জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.): বিচিত্র কিছু তথ্য

আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.): বিচিত্র কিছু তথ্য

মাহফুয আহমদ

এক.

আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) নিজ হাতে খুব বেশি বই লিখে না গেলেও তাঁকে নিয়ে কাজ হয়েছে প্রচুর, আল-হামদু লিল্লাহ। কাশ্মীরী রচিত আরবি গ্রন্থগুলো মাজমুয়াতু রাসায়িলিল কাশ্মীরী নামে চার খণ্ডে ছাপা হয়েছে। এছাড়া তাঁর দারস থেকে সংগৃহীত জ্ঞানগর্ভ মণিমুক্তাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি সংকলন। আর তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর পরিচালিত গবেষণাকর্মগুলোর হিসাব রাখা প্রায় অসম্ভব। আরবি-উর্দু ছাড়াও দুনিয়ার বহু ভাষায় তাঁকে নিয়ে কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে।

এই অধম যেহেতু আল-ফাওয়ায়িদুল মুনতাকা দিয়ে আল্লামা কাশ্মীরীর ওপর কাজ শুরু করেছিলাম এবং বর্তমানে তাঁর আবু দাউদের আরবি তাকরীর নিয়ে কাজ করছি; সেজন্য চাচ্ছি ধীরে ধীরে তাঁর সম্পর্কিত কিতাবগুলো যথাসাধ্য সংগ্রহ করে রাখবো। আল-হামদু লিল্লাহ! এই সংগ্রশালার সূচনা হয়েছে। কিছু কিতাবের মুদ্রিত কপি এনেছি, আরও অনেক কিতাবের অনলাইন ভার্সন (পিডিএফ/ওয়ার্ডফাইল) ল্যাপটপে সংরক্ষিত আছে। বিশেষত আল্লামা কাশ্মীরী (রহ.)-এর ওপর আরব ও পশ্চিমের একাধিক ইউনিভার্সিটিতে কৃত গবেষকদের থিসিসও পেয়েছি অনেক।

মূলকথা, আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট মনীষীর ওপর মুতাখাসসিস বা বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে চান তাহলে আপনাকে সেই মনীষীর রচিত অথবা তাকে নিয়ে রচিত কাজগুলোর একটি বিশাল সংগ্রহশালা গড়ে তোলা উচিত। তারপর নিজের কর্মপন্থা নির্ধারিত করতে পারবেন অনায়াসে।

দুই.

হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানবী (রহ.)-এর প্রতি যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.)-এর কয়েকটি চিঠির ছবি দেখলাম অনলাইনে। আল্লামা কাশ্মীরীর স্বহস্তে লিখিত চমৎকার সেই চিঠিগুলোর ভাষা কিন্তু ফারসি। বস্তুত তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। বরং একবার আল্লামা কাশ্মীরী (রহ.) হাদীসের দরস দিতে গিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি তো আরবি ও ফারসি উভয় ভাষার স্বাদ ও স্বভাব ধরে রাখার জন্য সাধ্যমতো উর্দুতে লেখালেখি করা থেকে বিরত থাকি। সেজন্য আমি চিঠিপত্রও সাধারণত আরবি কিংবা ফারসিতে লিখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু এখন সেই কর্মপন্থার ওপর আমার বড় আক্ষেপ হচ্ছে। কেননা হিন্দুস্তানে দীনের খেদমত এবং দীনী উলূমের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে উর্দু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা সময়ের দাবি। আর বহির্বিশ্বে দীনী খেদমতের জন্য ইংলিশ ভাষার কোনো বিকল্প নেই। আমি তোমাদেরকে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে ওসিয়ত করে যাচ্ছি।’ (সূত্র: ইকবাল আওর উলামায়ে পাক হিন্দ, পৃ. ২৫৪) এবার ভেবে দেখুন! আকাবির উলামায়ে কেরামের চিন্তা কতো সুদূরপ্রসারী ছিলো!

তিন.

আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.)-এর ব্যাপারে কারো কারো ধারণা যে, তিনি কট্টরপন্থি হানাফি ছিলেন! এই ধারণা একেবারে বাস্তবতা বিবর্জিত। আল্লামা কাশ্মীরী হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিলেন নিঃসন্দেহে। তবে তিনি আমাদের মতো সাধারণ কোনো অনুসারী যে ছিলেন না; তা তো বলাই বাহুল্য। বরং একাধিক মাসয়ালায় তাঁর নিজস্ব অভিমত ও অভিব্যক্তি ছিলো। (ভিন্ন সুযোগে ওই প্রসঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।) পাশাপাশি অপরাপর ইমামগণের মতের প্রতিও আল্লামা কাশ্মীরীর ছিলো অগাধ শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা। এই বিষয়টা কেউ কেউ বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। নিম্নে মাত্র দুটি উদাহরণ পেশ করা হলো।

প্রথমটি নেওয়া হয়েছে কাশ্মীরী রচিত নাইলুল ফারকাদাইন ফি মাসয়ালাতি রাফয়িল ইয়াদাইনের ভূমিকা থেকে। তাকবীরে তাহরিমা ছাড়া নামাযের অন্য কোনো মুহূর্তে হাত উঠানো উত্তম নয়; হানাফী ফিকহের এই মাসয়ালার সমর্থনে তিনি প্রচুর দলিল হাজির করেছেন এই গ্রন্থে। কিন্তু সূচনাতেই স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছেন যে, এবিষয়ক মতানৈক্য প্রকৃতপক্ষে সাংঘর্ষিক কোনো মতবিরোধ নয়। বরং এটা সুন্নাহর ভিন্নতা। বস্তুত এ সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো বৈচিত্র্যময়।

আর দ্বিতীয় উদাহরণটি নেওয়া হয়েছে কাশ্মীরী লিখিত ফাসলুল খিতাব ফি মাসয়ালাতি উম্মিল কিতাব গ্রন্থের পরিশিষ্ট থেকে। ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়া জরুরি নয়; হানাফী ফিকহের এই মাসয়ালার সপক্ষে তিনি ঢের প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন৷ সর্বশেষ তিনি লিখেন, এর অর্থ ইমাম শাফিয়ি (রহ.)-এর খণ্ডন নয়, কেবল হানাফি ফিকহের সমর্থন উদ্দেশ্য।

একথাগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আল্লামা কাশ্মীরী দরদমাখা যে মধুর ও প্রাঞ্জল আরবি ভাষা ব্যবহার করেছেন- সচেতন পাঠকবর্গ সেটার স্বাদ গ্রহণ না করে পারবেন না। তাছাড়া পরমতসহিষ্ণুতার এমন শিক্ষা আমরা আল্লামা কাশ্মীরী (রহ.)র অনেক বক্তব্য থেকেই গ্রহণ করতে পারি।

চার.

কবি ইকবালের ঘরে আল্লামা কাশ্মীরী!

১৯২৫ সালের ১৩ মার্চ আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.)-এর প্রতি আল্লামা কবি ইকবালের একটি চিঠি:

শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত হযরত কিবলা মাওলানা!

আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ

আমি এইমাত্র মাস্টার আবদুল্লাহ সাহেবের মারফতে খবর পেলাম যে, আপনি আরজুমানে খুদ্দামে দীনের সম্মেলনে আগমন করেছেন এবং এখানে দুয়েক দিন আপনি অবস্থানও করবেন। আমি নিজের জন্য খুবই সৌভাগ্যের বিষয় মনে করবো আপনি যদি আগামীকাল রাতের খাবার আপনার এই বহুদিনের শুভাকাঙ্‌ক্ষীর ঘরে এসে গ্রহণ করেন। আপনার মধ্যস্ততায় মাওলানা হাবিবুর রহমান উসমানি সাহেব, মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী সাহেব এবং মুফতি আজিজুর রহমান সাহেবগণের নিকটও একই অনুরোধ পেশ করছি। আমার আশা আপনি এই দাওয়াত গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করবেন। আপনার অবস্থানস্থল থেকে আপনাকে নিয়ে আসার জন্য এখান থেকে গাড়ি পাঠানো হবে। (তাসানীফে ইকবাল কা তাহকীকি তাওযীহি মুতালায়া; ড. রফি উদ্দীন হাশিমী, পৃ. ২২৭)

পাঁচ.

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) সম্পর্কে বিশদ জানার আগ্রহ অনেকের। আরব ও তুরস্কের বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদের সঙ্গে কথা বলে অন্তত আমার এটা মনে হয়েছে। কিন্তু এখনো তাঁর সম্পর্কে পর্যাপ্ত কাজ হয়নি। একাধিক ইউনিভার্সিটিতে হযরতকে নিয়ে থিসিস করা হয়েছে তা ঠিক, তবুও অনেক কাজ বাকি।

আল-ফাওয়ায়িদুল মুনতাকা ছিলো এ ময়দানে অধমের অপরিপক্ব হাতের সামান্য একটু কাজ। তাও শুরু হয়েছিলো দাওরায়ে হাদীস পড়াকালীন অনুসন্ধান থেকে। পরে আল্লামা কাশ্মীরী আন্তর্জাতিক কনফারেন্স উপলক্ষে আমালিল কাশ্মীরী বিষয়ে দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ রচনার সুযোগ পাই। এখন আবার আল্লামা যহুরুল হক সিলেটী (রহ.) কর্তৃক সংকলিত আল্লামা কাশ্মীরীর আবু দাউদের দারসগুলোর ওপর কাজ করার সৌভাগ্য হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।

অর্থাৎ তাঁর সম্পর্কে জানার পরিধি দিনদিন বিস্তৃত হচ্ছে। ইন শা আল্লাহ এসবকে কাজে লাগাতে চাই।আমাদের শায়খ ড. আবদুল হাকিম আল-আনিস (ইরাকি বংশোদ্ভূত, বর্তমানে দুবাই অবস্থান করেন) হাফিযাহুল্লাহ হলেন মূলত আল্লামা ইবনুল জাওযী ও আল্লামা সুয়ুতী বিশেষজ্ঞ। শায়খের কর্মপদ্ধতি আমাদের প্রেরণা যোগায়।

ছয়.

সহীহ আল-বুখারীর ওপর আল্লামা কাশ্মীরীর নতুন দুটি লেকচারসমগ্র

বিগত শতকে আল্লামা কাশ্মীরী (রহ.) ইলমে হাদিসের যে বিশাল খেদমত করে গেছেন, সেজন্য আজ ইলমি দুনিয়ায় তাঁর নাম স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ব্রান্ডে পরিণত হয়েছে। আরব বিশ্বে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে শায়খ রশিদ রেযা, আল্লামা যাহিদ কাউসারী, আল্লামা শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, আল্লামা শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত মনীষী বিশেষ ভ্থমিকা পালন করেছেন। তবে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.)-এর অবদান এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। আল্লামা কাশ্মিরীর আত-তাসরীহ বিমা তাওয়াতারা ফি নুযূলিল মাসীহ গ্রন্থটি তিনি আরব থেকে প্রকাশ করেন। শায়খের তাহকীক ও নিরীক্ষণ গ্রন্থটির মান বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছে। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি কাশ্মীরী (রহ.) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

আল্লামা কাশ্মীরী সাধারণত নিজে লিখতেন না। তাঁর মুক্তাসম কথা ও আলোচনাসমূহ শিষ্যগণ নোট করে রাখতেন। তিনি বলতেন ছাত্ররা লিখতেন। পরিভাষায় যাকে বলা হয় আমালী। পরবর্তী সময়ে সেই আমালী বা নোটগুলোই মহামূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে বিদ্বান মহলে সমাদৃত হয়।

আল্লামা কাশ্মীরী (রহ.) একাধারে বহুবছর সহিহ বোখারির পাঠদান করেছেন। তাঁর দারস ও লেচকচারসমূহ অনেকেই নোট করেন। কিন্তু তাঁর সুযোগ্য শাগরেদ আল্লামা বদরে আলম মিরাটী (রহ.) সংকলিত ফায়যুল বারী সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে। এটি আরবি ভাষায় রচিত। বিশাল কলেবরের চার খণ্ডে তা প্রকাশিত হয়। আরব থেকেও আধুনিক মানসম্মত ছাপায় ৬ খণ্ডে তা বাজারে এসেছে। সহীহ আল-বুখারীর ওপর ফায়যুল বারী ছাড়া উর্দু ভাষায়ও কাশ্মীরী (রহ.)-এর দারস গ্রন্থাকারে বের হয়েছে। কিন্তু আরবি ভাষায় তাঁর দারস সংবলিত আরও কোনো গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে অন্তত আমার জানা ছিলো না। সেজন্য গতদিন ইউকে ভিত্তিক একটি অনলাইন বুকশপে কিছু জরুরি কিতাব খুঁজতে গিয়ে নতুন দুটি আরবি সংকলন আবিষ্কার করলাম। দুটোই আল্লামা কাশ্মীরীর সহীহ আল-বুখারীর দারস থেকে সংগৃহীত ও সংকলিত।

  1. ফযলুল বারী ফি ফিকহিল বুখারী: এটি সংকলন করেছেন কাশ্মীরী (রহ.)-এর শাগরেদ মাওলানা আবদুর রাউফ হাজারওয়ী (রহ.)। তিনি আল্লামা কাশ্মীরীর নিকট সহীহ আল-বুখারী সর্বমোট তিনবার পড়েছেন। এটি ৪ খণ্ডে প্রকাশিত। সবকটি খণ্ড মিলিয়ে পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।
  2. আস-সায়হুল জারি ইলা জান্নাতিল বুখারী: এটি সংকলন করেছেন কাশ্মীরী (রহ.)-এর শাগরেদ মাওলানা আবদুল হালিম ইবনে আমির বখশ মুলতানি (রহ.)। এটি ৩ খণ্ডে প্রকাশিত। সবকটি খণ্ড মিলিয়ে পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় এক হাজার।

কিতাব দুটো হাতে পৌঁছার পর শায়খ ড. মুহি উদ্দিন আওয়ামাহ হাফিযাহুল্লাহকে অবগত করলাম। তাঁকে জানালাম, অধমের আল-ফাওয়ায়িদুল মুনতাকা (দারুল ফাতহ, জর্ডান থেকে প্রকাশিত) গ্রন্থটি মূলত ফয়যুল বারী থেকে চয়নকৃত। এখন ইনশাআল্লাহ এই দুটো সংকলন থেকেও নতুন তথ্য সংযোজন করা যাবে। তিনি তা জেনে আনন্দ প্রকাশ করলেন। বললেন, আপনার উচিত হবে এই তিনটি সংকলনের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা যে, কাশ্মীরী (রহ.)-এর এ তিন শাগরেদের মধ্যে কে যথাযথভাবে তাঁর আলোচনাগুলো উপস্থাপন করেছেন। প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, এটিও পৃথক একটি প্রসঙ্গ। কাজটি করতে পারলে অনেক উপকারী সাব্যস্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

আপাতত দৃষ্টিতে আমার মনে হয়েছে, নতুন এই দুই আরবি সংকলনের বর্ণনাভঙ্গি কিছুটা দুর্বোধ্য এবং ক্ষেত্রবিশেষ অতিসংক্ষিপ্ত। ইন শা আল্লাহ শীঘ্রই কিতাব দুটো পুরোপুরিভাবে পড়বো এবং অধমের আরবি কিতাব আল-ফাওয়ায়িদুল মুনতাকার পরবর্তী সংস্করণের জন্য তথ্য সংগ্রহ করবো।

সাত.

নাফহাতুল আরাবসহ গুরুত্বপূর্ণ একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা, শায়খুল আদব আল্লামা ই’যায আলী (রহ.) বলেন, ‘একবার দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে ইলমি বসলো। তখন প্রতিবছর মজলিসে ইলমি-ই নির্ধারণ করে দিতো যে, কোন উসতায কোন কিতাবের পাঠদান করবেন। আমার উসতায আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.)ও ছিলেন সেই মজলিসে ইলমির সদস্য। তো সে বছর মজলিসে ইলমিতে আল্লামা কাশ্মীরী প্রস্তাব করলেন যে, এবার মাওলানা ই’যায আলীকে সুনানে ইবনে মাজাহ পড়াতে দেওয়া হোক। সবাই এই প্রস্তাবে সম্মতি জানালো। এই সংবাদ শুনে আমি সোজা আল্লামা কাশ্মীরীর কামরায় চলে গেলাম। আরজ করলাম, সিহাহ সিত্তার কোনো কিতাবই পড়ানোর যোগ্যতা আমার নেই। আমি সবিনয়ে অপারগতা পেশ করলাম। আমার কথা শুনে আল্লামা কাশ্মীরী উঠে তাঁর কামরার এক কোণায় থাকা সুনানে ইবনে মাজাহের কপিটি নিয়ে এলেন। এটি হযরতের ব্যক্তিগত কপি। তিনি এতে অনেক জরুরি ও উপকারী হাশিয়া বা টীকাটিপ্পনী সংযুক্ত করেছেন, নিজের চমৎকার হস্তলিপিতে। আমার দিকে সেই কপিটি এগিয়ে দিয়ে হযরত বললেন, যাও! এটি নিয়ে অধ্যয়ন করো। আমার হাশিয়া সামনে রেখে তোমার পড়াতে আর কোনো সমস্যা হবে না ইন শা আল্লাহ।’ (তাযকেরায়ে ’যায; মাওলানা মুহাম্মাদ আনযার শাহ কাশ্মীরী, পৃ. ৭৬-৭৭)

সুবহানাল্লাহ! শাগরেদের প্রতি উসতাযের কী অকৃত্রিম ভালোবাসা! বস্তুত এর মাধ্যমে আল্লামা কাশ্মীরী স্বীয় ছাত্রকে অনুপ্রাণিত করলেন এবং সাহস যোগালেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো, আল্লামা কাশ্মীরী (রহ.) কর্তৃক সংযোজিত হাশিয়া বিশিষ্ট সুনানে ইবনে মাজাহের সেই কপিটি এখন কোথায় আছে এর কোনো হদিস পাওয়া যায় না!

আট.

