ছাত্রজীবনের সঠিক মূল্যায়ন করে যোগ্যতা অর্জন করুন, আল্লাহ পাক কাজ নেবেন
মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.)
-গত সংখ্যার পর
ইসলামী সংবিধান এবং পাকিস্তান আন্দোলন
হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.) তো ছিলেন শায়খুল হিন্দ। আমি ছোট মানুষ, আমার কথাই বলি। যখন আমি পাকিস্তান চলে এসেছি। আপনাদের হয়তো ধারণা, আমি এখানে এসেই একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছি এবং আমি মাদরাসা পরিচালনাকারী একজন হুযুর। কিন্তু না। আমি এখানে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আসিনি। আমি এসেছিলাম পাকিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। সংবিধান প্রণয়নের জন্য আমি এসেছি। সংবিধান প্রণেতাগণ আমার নিকট একটি ইসলামী সংবিধান প্রস্তুত করার আবেদন করেন। তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে আমরা ইসলামী সংবিধানের একটি রূপরেখা প্রস্তুত করি। অথচ সংবিধান সম্পর্কে আমার তেমন কিছুই জানা ছিল না। আপনারা যা পড়েছেন, আমিও তাই পড়েছি। সংবিধান নিয়ে তো কোনো পড়াশোনা ইতিপূর্বে হয়নি। কিন্তু যখন কাজের জন্য বসে গেলাম আল্লাহর শোকর, বুযুর্গদের জুতো সোজা করার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। পঠন-পাঠনের কাজে জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। যখন সংবিধান মুতালাআ শুরু করলাম, আলহামদুলিল্লাহ, সংবিধান সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা চলে এল। আমরা যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলাম তা ছিল বেসরকারি। তারপর সরকারিভাবে একটি প্রস্তুত করা হয় এবং এর জন্য পৃথক বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের প্রত্যেক সদস্যকে মাসে এক হাজার রুপি করে ভাতা প্রদান করা হত। এতে কতিপয় আলিম সদস্যও ছিলেন।
তো বলছিলাম, আমি তো জীবনে কখনো সংবিধান নিয়ে পড়াশুনা করিনি। ইসলামী সংবিধান নিয়েও নয় এবং জাগতিক সংবিধান নিয়েও নয়। এ বিষয়ে কোনো লেখালেখিও করিনি। কিন্তু যখন মাথার ওপর দায়িত্ব এসে পড়েছে এবং আমিও মুতালাআ শুরু করে দিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধান দেখেছি এবং ইংরেজি সংবিধান উর্দুতে অনুবাদ করিয়ে পড়েছি। তখন এ বিষয়ে আমার এত জানা-শোনা হল যে, দাবি করে বলতে পারি, সারা পৃথিবীর সংবিধান আমাদের জানা হয়ে গেছে।
একবার খাজা নাযিমুদ্দীন সাহেব (আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন) ভালো মানুষ ছিলেন, তিনি তখন প্রধানমন্ত্রী। তার সাথে আরো চার-পাঁচ জন বড় বড় মন্ত্রী ছিলেন। মজলিসে কথাবার্তা চলছিল। একজন (তিনি এখনও জীবিত, আমি তার নাম নিচ্ছি না) আমার দিকে ইশারা করে বললেন, আপনি সংবিধান সম্পর্কে কী জানেন? সে মনে করেছিল, আমি একজন হুযুর মানুষ। মাদরাসায় পড়াশোনা করেছি। ওযু-ইস্তিঞ্জার মাসআলা জানা থাকলেও সংবিধান সম্পর্কে আমার জানা-শোনা আর কীইবা থাকবে! তিনি অনেকটা তাচ্ছিল্য ভরে বললেন, মাওলানা! আপনার তো এ বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই। আমার খুব রাগ হল। আমি বললাম, সংবিধান সম্পর্কে আমি জানি না! আমি খুব ভালো করেই জানি, আপনি সংবিধান নিয়ে পকেটে করে যে নোট নিয়ে এসেছেন, যা আপনার সেক্রেটারি প্রস্তুত করে দিয়েছে, আপনার জ্ঞানের দৌড় ওই পর্যন্তই। আপনার নিজের জানা নেই, সংবিধান কাকে বলে! অথচ আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি সারা দুনিয়ার সকল সংবিধান মুতালাআ করেছি। আপনি আমাকে যে কোনো সংবিধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন, আমি আপনাকে বলে দেব, ইংল্যান্ডের সংবিধানে কি আছে, হিন্দুস্তানের সংবিধানে কি আছে, এবং ইউরোপ-আমেরিকারসহ অন্যান্য দেশগুলোতে কোন ধরনের সংবিধান অনুসরণ করে তারা দেশ চালাচ্ছে, আমি আপনাকে সবকিছু বলতে পারবো। অথচ আপনি আমাকে বলছেন, আমার কোনো ধারণা নেই সংবিধান সম্পর্কে! আমার কথা শুনে তিনি একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। এরপর আর কোনো কথা বলার সাহস করেননি। সেই মজলিসেও না এবং পরবর্তী আর কোনো মজলিসেও না।
তো আমি বলছিলাম, আমি তো রাজনীতি শিখিনি। তেপ্পান্ন বছর বয়সে পাকিস্তানে হিযরত করি। দু’বছর লেগে যায় দেশ গঠন করতে করতে। কেবল তখনই রাজনীতির অঙ্গনে অল্পবিস্তর আসা হয়। এর পূর্বে কি আমার জানা ছিল, রাজনীতি কী জিনিস? কিন্তু যখন প্রয়োজন পড়ল, তখন আল্লাহ রাস্তা খুলে দিলেন।
ইসলামী সংবিধান এখনো সচল
একবার পাকিস্তানের চার প্রদেশের চার প্রধানমন্ত্রী এবং আরো বড় বড় মন্ত্রী এবং আমাদের আলিমদের মধ্যে মতবিনিময় হচ্ছিল। তারা বলছিলেন, আপনারা যে সংবিধানের কথা বলছেন তা এ যুগে অচল। আমরা বললাম, যদি ইসলাম এ যুগে অচল হত, তা হলে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল আমাদেরকে কখনো এ নির্দেশ দিতেন না। আমাদের বিশ্বাস, এ যুগেও ইসলাম সে যুগের মত অবশ্যই চলবে। এসব বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা তো অনেক দীর্ঘ হল। যেটা বলতে চাচ্ছিলাম তা হল, নূরুল আমিন সাহেব, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ঘরে গিয়ে বললেন, সত্য কথা তো তাই যা মুফতি সাহেব বলেছেন। আমাদের মানা না মানা সেটা ভিন্ন জিনিস। ইনসাফের কথা হল, মুফতি সাহেবের কথাই সঠিক।
যোগ্যতা অর্জন করুন, সকল অঙ্গনে আল্লাহ কাজ নেবেন
তো যাইহোক, আমরা ইলম যেভাবে অন্বেষণ করতে হয় সেভাবে অন্বেষণ করেছি। যখন ছাত্র ছিলাম তখন আমাদের পড়া-লেখা ছাড়া অন্য কোন ব্যস্ততা ছিল না। পড়া-লেখা থেকে ফারেগ হওয়ার পর যখন প্রয়োজন হয়েছে, আল্লাহর শোকর এমনভাবে কাজ করেছি যে, বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য থাকত। যে কোনো আলিমের কথাই বলুন, দুনিয়াতে যারাই দীনের বড় বড় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, যদি তাদের ছাত্রজীবন দেখা হয় তাহলে কোথাও একথা খুঁজে পাবেন না যে, ছাত্রজীবনে তারা সভা-সমাবেশ করতেন এবং জোরে-শোরে শ্লোগান দিতেন। যদি তারা ছাত্রজীবনে শ্লোগান দিতেন, তা হলে দীনের বড় বড় খেদমত আঞ্জাম দেয়া তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হত না। বড় বড় আলিমদের মধ্য থেকে যারাই রাজনীতির ময়দানে এসেছিলেন, তারা সকলে এমনই ছিলেন। তাদের ছাত্রজীবন রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। তারা শুধুই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তারপর আল্লাহ যখন তাদেরকে কাজে লাগিয়েছেন তখন রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাদের দ্বারা অনেক কাজ হয়েছে। এ সব কিছু শোনানোর উদ্দেশ্য হল, ছাত্রজীবনকে গনীমত মনে করে কাজে লাগান। এখনো সময় আছে।
