প্রভুর বন্ধু প্রভুর দরবারে
[প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.)-এর স্মৃতিচারণ]
সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী
‘খলীল’ শব্দের তাত্ত্বিক আলোচনা
খলীল শব্দটি আরবি। তার মূলধাতু ‘খুল্লাতুন’ অর্থ বন্ধুত্ব, হৃদ্যতা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি। আর ‘খলীল’ মানে অন্তরঙ্গ বন্ধু, প্রেমিক, প্রিয়তম। ‘খলীলুর রহমান’ মানে পরম করুণাময়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু। ‘খলীলুর রহমান’ এটি আল্লাহর প্রিয়তম নবী হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর উপাধী। আল্লাহ তাঁকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাই তাঁকে এই উপাধীতে ভূষিত করেন। পৃথিবীর বুকে তিনি ব্যতীত আরও একজনকে আল্লাহ ‘খলীল’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি হলেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
প্রভুর প্রিয়তম অন্তরঙ্গ বন্ধু!
পবিত্র আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,
وَاتَّخَذَ اللّٰهُ اِبْرٰهِيْمَ خَلِيْلًا۰۰۱۲۵
‘মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আ.)-কে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন।’[1]
তাফসীরে সাউদিতে উল্লেখ আছে,
والخُلة أعلىٰ أنواع المحبة، وهذه المرتبة حصلت للخليلين محمد وإبراهيم عليهما الصلاة والسلام، وأما المحبة من الله فهي لعموم المؤمنين، وإنما اتخذ الله إبراهيم خليلًا لأنه وفَّىٰ بما أُمر به وقام بما ابْتُلي به، فجعله الله إمامًا للناس، واتخذه خليلًا ونوه بذكره في العالمين.
‘‘খুল্লাতুন’ শব্দটি গভীর ভালবাসা ও অন্তরঙ্গতা বোঝায়। এটি ভালবাসার সর্বোচ্চ স্তর। এই স্তরটি আল্লাহ তাঁর দুই বন্ধু হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে দান করেছেন এবং আল্লাহর সাধারণ ভালবাসা সকল মুমিনের জন্য রয়েছে। ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ পালন করেছেন এবং তার সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাই আল্লাহ তাআলা তাঁকে মানবজাতির ইমাম বানিয়েছেন। নিজের জন্য অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পৃথিবীতে তাঁর সুনাম উজ্জল করেছেন।’[2]
প্রভুর অনন্য অন্তরঙ্গ বন্ধু
রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন পৃথিবীর বুকে আল্লাহর অন্যন্য অন্তরঙ্গ বন্ধু। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«لَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا مِنْ أَهْلِ الْأَرْضِ خَلِيْلًا، لَاتَّخَذْتُ ابْنَ أَبِيْ قُحَافَةَ خَلِيْلًا، وَلَكِنْ صَاحِبُكُمْ خَلِيْلُ اللهِ».
‘আমি যদি পৃথিবীতে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে কাউকে গ্রহণ করতাম তাহলে আবু বকরকেই গ্রহণ করতাম। কিন্তু তোমাদের সাথী (মুহাম্মদ) তো আল্লাহকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছেন (তাই পৃথিবীর অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না)।’[3]
ভিন্ন হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«إِنَّ اللهَ اتَّخَذَنِيْ خَلِيْلًا كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيْمَ خَلِيْلًا».
‘আল্লাহ আমাকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন যেভাবে হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।’[4]
‘খলীল’ নামের প্রভুর বন্ধুগণ
উপাধী হিসেবে নয়, বরং নাম হিসেবে ‘খলীলুর রহমান’ নামটি ধারণ করেছেন পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। যেহেতু নামের অর্থের প্রভাব ব্যক্তির মধ্যে বিস্তার করে। তাই এই নামের অধিকারী লোকজন সাধারণত আল্লাহর বন্ধু হয়ে থাকেন। অধমের দুজন প্রিয় উস্তাদের নাম ‘খলীলুর রহমান’। একজন আজ পৃথিবী ছেড়ে বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি হলেন আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার প্রবীণ সিনিয়র উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.)। তিনি ১৪ রবিউস সানী ১৪৪১ হি. মোতাবেক ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ বৃস্পতিবার আনুমানিক রাত ১২.৪৫ মিনিটে রব্বে কারিমের ডাকে সাড়া দিয়ে ইহকাল ত্যাগ করেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃতকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৬ বছর। তিনি চার ছেলে, স্ত্রী ও অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত-অনুরক্ত রেখে যান। মৃত্যু অবধি তিনি জামিয়া পটিয়ার সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন। আল্লাহ তাঁর সকল ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন, জান্নতুল ফিরদাউস নসীব করুন, আমীন।
অপরজন এখনো পৃথিবীতে বিচরণ করে আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর বন্ধু বানানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি হলেন ভারতের লৌখনো থেকে প্রকাশিত মাসিক আল-ফুরকান-এর সম্পাদক, আধ্যাত্মিক জগতের মহা সম্রাট মাওলানা খলীলুর রহমান সাজ্জাদ নোমানী (হাফিযাহুল্লাহ)। আল্লাহ তাঁকে সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবী করুন, আমীন।
মূলত বসেছি আমাদের প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.)-এর স্মৃতিচারণ করার জন্য। সূচনাতে তাঁর নামের প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা চলে এসেছে। পাঠকদের উপকারার্থে ভূমিকা হিসেবে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। অতঃপর হযরতের কিছু স্মৃতিচারণ করার ইচ্ছা আছে। আল্লাহই তাওফীক দাতা। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের প্রিয় উস্তাদজির খতা-কসুর ক্ষমা করে দিন। তাঁর খেদমতগুলো কবুল করুন এবং তাঁকে আপনার প্রিয়তম অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন, আমীন।
তাঁর মুচকি হাসির অপূর্ব স্মৃতি!
জামিয়া পটিয়ায় শিক্ষা জীবনের সূচনালগ্ন থেকে মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.)-কে দেখেছি। হাস্যোজ্জ্বল চেহরায় সদামাটা জীবন-যাপনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। মুচকি হাসি ছিলো তার চিরাচরিত ভূষণ। তিনি যেন প্রতি নিয়ত সাদাকার সাওয়াব অর্জন করে চলেছেন। কথা-বার্তা, দরস-তাদরীস, শিক্ষা-দীক্ষা, ওয়ায-নসীহত; কোথাও তাঁকে চেহরা মলিন করে কথা বলতে দেখা যায়নি। মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে রাখার সুন্নাতটি তাঁর জীবনে সদা সজীব ছিল। তাঁকে কখনো গোমরা মুখে কথা বলতে দেখা যায়নি।
বস্তুত, হাসি সৌন্দর্যের প্রতীক। কখনো হাসি ভুলিয়ে দেয় রাশি রাশি দুঃখ ও যন্ত্রণাকেও। হাস্যোজ্জ্বল মানুষকে সবাই ভালবাসে। আপন ও কাছের ভাবে। হাসির মাধ্যমে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। একটুখানি মুচকি হাসি দুইজনের সম্পর্কে নতুনমাত্রাও যোগ করতে পারে।
একজন মুসলমান হিসেবে অন্য ভাইয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের আদাব-শিষ্টাচার প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) উম্মতকে শিখিয়ে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, একজন মুসলিম অপর ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করবে। কারণ এটি শরীয়তে সাদাকা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
«كُلُّ مَعْرُوْفٍ صَدَقَةٌ، وَإِنَّ مِنَ الْـمَعْرُوْفِ أَنْ تَلْقَىٰ أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ».
‘প্রতিটি ভালো কাজ সাদাকা। আর গুরুত্বপূর্ণ একটি ভালো কাজ হচ্ছে, অপর ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা।’[5]
আরেক হাদীসে নবীজী (সা.) ইরশাদ করেন,
«تَبَسُّمُكَ فِيْ وَجْهِ أَخِيْكَ لَكَ صَدَقَةٌ».
‘তোমার ভাইয়ের সাক্ষাতে মুচকি হাসাও একটি সাদাকা।’[6]
আমাদের প্রিয়নবী (সা.) সবসময় মুচকি হাসতেন। প্রতিটি হাদীসগ্রন্থে তার হাসির ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। মুচকি হাসা সুন্নাত। এই সুন্নাতের বাস্তব অনুশীলন করতে আমাদের প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.)-কে দেখেছি। আহ! কত সুন্দর, মধুময় ও হাস্যময়ী জীবন ছিল প্রিয় উস্তাদ মহোদয়ের! তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তাঁর হাস্যোজ্জ্বল চেহরা আমাদের হৃদয়ে গ্রোথিত হয়ে আছে।
হে মহা দয়াবান! আপনি দয়া করে উস্তাদে মুহতারমকে আপন নৈকট্য দান করুন। তিনি আমাদের কাছে হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন, এখন তোমার দরবারে চলে গেলেন, সেখানেও তাঁকে হাস্যোজ্জ্বল রাখুন, আমীন।
আল্লাহর নিদর্শনকে সম্মান প্রর্দশনের উত্তম আদর্শ
পৃথিবীতে আল্লাহর কিছু নিদর্শন আছে। মসজিদ সে নিদর্শনের অন্যতম। আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান জানাতে হয়। মহান রব্বুল আ’লামীনের নিদর্শনগুলোকে সম্মান জানানো খোদাভীতির পরিচায়ক। আল্লাহ বলেন,
ذٰلِكَ١ۗ وَمَنْ يُّعَظِّمْ شَعَآىِٕرَ اللّٰهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ۰۰۳۲
‘আর যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করলো, নিশ্চয়ই এটি তার অন্তরে তাকওয়া অর্জিত হওয়ার পরিচায়ক।’[7]
শা‘আয়িরুল্লাহ তথা আল্লাহর নির্দশন বলতে বোঝায় এমন দৃশ্যমান অনুভূতশীল বস্তু যাকে আল্লাহ তাআলা নির্দিষ্ট করেছেন। যেন তা দ্বারা মানুষ আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতে সক্ষম হয়। আল্লামা শাহ ওলি উল্লাহ (রহ.) বড় বড় শা‘আয়িরুল্লাহ চারটি বলেছেন। বায়তুল্লাহ শরীফ, কুরআন শরীফ, নবী-রাসূলগণ এবং নামায। প্রিয় উস্তাদ হযরত মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে অত্যাধিক সম্মান করতেন। তিনি মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ছিলেন। শরিরের এক পাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি অনেক কষ্ট করে একাকি মসজিদে গমন করতেন। তাঁকে দেখে অনেক কষ্ট অনুভব হতো। তিনি পা হেচড়ে ধীরে ধীরে মসজিদের দিকে এগিয়ে আসতেন। কখনো কখেনো থাকিয়ে থাকতাম। আবার কখনো কখনো অশ্রু প্রবাহিত করে দুআ করতাম। আল্লাহ! তুমি দয়া করে উস্তাদে মুহতারমকে সুস্থ করে দিন।
