মাজহারুল হাসান নাহিদ
২০২০ মানব জাতির ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর বছর। বিজ্ঞান যখন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছিয়েছে ঠিক সাল তখন এক অতিশয় ক্ষদ্র ভাইরাস মানব জীবনকে থামিয়ে দিয়েছে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে মানুষের সকল অহংকার। এই মরণঘাতী ভাইরাস ধনী, গরীব, সাদা, কালো, আস্তিক, নাস্তিক, রাজা, প্রজা কাউকেই চিনছে না। সকলকেই ভাইরাস একই ভাবে আক্রমণ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে মোট করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী ৬৪,৮৪,০০৫ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৩,৮৩, ১০৫ জন (৩ জুন, ২০২০, ওয়ার্ল্ডওমিটার)
তন্মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক ১৮,৮২,১৪৮ জন মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১,০৮,১০৪ জন মারা গিয়েছেন (৩ জুন, ২০২০, ওয়ার্ল্ডওমিটার)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ আফ্রো-আমেরিকান। হোয়াইট হাউজের তথ্যমতে, দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে ৫০ শতাংশ হচ্ছে আফ্রো-আমেরিকান। দেশটির শিকাগো অঙ্গরাজ্যে আফ্রো-আমেরিকানদের বসবাস বেশি। শিকাগোতে মোট আক্রান্তের ৫২ এবং মৃতদের ৬৮ শতাংশই এই জনগোষ্ঠীর। বর্তমানে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ গুরুতর রোগীই আফ্রো-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষাঙ্গদের মধ্যে মৃত্যুর হারও ৬ শতাংশ বেশি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের জরিপে দেখা গেছে দেশটিতে কৃষাঙ্গরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত। শিকাগোর আফ্রো-আমেরিকান প্রধান অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে বরাবরই সরকারি অনুদানও কম। স্বাস্থ্যসেবার মত সবচেয়ে গুরুত্পূর্ণ খাতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি কি পরিমাণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে আফ্রিকানরা। তবে বর্তমানে করোনাভাইরাস নয়, পুলিশ কর্তৃক জর্জ ফ্লয়েড নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যার পর, আমেরিকা সমগ্র বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। সমগ্র আমেরিকাতে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়েছে হত্যার প্রতিবাদস্বরূপ| লকডাউন, ভাইরাস, কারফিউ কোনো কিছুই যেন এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে পারছে না। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিং-এর মৃত্যুর পর এটিই আমেরিকাতে সংঘটিত হওয়া সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ।
কিন্তু এইখানে একটি প্রশ্ন আমাদের সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে তা হচ্ছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মানুষ যেখানে খাবার কেনার প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেই বের হচ্ছে না, এ অবস্থায় আমেরিকাতে করোনাভাইরাসের প্রচণ্ড প্রকোপ থাকা সত্ত্বেও কেন হাজার হাজার আমেরিকান জীবনের কোনো তোয়াক্কা না করেই রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করল। আসলে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।
ইউরোপীয়রা আফ্রিকা উপকুল থেকে কালো মানুষদের ধরে ধরে শিকলবন্দি করে আমেরিকার ভার্জিনিয়া উপকূলে প্রথম জাহাজ ভিড়িয়েছিল ১৬১৯ সালের ২৪ অগাস্ট। মারণাস্ত্রের উন্নয়ন এবং নৌশক্তির উপর ভিত্তি করে ক্রমবর্ধমান উপনিবেশিক অঞ্চলের উৎপাদন ও শ্রম ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে স্প্যানিশ, ব্রিটিশ ও ওলন্দাজরা সম্পদের পাহাড় গড়তে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা কালো মানুষরাই ছিল বুনিয়াদি সম্পদ। ব্রিটিশ ও স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার অন্যতম সম্পদ এই দাসরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের মূল ভূমিকা পালন করেছিল। আমেরিকার কৃষি উৎপাদন, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন, রেললাইন নির্মাণ থেকে শুরু করে নতুন আমেরিকান সভ্যতার পেছনে এই কালোরা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া ট্যাক্স ও সম্পদ লুন্ঠনের বিরুদ্ধে আমেরিকার জনগণের বিদ্রোহ ও ১৭৭৫ সালে শুরু হওয়া স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে বিপক্ষে আফ্রিকান-আমেরিকানরা অংশগ্রহণ করলেও প্যাট্রিয়টিক বাহিনীতে কৃষ্ণাঙ্গরা অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। আটবছর ধরে চলা যুদ্ধশেষে ১৭৮৩ সালে আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পেছনে আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান অনেক। আমেরিকার স্বাধীনতার পর দেড়শ বছরেও প্রত্যাশিত অধিকার পায়নি কালো গায়ের মানুষেরা। আমেরিকান সিভিল ওয়ারের মূল কারণই ছিল দাসত্ব বিলোপের দাবির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান। ১৮৬১ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দল থেকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা বিলুপ্তির প্রশ্নে উত্তরের ৭টি রাজ্যের ইউনিয়ন স্টেটের শক্তি নিয়ে প্রতিপক্ষ দক্ষিণের ১১টি অঙ্গরাজ্যের কনফেডারেশনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মূলত দাসদের শক্তিই তাকে বিজয়ী শক্তিতে পরিণত করে। গৃহযুদ্ধে বিজয় লাভের পর আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেন এবং দাসদের মুক্তির ঘোষণা দেন। দাস প্রথার সমর্থকরা পরাজিত হলেও ভেতরে ভেতরে সক্রিয় ছিল। তারা ১৮৬৫ সালে আব্রাহাম লিঙ্কনকে গুলি করে হত্যা করে।
দাসত্ব প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে আমেরিকা কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। আব্রাহাম লিঙ্কনের শতবছর পর কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আমেরিকায় কালোদের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে ওঠে। ১৯৬৩ সালে লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কিং তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণ দেন। এরপর লুথার কিং-এর আন্দোলনের ফলে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু লুথার কিং বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেননি। ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের গুলিতে লুথার কিং নিহত হন।
মানবাধিকাররের বড় বড় বুলি আওড়ানো আমেরিকা আসলে মানবাধিকার শব্দটাকেই অপব্যবহার করেছে। নিজের দেশে মানুষের বেঁচে থাকার নূন্যতম অধিকার মানুষ পাচ্ছে না অথচ লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনে মানবাধিকার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে হাজার হাজার বেসামরিক নিরপরাধ মানুষদেরকে হত্যা করে চলছে এই যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকাতে যুগ যুগ ধরে শুধু চামড়া সাদা না হবার কারণে আমেরিকার নাগরিক হবার পরেও কালোরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে জীবনযাপন করছে। শুধুমাত্র আফ্রিকান বা কালো চামড়ার মানুষই নয় এশীয়, চাইনিজসহ সকল ধরনের মানুষ সেখানে নাগরিকত্ব পেয়েও সব জায়গাতেই নিপীড়িত হচ্ছে শুধু চামড়া সাদা হবার না কারণে। আর যাদের চামড়ার রঙ সাদা নয় আবার নাগরিকত্ব ও পাননি, তাদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাদা বাদ দিয়ে অন্যান্য গায়ের রঙয়ের মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তারই ফলাফল আমরা বিগত কয়েক দিনের আমেরিকাতে সংঘঠিত হওয়া আন্দোলনের মাধ্যমে দেখতে পাই। কাউকে যদি স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, তারপর যদি ছেলেটি পরীক্ষায় খারাপ করে, তখন যদি তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তুমি খারাপ করলা কেন। হয়তবা ছেলেটি কোনো এক উত্তর দিতে পারবে কিন্তু কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তুমি কালো কেন, সেই উত্তর একজন মানুষ কিভাবে দেবে। এটার উত্তর আসলেই কি হতে পারে। এখানে তো তার কোনো হাত নেই।
তবে তিক্ত সত্য হচ্ছে আমরা যারা অনেকেই কালোদের অধিকার আদায়ের কথা বলি তারাই বাস্তব জীবনে সেটি প্রয়োগ করতে পারি না, সেক্ষেত্রে আমরা বুঝি যে এটা করা উচিত না তারপরেও নিজে চাই আমার প্রিয়জন ফর্সা হোক। এটার অন্যতম একটি কারণ হতে পারে আমাদের জেনেটিকাল চাহিদা। যুগ যুগ ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা সাদাদেরকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে মূল্যায়ন করে এসেছে। সেই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে আমাদের অবশ্যই কষ্ট হবে, সময় লাগবে তবে সেটা যত যত তাড়াতাড়ি পারব ততই তা মানব জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।