রাজনীতির কারণে স্কুল-কলেজের ধ্বংসাত্মক পরিণতি
বিশেষভাবে রাজনীতি আজ স্কুল-কলেজকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের কাছে না আছে ইলম, না আছে দীন এব না আছে দীনদারী, না হালাল-হারামের পার্থক্য। আছে শুধু শ্লোগান এবং শ্লোগানের পেছনে ডিগ্রি। আর ডিগ্রির ওপর নির্ভর করে তাদের চাকুরি। এভাবে চলেও তারা পার পেয়ে যায়। কারণ তারা শ্লোগান দিতে শিখেছে এবং শ্লোগান দিয়ে চড়াও হয় নিজেদের প্রধান শিক্ষকের ওপর- দাও, আমাদেরকে ডিগ্রি দিয়ে দাও। এভাবে তাদের চাকুরিও হয়ে যায় এবং দুনিয়াতে তারা বাহ্যিকভাবে কামিয়াবও হয়ে যায়। যদিও সেটা কোনো কামিয়াবি নয়, কেবল ছাই।
সার্টিফিকেট বনাম যোগ্যতা
প্রিয় ছাত্র ভাইয়েরা! আমি বলতে চাই, আপনারা এসবের লোভ করবেন না। আপনাদের সনদের দু’পয়সারও মূল্য নেই। ধরুন, আমি বড় বড় উপাধি আপনার নামের শুরুতে লিখে দিলাম। বাজারে যান, দেখবেন সেগুলোর মূল্য দু’পয়সাও হবে না। অফিসে যান, কোনো চাকুরিও এই সার্টিফিকেট দিয়ে পাবেন না। হ্যাঁ, যদি আপনার যোগ্যতা থাকে তাহলে সবকিছু আছে। এটা অনেক বড় মূল্যবান জিনিস। আর যদি যোগ্যতা না থাকে, তাহলে কিছুই নেই। সুতরাং আপনারা সার্টিফিকেটের লোভ করবেন কেন? দেখুন আমি যা বলছি হয়ত আমার পরে এ কথা বলার কেউ থাকবে না। আমি শুধুশুধুই আমার চুলদাড়ি সাদা করিনি। বরং সারাটা জীবন এ কাজেই ব্যয় করলাম। আমার চোখ খুলেছে মাদরাসায়। ছাত্রদের মাঝে আমার শৈশব কেটেছে। শৈশবের খেলাধূলাও আমি করেছি ছাত্রদের সাথে। আমার জীবনটাই কেটেছে দারুল উলুম দেওবন্দের পরিবেশে। সেসব আকাবিরের কোলে, বর্তমান দুনিয়ায় যাদের কোনো নযীর খুঁজে পাবেন না। সেসকল আকাবিরদের তত্ত্বাবধানে শুধু পড়িনি, পড়িয়েছিও।
ইলমে দক্ষ ও প্রাজ্ঞ হোন, রাজনীতিতে নয়
প্রিয় ছাত্ররা! আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। বিশ্বাস করুন, আমার পরে একথা বলার লোক আর পাওয়া যাবে না। কারণ সেই পরিবেশ দেখেছে এবং এত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এমন লোক আর কেউ বেঁচে নেই। সবাই নবীন। নতুন কাজে যোগ দিয়েছে। অল্প কিছু লাভের পেছনে তারা ছুটে যায়। আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা হল, যে ছাত্র তার ছাত্রজীবনে অন্য কোনো ধান্দায় লিপ্ত হয়ে যায়, বিশেষভাবে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যোগদান করে…। রাজনীতি তো ছাত্রদের জন্য একেবারে বিষের মত। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে বক্তৃতা-প্রশিক্ষণের যে প্রোগ্রামগুলো হয় এতে বাড়াবাড়ি করাও ক্ষতিকর। অনেকে দেখা যায়, সবক-তাকরার ইত্যাদি বাদ দিয়ে বক্তৃতা শেখার পেছনে লাগে, এটা কিন্তু তাদের জন্য মোটেই উপকারী নয়। হ্যাঁ, সাদামাটাভাবে প্রতি সপ্তায় বক্তৃতা শেখার অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।
তো ভাই, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে এবং এই অভিজ্ঞতা সে সকল মনীষীরও যারা ছাত্রজীবনকে জ্ঞান অর্জনের পেছনে ব্যয় করেছেন, বরং অমুসলিম মনীষীদের অভিজ্ঞতাও এটাই। হযরত শায়খুল হিন্দের আন্দোলনের সময়ের কথা। বেনারস ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর (যিনি হিন্দু ছিলেন) তার ভার্সিটিতে এক বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেন, আমি ছাত্রদেরকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ কিছুতেই দেব না। কারণ রাজনীতি ছাত্রদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
তাই বলি, এই সময়কে গনীমত মনে করুন। যা বলেছি সেগুলো নিয়ে চিন্তা করুন। কুরআনের আয়াত কী বলে সেটা দেখুন। আমার অভিজ্ঞতা আপনাদের সামনে পেশ করলাম। আপনাদের তো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। এই সময়টিকে শুধুই কিতাব বোঝার, দীনী প্রজ্ঞা অর্জন করার এবং বৃদ্ধি করার পেছনে ব্যয় করুন। দু’চার বছর এভাবে মেহনত করেই দেখুন না।
چند روزى جہد كن باقی بخند
‘অল্প কিছু দিন পরিশ্রম কর, তারপর বাকি জীবন সুখে থাক।’
ছাত্রজীবন সমাপ্ত করে রাজনীতি করতে পারেন
যখন ছাত্রজীবন সমাপ্ত হবে, তখন যদি কারো মনে চায় রাজনীতি করতে, তা হলে ইস্তেখারা করবে। চিন্তা-ভাবনা করবে। যদি রাজনীতি সত্যিই দীনের স্বার্থে হয়ে থাকে…। আজকাল রাজনীতি এত নোংরা হয়ে গেছে যে, যারা ধর্মের জন্য রাজনীতি করে, রাজনীতিতে গিয়ে তাদের ধর্মও শূন্যের কোঠায় নেমে আসে এবং অনিচ্ছাতেই অন্যান্য জিনিস লেগে যায়। আমি তো রাজনীতির পেছনে দশ বছর ব্যয় করেছি। শেষে এই দেখে বের হয়ে এসেছি যে, মানুষ সেখানে যাওয়ার পর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এরপর অন্যান্য লোভ-লাভের চিন্তা প্রবল হয়ে যায়। ফলে সে বাধ্য হয় দীনের খেলাফ চলতে থাকে। তখন শুধু বিভিন্ন ব্যাখ্যার আশ্রয় খোঁজে।
যা হোক পড়ালেখা সমাপ্ত হওয়ার পর প্রত্যেকে স্বাধীন। যদি পূর্ণ যোগ্যতা অর্জনের পর সত্যি সত্যি ইসলামী সিয়াসত মনে হয়, তা হলে তাতে অংশগ্রহণ করতে কোন বাধা নেই। দীন রক্ষার জন্য তা ভালো কাজ। যেমন আমিও দু’বছর পাকিস্তান হওয়ার আগে এবং দশ বছর পাকিস্তান হওয়ার পর রাজনীতিতে সময় ব্যয় করেছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং দেশের কর্ণধারদের সাথে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে চেষ্টা করেছি রাজনীতিকে ইসলামের রঙ্গে রঙ্গীন করার। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
দীনী মাদরাসার গুরুত্ব
পরে মনে হল, যাক নিজের কাজ করি। নয়তো এটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। কারণ ‘ইলম অন্বেষণ করলে সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়।’ এ উদ্দেশ্যে মাদরাসা বানালাম এবং মাদরাসাকে মনে হল গনীমত। দীনের যেটুকু নিঃশ্বাস বাকি আছে তা এই মাদরাসার উসিলায় এবং এটা তখনই হবে যখন সব ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে একমনে পড়ালেখায় লেগে থাকবেন এবং এ সময়টাকে গনীমত মনে করে কাজে লাগাবেন। কবিতা:
دل آرامے کہ داری دل درد بند
دگر چشم از ہمہ عالم فروبند
‘সবকিছু থেকে চক্ষু বন্ধ করে ইলমের পেছনে লেগে যাও। চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাও।’
