দেশব্যাপী ধর্ষণ ও বলাৎকারের পৈশাচিকতা
বিগত এক বছরের জাতীয় দৈনিক খুললে যে খবরটি সবচেয়ে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও হতাশা তৈরি করে তা হলো ধর্ষণ ও বলাৎকারের বীভৎস ঘটনাপরম্পরা। দেশ যেন ধর্ষকামীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এক শ্রেণীর শিক্ষক থেকে শুরু করে বাসের কন্ডাক্টর, ছাত্র থেকে শুরু করে সরকারি অফিসার সবাই এক কাতারে শামিল। বিকৃত যৌন উম্মাদনায় উন্মত্ত ও উন্মার্গ। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কার্যালয়ে সর্বত্র ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কদের অবাধ বিচরণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্র ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে ছাত্রীর মাকে ধর্ষণ এখন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। কোমলমতি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না যৌন সহিংসতার হাত থেকে। মনোবিজ্ঞানের সূত্রমতে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালানোর অন্যতম কারণ অসুস্থ ও বিকৃত মানসিকতা, ইংরেজিতে যাকে বলে Pedophilia|
এ প্রবণতার ধারাবহিকতায় যুক্ত হয়েছে আরেকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। গত ২৭ জুন’১৯ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের একটি স্কুলের জনৈক শিক্ষক ২০ ছাত্রীকে ধর্ষণ করার অভিযোগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। লম্পট এই শিক্ষকের নাম আরিফুল ইসলাম। স্থানীয় জনগণ গণধোলাই দিয়ে তাকে র্যাব-১১ ও পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। সে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে পালাক্রমে ছাত্রীদের ধর্ষণ করতো। পরে আপত্তিকর ছবিগুলো উদ্ধার করা হয় (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৮ জুন ২০১৯, পৃ. ১)। ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সেই পরিমল মাস্টারের কুকীর্তির কথা মানুষ এখনো ভুলেনি।
৭০ ভাগ ঘটনা লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে প্রকাশ পায় না। ৩০ ভাগ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। অনেক বালক ও মেয়ে ধর্ষকদের হাতে প্রাণ হারান। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান মতে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪হাজার ৩০৪জন। এর মধ্যে ৭৪০জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে (প্রথম আলো, ২৯ মার্চ ২০১৬)। অনেকে গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ধর্ষণের কারণে সমাজে মেয়েরা লাঞ্চিত হয়, কলঙ্কিত হয়, পুরুষের কিছু হয় না। বহুক্ষেত্রে মামলা হয় না। অনেক সময় আসামী জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে আরও ত্রাসের সৃষ্টি করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষকদের মনোবিকৃতিকে (Psychopathy) উস্কে দিচ্ছে। অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি এই দেশে।
২০১৯ সালের সাড়ে ৩মাসে ৩৯৬ নারী, শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র মতে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনে মামলা হয়েছে ১হাজার ১৩৯টি এবং হত্যা মামলা হয়েছে ৩৫১টি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ এপ্রিল ২০১৯)। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়া মোট ৩৪৫টি ঘটনার মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩৫৬। এদের মধ্যে মারা গেছেন ২২জন, আহত ৩৩৪জন।
সমাজের সচেতন মানুষ ও অভিভাবকগণ অজানা শংকায় আতংকিত। কোন সময় মানুষরূপী হায়েনার হিংস্রথাবায় তাঁদের সন্তানের করুণ পরিণতি ঘটে। ছাত্র-ছাত্রীগণ যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের হাতে, সরকারি অফিসে কর্মকর্তাগণ যদি বসের হাতে এবং গণপরিবহনে যদি মহিলা যাত্রী ড্রাইভার-হেলপারের হাতে নিরাপদ না হয়, তাহলে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে, নৈরাজ্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। প্রতিশোধস্পৃহা থেকে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। কোন সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি মনে করে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল। ধর্ষিতার পরিবার যদি মনে করে অপরাধীরা প্রভাবশালী, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা মজবুত, দাপটের কারণে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তখন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। অপরাধীকে খুন করে বুকের ওপর নোট লিখে দেয় ‘প্রতিশোধ নিলাম’। বাংলাদেশে এমনতর ঘটনা ভুরিভুরি।
কেন এই পৈশাচিকতা? মানবচরিত্রের কেন এই বিপর্যয়? কেন মানুষের পাশবপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লো? ভাবতে হবে সবাইকে। সমাধানের পথ বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজের দায়িত্ব কম নয়। রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাও ব্যাপক। নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রশাসযন্ত্রের অবস্থান ভুক্তভোগীদের পক্ষে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে থাকতে হবে।
প্রথমত: বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা বিচারহীনতারই নামান্তর। আইন সংশোধন করে ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। আসামী যাতে জামিন না পায় আইনে এমন বিধি সংযোজন করতে হবে। দেখা গেছে সাক্ষীর অভাবে বহু মামলা খারিজ হয়ে যায়। আসামিগণ সাক্ষীদের হুমকি দেওয়ার ফলে তারা আর কোর্টে যেতে আগ্রহী হয় না। মহিলা আইনজীবী সমিতির জরিপে দেখা যায় ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামী খালাস পেয়ে যায়। নারীপক্ষ -এর গবেষণায় দেখা গেছে ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দেশের ৬টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা ৩হাজার ৬৭১টি মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র ৪জনের (যুগান্তর, ১০ এপ্রিল ২০১৮)। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে এই প্রবণতা হৃাস পাবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে অপরাধীগণ বুঝতে সক্ষম হবে যে, যৌন নিপীড়ন করলে শাস্তি অবধারিত।
দ্বিতীয়ত: সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, টকশো ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করা যেতে পারে। সমাজের মানুষ সচেতন হলে কোন্ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিপীড়ক সক্রিয় তা চিহ্নিত করা কঠিন হবে না।
তৃতীয়ত: গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে সরকারি বেসরকারি অফিসে যৌন নিপীড়কদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা যেতে পারে। ভিক্টিমকে প্রটেকশন দিতে হবে। অফিস ও প্রতিষ্ঠান প্রধানকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অপরাধীর অপরাধ এক পর্যায়ে ফাঁস হয়ে যায়।
চতুর্থত: মানুষের মনে যাতে তাকওয়া ও খোদাভীতি তৈরি হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। ওলামা-মাশায়েখ, ইমাম-খতীব, বক্তা-ওয়ায়েযগণ এই বিষয়টিকে হাইলাইট করে জনমত গঠন করতে পারেন।
পঞ্চমত: পারিবারিক পরিসরে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। এক্ষেত্রে মা বাবা, বড়ভাই ও অভিভাবকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পরিবার হলো আদর্শ পাঠশালা। নারীদের প্রতি সম্মান করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ক্ষণিকের লোভ জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে এই শিক্ষা সন্তানদের দিতে হবে। এই শিক্ষা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে আমৃত্যু।
ষষ্টত: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাবকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। ধর্ষকামী মনকে পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিতে হবে। ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে। আল্লাহর ভয়, আইনের ভয় ও শাস্তির ভয়।
সপ্তমত: নারীদের উগ্র পোষাক, মাদকের বিস্তার, ফেসবুক, পর্নোগ্রাফি ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসন ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীগণ। এই গুলোকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।
অষ্টমত: ধর্ষণ, বলাৎকার ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাঁরা জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন আর যারা প্রাণে বেঁচে আছেন সমাজে তাঁরা কিভাবে থাকবেন? ধর্ষণের শিকার মেয়েদের বিয়ে দিতেও মা বাবাকে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। এটা সামাজিক বাস্তবতা।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন