জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহিলা মুহাদ্দিস!

মহিলা মুহাদ্দিস!

ড. মাওলানা আকরাম নদভী

অনেকেই হয়তো অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বসবেন, আরে! মহিলারা আবার ইসলামিক স্কলার হতে পারে নাকি? আসলে এখানে শুধু মহিলা স্কলার বলা হয়নি, বলা হয়েছে মুহাদ্দিসাত অর্থাৎ মহিলা মুহাদ্দিস!

ইসলামের গত চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে আমরা অনেক যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ ইত্যাদি খুঁজে পাই। বেশিরভাগ সময়েই তাঁদের পুরুষ হিসেবেই দেখে আসছি। তাই হয়তো অনেকের এরকম চিন্তা হতে পারে যে ইসলামের জ্ঞান প্রচারের ইতিহাসে নারীদের হয়তো কোন অবদানই নেই। অথচ সত্যটা আসলেই অনেক অদ্ভুত আর সুন্দর। সেটিই ইতিহাস ঘেঁটে প্রমাণ করে দেখিয়েছি।

খুঁজে খুঁজে এক-দুই না, একশ-দুইশ ও না, আট হাজার নারী মুহাদ্দিস ও ফকীহ খুঁজে পেয়েছি, যারা জ্ঞানে, ঈমানে, আখলাকে ছিলেন তুলনাতীত। যাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন খোদ আমাদের বড় বড় ইমামগন! উম্মুল মু’মিনিন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে শুরু করে এই শতাব্দির শায়খা বাহিয়া আল কুতবিয়া পর্যন্ত যত বড় বড় আলিমা ছিলেন তাঁদের জীবনী চল্লিশ ভলিউমের magnum opus মুক্কাদ্দিমায় সংকলন করা হয়েছে। সেই বিশাল কাজের মুখবন্ধ অথবা ভূমিকাই হল ৩১৪ পৃষ্ঠার মুহাদ্দিসাত al-Muhaddithat|

বইটি প্রধান ১০টি অধ্যায়ে রয়েছে হাদীসের বিভিন্ন ধরন, হাদীস সংকলনের নিয়ম ইত্যাদি বিভিন্ন তাত্ত্‌িবক আলোচনাও এনেছেন প্রয়োজন মাফিক। কি কি বিভিন্ন তরীকায় নারীরা শিক্ষিকার ভূমিকা পালন করেছেন, কীভাবে তাঁরা এই জ্ঞান অর্জন করেছেন, কারা কারা তাঁদের ছাত্র ছিলেন, তাঁদের প্রতি সালাফদের ইমামদের ধারণা কি ছিল ইত্যাদি এতো সুন্দর করে গোছানো হয়েছে বইটি পড়লে অবাক হতে হয়।

আম্মাজান আয়িশা (রাযি.)-এর সম্পর্কে অনেকের জ্ঞান ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একজন স্ত্রী হিসেবে আর একজন রাবী হিসেবে। কিন্তু উম্মাহর সবচাইতে শক্তিশালি মুহাদ্দিস আর ফকীহদের একজন হিসেবে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে আমার বলতে গেলে কোন ধারণাই ছিল না। হাদীসের জারহ আর তা’দীলের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য| কারণ হাদীসের সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের নিয়মগুলো বলতে গেলে তাঁর দৃষ্টান্ত থেকেই নেওয়া হয়েছিল। কীভাবে? সেটা বইয়ের ২৪০ তম পৃষ্ঠা পড়লেই বুঝতে পারবেন।

আজ আমরা আমাদের আশেপাশে, আমাদের দেশে কিংবা অন্য কোন দেশে কয়জন হাফেযা পাই? অথচ এক সময় ছিল যখন পুরো কুরআন মুখস্ত থাকা একজন নারীর জন্য খুব একটা বড় ব্যাপার ছিল না। ইসলামের নারীরা তখন কুরআনের সাথে সাথে এর শানে নুযুল আর তাফসীর শিক্ষা করতেন অহরহ। তাঁরা নিজেরা শিক্ষা দিতেন ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সুনান এর সমস্ত গ্রন্থ, মুসনদে ইমাম আহমদ, বুখারী-মুসলিমসহ ফিকহের বড় বড় গ্রন্থসমূহ আর এ সবকিছুই তাঁদের মুখস্ত ও নখদর্পনে ছিল।

কত শত ইমামের উস্তাদ যে নারী ছিলেন তার ইয়াত্তা নেই। ইমাম আহমদ ইবনে nv¤^j, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল জাওযী, ইবনে কাইয়িম, ইমাম যাহাবী, ইবনে কসীর, ইবনে রজবসহ আরও অনেকের উস্তাদগণের মধ্যে নারীরাও ছিলেন। তখনকার সাথে আজকের দুনিয়ার সাথে তুলনা করলে দেখা যায় দীনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের মা-বোনদের বলতে গেলে একরকম পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে। বড়জোর তাদের শুধু হাফেযা বানানো হয়ে বাচ্চাদের মাদরাসায়।

অথচ একজন মা যখন আলিমা হবেন তার সন্তানরাও আলিম হবেই। একজন স্ত্রী যখন আলিমা হবেন স্বামী আলিম হবেই। আজ আমাদের সমাজে মহিলাদের মধ্যে দীনের জ্ঞান বলতে গেলে কিছুই নেই। তাই তারা মকসুদুল মুমিনীন, আমলে নাজাত, বারো চান্দের ফযীলত এসব বইগুলো ধরে পড়ে আছেন এখনো।

ইসলাম তো চৌদ্দশ বছর আগে থেকেই একুশ শতাব্দির চাইতেও মডার্ন হয়েই আছে। শুধু আমরাই দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ছি।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নারী-পুরুষ সৃষ্টি করেছেন যেন তারা তাদের যোগ্যতা এবং প্রতিভার আলোকে শিক্ষা অর্জন করে নিজেদের উন্নত করতে পারে, একজন উন্নত মানুষে পরিণত হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি তাদের সুযোগ না দেন, তাহলে যা হবে তারা কোনো কিছু শিখবে না, তাদের জ্ঞান থাকবে না, তারা অজ্ঞ মূর্খ হিসেবে বড় হবে।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে হযরত খাদিজা (রাযি.)সহ অনেক মহিলা এই শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ পেয়েছিলেন তাই তারা এমন মহান হতে পেরেছিলেন। আমাদের সময়ের নারীরাও তাদের মত হতে পারতো। কিন্তু আমরা তাদের শিক্ষা অর্জন করার সময় এবং সুযোগ দান করি না। ফলে এভাবে অনেকেই অজ্ঞ থেকে জীবন পার করে গেছেন কিছু করতে পারেননি।

বহুদিন ধরে আমাদের সমাজে মহিলারা সম্মান পায়নি। অনেকেই আমার একথা পছন্দ না করতে পারেন। কিন্তু আপনার বাসার দিকে একটু মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখুন। মানুষ মহিলাদের সম্মান করে না। পিতারা তাদের কন্যাদের মর্যাদা দেয় না, ভাইয়েরা বোনদের সম্মান করে না। সব সময় আপনি এটা দেখতে পাবেন। মানুষ শুধু ছেলেদের সম্মান করে। তারা কোনো কিছু আশা করলে শুধু ছেলেদের থেকে আশা করে।

এমনকি স্বামীরাও স্ত্রীদের থেকে কিছু আশা করে না। তারা মনে করে না যে, তার স্ত্রীও একজন ভালো বন্ধু হতে পারেন, ভালো সাহায্যকারী হতে পারেন। আপনি তার কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারেন।

যখন আমি মুহাদ্দিসাত (নারী হাদীস স্কলারদের ওপর চল্লিশ ভলিউমের বিশাল বই)-এর ওপর রিসার্স শুরু করি, এই কাজ করার পেছনে আমার অন্যতম একটি প্রেরণা ছিল, অন্তত এই কাজটি মানুষের নিকট প্রমান করবে যে, প্রাথমিক যুগের ইসলাম এমন ছিল না। অতীতের মুসলমানরা নারীদের সব ধরণের মর্যাদা দান করেছিল। রাসূল (সা.) মহিলাদের মসজিদে আসতে দিতেন, তারা মসজিদে রাসূল (সা.)-এর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন।

তিনি এমনকি বলেছেন, ‘নারীদেরকে মসজিদে আসার ক্ষেত্রে বাধা দিও না।’

যখন তিনি নামায পড়াতেন তখন কখনো তাঁর দুই নাতি হযরত হাসান-হুসাইন (রাযি.) আবার কখনো তাঁর নাতনি উমামাহ বিনতে আবিল আসকে তার কাঁধের ওপর চড়তে দিতেন। তাদের সবার সাথে সঠিকভাবে সমান আচরণ করতেন। তাদের সবাইকে সমান সুযোগ দিতেন। রাসূল (সা.)-এর যুগে আল্লাহ নারীদের এভাবে মর্যাদা দান করেছিলেন। এরপরের কয়েক প্রজন্ম ধরে তাদের এই মর্যাদা অব্যাহত ছিল। কিন্তু আমাদের সময়ে এসে সেটা হারিয়ে গেছে।