যে কোনো বড় আলিমের কথাই বলেন, তার ছাত্রজীবন দেখুন। দেখবেন, ছাত্রজীবনকে তিনি সত্যিকারের ছাত্রের মতই ইলমের অন্বেষণ কাটিয়েছেন। যদি আপনারা দুনিয়া আখেরাতে সফলতা চান, তা হলে এই বৃদ্ধের কথা শুনুন এবং মান্য করুন। এরপরে এভাবে উপদেশ দেয়ার লোক আর পাবেন না। কারণ আমি যে পরিমাণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, মাদরাসার মধ্যে পড়ে এবং পড়িয়েই আমার জীবন কেটেছে। আল্লাহ জানেন, চোখের সামনে কত মাদরাসা গড়তে দেখেছি এবং ভাঙ্গতে দেখেছি। সুতরাং আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিশেষভাবে এ কাজে লেগে থাকুন।
সফলতার রহস্য
দ্বিতীয় বিষয় হল, হালাল-হারামের চিন্তা করুন। তাকওয়া অবলম্বন করুন। শুধু এইটুকু আমল করুন। অতিরিক্ত নফল নামায, নফল যিকির আযকার ইত্যাদির কথা বলছি না। শুধু বলছি, নামায রোযা গুরুত্বসহ আদায় করুন। সবকিছুতে হালাল-হারাম বেছে চলুন। যদি আপনারা সবকিছুতে হালাল-হারাম বেছে চলতে পারেন তাহলে সবকিছু আপনাদের পায়ের তলে লুটিয়ে পড়বে। যেখানেই যাবেন ইনশা আল্লাহ সেখানেই আপনাদের কদর হবে। আল্লাহর সাহায্য সর্বদা আপনাদের সাথে থাকবে। আর যদি এই সময়টাকে নষ্ট করে ফেলেন (আল্লাহ না করুন) তাহলে দুনিয়াও বরবাদ হবে, আখেরাতও বরবাদ হবে। ইলম তো আসবেই না, বরং যে জিনিসের জন্য এ সময়কে নষ্ট করা হয়েছে, তাও অর্জিত হবে না। তখন কেবল ক্ষতিই ক্ষতি হবে। আপনাদের মূল্য নির্ণীত হবে ইলমের মাধ্যমে, যোগ্যতার মাধমে। অথচ এই ইলম ও যোগ্যতা তো অর্জন করেননি।
যারা কলেজে পড়ছে তাদের সেখানে ইলম নেই। আগে কিছু যোগ্য লোক সেখানেও তৈরি হত, এখন তাও হচ্ছে না। তবে ডাণ্ডার জোরে ডিগ্রি ঠিকই আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু আপনাদের তো এ উপায় নেই। সুতরাং নিজেদের অবস্থার ওপর দয়া করুন। বছর শেষ হওয়ার আরো এক দেড় মাস বাকি। অভিজ্ঞতায় এটাও দেখা যায়, কেউ যদি শুরুর সময়ে গাফেল থাকে কিন্তু শেষ সময়ে মেহনতের সাথে পড়ে তাহলে সেও সফলতা লাভ করে।
সময়ের মূল্য দিন এবং কাজ করে যান
ভাই আগে যদি না করে থাকেন তাহলে এখন করুন। নিজের ওপর একটু দয়া করুন। নিজের মা-বাবার ওপর একটু দয়া করুন। তারা আপনাদেরকে এই কাজের জন্য এখানে পাঠিয়েছেন। সুতরাং আপনারাও কিছু অর্জন করে নিন। অর্জন করার সময় এখনই। যদি এই সময় অতীত হয়ে যায় তাহলে এই সম্পদ আর কোনোভাবে অর্জন করতে পারবেন না। দুনিয়ার সকল কিছু আসবে। যা চাও হয়ত তাই পাবে। কিন্তু ইলম আর পাবে না। যে সকল জিনিস উস্তাযের নিকট থেকে শিখতে হয়, তাতে ইলম, আমাল, আখলাক ও আদাব সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। আমি একদু’জন নয় অনেক তালিবুল ইলমকে দেখেছি, যারা সময় অপচয় করেছে। তারপর পরিণামে নিজেরা ধ্বংস হয়েছে।
আমরা যারা শিক্ষকতা করছি, আমাদের ছাত্রদের মধ্যে যারা পরীক্ষায় উচ্চ নম্বরে কৃতকার্য হয় যদি তাদেরকে আমরা নিজেদের মানদণ্ড যাচাই করি তাহলে খুব কমসংখ্যক ছাত্রই যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারবে। আগের মানদণ্ড অনুসারে পরীক্ষা নিলে আপনাদের মধ্যে হয়ত চার পাচঁজন খুব কষ্ট করে পাস করতে পারবে। আমরা এখন দেখেও না দেখার ভান করে আপনাদের পাস করিয়ে দিই। যোগ্যতা তো কমছেই কমছে। এরপর যদি মুতালাআও কমিয়ে দেন তাহলে কী অবস্থা হবে? যাক, এ কথার ওপরই আজকের মজলিস শেষ করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের সবকিছুকে তাফাক্কুহ অর্জনের জন্য বিসর্জন না দেবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাফাক্কুহ হাসিল হবে না।
মাদরাসায় তো আপনারা এজন্যই এসেছেন। এজন্যই তো আপনাদের বাবা মা আপনাদেরকে মাদরাসায় পাঠিয়েছেন। আপনারা খাওয়া-দাওয়াও এ উদ্দেশ্যেই করে থাকেন। মানুষের সামনে এটাই বলেন যে, আমরা দ্বীনি ইলম হাসিলের জন্য মাদারাসায় এসেছি। সুতরাং আপনাদের দায়িত্ব হল তাফাক্কুহ অর্জনের চেষ্টা করা। এখনও যদি চেষ্টা করেন, তা হলে সারা বছরের ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। সে সাথে নামাযের পাবন্দী করুন। একটু চিন্তা করুন, যদি আমাদের নামাযটাই এখনো ঠিক না হয় তাহলে আমরা দীনের কী খেদমত করব? কমপক্ষে নামাযটা তো আমাদেরকে জামাতের সাথে গুরুত্ব দিয়ে পড়া উচিত। এর জন্য একে অপরকে সহযোগিতা করবেন। সহানুভূতির সাথে, রাগের সুরে নয়। ফযরের সময় একে অপরকে আস্তে আস্তে উঠিয়ে দিবেন। যদি সে না উঠে, আর আপনি নামায পড়তে চলে যান, তাহলে নামাযের পর আবার তাকে জাগিয়ে দিন। নিজের ভাইয়ের পেছনে এইটুকু মেহনত তো আমাদের করতে হবে।
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা! মুফতী সাহেব (রহ.)-এর এ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি মনোযোগদিয়ে পড়ুন এবং বারবর পড়ুন। তাঁর হৃদয় নিঙ্গড়ানো দরদমাখা কথাগুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করুন। দেখবেন, নিজের মধ্যে এক ধরনের জযবা ও আবেগ, গতি ও স্প্রিড অনুভূত হবে। হীনমন্যতা দূরিভূত হবে। পড়া-লেখায় নতুন গতি সঞ্চারিত হবে, ইনশা-আল্লাহ।
অনুবাদ: সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
ঘোষণা
(সমস্যা নিয়ে আর নয় অস্থিরতা, সমাধানই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা)
শিক্ষার্থী বন্ধুরা, আপনাদের সহযোগিতা ও দিক-নির্দেশনার লক্ষ্যে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মুখপাত্র, ইসলামী গবেষণা ও সৃজনশীল সাহিত্য পত্রিকা মাসিক আত-তাওহীদে নিয়মিত বিভাগ ‘শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পমার্শ’ চালু করা হয়েছে। উক্ত বিভাগে একদিকে থাকবে আপনাদের জন্য নিয়মিত দিক-নির্দেশনা মূলক প্রবন্ধ। অপরদিকে থাকবে আপনাদের সমস্যা-সমধান নিয়ে শিক্ষা পরামর্শ।
অতএব এখন থেকে সমস্যা নিয়ে আর নয় অস্থিরতা, সমাধানই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা’ শ্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাবো উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে। সুতরাং শিক্ষা বিষয়ক যে কোন সমস্যা আমাদের নিকট লিখুন এবং টেনশানমুক্ত জীবন গড়ুন। আমরা আপনার সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকবো এবং অতিদ্রুত সময়ে যথার্থ সমাধান পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহই তাওফীকদাতা।
যোগাযোগের ঠিকানা
বিভাগীয় সম্পাদক
শিক্ষার্থীদের পাতা ও শিক্ষা পরামর্শ বিভাগ
মাসিক আত-তাওহীদ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
ই-মেইল: hmsalimuddin22@gamil.com