মনে প্রবল ইচ্ছে হতো। হুযুরের হাত ধরে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু করা সম্ভব হতো না। কারণ তাতে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন। তৃতীয় তলার বাসা থেকে পা পা করে মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন। মসজিদের দরজায় এসে নিজের জুতোগুলো নিজেই সোজা করে রাখতেন। কারো জুতো যদি মসজিদের সিঁড়িতে রাখা অবস্থায় দেখতেন, তখন তিনি রেগে যেতেন। নিজ লাঠি দিয়ে ফেলে দিতেন। সে জুতো বড় কিংবা ছোট; যে কারোই হোক না কেন। জুতোগুলো ছুড়ে মারতেন। মনে হতো যেন তিনি স্পষ্ট বলছেন, মসজিদের আজমত-সম্মান অন্তরে না থাকলে মসজিদে কে আসতে বলেছে?
আর্শ্চয অনুভূতি! অল্প ক’দিন পূর্বের ঘটনা। মাওলানা মাসুম (হাফিযাহুল্লাহ)-কে দেখিয়ে বললাম দেখুন, মাওলানা কি করছেন! তখন মাওলানা (রহ.) মসজিদের সিঁড়িতে রাখা পাপোশটি সে অবশ পা দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করছেন। কারণ তিনি পা হেচড়ে চলতেন। তাঁর পায়ের সাথে লেগে পাপোশটি একটু নীচে সরে গেল। সে পাপোশটি সেভাবে রেখে যাওয়া মসজিদের সম্মানের খেলাফ মনে করলেন। তাই, তিনি সাথে সাথে সে ভাঙ্গা পা দিয়ে তা সোজা করে দিলেন, সুবহানাল্লাহ। একজন মানুষ কতটুকু সংবেধনশীল, কত বেশি অনুভূতিপ্রবণ হলেই এমন কাজ করতে পারেন, তা তাঁর এই কাজটি না দেখলে অনুমান করা সম্ভব হতো না।
আমরা অনেকেই মসজিদে যায়। কিন্তু মসজিদের আদাবগুলোর প্রতি খেয়াল রাখা হয় না। মসজিদ আল্লাহর প্রিয় স্থান। আল্লাহর শাহী দরবার। শাহী দরবারে আদব-শিষ্টাচার রক্ষা করা সকলের জন্য জরুরি। আমাদের প্রিয় উস্তাদজি (রহ.) সেগুলোর ব্যাপারে খুবই যত্মবান ছিলেন। আল্লাহ আমাদদেরকে তাঁর আদর্শে আদর্শবান হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন। হে আল্লাহ, যিনি তোমার নিদর্শনের প্রতি সম্মান জানিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন আপনি তাঁর ওপর রহম করুন, তাঁকে সম্মানের সু-উচ্চ মকাম দান করুন, আমীন।
মসজিদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক
মসজিদ হলো হেদায়ত ও বরকতের মারকায। আল্লাহ পৃথিবীতে যেমনি আলো বিতরণের জন্য সূর্য সৃষ্টি করেছেন তেমনি হিদায়ত ও বরকত বিতরণের জন্য বায়তুল্লাহ নির্মাণ করেছেন। সমগ্র মানবজাতি পৃথিবী ব্যাপী বরকত ও কল্যাণ, হেদায়ত ও পথের সন্ধান সেখান থেকেই লাভ করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,
اِنَّ اَوَّلَ بَيْتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِيْ بِبَكَّةَ مُبٰرَكًا وَّهُدًى لِّلْعٰلَمِيْنَۚ۰۰۹۶
‘নিশ্চয় প্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তা মক্কায়। যা বরকতময় ও হিদায়াতের দিশারী বিশ্ববাসীর জন্য।’[8]
মুফাসসিরগণ বলেন, পৃথিবীতে হেদায়ত ও বরকত শুরু হয় কা’বা শরীফ থেকে এবং তা বণ্টিত হয় মসজিদের মাধ্যমে। এ জন্য মানুষ যদি পৃথিবীতে হেদায়ত ও বরকত অর্জন করতে চায় তাহলে তাকে কা’বা শরীফে গমন করতে হবে। আর যদি সেখানে যেতে সক্ষম না হয় তাহলে নিজ নিজ এলাকার মসজিদে গমন করবে। মসজিদে এসে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করবে। তাতে সে হেদায়ত ও বরকত অর্জন করতে সক্ষম হবে। এ জন্যই যারা মসজিদে এসে জামায়াতে শরিক হয় তাদের নামাযের মান বেড়ে যায়। একা নামায পড়ার তুলনায় জামায়াতের সাথে নামায পড়ার সাওয়াব সাতাশগুন বেশি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
«صَلَاةُ الْـجَمَاعَةِ أَفْضَلُ مِنْ صَلَاةِ الْفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِيْنَ دَرَجَةً».
