ইসরায়েল–আমিরাত শান্তি চুক্তি
১৩ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতিতে হোয়াইট হাউসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরায়েলের যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তার তাৎপর্য বহুমাত্রিক| এতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস বইবে না নতুন করে সংঘাত তৈরি করবে এ বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো হয়নি| এই চুক্তির মাধ্যমে দু’দেশ ফ্লাইট পরিচালনা, নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, প্রযুক্তি, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও দূতাবাস বিনিময়ে আর কোন বাধা রইল না।
১৯৪৮ সাল থেকে কমবেশি সব সময় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত অব্যাহত রয়েছে| চুক্তির আগে ও পরে হামলা ও পাল্টা হামলা চলে| চলতি মাসের ১২ ও ১৫ আগস্ট ইসরায়েল বাহিনী গাজা স্ট্রিপে হামলা চালিয়ে ক্ষতি সাধন করে। তাদের অভিযোগ হামাস বেলুনভর্তি বিস্ফোরক পাঠিয়েছে ইসরায়েলী ভূখণ্ডে| এতে দক্ষিণ ইসরায়েলের বিস্তৃত ক্ষেতের ফসলে আগুন ধরে যায়|
অপরদিকে চুক্তির অন্যতম শর্ত হলো ইসরায়েল জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করবে না। কিন্তু চুক্তির পরপরই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুরোধ রক্ষার্থে বসতি স্থাপন তাঁরা সাময়িক স্থগিত রাখবেন। সম্প্রসারণের মূল পরিকল্পনা থেকে সরে আসবেন না। ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারীদের মধ্যে মিসর ও জর্ডানের পর আরব আমিরাত তৃতীয় রাষ্ট্র। তাঁরা কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা সুসংহত করতে চান। তাঁরা মনে করেন আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ অড়গ্রগতি। স্মর্তব্য যে, ১৯৭৯ সালে মিসর আর ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। মিসর ও জর্ডানের সাথে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পরও ইসরায়েল জোরপূর্বক ফিলিস্তিনি ভূমি অধিগ্রহণ অব্যাহত রাখে।
বর্তমান এই চুক্তি বিশ্বজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বাহারাইন, মিসর, ওমান, জর্ডান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জাতিসংঘ চুক্তিকে স্বাগত জানায়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী চুক্তিকে ‘অতুলনীয় আনন্দ ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বললেও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এটাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করেন। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, আমিরাতের এই ‘ভণ্ডামি আচরণ’ ইতিহাস ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ কখনো ক্ষমা করবে না। ইরানের কাছে এই চুক্তি ‘বিপজ্জনক ও অবৈধ’| সৌদি আরব সরকারিভাবে কোন মন্তব্য করেনি। বিশেষজ্ঞদের অভিমত রিয়াদ-তেলআবিব পারস্পরিক সম্পর্ক ইতিবাচক হলেও সৌদি আরব মুখ খুলছে না চুক্তির ব্যাপারে। নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যানের মতে এই চুক্তি ‘মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক ভূমিকম্পের আঘাত। ১৯৭৯ সালে ইসরায়েল-মিসর চুক্তির ফলে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়েছিল’ (নয়া দিগন্ত, ১৬.৮.২০)।
এই চুক্তি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোন ভূমিকা রাখবে না এবং দুর্দশাও লাঘব করবে না। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত হৃাস পাবে বলেও মনে হয় না। একমাত্র ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বিপাক্ষিক সম্মানজনক ও ফলপ্রসূ আলোচনা বা সমঝোতা চুক্তি সুফল বয়ে আনতে পারে| ইসরায়েলের সাথে আমিরাতের কূটনৈতিক, আর্থ-বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে অস্ত্রবিক্রির সুযোগ আরো বৃদ্ধি করতে পারবে। চলতি বছর ৫৫৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৪হাজার ৫৬৯টি মাইন রেসিস্ট্যান্ট অ্যাম্বুশ প্রটেকটেড যান আমিরাতের কাছে বিক্রির জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। এটা এখন কার্যকর হতে বাধা নেই।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমানের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র তাঁরা পেতে থাকবে। আরবদেশগুলোর হাতে এত উন্নত অস্ত্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার বাইরে যাওয়ার সক্ষমতা ইসরায়েলের নেই। ইসরায়েলের নিজের অস্থিত্ব বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামরিক সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন ও রাজনৈতিক মোড়লিপনা অব্যাহত রাখার জন্য ইসরায়েলের সহায়তাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি।
