জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্ষণের ভয়াবহতা ও শাস্তি

ধর্ষণের ভয়াবহতা শাস্তি

নূর মুহাম্মদ রাহমানী

 

বিয়ে করা স্ত্রী ছাড়া কারও সঙ্গে কোনো ধরনের যৌনসম্পর্ক স্থাপন করাকে ইসলাম কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং এটিকে একটি জঘণ্য পাপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শুধু ইসলাম নয়; কোনো ধর্মেই ব্যভিচারের শিক্ষা নেই। ইসলাম ব্যভিচারকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ এবং হারাম আখ্যায়িত করেছে। বহু অন্যায় কাজের দ্বার খুলে দেয় এটি। এজন্য এর কাছে যেতেও নিষেধ করা হয়েছে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না, নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল ও মন্দ কাজ যা আরও অন্যায় কাজের পথ প্রদর্শক।’ (সূরা আল-ইসরা: ৩২)

বাইবেলে বলা হয়েছে ‘তোমরা ব্যভিচার করবে না।’

ব্যভিচারের শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী-তাদের প্রত্যেককে ১০০ কশাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেগ না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সূরা আন-নূর: ২)

এটা হলো অবিবাহিতদের ব্যভিচারের শাস্তি। আর বিবাহিতদের ব্যভিচারের শাস্তি প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে, ‘অবিবাহিতের ক্ষেত্রে শাস্তি ১০০ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে ১০০ বেত্রাঘাত ও রজম পা পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড।’ (সহীহ মুসলিম: ৪৫১১)

যিনা-ব্যভিচার সুস্পষ্ট হারাম ও নিন্দনীয় অপরাধ। আর ধর্ষণ তো আরও মারাত্মক। এ কেবল যৌন নির্যাতনই নয়; বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের বহিঃপ্রকাশ। দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্ক। অনৈতিকতা ও পাশবিকতার চূড়ান্ত পর্যায়।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় অবধারিতভাবে সংঘটিত হয়। এক. ব্যভিচার। দুই. বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন। প্রথমটির জন্য পূর্বোক্ত শাস্তি বরাদ্দ। পরেরটির জন্য ইসলামি আইনজ্ঞদের এক অংশ বলে, ‘মুহারাবা’র শাস্তি হবে। মুহারাবা হলো, পথে কিংবা অন্য কোথাও অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়া ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা। এতে কেবল সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে, আবার কেবল হত্যা করা হতে পারে। আবার উভয়টিই হতে পারে।

মুহারাবার শাস্তি ঘোষণা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সূরা আল-মায়িদা: ৩৩)

আর যদি ধর্ষণের কারণে হত্যাজনিত অপরাধ সংঘটিত হয় কিংবা ধর্ষণের শিকার কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তবে ঘাতকের একমাত্র শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।

জোরপূর্বক যদি ধর্ষণ করা হয় তাহলে যার ওপর জোর করা হবে তার ওপর কোনো শাস্তি আসবে না, শাস্তি আসবে শুধু জোরকারীর ওপর। রাসূল (সা.) এর যুগে এক নারীর সাথে জোরপূর্বক যিনা করা হয়। রাসূল (সা.) ওই মহিলার ওপর হদ তথা যিনার শাস্তি প্রয়োগ করেননি। যে জোরপূর্বক যিনা করেছে তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করেছেন।’ (সুনানে তিরমিযী: ১৪৫৩)

অন্য বর্ণনায় আছে, ‘সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম গণিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসীর সাথে জোড় করে ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে তার কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হযরত ওমর (রাযি.) ওই গোলামকে কশাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসীটিকে সে বাধ্য করেছিল বলে তাকে কশাঘাত করেননি।’ (সহীহ আল-বুখারী)

তাছাড়া নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বল প্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ২০৪৫)

আর অবশ্যই ধর্ষিতা নারীকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। প্রতিরোধ করতে গিয়ে ধর্ষিতা নারী মারা গেলে শহীদের মর্যাদা পাবে। হযরত সাইদ ইবনে যায়েদ (রাযি.) বলেন, ‘আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে-ও শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে-ও শহীদ।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭২)

উত্তোরণের উপায়

ব্যভিচার-ধর্ষণ থেকে বাঁচতে হলে দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে হবে এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করে চলতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে ও তাদের যৌনাঙ্গের সুরক্ষা করে এবং মুমিন নারীদের বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে ও তাদের যৌনাঙ্গের সুরক্ষা করে।’ (সূরা আন-নুর: ৩০-৩১)

আর দৃষ্টি অবনত রাখা ও যৌনাঙ্গ হেফাজতের কার্যকর পন্থা হলো বিয়ে। নবীজি (সা.) বলেছেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.)-এর বর্ণনায় রাসূল (সা.) বলেন, ‘হে যুব-সম্প্রদায়! তোমাদের মাঝে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কারণ বিয়ে দৃষ্টি অবনত রাখতে এবং লজ্জাস্থানের পবিত্রতায় অধিক সহায়ক। আর যে বিয়ে করতে সক্ষম নয় সে যেন রোজা রাখে। কেননা রোজা তার যৌনবাসনাকে দমিত করবে।’ (সহীহ আল-বুখারী: ২/৭৫৮)

তাই সমাজ থেকে ধর্ষণ, যৌননিগ্রহ, যৌন হয়রানি এবং কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভীতি প্রদর্শন, নারী অপহরণ এবং জোড়পূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, যৌন দাসত্ব, জোড়পূর্বক গর্ভধারণ এবং স্বামী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির যৌনাচরণসহ নারীর প্রতি সব রকমের সহিংসা দূর করতে নারীর পরিবারকে সোচ্চার হতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক না কেন, তাকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। পবিত্র কুরআনের বিধিমতে শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। নারী নিজেরও আত্মসচেতনতা তৈরি ও সোচ্চার হতে হবে। নির্যাতনকারী সমাজের যেই হোক না কেন, জোড়ালো কণ্ঠে কথা বলতে হবে তাদের বিরুদ্ধে। পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতি বর্জন করতে হবে। শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও অনুষ্ঠানাদিতে নারীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেসব জিনিস সহিংতার মনস্তত্ত্ব তৈরি করে, একে উসকে দেয় এবং যে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অবস্থানের সমন্বয়ে মানুষ এগুলেরার প্রতি প্রলুব্ধ হয়, সেগুলো থেকে প্রত্যেককে নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ অনুযায়ী বেঁচে থাকতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা বন্ধের জন্য দায়িত্বশীলদের কাছে দাবি জানাতে হবে। সুস্থ ও সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। সর্বোপরি ইসলামি চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে; আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহিতার কথা অন্তরে সদা জাগরুক রাখতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে গণমাধ্যমের পর্যাপ্ত ভূমিকা থাকতে হবে। তবে আদর্শ ও নৈতিকতার দীক্ষা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