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এভাবে,
وَقَالُوْا لَا تَذَرُنَّ اٰلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَّلَا سُوَاعًا١ۙ۬ وَّلَا يَغُوْثَ وَيَعُوْقَ وَنَسْرًاۚ۰۰۲۳
‘এবং তারা বললো, তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে এবং কখনো পরিত্যাগ করো নাওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগূস, ইয়াঊক ও নাসরকে।’ (সূরা নূহ: ২৩)
এখানে ইলাহ-উপাস্য ও মূর্তিগুলোকে আলাদা করে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং কাফের সম্প্রদায়ের দুটো বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে, ক) মিথ্যা উপাস্যদের পরিত্যাগ না করা। খ) মূর্তি-ভার্স্কয পরিহার না করা।
তাহলে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার মতো ভার্স্কযপ্রীতিও কুরআন মজীদে কাফেরদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
উপরের আয়াতে উল্লেখিত মূর্তিগুলো সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, এগুলো হচ্ছে নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায়ের কিছু পুণ্যবান লোকের নাম। তারা যখন মৃত্যুবরণ করেছে, তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে ওই কুমন্ত্রণা দিয়েছে যে, তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে তাদের ভাস্কর্য স্থাপন করা হোক এবং তাদের নামে সেগুলোকে নামকরণ করা হোক। লোকেরা এমনই করল। ওই প্রজন্ম যদিও এসব ভাস্কর্যের পূজা করেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকৃত বিষয় অস্পষ্ট হয়ে গেল এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পূজায় লিপ্ত হল। (সহীহ আল-বুখারী: ৪৯২০)
আল-কুরআনে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে পথভ্রষ্ট তার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
وَقَدْ اَضَلُّوْا كَثِيْرًا١ۚ۬ ۰۰۲۴
‘অথচ এগুলো অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে।’ (সূরা নূহ: ২৪)
কুরআনে একটা বস্তুকে ভ্রষ্ট তার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, আবার শরীয়াতে তা বৈধ ও গ্রহণযোগ্য থাকবে এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে?
২. কাবা ঘরের পাশে যে তিনশ ষাটটা মূর্তি ছিলো, তার অনেকগুলো উপাসনার জন্য স্থাপিত হয়নি বা সেগুলো প্রতিমা ছিলো না। সেগুলো ছিলো নিছক জায়গা ভরার এবং সৌন্দর্য বর্ধনের মূর্তি। শৈল্পিক ভাস্কর্যমাত্র। যেমন- হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর প্রতিকৃতি। এ দুটি প্রতিকৃতির পূজা হতো না। আরব অনারবে এর কোনো পূজারী ছিলো না। এরপরও রাসূল (সা.) মক্কা বিজয়ের অব্যবহতি পরে সেগুলোসহ সমস্ত মূর্তি-ভাস্কর্য উৎখাত করেন। চিত্র মুছে দেন। এতে বোঝা যায়, ইসলাম মূর্তি-ভাস্কর্য উৎখাত করতে বলে, বানাতে বলে না।
এ প্রসঙ্গে হাদীসের কয়েকটি দলিল নিম্নরূপ:
(ক) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন মক্কা বিজয়ের দিন যখন নবীজি (সা.) মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন তখন বায়তুল্লাহর আশে পাশে তিনশ ষাটটা মূর্তি বিদ্যমান ছিলো। তিনি প্রত্যেক মূর্তির দিকে হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করছিলেন এবং বলছিলেন,
جَآءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ١ؕ اِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا۰۰۸۱ وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ١ۙ وَلَا يَزِيْدُ الظّٰلِمِيْنَ اِلَّا خَسَارًا۰۰۸۲
‘সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল। সত্য আগমন করেছে আর মিথ্যা না পারে কোনো কিছু সূচনা করতে, না পারে পুনরা বৃত্তি করতে।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৪৭২০; সহীহ মুসলিম: ১৭৮১)
(খ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) যখন মক্কায় এলেন তখন বায়তুল্লাহে মিথ্যা উপাস্যদের থাকা অবস্থায় প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাঁর আদেশে ওই মূর্তি ও প্রতিকৃতিগুলো বের করা হল। এগুলোর মধ্যে হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এরও প্রতিকৃতি ছিল। তাঁদের হাতে ছিল ভাগ্যনির্ধারণী ‘শর’। নবীজি (সা.) বললেন, আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন, তাদের জানা ছিল যে এই দুজন কখনও ‘শর’ দ্বারা ভাগ্য গণনার চেষ্টা করেননি। (সহীহ আল-বুখারী: ৪২৮৮; সুনানে আবু দাউদ: ২০২০)
ثُمَّ دَعَا رَسُوْلَ اللهِ ^ بِزَعْفَرَانٍ فَلَطَّخَهُ بِتِلْكَ التَّمَاثِيْلِ.
‘এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) জাফরান আনতে বললেন এবং সেগুলোর ওপর জাফরানের প্রলেপ দিয়ে দিলেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বা: ৩৮০৬০)
উল্লেখ্য যে, এ হাদীসে হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর প্রতিকৃতিসমূহকে মিথ্যা উপাস্য বলা হয়েছে। তাঁদের প্রতিকৃতি পূজার মূর্তি ছিল না।
(গ) হযরত জাবির (রাযি.) থেকে বর্ণিত, মক্কা-বিজয়ের সময় নবীজি (সা.) ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)-কে আদেশ দিলেন, তিনি যেন কাবা ঘরের সব ছবি মুছে ফেলেন। সকল ছবি মোছার আগ পর্যন্ত তিনি কাবায় প্রবেশ করেননি। (সুনানে আবু দাউদ: ৪১৫৩, সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৮৫৭)
৩. বায়তুল্লাহ তো আল্লাহর ঘর। মসজিদ। রাসূলে করীম (সা.) তো নিজের ঘরেও ছবি রাখা বরদাশত করতেন না। হযরত আয়িশা (রাযি.) বলেন,
«أَنَّ النَّبِيَّ ^ لَـمْ يَكُنْ يَتْرُكُ فِيْ بَيْتِهِ شَيْئًا فِيْهِ تَصَالِيْبُ إِلَّا نَقَضَهُ».
‘নবীজি (সা.) তাঁর ঘরে ছবি অঙ্কিত কিছু দেখলে তা বিনষ্ট করে দিতেন।’ (সহীহ বুখারী: ৫৯৫২)
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল হাইয়ায আসাদী (রহ.) বলেন, হযরত আলী ইবনে আবু তালেব আমাকে বললেন,
أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَىٰ مَا بَعَثَنِيْ عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللهِ ^؟ «أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ».
‘আমিকি তোমাকে এমন কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যার জন্য নবী (সা.) আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? (তা এই যে) তুমি সকল প্রাণীর মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সকল সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দেবে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে… এ সকল চিত্র মুছে ফেলবে। (সহীহ মুসলিম: ৯৬৯)
হযরত আলী ইবনে আবু তালেব বলেন, নবীজি (সা.) একটি জানা যায় উপস্থিত ছিলেন, তখন তিনি বললেন,
«أَيُّكُمْ يَنْطَلِقُ إِلَى الْـمَدِينَةِ فَلَا يَدَعُ بِهَا وَثَنًا إِلَّا كَسَرَهُ، وَلَا قَبْرًا إِلَّا سَوَّاهُ، وَلَا صُورَةً إِلَّا لَطَّخَهَا؟»
‘তোমাদের মধ্যেকে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো মূর্তি পাবে ভেঙে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিসাৎ করে দেবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দেবে।’
হযরত আলী (রাযি.) এ দায়িত্ব পালন করলেন। ফিরে আসার পর নবীজি (সা.) বললেন,
«مَنْ عَادَ لِصَنْعَةِ شَيْءٍ مِّنْ هَذَا، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ ^».
‘যেকেউ পুনরায় ওইসব বস্তু তৈরি করবে সে মুহাম্মদের প্রতি নাযিলকৃত দীনকে অস্বীকারকারী।’ (মুসনদে আহমদ: ৬৫৯)
মোটকথা বায়তুল্লাহ থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) যেভাবে পূজার মূর্তি সরিয়েছেন তেমনি স্তম্ভ ও দেয়ালে অঙ্কিত চিত্রগুলোও মুছে দিয়েছেন। তিনি সেগুলোর ওপর এই বলে আপত্তি করেন নি যে, এগুলোর পূজা করা হয়, বরং তিনি বলেছেন,
«قَاتَلَ اللهُ قَوْمًا يُصَوِّرُوْنَ مَا لَا يَخْلُقُوْنَ».
‘আল্লাহ ওই গোষ্ঠীকে ধ্বংস করুন যারা এমন প্রতিকৃতি নির্মাণ করে যা তারা সৃষ্টি করে না।’ (শুআবুল ঈমান: ৫৯০৩)
আরও বলেছেন,
«لَا تَدْخُلُ الْـمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيْهِ صُوْرَةٌ».
‘ফেরেস্তাগণ ওই গৃহে প্রবেশ করেন না যাতে রয়েছে প্রতিকৃতি।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৩২২৬)
আম্মাজান আয়িশা (রাযি.)-এর কক্ষে ঝোলানো পর্দা তিনি এই বলে খুলে দেন নি যে, এই চিত্রগুলো পূজার সামগ্রী, বরং তিনি বলেছেন,
«أَشَدُّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الَّذِيْنَ يُضَاهُوْنَ بِخَلْقِ اللهِ».
‘কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আযাবে ওসব লোক পতিত হবে যারা আল্লাহর সৃষ্টি বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৫৯৫৪)
আরও বলেছেন,
«إِنَّ أَصْحَابَ هَذِهِ الصُّوَرِ يُعَذَّبُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَيُقَالُ لَـهُمْ: أَحْيُوْا مَا خَلَقْتُمْ».
‘এই প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীদেরকে কিয়ামতের দিন আযাব দেওয়া হবে, তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার কর।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৫১৮১)
ভাস্কর্য নির্মাণের শাস্তি
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন,
«إِنَّ الَّذِيْنَ يَصْنَعُوْنَ هَذِهِ الصُّوَرَ يُعَذَّبُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يُقَالُ لَـهُمْ: أَحْيُوْا مَا خَلَقْتُمْ».
‘যারা এসব প্রতিকৃতি প্রস্তুত করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। তাদেরকে বলা হবে, যা তোমরা সৃষ্টি করেছিলে তাতে প্রাণ সঞ্চার কর। (সহীহ আল-বুখারী: ৫৯৫১; সহীহ মুসলিম: ২১০৮)
২. হযরত আবু তালহা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
«لَا تَدْخُلُ الْـمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيْهِ كَلْبٌ وَلَا تَصَاوِيْرُ».
‘ফেরেস্তাগণ ওই গৃহে প্রবেশ করেন না যাতে কুকুর বা প্রাণীর ছবি রয়েছে।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৫৯৪৯; সহীহ মুসলিম: ২১০৬)
৩. হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
«لَا تَدْخُلُ الْـمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيْهِ تَمَاثِيْلُ أَوْ تَصَاوِيْرُ».
‘ফেরেস্তারা ওই ঘরে প্রবেশ করেন না যাতে মূর্তি বা ছবি রয়েছে।’ (সহীহ মুসলিম: ২১১২)
৪. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, আমি মুহাম্মদ (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে,
«مَنْ صَوَّرَ صُوْرَةً فِي الدُّنْيَا كُلِّفَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنْ يَنْفُخَ فِيْهَا الرُّوْحَ، وَلَيْسَ بِنَافِخٍ».
‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করবে, তাকে কিয়ামতের দিন বাধ্য করা হবে যেন সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে, অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৫৯৬৩)
৫. মুসলিম ইবনে সুবাইহ বলেন, আমি মাসরুকের সঙ্গে একটি ঘরে ছিলাম যেখানে হযরত মারইয়াম (রাযি.)-এর প্রতিকৃতি ছিল। মাসরুক জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি কিসরার প্রতিকৃতি? আমি বললাম, না, এটি হযরত মারইয়াম (রাযি.)-এর প্রতিকৃতি! তখন মাসরুক বললেন, আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.)-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«أَشَدُّ النَّاسِ عَذَابًا يَّوْمَ الْقِيَامَةِ الْـمُصَوِّرُوْنَ».
‘প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীরা কেয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আযাবের মুখোমুখি হবে।’ (সহীহ মুসলিম: ২১০৯)
৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি,
«كُلُّ مُصَوِّرٍ فِي النَّارِ، يَجْعَلُ لَهُ، بِكُلِّ صُوْرَةٍ صَوَّرَهَا، نَفْسًا فَتُعَذِّبُهُ فِيْ جَهَنَّمَ».
‘যে প্রত্যেক চিত্রাঙ্কনকারীই জাহান্নামী। চিত্রকর যতোটি (প্রাণীর) চিত্র এঁকেছে, ততটি প্রাণ তাকে দেওয়া হবে। প্রতিটির মাধ্যমে তাকে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে।’ (সহীহ মুসলিম: ২১১০)
উম্মাহর ইজমা: ইসলামের সূচনা থেকে অদ্যাবধি প্রাণীর প্রতিকৃতি-ভার্স্কয নির্মাণ অবৈধ ও হারাম। এ বিষয়ে গোটা মুসলিম উম্মাহ একমত। এটি মুমিনদের ঐকমত্যপূর্ণ পথ। আর কুরআন মজীদে মুমিনদের ঐকমত্যপূর্ণ পথ পরিহার করাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বলা হয়েছে। ইমাম ইবনুল আরবী মালিকী (রহ.) বলেন,
حَاصِلُ مَا فِي اتِّخَاذِ الصُّوَرِ أَنَّهَا إِنْ كَانَتْ ذَاتَ أَجْسَامٍ حَرُمَ بِالْإِجْمَاعِ.