আমিরাত-ইসরায়েল চুক্তির ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রহটা বেশি। কারণ করোনা-কালে দেশের অভ্যন্তরে তিনি জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন| যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ বছরের ইতিহাসে স্বাস্থ্যখাতে এত নাজুক পরিস্থিতি আগে কখনো তৈরি হয়নি। কোভিড-১৯ এ দু’লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে লাখ লাখ মানুষ হয়েছে কর্মহীন। এহেন পরিস্থিতিতে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর কৃতিত্ব হিসেবে এটা দেখাতে চান। নভেম্বরের ভোটে এটা প্রভাব ফেলতে পারে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির সাথে তালিবানদের যুদ্ধনিরোধ চুক্তির পেছনেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একই পরিকল্পনা কাজ করেছে।
একটা কথা মনে রাখা দরকার ইরান-মার্কিন সম্পর্ক যতই টানাপোড়েন চলুক| ইসরায়েল নিয়ে ইরান যতই হুমকি ধামকি চালাক| ইরান দুর্বল হোক বা ধ্বংস হোক সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল চাইবে না| কারণ আরবদেশগুলোকে ‘শিয়াজুজু’-এর ভয় দেখিয়ে অস্ত্র বিক্রি করার এবং ঘাঁটি স্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে কোটি কোটি ডলারের তেল, বেতন, ভাতা ও উপঢৌকন নেয়ার দূরপ্রসারী পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে|
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্য এই চুক্তির প্রয়োজন ছিল| বেশ কিছুদিন যাবত ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে নেতানিয়াহু বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে| এটি ইসরায়েলি জনগণের দৃষ্টি ফেরানোর অস্থায়ী পদক্ষেপ। তবে পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর জনপ্রিয়তায় ধস নামতে পারে। পশ্চিম তীরের এক তৃতীয়াংশ ভূমি দখল ছিল নেতানিয়াহুর নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি। মার্কিন রাজনীতি ও প্রশাসনে ইহুদি লবি বেশ শক্তিশালী। ডেমোক্রাটিক অথবা রিপাবলিকান দলের যিনিই প্রেসিডেন্ট হন না কেন, ইহুদি প্রেসার গ্রুপের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা থেকে ইসরায়েল শতভাগ সুবিধা নিয়ে আসছে এবং আগামীতেও নেবে।
১৯১৭ সালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। এটা ইতিহাসে ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ব্রিটেন ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলো তড়িঘড়ি করে ইসরায়েলের স্বীকৃতি দিতে থাকে। ১৮৮২ সাল থেকে মূলত অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলেও হিটলারের নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচার জন্য হাজার হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে হিটলার ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। যে ভূমিতে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয় সেখান থেকে সাড়ে সাতলাখ ফিলিস্তিনি নাগরিক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা আর কখনো ফিরে আসতে পারেনি। ইসরায়েলের অস্থিত্ব রক্ষায় ইহুদিরা খ্রিষ্টানদের সাথে অতীতের তিক্ততা ভুলে এক মঞ্চে আসতে পারলেও মুসলমানরা একতাবদ্ধ হতে পারেনি।
ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের সাথে আরবদের যুদ্ধ হয়েছে চারবার। প্রতিটি যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়েছে। ইসরায়েল প্রতিটি যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছে ব্যাপকহারে। আরবদের সাথে সংঘাতের ইতিহাসে ২০০৬ সালে ইসরায়েলি সেনাসদস্যরা হিজবুল্লাহ গেরিলাদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। এর পেছনে ছিল ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তা। ৩৪ দিনের এই লড়াই জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইতি ঘটে। এতে দেড় হাজার লেবাননি নাগরিক প্রাণ হারায় এবং ১০লাখ বাস্তুচ্যুত হয়।
লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, মিসর ও সৌদি আরব নিয়ে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হলো ইহুদিদের লালিত স্বপ্ন| তারা দাজ্জালের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। নতুন নতুন বৈশ্বিক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এসব কথা The Protocols of Learned Elder Zion গ্রন্থে সবিস্তারে উল্লেখ আছে। অনারব কোন একটি মুসলিম দেশ অথবা জোট ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে এগিয়ে আসতে পারে। এ দেশ বা জোটকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা একতাবদ্ধ হবে। চূড়ান্ত লড়াই হবে এবং মুসলমানদের হাতে বিজয় সূচিত হবে। ফিলিস্তিনিরা হারানো ভূমি উদ্ধার করে স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকার ফিরে পাবে। নতুন নামে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মতো অকুতোভয় বীরের জন্ম হবে। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ যৌক্তিক পরিণতির দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে। আগেভাগে দিনক্ষণ বলা মুশকিল তবে এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এমন ইঙ্গিতের উল্লেখ রয়েছে। আকাশে ঘনমেঘ দেখলে বৃষ্টির আন্দাজ ও প্রত্যাশা করা যায়।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন