জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল্লাহ তাআলার গজব করোনা ভাইরাস ও মরুপতঙ্গের তাণ্ডব

আল্লাহ তাআলার গজব করোনা ভাইরাস মরুপতঙ্গের তাণ্ডব

ড. খালিদ হোসেন

 

সাম্প্রতিক কালে নোভেল করোনা ভাইরাস (COVID-19) বৈশ্বিক আতঙ্ক তৈরি করেছে। চীনের মহাপ্রাচীর পেরিয়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস এশিয়া, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে-ধীরে বৈশ্বিক মহামারীর রূপ পরিগ্রহ করছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আফ্রিকার পঙ্গপালের তাণ্ডব। করোনা ভাইরাসে এ পর্যন্ত ৩ হাজার মানুষ মারা গেছে এবং দু’লাখ আক্রান্ত হয়েছে। নিরাময়যোগ্য কোন ওষুধ ও প্রতিষেধক আবিস্কৃত না হওয়ায় আগামীতে লাখ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

চীন কেন্দ্রীক আন্তর্জাতিক আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য চরম ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনীতির গবেষকদের মতে চলতি বছরের শেষের দিকে ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবে (Asia Times, 20 February’2020)|

সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ভিয়েতনাম, ইসরায়েল, লেবানন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৫৩টি দেশে ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় রেড এলার্ট জারি করেছে সরকার। ইরানের ১৪টি প্রদেশে মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রধান টেড্রস গেব্রেয়েসাস হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘এ ভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে।’

অপরদিকে ঝাঁকে-ঝাঁকে পঙ্গপাল সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, জিবুতি, উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান, জর্দান, মিশর, সৌদি আরব ও পাকিস্তানে হানা দিয়েছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের ধান, গম, যব, ভুট্টা ও তুলা সাবাড় করে দিচ্ছে। জর্দান, পাকিস্তান ও সোমালিয়া সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ১০ লাখ পতঙ্গের পাল যদি কোন ফসলের ক্ষেতে হামলে পড়ে একদিনের মধ্যে ৩৫ হাজার মানুষের খাদ্য সাবাড় করে ফেলে। প্রতি ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার আকাশ পথ অতিক্রম করে হানাদার পতঙ্গবাহিনী অন্য জায়গায় অভিযান চালায়। ঘাসফড়িংয়ের মতো দেখতে এ পতঙ্গের ঝাঁক ৪৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃৃত ভূমি আচ্ছাদিত করে রাখে।

জাতিসংঘের মতে, বিগত ৭০ বছরের মধ্যে পঙ্গপালের এত ভয়ঙ্কর আক্রমণ অতীতে আর দেখা যায়নি। আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় ঝাঁকবদ্ধ মরুপতঙ্গ ৩০টি দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। জিবুতি ও ইরিত্রিয়ায় ৩৬ হাজার কোটি পতঙ্গের আক্রমণে খাদ্য নিরাপত্তা অভূতপূর্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা এতে পুরো অঞ্চলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। প্রতি কিলোমিটার ঝাঁকে চার থেকে আট কোটি পতঙ্গ থাকে। স্ট্রিট জার্নালের ভাষ্যকারের মতে, মাঝারি ধরনের একটি পতঙ্গপাল নিউ ইয়র্কের জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য নিঃশেষ করে দিতে পারে। কীটনাশক প্রয়োগ করেও এ মরুপতঙ্গকে দমন করা যাচ্ছে না।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও পঙ্গপালের আক্রমণের জাগতিক উৎপত্তি ও বিস্তৃতির বৈজ্ঞানিক কারণ যাই থাকুক এটা নিঃসন্দেহে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ প্রকৃতির নিয়ন্ত্রকশক্তি কিন্তু আল্লাহ তাআলা। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যুগে যুগে নানা জাতিগোষ্ঠীর ওপর বিপর্যয়, মহামারী, দুর্যোগ- দুর্বিপাক নেমে এসেছে। সাইক্লোন, প্লাবন, টর্ণেডো, ভূকম্পন, ভূমিধস, সুনামি, খরা, জলোচ্ছ্বাস, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, সার্স, মার্স, এইডস, দাবানল প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিচিত্র রূপ। অনৈতিক যৌনকর্ম, পাপাচার, ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরোধিতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারা ও আল্লাহ তাআলার বিধিনিষেধের অবাধ্যতার কারণে পৃথিবীতে বিপর্যয় নেমে আসে। অতীতে সীমালঙ্ঘন, নাফরমানি, নবী-রাসূলগণের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তাআলা বহু জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনো বিপদ আপতিত হয় না (সুরা আত-তাগাবুন: ৪০)। আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মানুষের প্রতিটি ক্রিয়া-কর্ম ও গতিবিধির ওপর নজর রাখেন এবং প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের জন্য প্রতিদান ও শাস্তি প্রদান করেন। তাওবা, ক্ষমাপ্রার্থনা ও সৎ জীবন যাপনের মাধ্যমে এ জাতীয় বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ আছে।

মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা কোনো জাতি ও সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ স্বয়ং তারাই নিজেদের অবস্থা, কাজ কর্ম, অনৈতিকতা ও অবাধ্যতায় পরিবর্তিত করে না দেয়। যখন আল্লাহ তাআলা কোন ব্যক্তি বা সমষ্টিকে আযাব দিতে চান, তখন কেউ তা রদ করতে পারে না; আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে তার সাহায্যার্থে কেউ এগিয়ে আসতে পারে না (সূরা আর-রা’দ, মাআরিফুল কুরআন, মদীনা, পৃ. ৭০২)।

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে হযরত লুত (আ.)-এর উম্মতকে সমকামিতা ও পুংমৈথুনের মতো গর্হিতকর্মের জন্য ৫লাখ অধ্যুষিত জনপদকে আসমানে তুলে আছাড় দিয়েছেন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক নদী, যা ইতিহাসে ‘মৃতসাগর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ সাগরের দৈর্ঘ ৬৭ কি. মি., প্রস্থ ১৮ কি. মি. এবং গভীরতা ১.২৪০ ফুট। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৪২২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এ সাগরের পশ্চিমে রয়েছে ইসরাঈল ও পূর্বে জর্দান। এখান থেকে জেরুজালেম নগরীর দূরত্ব মাত্র ১৫ মাইল। পৃথিবীর অন্যান্য মহাসাগরের তুলনায় লবনাক্ততা বেশি হওয়ায় এতে কোন মাছ জন্ম নেয় না। জর্দান নদী থেকে মাছ এই নদীতে আসার সাথে সাথে মারা যায়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে রয়েছে বিপুল ব্যাকটেরিয়া (Microbe) এবং ক্ষুদ্রকায় ছত্রাক (Encyclopadia Encarta, Chapter-Dead Sea)|

পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী সমকামিতার মতো পাপকার্যে লিপ্ত হওয়ার কারণে সডম ও গোমাররাহ নামক লোকালয় মহান আল্লহর হুকুমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানটি বর্তমানে ‘মৃত সাগর’। আল্লাহর নবী হযরত লুত (আ.)-এর বারংবার সাবধান বাণী সত্ত্বেও সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অবৈধ যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার অভ্যাস পরিত্যাগ করেনি। পৃথিবীর বুকে একমাত্র তারাই যৌন ক্ষুধা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে মহিলাদের বাদ দিয়ে পুরুষদের উপর উপগত হতো (সূরা আল-আরাফ, ৮০-৮১)। ফলে গযব হিসেবে আল্লাহ তাআলা এ জনপদের জনগোষ্ঠীকে বাস্তু-ভিটাসহ বিধ্বস্ত করে দেন।