অর্থাৎ উম্মাহর সর্বসম্মত মতানুসারে সম্পূর্ণ অবয়বসহ যেকোনো প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও ভার্স্কয-প্রতিকৃতি নির্মাণ শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। (ফতহুল বারী, ১০/৩৮৮, ৩৯১, আরও দেখুন: ইকমালুল মুলিম: ৬/৬৩৫, রদ্দুল মুহতার: ১/৬৪৭, মাওয়াহিবুল জলীল: ১/৫৫২, হাশিয়া কালয়ূবী: ৩/২৯৮, আল-ইনসাফ; ১/৩৭৫)
সুতরাং অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত তথা উম্মাহর ঐকমত্যের আলোকে ভাস্কর্য স্থাপন হারাম ও নিষিদ্ধ। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। চাই তা পূজার মূর্তি হোক বা সাধারণ সাংস্কৃতিক স্মারকভার্স্কয। শুধু সম্মান প্রদর্শনমূলকই হোক না কেন। কেননা পূজার মূর্তি-তার পূজা ও প্রতিকৃতি এই দুই কারণে হারাম। আর সাধারণ সাংস্কৃতিক স্মারকভার্স্কযপূজার উদ্দেশ্য না থাকলেও প্রাণীর প্রতিকৃতির কারণে হারাম।
পূজার উদ্দেশ্য না থাকলেও ভার্স্কয স্থাপন হারাম:
মূলত, ভার্স্কয স্থাপন আল্লাহর সৃষ্টিগুণের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ। যা তাঁর সঙ্গে মোকাবেলা করার সমার্থক। আল্লাহ তাআলা প্রাণীর আকৃতিদানকে একমাত্র তাঁরই অধিকার সাব্যস্ত করেছেন। কেননা আকৃতির মধ্যে শুধু তিনিই প্রাণ দান করতে পারেন। যার পক্ষে প্রাণদান সম্ভব নয়, তাকে আল্লাহ আকৃতি নির্মাণের অনুমতি দেন না। একে তিনি তাঁর সঙ্গে মোকাবেলা করার সমার্থক বলেছেন। সুতরাং কেউ যখন মূর্তি-ভার্স্কয ও প্রতিকৃতি নির্মাণ করে তখন সে যেন আল্লাহর কাজে দখল দেয়। হযরত আয়িশা (রাযি.) বলেন,
قَدِمَ رَسُوْلُ اللهِ ^ مِنْ سَفَرٍ، وَقَدْ سَتَرْتُ بِقِرَامٍ لِيْ عَلَىٰ سَهْوَةٍ لِّيْ فِيْهَا تَمَاثِيْلُ، فَلَمَّا رَآهُ رَسُوْلُ اللهِ ^ هَتَكَهُ وَقَالَ: «أَشَدُّ النَّاسِ عَذَابًا يَّوْمَ الْقِيَامَةِ الَّذِيْنَ يُضَاهُوْنَ بِخَلْقِ اللهِ»، قَالَتْ: فَجَعَلْنَاهُ وِسَادَةً أَوْ وِسَادَتَيْنِ.
‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এক সফর থেকে ফিরলেন। আমি কক্ষের দ্বারে একটি পর্দা ঝুলিয়ে ছিলাম, যাতে ছবি অঙ্কিত ছিল। তিনি তা খুলে ফেললেন এবং বললেন, ‘কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন আযাব দেওয়া হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টিগুণের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে।’ উম্মুল মুমিনীন বলেন, তখন আমরা তা কেটে ফেললাম এবং একটি বা দুটি বালিশ বানালাম। (সহীহ আল-বুখারী: ৫৯৫৪)
অপর এক হাদীসে আবু যুরআ (রহ.) বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রাযি.)-এর সঙ্গে মারওয়ানের গৃহে প্রবেশ করলাম। সেখানে কিছু চিত্র তাঁর দৃষ্টিগোচর হল। তখন তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
«وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ كَخَلْقِيْ، فَلْيَخْلُقُوْا ذَرَّةً أَوْ لِيَخْلُقُوْا حَبَّةً أَوْ شَعِيْرَةً».
‘ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে যে আমার সৃষ্টির মতো কোন কিছু সৃষ্টি করতে চায়। (তাদের যদি সামর্থ থাকে) সৃষ্টি করুক একটি কণা, একটি শস্য কিংবা একটি যব।’ (সহীহ মুসলিম: ২১১১; সহীহ বুখারী: ৫৯৫৩)
ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, শুধু পূজার জন্য নয়, মৃত ব্যক্তির স্মারক হিসেবেও মূর্তি নির্মাণ আরব জাহেলী সংস্কৃতির একটি অংশ ছিল। আধুনিক প্রত্নতাত্বিক অনুসন্ধানে যে নিদর্শনগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে দেখা যায়, কোন কোন স্মারকের গায়ে সনম শব্দও খোদিত থাকত। (ড. জাওয়াদ আলী, আল-মুফাসসাল ফী তারীখিল আরব, ৮/৫৪)
এমনকি আরবের অন্ধকার যুগের বিখ্যাত একটি মূর্তি ছিল ‘লাত।’ এই মূর্তি ও তার মন্দির তায়েফ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, যে স্থানে মূর্তি ও মন্দির স্থাপিত হয় সেটা মূলত এক ব্যক্তির সমাধি। ধর্মীয়ভাবে তার গুরুত্ব ছিল। ‘লাত‘ তারই উপাধী। মৃত্যুর পর তার সমাধির উপর ভার্স্কয নির্মাণ করা হয় এবং ধীরে ধীরে সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। (তাফসীরে আবুস সাউদ: ৬/১৫৫; রুহুল মাআনী: ২৭/৫৫)
বোঝা যাচ্ছে, এস্মারক-ভাস্কর্যের পথ ধরেই অতীত জাতিসমূহে শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাই ইসলামও চূড়ান্তভাবে ভার্স্কযশিল্প ওতার নির্মাণের অবৈধতার ঘোষণা করেছে।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রাযি.) বলেন নবী (সা.)-এর অসুস্থতার সময় তাঁর জনৈকা স্ত্রী একটি গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। গির্জার নাম ছিল মারিয়া। উম্মে সালমা ও উম্মে হাবীবা ইতিপূর্বে হাবাশায় গিয়েছিলেন। তাঁরা গির্জাটির কারুকাজ ও তাতে বিদ্যমান প্রতিকৃতিসমূহের কথা আলোচনা করলেন। নবী (সা.) শয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন,
«أُوْلَئِكِ إِذَا مَاتَ مِنْهُمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ بَنَوْا عَلَىٰ قَبْرِهِ مَسْجِدًا، ثُمَّ صَوَّرُوْا فِيْهِ تِلْكَ الصُّوْرَةَ أُوْلَئِكِ شِرَارُ الْـخَلْقِ عِنْدَ اللهِ».
‘তাদের কোনো পুণ্যবান লোক মারা গেলে তারা তার কবরের ওপর ইবাদাতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম মাখলুক।’ (সহীহ আল-বুখারী: ১৩৪১; মুসলিম: ৫২৮)
অতএব বিধানগত দিক ছাড়াও ইসলামের মৌলিক আদর্শ ও চেতনার সাথে মূর্তি ও ভার্স্কযের বিরোধ চিরসত্য, যা রুচিশীল ব্যক্তিমাত্রই বুঝতে সক্ষম।
একথা তো বলা বাহুল্য, মুমিন কখনো কখনো শয়তানের ধোকায় পড়ে কোন হারাম কাজ করতে পারে, কিন্তু এই হারাম কাজকে কখনো হালাল সাব্যস্ত করতে পারে না। কারণ হারামকে হালাল সাব্যস্ত করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
হারামকে হালাল সাব্যস্তকারীর পরিণতি ভয়াবহ:
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
قَاتِلُوا الَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْاٰخِرِ وَلَا يُحَرِّمُوْنَ مَا حَرَّمَ اللّٰهُ وَرَسُوْلُهٗ ؒ۰۰۲۹
‘যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা কিছু হারাম করেছেন তাকে হারাম মনে করে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করো।’ (সূরা আত-তাওবা: ২৯)
আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আল্লাহ ও তদীয় রাসূল কর্তৃক হারামকে হারাম বলে অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন,
قُلْ اَرَءَيْتُمْ مَّاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ لَكُمْ مِّنْ رِّزْقٍ فَجَعَلْتُمْ مِّنْهُ حَرَامًا وَّحَلٰلًا١ؕ قُلْ آٰللّٰهُ اَذِنَ لَكُمْ اَمْ عَلَى اللّٰهِ تَفْتَرُوْنَ۰۰۵۹
‘বল, চিন্তা করে দেখ তো, আল্লাহ তোমাদের জন্যযে রিযক নাযিল করেছিলেন, তারপর তোমরা নিজেদের পক্ষ থেকে তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম সাব্যস্ত করেছ! জিজ্ঞেস কর, আল্লাহই কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছিলেন, না তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ?’ (সূরা ইউনূস: ৫৯)
আল্লাহু আকবার! আয়াতে হারামকে হালাল সাব্যস্তকারী যেন আল্লাহকেই (!) মিথ্যা অপবাদদাতা আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন,
وَلَا تَقُوْلُوْا لِمَا تَصِفُ اَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هٰذَا حَلٰلٌ وَّ هٰذَا حَرَامٌ لِّتَفْتَرُوْا عَلَى اللّٰهِ الْكَذِبَ١ؕ اِنَّ الَّذِيْنَ يَفْتَرُوْنَ عَلَى اللّٰهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُوْنَؕ۰۰۱۱۶
‘যেসব বস্তু সম্পর্কে তোমাদের জিহ্বা মিথ্যা রচনা করে, সে সম্পর্কে বলো না এটা হালাল এবং এটা হারাম। কেননা তার অর্থ হবে তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ। জেনে রেখ, যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়, তারা সফলকাম হয় না। (সূরা আন-নাহল: ১১৬)
আয়াতে হারামকে হালাল সাব্যস্ত করাকে আল্লাহর (!) প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপের নামান্তর সাব্যস্ত করা হয়েছে, আর আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ রচনাকারী কখনই সফলকাম হয় না বলে ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন,
اَمْ لَهُمْ شُرَكٰٓؤُا شَرَعُوْا لَهُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَاْذَنْۢ بِهِ اللّٰهُ ؕ ۰۰۲۱
‘নাকি তাদের রয়েছে এমন কতক শরিক, যারা তাদের জন্য এমন দীন প্রবর্তন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি।’ (সূরা আশ-শূরা: ২১)
উল্লেখ্য যে, যারা হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল বলে সাব্যস্ত করে যেন তারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আল্লাহর সমকক্ষ বিধানদাতা স্বীকার করে নেয়।
আয়াতে বলা হয়েছে, রাসূলের আদেশের বিপরীত যারা নিজেদের মতে হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল বলে সাব্যস্ত করে তারা রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারী এবং মুমিনদের পথ থেকে বিচ্যুত।
উল্লিখিত আয়াতসমূহে এবং এছাড়া আরও বহু আয়াত ও হাদীসে হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল বলে সাব্যস্তকরার ভয়াবহতা ও শাস্তির সতর্কবাণী বর্ণিত হওয়ার পরও কোন সত্যিকারের মুমিন-মুসলিম হঠকারিতাবশত প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও ভার্স্কয স্থাপনের মত হারাম ও গর্হিত কাজকে হালালওবৈধসাব্যস্তকরার দুঃসাহস দেখাতে পারে না। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাজত করুন।
কিছু সংশয় নিরসন:
১. ‘তিমসাল (تمثال): অনেকেই ভাস্কর্যের বৈধতার পক্ষে হযরত সুলাইমান (আ.)-এর শরীয়ত সম্পর্কিত কুরআনের একটি আয়াত প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন! আয়াতটি এই,
يَعْمَلُوْنَ لَهٗ مَا يَشَآءُ مِنْ مَّحَارِيْبَ وَتَمَاثِيْلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُوْرٍ رّٰسِيٰتٍ١ؕ اِعْمَلُوْۤا اٰلَ دَاوٗدَ شُكْرًا١ؕ وَقَلِيْلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُوْرُ۰۰۱۳
‘তারা সুলাইমানের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাওয-সদৃশ বৃহদাকারের পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে ডেগ-পাতিল নির্মাণ করতো।’ (সূরা সাবা: ১৩)
পর্যালোচনা: শরীয়তে সুলাইমানীতে এটি যদিও বৈধ ছিল কিন্তু শরীয়তে মুহাম্মদীতে এর বৈধতা রহিত হয়ে যায়। এমন বহু বিধান রয়েছে, যা পূর্বের শরীয়তে বৈধ ছিল কিন্তু শরীয়তে মুহাম্মদীতে তা বৈধ নয়। যেমন- হযরত আদম (আ.)-এর শরীয়তে ভাই তার ঔরসজাত বোনকে বিয়ে করা বৈধ ছিল। তাই বলে কি তা শরীয়তে মুহাম্মদীতেও বৈধ? অতএব কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত তথা উম্মাহর ঐকমত্যের আলোকে ভার্স্কয স্থাপন হারাম ও নিষিদ্ধ প্রমাণিত হওয়ার পরও একটি রহিত বিধান দ্বারা তা বৈধ সাব্যস্ত করা শরীয়ত ও তার মূলনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতার প্রমাণ বৈ কিছু নয়। তাছাড়া আয়াতে প্রাণী-ভাস্কর্যের কথা সুস্পষ্ট নয়, জড়ভাস্কর্য হওয়ার প্রবল সম্ভাবনাও রয়েছে। শরীয়তের মেযাজ, নবীজি (সা.), সকল সাহাবী ও উম্মাহর ঐকমত্য এটিই নির্দেশ করে।
২. হযরত মারইয়াম (مريم): অনেকেই চিত্রাঙ্কনের বৈধতা প্রমাণকল্পে এ গাল-গল্পের অহেতুক অবতারণা করে থাকে যে, কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভে নাকি বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি অপূর্ব ছবি আঁকা ছিল। মক্কা বিজয়ের দিন নবীজি (সা.) সেখানে হাত রাখলেন এবং বললেন, ‘এ ছবি তোমরা নষ্ট করো না।’
পর্যালোচনা: এটি একটি অসত্য ও ভিত্তিহীন বর্ণনা। সকল সহীহ হাদীসের বক্তব্য এ বিষয়ে অভিন্ন যে, মক্কা বিজয়ের সময় বায়তুল্লাহর ভেতরে-বাইরে এবং চারপাশে না কোনো মূর্তি অবশিষ্ট রাখা হয়েছিল, না কোনো চিত্র-ছবি।
নবীজি (সা.) যিনি ঘরে-বাইরে কোথাও ছবি রাখার অনুমোদন দেননি, বরং তা মুছে ফেলার আদেশ করেছেন, তিনি বায়তুল্লাহে কোনো ছবি, বিশেষত কোন নারীর ছবি বহাল রাখতে বলবেন যেখানে শুধু ছবিই নয় পর্দাহীনতা (!)ও রয়েছে এটা সুস্পষ্ট মিথ্যাচার বৈ কিছু নয়।
৩. কাবা (كعبة): যদি সম্মান প্রদর্শনমূলক বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা বৈধ হয়, তাহলে স্মৃতিস্তম্ভের মর্যাদাপূর্ণ স্থাপন কেন অবৈধ হবে?
পর্যালোচনা: হজে আমরা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করি। কিন্তু এটি বায়তুল্লাহর সম্মানের জন্য করা হয় না। করা হয় আল্লাহর ইবাদতের জন্য। আল্লাহ তাআলা তাওয়াফ করতে বলেছেন, তাই করি। এটা ঠিক যে, আল্লাহ বায়তুল্লাহকে সম্মানিত করেছেন। কিন্তু তাওয়াফ সে সম্মানের জন্য নয়। দেখুন, তাওয়াফ শুরু হয় হাজরে আসওয়াদ থেকে। বায়তুল্লাহকে বাম পাশে রেখে তাওয়াফ করতে হয়। তাওয়াফের হালতে বায়তুল্লাহর দিকে তাকানো নিষেধ। বায়তুল্লাহর দিকে সীনা ফেরানোও নিষেধ। এ মাসআলাগুলো এটিই প্রমাণ করে যে, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ বায়তুল্লাহর জন্য নয়, আল্লাহর জন্য। এটি আল্লাহর ইবাদত।
৩. হাজরে আসওয়াদ (حجر أسود): কেউ আবার হাজরে আসওয়াদের চুম্বন করার বিষয় দিয়ে বস্তু পূজার বৈধতার অপচেষ্টা চালাতে চায়!
পর্যালোচনা: হাজরে আসওয়াদে চুম্বনের বিষয়টি বাহ্যত মনে হতে পারে পাথরের প্রতি ভক্তি প্রকাশ অথচ মোটেই তা নয়। নিয়ম হল, অন্যকে কষ্ট না দিয়ে যদি তাকে চুম্বন করা সম্ভব হয় তাহলে চুম্বন করবে। অন্যথায় দূর থেকে হাত উঁচিয়ে হাতে চুম্বন করবে। হাজরে আসওয়াদ হচ্ছে বেহেশতি পাথর। আল্লাহ তাআলা বেহেশত থেকে তা পাঠিয়েছেন এবং এতে চুম্বন করলে তিনি বান্দার গোনাহ মাফ করবেন। লক্ষ্য করুন, গোনাহ মাফ করবেন আল্লাহ তাআলা। তাই আল্লাহর আদেশে হাজরে আসওয়াদের চুম্বন করা হয়। এ চুম্বন কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য দেবে যে, এ ব্যক্তি তাওহীদের লোক ছিল। দেখুন, তাওহীদপন্থি বলে সাক্ষ্য দেবে। কেননা তা আল্লাহর পক্ষ হতে র্নির্দেশিত।
হযরত ওমর ফারুক (রাযি.)-এর ঘটনা অনেকেরই জানা আছে। হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার সময় তিনি বললেন, ‘আমি জানি, তুমি একটি পাথর মাত্র। কল্যাণ বা অকল্যাণের কোন ক্ষমতা তোমার নেই। আমি যদি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কেচুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি কখনো তোমাকে চুম্বন করতাম না। তাহলে পরিষ্কার পার্থক্য হয়ে গেল হিন্দুদের পাথর-পূজা ও আমাদের হাজরে আসওয়াদের চুম্বনের মাঝে।
৪. হযরত আয়িশা (রাযি.)-এর খেলনার পুতুল: আম্মাজান যখন ছোট ছিলেন তখন পাখাঅলা ঘোড়ার পুতুল ছিল তাঁর খেলার সামগ্রী। এর ওপর নবীজি (সা.) আপত্তি করেননি, কিন্তু যখন তিনি বড় হলেন এবং ঘোড়ার ছবিযুক্ত পর্দা ব্যবহার করলেন তখন নবীজি তা খুলে ফেলার আদেশ দিয়েছেন এবং তাঁকে সতর্ক করেছেন।
বোঝা যাচ্ছে, বাচ্চারা খেলার জন্য পুতুল বানানো বৈধ। এটি শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত। তাই হযরত আয়িশা (রাযি.)-এর খেলনার পুতুল দিয়ে মূর্তি নির্মাণের বৈধতা প্রমাণ ধোপে টেকে না। তাছাড়া বাচ্চাদের কাছে পুতুল বিশেষ মর্যাদাপূর্ণও নয়, কেননা খেলা শেষ বলে তারা সেগুলো খুব ন্যক্কারজনকভাবে ভেঙে ফেলে।
৫. বরেণ্য ব্যক্তির ভাস্কর্য: অনেকেই রুমী, সাদী, আত্তার এমন অনেক বরেণ্য ও বুযুর্গ ব্যক্তির ভাস্কর্যকে ভাস্কর্য নির্মাণের বৈধতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন?!
আসলে এখানে আমরা কি দেখবো? কে ভাস্কর্য নির্মাণ করল, না কার ভাস্কর্য নির্মাণ করা হল? জাহেলী যুগে মুশরিকরা তো হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছিল। এতে কি দাবি করা যায় যে, প্রতিকৃতি নির্মাণ হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং ইসমাঈল (আ.)-এর নীতি ছিল। বরং মূর্খরাই এমনটি করেছিল। যদি বরেণ্য ব্যক্তিদের কর্ম ও সিদ্ধান্তের দ্বারাই দাবি প্রমাণ করতে হয় তাহলে ইতিহাস থেকে দেখাতে হবে যে, নবী (সা.), সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.), তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং পরবর্তী মুজিতাহিদ ইমামগণের মধ্যে কেউ কারো কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ করিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে, এটা প্রমাণ করা অসম্ভব।
বৈধ প্রতিকৃতি ও তার প্রকার
মানুষের স্বভাবে অঙ্কন ও নির্মাণের যে প্রেরণা রয়েছে তার জন্য আল্লাহ তাআলা জড় বস্তু বা প্রাণহীন বস্তুর চিত্র-প্রতিকৃতি প্রস্তুতের অনুমতি দিয়েছেন। এতে করে মুসলমানের শিল্পমন অধিক নিবদ্ধ হবে স্থাপত্য শিল্প, নিষ্প্রাণ প্রতিকৃতি ও হস্তলিপি, পাথুরে কারুকাজ, বয়নশিল্প, কারুশিল্প ইত্যাদি উপকারী শিল্পের প্রতি। হবে মানবসভ্যতার প্রচুর কল্যাণ। এভাবেই গুরুত্ব পাবে উপকারী শিল্প ও কারুকাজ। তাই ইসলামে তিন ধরণের প্রতিকৃতি নির্মাণ বৈধ ও হালাল:
- জড়বস্তু, বৃক্ষলতা, সাগর-নদী, প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদি প্রাণহীন বিষয়।
- বিচ্ছিন্ন কোনো অঙ্গ যেমন শুধু হাত, চোখ, পা ইত্যাদি।
- ছোট মেয়েদের খেলার পুতুল।
পক্ষান্তরে চারধরণের প্রতিকৃতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম:
- কোনো মানুষ বা প্রাণীর মূর্তি।
- হাতে অঙ্কিত প্রাণীর চিত্র।
- প্রাণীর পূর্ণ ছবি।
- কোনো প্রকাশ্য স্থানে স্থাপিত কিংবা কোথাও ঝোলানো ছবি। (দলিলসহ বিস্তারিত জানতে দেখুন রাওয়াইউল বয়ান: ১/৪০৯-৪১৩)
কীর্তিমানদের স্মৃতি রক্ষার বাস্তবতা:
বস্তুত মানুষ যত বড়ই হোক না কেন তার প্রকৃত অবস্থা থেকে বাড়িয়ে তাকে মর্যাদা প্রদান করা ইসলামে এর কোনোই অনুমোদন নেই। বরঞ্চ এটি একটি নিন্দনীয় কাজ। স্বয়ং নবীজি (সা.) তাঁর নিজের সম্পর্কেও সতর্ক করে বলেছেন, ‘তোমরা আমার এমন অবাস্তব প্রশংসা করো না যেমন খ্রিস্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ.) সম্পর্কে করেছে। আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।’ (সহীহ আল-বুখারী: ৩৪৫৪)
শ্রদ্ধা নিবেদনের ক্ষেত্রে এটি যে দীনের আদর্শ ও মানদণ্ড, সে দীন কখনও কোন মানুষের মর্যাদাকল্পে মূর্তির মতো স্মারক-ভাস্কর্য নির্মাণের অনুমতি দিতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টিই হলো কারো অমরত্ব লাভের অন্যতম মাধ্যম। যা একজন মুমিনের পরম লক্ষ্য। স্মৃতিরক্ষার প্রয়োজনে হৃদয়ের ভালোবাসা, কর্ম ও কীর্তির সশ্রদ্ধ আলোচনা এবং চিন্তা ও চেতনার আদর্শ অনুসরণের প্রেরণাই হল অমরত্বের মূল উপাদান। ইট-পাথরের ভাস্কর্য নয়।
আল্লাহর নবী ও তাঁর খলীফাগণের এবং ইসলামের মহান পূর্বসূরিদের অমর স্মৃতিপাথরের ভাস্কর্যের দ্বারা সংরক্ষিত হয়নি। তা হয়েছে প্রজন্ম পরম্পরায় মানুষের হৃদয়ে এবং তাদের কর্ম ও অবদানের সুরভিত আলোচনায়। এটা হল ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যদিকে ভাস্কর্য ভিত্তিক স্মৃতিরক্ষার পদ্ধতি হচ্ছে অত্যন্ত স্থূল ও পশ্চাৎপদ চিন্তার ফসল। প্রাচীন গ্রীক, পারস্য সভ্যতায় এটা বিদ্যমান ছিল। পরে ইউরোপীয়রা তা অনুসরণ করেছে। এরা স্বভাবতই ছিল মূর্তি পূজারী। তাদের পক্ষে মানুষের প্রতিভা ও বৈশিষ্ট্য মূল্যায়ণ করা সম্ভব নয়। ত্যাগ ও বীরত্বের সমুন্নত দৃষ্টান্তরূপে মানুষের সম্ভাবনাকে অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি বলেই তারা তাদের বীর পুরুষদেরকে উপাস্য হিসেবে এবং উপাস্যদেরকে বীর যোদ্ধা হিসেবে কল্পনা করেছে।
পরিশেষে বলবো, প্রাণীর চিত্রাঙ্কন ও তার ভার্স্কয নির্মাণ শরীয়তের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ বিধান। তা হালাল ও বৈধ হওয়ার ন্যূনতম সুযোগ ইসলামে নেই।