জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-২৪শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি-২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিজয় দিবসের তাৎপর্য

বিজয় দিবসের তাৎপর্য

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

 

১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। জাতি প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করে। আমাদের জাতীয় জীবনে দিবসটির তাৎপর্য অপরিসীম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর জাতি বিজয় অর্জন করেছিল। পাক হানাদার বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য এই দিন বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল। যার ফলে বিশ্বের বুকে জন্ম নিল স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির দীর্ঘ দিনের সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা এই দিন সফল ও সার্থক হয়েছিল। বাঙালি জাতি দীর্ঘ ২৫ বছরের শোষণ-নিপীড়ন থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তি পেয়েছিল।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, যা এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই আমি এই নিবন্ধে অতিসংক্ষেপে স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে আলোকপাত করছি। ১৯৬৯ সালে স্বৈরচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) যে গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তৎকালীন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ক্ষমতা গ্রহণ করে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন এবং শীঘ্রই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপি। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া বাঙালিদের বিরুদ্ধে আবারও ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর পরামর্শে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার জন্য আহ্বান জানালেন। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেন।

কিন্তু জুলফিকার ভুট্টো ঘোষণা দিলেন যে, তার দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে না। তিনি আরও বললেন যে, তিনি ছয় দফা মানেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন যে, ছয় দফার পক্ষে জনগণ রায় দিয়েছে, কাজেই ছয় দফার ভিত্তিতেই পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হবে। ভুট্টোর পরামর্শে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ এক ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়ার এই ঘোষণায় পূর্বপাকিস্তানে আগুন জ্বলে উঠল। হাজার হাজার মানুষ লাঠি-সোটা নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমে আসল। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন এবং ২ ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করলেন। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করে এবং রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল করে। সেনাবাহিনীর সাথে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষ বাঁধে। এসব সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর গুলিতে বহুলোক হতাহত হয়। ঢাকায় সেনাবাহিনীর গুলির প্রতিবাদে ৬ মার্চ পর্যন্ত হরতাল বর্ধিত করা হয়। হরতালে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ দেন। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু জনগণকে স্বাধীন তাসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পূর্বপাকিস্তানের তুমুল আন্দোলনে ভীত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চ বেতার ভাষণে স্থগিতকৃত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চে আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাগদানের ব্যাপারে কয়েকটি শর্ত আরোপ করেন। শর্তগুলোহল: সামরিক আইন তুলে নেওয়া, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তাহলে তিনি ও তাঁর দলের সদস্যরা জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগদান করবেন বলে তিনি ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ ঢাকায় আসলেন। ১৬ মার্চ থেকে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা শুরু হল। ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণে ভুট্টোও ঢাকায় এসে আলোচনায় শরীক হন। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সাথে কয়েক দফা আলোচনায় বসলেন, কিন্তু এসব আলোচনায় কোন ফল হয়নি, বরং কোনো প্রকার মিমাংসা ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়। আলোচনা ও অসহযোগ আন্দোলন একসাথেই চলছিল। অপরদিকে বিমানে ও জাহাজে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্বপাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আসছিল। অবশেষে ইয়াহিয়াখান ২৫ মার্চ রাতে পাকসেনাদের বাঙালি নিধনের নির্দেশ দিয়ে গোপনে পাকিস্তানে চলে যান। পাকসেনারা রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। প্রথমেই তারা ঢাক শহরে আক্রমণ শুরু করল এবং হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করতে লাগল। গভীর রাতে পাকসেনারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালিরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাঙালি সেনাবাহিনী, ইপিআর, আনসার এবং পুলিশ পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলল। শুরু হল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ| ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধে সার্বিকভাবে সাহায্য করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৭ মে কুষ্টিয়ার বদ্যনাথ তলায় (মুজিবনগরে) আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করা হল। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করা হল। পূর্বেই বলা হয়েছে, ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বোতভাবে সাহায্য করেছিল। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-শস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। দেশের তরুণ ও যুবকরা দলে দলে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে লাগল। এছাড়াও ভারত এককোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল। এই নয় মাস বাংলাদেশে বহু রক্ত ঝরেছিল। পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচারে নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করেছিল এবং গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিরিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল এবং হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম নষ্ট হয়েছিল। বাংলার দামাল ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনী ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকহানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তখন তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বড়বড় শহরে জমায়েত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথকমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করে। দেশ শত্রুমুক্ত হল এবং বিশ্বের বুকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের গৌরবের দিন, আনন্দেরদিন, এই দিনকে আমরা আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করব।

লেখক : প্রাবন্ধিক কলামিস্ট

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