অনৈতিক যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার শাস্তিস্বরূপ সাম্প্রতিককালে দেখা দিয়েছে এইডস/এইচআইভি। ‘এইডস’ মানে নিশ্চিত মৃত্যু। আজ পর্যন্ত এর কোন কার্যকর ওষুধ আবিস্কৃত হয়নি। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এইডসে আক্রান্ত হয়ে গোটা দুনিয়ায় ৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং এইচআইভি’তে আক্রান্ত হয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে এইডস রোগী সনাক্ত হয়েছে সর্বপ্রথম ১৯৮৯ সালে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এইডস/এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী মানুষের সংখ্যা ১৪ হাজার। এর মধ্যে মারা গেছে ১০২২ জন। এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান কারণ হচ্ছে অবৈধ যৌনমিলন ও সমকামিতা।

হযরত নুহ (আ.)-এর অধঃস্থন পুরুষ প্রাচীন আদ জাতির হিদায়তের জন্য আল্লাহ তাআলা হযরত হুদ (আ.)-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন। জর্দান থেকে হাযরামাউত ও ইয়ামেন পর্যন্ত ছিল তাদের অধিবাস। গৃহনির্মাণ ও স্থাপত্যশৈলীতে তাদের দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। তারা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অমান্য করে মূর্তিপূজা শুরু করে। শাদ্দাদ স্বর্ণখচিত একটি কৃত্রিম বেহেশত বানিয়ে ঔদ্ধত্যের পরাকাষ্ঠা দেখায়। আদ জাতির অমার্জনীয় পাপের ফলে গজবস্বরূপ তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। ক্ষেত-খামার, বাগান ও গাছপালা পানির অভাবে শুকিয়ে যায়। প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তারপরও তারা পাপাচার ত্যাগ করেনি। অবশেষে চূড়ান্ত শাস্তি নেমে আসে। সাত রাত আট দিনব্যাপী অনবরত ঘূর্ণিঝড় ও বজ্রপাতে বিধ্বস্ত হয়ে যায় জনপদ ও লোকালয়। মানুষ ও জীবজন্তু শুন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে জমিনে পতিত হয়। উৎপাটিত খর্জুর বৃক্ষের কাণ্ডের ন্যায় তাদের নিক্ষেপ করা হয় (সূরা আল-কামার: ১৮-২১)।

মাদায়েনের ছামুদ জাতিকে আল্লাহ তাআলা বিধ্বস্ত করে দেন অগ্নিবৃষ্টি দিয়ে। তারা ওজনে কম দিত। দুর্নীতি, ডাকাতি, ধর্ষণ, ছিনতাই ও খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতো। আল্লাহ তাআলা তাদের সতর্ক করার জন্য প্রেরণ করেন হযরত সালেহ (আ.)-কে। তারা নবীর কথা তো শুনেনি উপরন্তু আল্লাহর নিদর্শন উষ্ট্রীকে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি (সূরা আশ-শামস: ১২-১৫)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা স্পষ্ট। ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদেরকে কোন কোন কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সূরা আর-রূম: ৪১)।

পৃথিবীর দেশে দেশে অনাচার, পাপাচার, দুর্বৃত্তপনা ও খোদাদ্রোহিতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির পরিবর্তে অসন্তুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং ইতিহাসের পথ ধরে বিপর্যয় ও গজব নামতে বাধ্য। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, মানুষ মানুষকে মারার জন্য যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও মজুদ করেছে তাতে এ পৃথিবীকে ৩৮ বার ধ্বংস করা যাবে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা পাপাচার, অমানবিক কর্মকাণ্ড ও আল্লাহর নাফরমানির বিস্তারের ফলে কতিপয় জাতিগোষ্ঠী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এমনকি সমগ্র মানবজাতিও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আসলে বিপর্যয় ও ধ্বংস মানুষের কৃতকর্মের ফসল। আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা, ক্ষমাপ্রার্থনা, মানবিকতার উজ্জীবন, কল্যাণকর জীবন যাপনের অঙ্গিকার ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপর্যয় ও গজবের হাত থেকে মানবগোষ্ঠী রক্ষা পেতে পারে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