তাই আমার চিন্তা ছিল, অন্তত যদি নারী হাদীস বিশারদদের ইতিহাস লেখা হয় তাহলে মানুষ সেই সময়ের কথা মনে করে আবার ফিরে আসার প্রচেষ্টা চালাবে। আর এটা ইসলামের জন্যেও ভালো কাজ হবে।

কারণ পাশ্চাত্যে বহু মানুষ মনে করে, ইসলামে নারীদের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই আমি এই ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে চেয়েছি যে, এই জন্য ইসলাম দোষী নয়। আমাদের সমাজ সংস্কৃতি বিষয়টাকে খারাপ রূপ দিয়েছে।

আমার এই ক্ষুদ্র পার্সেন্টিজের কথা ধরুন, আমি উৎসসমূহ মাত্র একবার করে পড়েছি। বহু উৎস আমি মিসও করেছি। তারপরেও শুধুমাত্র হাদীস শাস্ত্রে আমি প্রায় ৮ হাজার… না, এখন প্রায় ৯ হাজারে পৌঁছেছে, কারণ আমি নতুন তথ্য পেলে যুক্ত করি… ৮ হাজার ৫ শত নারী হাদীস বিশারদ ছিল শুরুতে এখন এটা প্রায় ৯ হাজারের উপরে পৌঁছেছে… তো, শুধুমাত্র হাদীস শাস্ত্রে ৯ হাজারের উপরে মুহাদ্দিসাত (নারী হাদীস বিশারদ)! শুধু একজন মানুষের রিসার্স। ওপরন্তু আমি বহু উৎস মিস করেছি। আর আমি জানি যে, এই বিষয়ে আর বহু তথ্য রয়েছে। কিন্তু আমি বেশি গভীরে যেতে চাইনি। কারণ আমার অন্যান্য কাজ আছে।

একবার চিন্তা করে দেখুন, ইসলামের ইতিহাসে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রায় ৯ হাজারের বেশি মহিলা হাদীস শাস্ত্রে অবদান রেখেছেন। তারা মানুষকে হাদীস শেখাতেন, ফতোয়া দিতেন। তারা রাসূল (সা.)-এর মসজিদে শিক্ষা দিতেন, হারাম শরীফে শিক্ষা দিতেন, জেরুজালেমে শিক্ষা দিতেন, তারা মিসরের প্রতিটি মসজিদে শিক্ষা দিতেন, সিরিয়া, মরক্কো এবং মুসলিম বিশ্বের আরও অনেক দেশে তারা এভাবে শিক্ষা দিতেন।

ইসলামের ইতিহাসের বহু বিখ্যাত পুরুষ আলিমরা, বহু বড় বড় ইমামরা যেমন- ইবনে আসাকির, ইবনে হাজার আল-আসকালানী, সুয়ুতী, সাখাওয়ী, ইবনে তাইমিয়া, যাহাবী, মিযযী, এমনকি ইমাম আবু হানিফ, ইমাম মালিক, শাফিয়ী, ইবনে হাম্বল … এ সকল আলিমরা বহু নারী স্কলারদের ক্লাসে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে ইলম হাসিল করেছিলেন।

এমনটা ছিল না, নারীরা শুধু জ্ঞান গ্রহণ করতেন বরং মহিলারা শিক্ষা দীক্ষায় এতোই পারদর্শী ছিলেন যে, মানুষ তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।

ইমাম আবু আবদুল্লাহ আল-হাকিম আন-নায়শাপুরী ঠিকই বলেছিলেন যে, মুসলমানরা তাদের ধর্মের এক চতুর্থাংশের জন্য এককভাবে নারীদের শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। চিন্তা করে দেখুন! ধর্মের এক চতুর্থাংশ শুধু নারীদের মাধ্যমেই জানা সম্ভব হয়েছে।

এজন্যই আমি বার বার বলি, পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মের ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায় না যেখানে ধর্মের একেবারে গোড়ার দিকে গঠনমূলক সময়ে নারীরা এতো বড় ভূমিকা রেখেছেন এবং ইলমে দীনের খেদমত আনজাম দিয়েছেন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