বিদগ্ধ হাদিস বিশারদ আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী ইন্তেকাল করেছেন ১৩৫২ হিজরিতে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর পূর্বে। কিন্তু অদ্যাবধি তাঁর রেখে যাওয়া ইলমি তুরাস বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েই যাচ্ছে। আল্লামা কাশ্মীরী তাঁর জীবনে সুনানে তিরমিযীর দারস দিয়েছেন লাগাতার বেশ কয়েকবছর। সেই দারসগুলোর নোট লিখে রেখেছিলেন তাঁর অনেক প্রথিতযশা শাগরেদ। ইতোপূর্বে সেই আমালি বা দারসের নোটগুলো আরবি ভাষায় প্রকাশিত হয়ে দুনিয়া জুড়ে সমাদৃত হয়েছে। যেমন- আল-আরফুশ শাযী, মাআরিফুস সুনান প্রভৃতি। কিছুদিন পূর্বে আল্লামা কাশ্মীরীর সুনানে তিরমিযির তাকরীর থেকে সংকলিত আরেকটি গ্রন্থ বের হয়েছে। আল-আরফুয যাকী নামে নতুন মুদ্রিত এই গ্রন্থটি একাধিক খণ্ডের। কাজটি করেছেন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাজ্ঞ উসতায ও মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল্লাহ মারুফী হাফিযাহুল্লাহ।

নয়.

আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) প্রায়শই ¯^xq ছাত্রদের তাগিদ দিতেন যে, তোমরা নিজ অঞ্চলে ফিরে গিয়ে দারসে কুরআন চালু করবে। যাতে করে শিক্ষিত এবং সাধারণ মুসলমান, বিশেষত আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবসমাজ এই সুযোগে আলেমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এতে তাদের মাঝে দীনি চেতনা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। এই শিক্ষিত সমাজ উলামায়ে কেরামের সান্নিধ্য ও সংস্পর্শে থেকে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশ ও জাতির সেবা করে যাবে। (তাকাদ্দুসে আনওয়ার, পৃ. ২৬৭)

আল্লামা কাশ্মীরী (রহ.)-এর এই নসিহতটি শুধু চমৎকার এমন নয়, বরং সার্বিক অবক্ষয়ের নাজুক এই সময়ের একান্ত দাবি এটি। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কোরআনের শিক্ষা প্রচারে এগিয়ে আসি। দারসে কোরআন ইত্যাদি আয়োজনের কত যে সুদূর প্রভাব ও উপকার- তা বলে শেষ করবার নয়।আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন।

দশ.

লেখালেখি এবং গ্রন্থ রচনার প্রতি আল্লামা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.)-এর তেমন আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিলো না। তিনি বরং তাত্ত্বিক ও তথ্যনির্ভর আলোচনা এবং পাঠদানেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন বেশি। তবে প্রয়োজনের তাগিদে যদি তিনি গ্রন্থ প্রণয়ন করতেন, তাহলে সেটা কেবল বিশেষজ্ঞ পাঠকদের উপযুক্ত হতো। বস্তুত গবেষণালব্ধ তাঁর লেখা বইগুলো বুঝে উঠতে পারা সাধারণ পাঠকদের জন্য ছিলো খুবই দুরূহ ব্যাপার। শাস্ত্রীয় জ্ঞানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ সেগুলো থেকে গবেষণার রসদ গ্রহণ করে থাকেন।

সেজন্য আল্লামা কাশ্মীরী রচিত ফাসলুল খিতাব নামক আরবি গ্রন্থটি যখন ছাপা হলো, তখন মাওলানা সাইয়িদ আসগর হোসাইন দেওবন্দী (রহ.) বই প্রকাশের ঘোষণাপত্রে এও লিখে দিলেন যে, ‘ফাসলুল খিতাব বইটি মূলত ইলমুল হাদীসের শাস্ত্রীয় গবেষণা এবং একাডেমিক আলোচনার ক্ষেত্রে একটি অসাধারণ রচনা। এটি পূর্ববর্তী মহান মুহাদ্দিসগণের রচনাবলির জীবন্ত একটি নমুনা। দারুল উলূম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসীন হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ সাহেব পূর্ণ ইনসাফের সাথে এটি আরবিতে রচনা করেছেন। বড় বড় আলেমরা পর্যন্ত এটি বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন। সুতরাং অল্প যোগ্যতা সম্পন্ন কোনো মৌলবি যেন এটি তলব না করেন!’ (তাকাদ্দুসে আনওয়ার, পৃ. ২৯২)

সুবহানাল্লাহ! এবার তাহলে চিন্তা করুন!

লেখক: উসতাযুল হাদীস, মাদানী মাদরাসা, লন্ডন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