‘জামায়াতের সাথে নামায আদায় একা নামায আদায়ের চেয়ে সাতাশগুণ বেশি ফযীলতপূর্ণ।’[9]
প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) জামায়াতের সাথে নামায আদায় করাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। সুস্থ্য অবস্থায় তিনি জামায়াতের পাবন্দি করতেন। অসুস্থ্য হওয়ার পরও তিনি যাথাসাধ্য জামায়াতে আসার চেষ্টা করতেন। অনেক কষ্ট করে বাসা থেকে মসজিদ পর্যন্ত একাকি যাতায়ত করতেন। তাঁর অন্তরটি যেন মসজিদের সাথে সদা লেগেই থাকতো। প্যারালাইসেস হওয়ার পর তিন তলার বাসা থেকে পা হেচড়িয়ে হেচড়িয়ে জামায়াতে শরিক হতেন। মনে হতো ঘরে গেলেও তিনি আবারো মসজিদে আসার অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁর মন মসজিদ থেকে বের হয়ে আবার সেখানে ফেরা পর্যন্ত মসজিদেই পড়ে থাকতো। অন্তর সদা মসজিদের প্রতি ঝুকে থাকতো। যেন তিনি ইহকালে থাকা অবস্থায় আরশের ছায়া পাওয়ার বিষয়টি নিজের জন্য নিশ্চিত করে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِيْ ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ، … وَرَجُلٌ كَانَ قَلْبُهُ مُعَلَّقًا بِالْـمَسْجِدِ إِذَا خَرَجَ مِنْهُ حَتَّىٰ يَعُوْدَ إِلَيْهِ».
‘সাত ধরনের মানুষকে আল্লাহ তাআলা সেদিন (কিয়ামতের দিন) তাঁর ছায়ার নীচে আশ্রয় দেবেন যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কারো ছায়া থাকবে না। … সেখান থেকে তৃতীয়জন হলেন সে ব্যক্তি, যিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে আবার সেখানে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত মসজিদেই তার মন পড়ে থাকে।’[10]
আমাদের বিশ্বাস প্রিয় উস্তাদ হযরত মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) এই হাদীসের ওপর পরিপূর্ণ আমল করে দেখিয়েছেন। তাই তিনি ৩য় তলা থেকে দৈনিক কয়েকবার একাকি উঠা-নামা করে জামায়াতে শরিক হতেন। আল্লাহ তাঁর আমলগুলো কবুল করুন, আমীন। হে মহা মহিয়ান, দয়া করে তুমি উস্তাদ মহোদয়কে কিয়ামতের সঙ্কট থেকে মুক্তি দান করো এবং তোমার আরশের নীচে ছায়া দান করো, আমীন।
সাহিত্যপ্রিয় এবং বহু ভাষার অধিকারী
প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান (রহ.)-এর সাথে দরসী সম্পর্কের পূর্ব থেকেই তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হয়ে আসছি। তিনি ছিলেন জামিয়া পটিয়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘আন-নাদী আস-সাকাফী’র তত্ত্বাবধায়ক। সেই সুবাধে তাঁর কাছে উপকৃত হওয়ার ধারা সূচিত হয়েছিল।
আন-নাদী আস-সাকাফী ছিল তৎকালীন একঝাঁক তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের মিলনমালা। জামিয়ার নির্বাচিত সেরা মেধাবীরাই এই সংগঠনের সদস্য হতো। তাদেরকে পরিচালিত করার জন্য তৎকালিন জামিয়া প্রধান আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী (রহ.) দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারুণ্যের অহংকার জামিয়া পটিয়ার প্রাক্তন সফল সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা মাহমুদুল হাসান আযহারী (হাফিযাহুল্লাহ)-কে। তিনি জামিয়ার কয়েকজন দক্ষ শিক্ষকম-লী দ্বারা এই সংগঠনকে সু-সজ্জিত করেন। ভরপুর জীবন ও যৌবন দান করেন। এক সময় তিনি উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্যে জামিয়াতুল আযহারে পাড়ি জমান। তখন থেকেই এই সংগঠনের হাল ধরেন আমাদের প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.)। পরবর্তীতে মিশর থেকে মাওলানা মাহমুদুল হাসান (হাফিযাহুল্লাহ) জামিয়ায় প্রত্যাবর্তন করার পর উভয়জন পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সাহিত্য সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যান। একসময় মাওলানা আযহারী জামিয়া থেকে অব্যহতি নেন। তখন থেকে মাওলানা মীর খলীলুর রহমান (রহ.) অসুস্থ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সংগঠনকে পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে পরিচালনা করেন। তাঁর অসুস্থার কারণে সংগঠনটি রূপ পরির্বতন করে এখন দায়িরাতুল আদব হিসেবে বিদ্যমান আছে। যা জামিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল জলীল কাওকব (হাফিযাহুল্লাহ) কর্তৃক পরিচালিত। আমরা দুআ করি, আল্লাহ যেন হযরতকে হায়াতে তায়্যিবা দান করেন এবং এই সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আরও অধিক সজীব ও কর্মময় করার তাওফীক দান করেন, আমীন।
মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) আন-নাদী আস-সাকাফীতে দরস দিতেন। তিনি আরবি ও বাংলা সাহিত্যের দরস প্রদান করতেন। তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হয়েছে। তিনি ছাত্রদেরকে দরসী কিতাবের পরিপূর্ণ হক আদায়পূর্বক অন্যান্য জরুরি বিষয়াদির প্রতি গুরুত্বারোপ করতে তাগিদ দিতেন। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ছে। তিনি একদিন বলেছিলেন, তোমারা ভৌগলিক জ্ঞান অর্জন করবে। কারণ একজন দায়ীর জন্য ভৌগলিক জ্ঞান অত্যন্ত জরুরি। যেমন- কেউ বক্তব্য রাখছেন বিদেশি কোন রাষ্ট্র সম্পর্কে। কিন্তু ইশারা করছে ভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি। এটি শ্রোতাদের মনে বক্তা সম্পর্কে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এ জন্য কোন দেশ সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে জেনে নিতে হবে এটি কোন মহাদেশের রাষ্ট্র, সেটির অবস্থান আমাদের অবস্থানের কোন পার্শে। তারপর ঐদিকে ইঙ্গিত করেই ইশারা করবে।
তাঁর ভাষাজ্ঞান
তিনি অত্যন্ত সাহিত্যপ্রেমী ও ভাষা অনুসন্ধানী ছিলেন। তিনি আরবী-বাংলা, উর্দু-ফারসি সকল ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন। আরবি সাহিত্যে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। জামিয়া পটিয়ায় আধুনিক আরবির একমাত্র কেন্দ্রস্থল ছিলেন তিনি। জামিয়া পটিয়ার বর্তমান সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া (হাফিযাহুল্লাহ) একদিন বলেছিলেন, আধুনিক আরবির কোন টেক্সট আমাদের বোধগম্য না হলে আমাদের কোন চিন্তা ছিল না। ব্যাস, মাওলানা মীর খলীলুর রহমান (রহ.)-এর নিকট নিয়ে গেলেই সমাধান পাওয়া যেত। তিনি অসুস্থ হওয়ার পরই তার মূল্য আমাদের কাছে বুঝে এসেছে। তিনি আমাদের জন্য কত বড় সম্পদ ছিলো।
জামিয়া পটিয়ার পরিচালনাধীন বাংলাদেশ তাহফীযুল কুরআন সংস্থার কাজে তাঁকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যেতো। গত কয়েক বছর ধরে তাহফীযের বিভিন্ন কাজে সংশিস্নষ্ট হওয়ার পর একটি বিষয় খুবই চমকে দিতো। তা হলো তাদের কাজগুলো উন্নতমানের আরবি সাহিত্যের পরিভাষায় সন্নিবেশিত। মনে মনে ভাবছিলাম কাউকে জিজ্ঞাসা করবো। এগুলোর পেছনে মূল ভূমিকা কার? কিন্তু সেদিন জামিয়া পটিয়ার সিনিয়র শিক্ষক, বন্ধুবর মাওলানা নাসির উদ্দীন সাহেবের কাছ থেকে বাস্তব বিষয়টি সম্পর্কে জানলাম। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন, আমীন। তিনি বলেন, মাওলানা মীর খলীলুর রহমান (রহ.) ও মাওলানা রহমাতুল্লাহ (রহ.) দু’জনই আন্তরিক বন্ধু ছিলেন। উভয়জন এক সাথে বসে তাহফীযের কাজ করতেন। আমি অনেক সময় আর্শ্চযবোধ করতাম। মাওলানা রহমাতুল্লাহ (রহ.) বিভিন্ন বিষয়ে মাওলানা মীর খলীলুর রহমান সাহেব (রহ.)-কে আরবি ভাষায় অনুবাদ করতে বলেতেন। তখন তিনি তৎক্ষণাৎ তা আরবি করে দিতেন। কোন ধরণের অভিধানের সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন হতো না।
ভাগ্যের কি চমৎকার মিলন! মৃত্যুর পর একে অপরের পাশেই শুয়ে আছেন। মাওলানা মীর খলীলুর রহমান (রহ.) এবং মাওলানা রহমাতুল্লাহ কাউসার নেজামী (রহ.) উভয়জনের কবরের পাশে গেলেই তাঁদের বন্ধুত্বের কথা স্মরণ না করে কেউ ফিরতে পারে না। হে আল্লাহ আমাদের এই প্রিয় উস্তাদগণ তোমার সান্নিধ্যে গমন করেছেন। তুমি আপন দায়ায় তাঁদেরকে ক্ষমা করো। জান্নাতের সু-উচ্চ মকাম দান করো, আমীন।
ফারসি ভাষায় তাঁর দক্ষতা
তিনি আমাদেরকে ভাষা আয়ত্বের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলতেন, আমাদের দেশের ভাষা বাংলা। তাই আমাদেরকে বাংলা ভাষা আয়ত্ব করতে হবে। কুরআন-হাদীসের ভাষা এবং ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল ভাষা আরবি। তাই আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তেমনি বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি ভাষায়ও দক্ষ হবে। আর আমাদের অঙ্গণে এখনো উর্দু-ফারসির বেশ কদর রয়েছে। যেহেতু এগুলো আমাদের ইলমী ভাষা, তাই এই দুই ভাষাকেও আয়ত্ব করতে হবে। তিনি বলেন, আমি যখন জিরি মাদরাসায় পড়ি, তখন আমাদের এক উস্তাদ ছিলেন। তিনি ফারসী ভাষা খুবই পছন্দ করতেন। তাই আমি তাঁর কিতাবের পরীক্ষা ফারসি ভাষায় দিতাম। তিনি অনেক খুশি হতেন। আমাকে পরিপূর্ণ নম্বর দিয়ে দিতেন। তেমনি একবার আমরা ট্রানজিট সফরে ইরানের এক হোটেলে ছিলাম। তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ ফোনে আমাদের সাথে ফারসিতে কথা বলেন। আল-হামদুলিল্লাহ, আমি সেখানে তাদের সাথে ফারসি ভাষায় কথা বলেছি। তাতে তারা খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিল। আমাদের মাদরাসায় প্রচলিত কয়েকটি ভাষায় (উর্দু-ফারসি, আরবি-বাংলায়) দক্ষতা অর্জনের প্রতি মাওলানা (রহ.) খুব বেশি জোর দিতেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। তাঁর স্মৃতিগুলো আমাদের অন্তরে গ্রোথিত হয়ে আছে। হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে তাঁর নসীহত অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করো, এবং তাঁর ভুল-ক্রটিগুলো ক্ষমা করে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করো, আমীন।
সহজ-সরল পাঠদান পদ্ধতি
প্রিয় উস্তাদ মাওলানা খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) নিকট তেমন বেশি দরসী কিতাব পড়ার সুযোগ হয়নি। একটি মাত্র কিতাব পড়েছি। ফিকহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য এবং দুর্বোধ্য কিতাব ‘হিদায়া’ ৪র্থ খণ্ড। তিনি এক অন্যন্য পদ্ধতিতে আমাদেরকে পাঠদান করতেন। তাঁর পদ্ধতিই ছিল ভিন্ন ও অন্যন্য। তিনি স্বল্প কথায় মূল বিষয়টি সহজ-সরল, সাবলিল ভাষায় উপস্থাপন করতেন। তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ছিল সর্বমর্মী ও সর্বব্যাপী।
বস্তুত হিদায়া কিতাবটি দরসে নেজামীর একটি দুর্বোধ্য কিতাব। এটি চার খণ্ড বিশিষ্ট একটি কিতাব। তন্মধ্যে ৩য় খণ্ড সবচেয়ে বেশি দুর্বোধ্য হলেও ৪র্থ খণ্ডের বিষয়বস্তু অপ্রতুলতার কারণে তুলণামূলক কম মুশকিল নয়। আল-হামদু লিল্লাহ। আমরা এই দুটি কিতাব এমন দুই মনীষীর কাছ থেকে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি যাঁরা আমাদেরকে কিতাবের দুর্বোধ্যতা অনুভব করতে দেননি। একেবারেই সহজ, সরল পদ্ধতিতে পানির মতো পান করিয়ে দিয়েছেন। কখনো মনে হতো না এই কিতাবগুলো আদৌ কোন কঠিন-দুঃসাধ্য কিতাব। অনেক শিক্ষার্থী যখন এগুলোর দুর্বোধ্যতার কথা বলে তখন আমাদের কাছে মুচকি হাসি আসে। আর আল্লাহর দরবারে প্রিয় উস্তাদগণের জন্য দু’হাত তুলে দুআ করি। হে আল্লাহ, আপনি তাঁদেরকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।
তাঁদের একজন হলেন, বর্তমান জামিয়া প্রধান আল্লামা মুফতি আবদুল হালীম বোখারী (হাফিযাহুল্লাহ)। আর অপরজন হলেন প্রিয় উস্তাদ মাওলানা খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.)। হিদায়া ৩য় খণ্ডের আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। অন্যথায় ৩য় খণ্ড পাঠদানের যিম্মাদারি যখন অধমের ওপর এসেছিল তখনকার স্মৃতিগুলো লিখার জন্য অন্তরে জোর তাকাদা সৃষ্টি হচ্ছিল। অন্য কোন সময় সুযোগ করে লিখব, ইনশা আল্লাহ।
মাওলানা মরহুম হিদায়া ৪র্থ খণ্ডের দরসে মূল টেক্সটের (ইবারতের) প্রতি খুবই গুরুত্বারুপ করতেন। অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় যথার্থ উপমা দ্বারা ‘ইবারতে’র ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। কঠিন-দুঃসাধ্য বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপনের দক্ষতা; শিক্ষার্থীকে রীতিমত চমকে দিতো। সেদিন জামিয়া পটিয়ার সম্মানিত শিক্ষক মাওলানা মা’সুম (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, আমাকে এক ছাত্র হুযুরের দরস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। আমি তাকে বললাম, দেখ, বর্তমানে যেমনি কর্ণফুলি নতুনব্রিজ থেকে বহদ্দার হাট পর্যন্ত যাতায়তের পথে কোন ধরনের ট্রাফিক নেই, ঠিক তেমনি হুযুরের দরসের মধ্যেও কোন ধরনের ট্রাফিক ছিল না। অত্যন্ত সাদা, সহজ ও চমৎকার পদ্ধতিতে সুন্দর সুন্দর উপমা দিয়ে জঠিল-দুঃসাধ্য বিষয়গুলো ট্রাফিক বিহিন শিক্ষার্থীদের মসিত্মষ্কের নিকটে পৌঁছে দিতেন।
টীকা কিংবা ব্যাখ্যাগ্রন্থ নয়!
মূল ইবারত-টেক্সট বুঝতে হাশিয়া-টীকা কিংবা শরহ-ব্যাখ্যাগ্রন্থের সাহায্য নেওয়ার পূর্বে নিজ বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, টীকাকারক ও ব্যাখ্যাকারকও তোমাদের মত একজন পাঠক। তিনি নিজে তা পাঠ করে একটি উদ্দেশ্য নির্ণয় করেছেন। তোমাকেও তা মেনে নিতে হবে, জরুরি নয়। হতে পারে তোমার বিবেক-বুদ্ধি তার চেয়েও ভালো কোন উদ্দেশ্য বের করতে সক্ষম হবে। অতএব তুমি নিজেই প্রথমে মূল টেক্সটের প্রতি মনোনিবেশ করো। চেষ্টা করো, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যায় কি না? অপারগ হয়ে গেলে টীকা কিংবা ব্যাখ্যাগ্রন্থের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে, অন্যথায় নয়।
জামিয়া পটিয়ার সিনিয়র শিক্ষক বন্ধুবর মাওলানা নাসির উদ্দিন (হাফিযাহুল্লাহ) সেদিন বলেছেন, আমরা হুযুরের কাছে হিদায়া ৪র্থ খণ্ডের দরস গ্রহণ কালিন সময়ে একদিন দরস চলাকালে হুযুরের কি যেন সন্দেহ হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ তিনি দরস বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে যান। পরে অনেক্ষণ চিন্তা করার পর তার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। বেশকিছু সময় তিনি মূল টেক্সট (ইবারত) নিয়ে চিন্তা করতে ছিলেন। কিন্তু একটি বারের জন্যও টীকার দিকে তাকাতে দেখিনি। বন্ধুবর মাওলানা নাসির উদ্দিন (হাফিযাহুল্লাহ)-এর কাছে থেকে ঘটনাটি শুনার পর স্মরণ হলো আমাদের সময়ও অনুরূপ একটি ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। তখন হুযুরের সন্দেহ দূর করার জন্য কোন একজন সহপাঠী বলেছিলেন। হযরত! এ সম্পর্কে টীকায় এমনটি দেয়া আছে। তখন প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) বলেন, আমি টীকা দেখে ইবারতের ব্যাখ্যা গ্রহণকরাকে ভালো মনে করি না। মূল টেক্সট থেকেই মর্ম বের করার চেষ্টা করা উচিত। কারণ এটিও অন্যান্য অভিমতের মত একটি অভিমত মাত্র। তোমার কাছে এই মতের ভিন্ন অভিমত থাকতে পারে। যা হয়ত তার চেয়েও উত্তম হবে। সুবাহানাল্লাহ, তিনি শিক্ষার্থীদেরকে কেবল দরস প্রদান করতেন না, বরং তাদেরকে একজন দক্ষ ব্যাখ্যাকারক হিসেবে গড়ে তুলতেন। তিনি আজ আমাদের ছেড়ে তাঁর প্রিয় রবের দরবারে গমন করেছেন। আমরা দুআ করি তিনি যেন সেখানে সুখ-শানিত্মতে থাকেন।
হে রাব্বে কারিম! তুমি দয়া করো আমাদের প্রিয় উস্তাদজির ওপর। তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করো। তাঁকে তোমার বন্ধুদের সাথে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মকাম দান করো, আমীন।
তাঁর রাগ ও ক্রোধ ছিল কেবল আল্লাহর জন্যই
প্রিয় উস্তাদ মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) যেমনি ছিলেন নম্র ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী, তেমনি সিদ্ধানেত্মর ক্ষেত্রে ছিলেন অনড় ও সুদৃঢ়। তাঁর এই মহৎ চরিত্রের কারণে তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর মুখে সদা মুচকি হাসির মায়াবি আভা লেগে থাকতো। তাঁকে দেখলে অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী মনে হতো। কিন্তু নিয়মনীতি প্রতিপালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদৃঢ় ও খুবই অনড়। শিক্ষার্থীদের কোন অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দেখলে তা মোটেও সহ্য করতেন না। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে চেহরার রঙ বিবর্ণ হয়ে যেতো। নিজ হাতে তা সাথে সাথে প্রতিহত করত প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেন।
জামিয়া পটিয়ার পরীক্ষার হল একটি ঐতিয্যবাহী হল। শত-সহস্র পরীক্ষার্থী এক সাথে একই হলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। হলের সৌন্দর্যতা ও বিশালতা দেখে যে কোন পরিদর্শক অবাক না হয়ে পারে না। হলের চৌকস যিম্মাদারগণ সদা সক্রিয় থাকেন। যেন কোন ধরেনের হট্টগোল কিংবা বিশৃংখলা পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে এবং পরীক্ষার্থীরা বিনাবিগ্নতায় পরীক্ষা দিতে পারে।
অধমেরও এই পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। অনেক শিক্ষাকম-লী সেখানে সক্রিয়ভাবে যিম্মাদারী পালন করতে দেখেছে। তবে, প্রিয় উস্তাদ মাওলানা খলীলুর রহমান (রহ.)-এর দায়িত্ব পালনের পদ্ধতি ছিল দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার মত। তাঁকে দেখা যেত, পরীক্ষার হলে কোন পরীক্ষার্থী অনিয়ম করলে, কিংবা কারো সাথে কথা বললে তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে যেতেন। বিকট এক হুংকারে গোটা হল নিয়তন্ত্রণ করে নিতেন। শুরুতে শুরুতে অনুসন্ধানি হয়ে দেখার চেষ্টা করতাম, উনি কে? যখন দেখতাম তিনি মাওলানা (রহ.) তখন খুবই আশ্চর্যবোধ করতাম। কারণ তাঁকে তো কখনো এমন রাগ করতে দেখা যায়নি। তিনি আজ এতো ক্রোধান্বিত!! এতো রাগান্বিত!!
পরে যখন হাদীসের কিতাবাদিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামের ঘটনা পড়ার সুযোগ হলো তখন অনেকটা আঁচ করতে পারলাম। মূলত তিনি সুন্নাতের ওপর আমল করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ বাস্তবায়ন করেছেন।
বস্তুত অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দেখলে রেগে যাওয়া রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত ও সাহাবায়ে কেরামের অন্যতম আদর্শ। রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী, তেমনি তিনি অন্যায় দেখলে রেগে যেতেন। এ রাগ দূষণীয় নয়। রবং মানুষের মধ্যে এই রাগের বৈশিষ্ট্য দান করার অন্যতম হেকমত ও দর্শন হলো; মানুষ যেন অন্যায়-অবিচারকে মাথা পেতে না নেয়। মহানবী (সা.) কখনো নিজের স্বার্থে ক্রুদ্ধ হতেন না। তবে মহান আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত বিধান লঙ্ঘন করা হলে তখন (কেবল আল্লাহর স্বার্থেই) ক্রোধ প্রকাশ করতেন।
عَنْ عَائِشَةَ i، قَالَتْ: «مَا انْتَقَمَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لِنَفْسِهِ فِيْ شَيْءٍ يُؤْتَىٰ إِلَيْهِ حَتَّىٰ يُنْتَهَكَ مِنْ حُرُمَاتِ اللهِ، فَيَنْتَقِمَ للهِ».
‘হযরত আয়িশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো নিজের জন্য প্রতিশোধ নেননি, যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাআলার মর্যাদা (শরীয়তের বিধি-বিধান) ড়্গুন্ন হয়। তখন তিনি (আল্লাহর স্বার্থে) প্রতিশোধ নিতেন।’[11]
হে মহাদয়াবান প্রভু! আমাদের প্রিয় উস্তাদ কখনো (নিজস্বার্থে) আমাদের সাথে রাগ করেননি। রাগ করলেও একমাত্র আপনার উদ্দেশ্যেই করেছেন। তিনি আজ তোমার নিকট গমন করেছেন। দয়া করে তুমিও তাঁর ওপর রাগান্বিত হয়ো না। তাঁর পদস্খলনগুলো ক্ষমা করো। আপন দয়ায় তাঁকে নাজাত দান করো, আমীন।
নিজের কাজ নিজে করতে অভ্যস্ত ছিলেন
মাওলানা মীর খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করতেন। ‘নিজের কাজ নিজে করি, সুন্দর জীবন ঘড়ি—উক্তিটির যথার্থ প্রতিফলন হয়েছিল তাঁর জীবনে। একজন বড় মাপের আলেমে দীন হওয়া সত্ত্বেও ছোট-বড় যে কোন কাজ করতে তিনি লজ্জাবোধ করতেন না। তাঁর কাজ অন্য কেউ করার সুযোগ পেতো না। সুস্থ অবস্থায় তিনি কারো কাছ থেকে সেবা-যত্ম গ্রহণ করতেন না। অসুস্থ হওয়ার পরও যথাসম্ভব অন্যের কাছ থেকে খেদমাত নিতে প্রস্তুত থাকতেন না। কেউ স্বেচ্ছায় খেদমত করতে চাইলেও তাঁকে রাজি করা মুশকিল হতো।
বস্তুত সুন্দর জীবন গড়তে নিজের কাজ নিজে করার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। নিজের কাজ নিজে করলে কাজ গুছিয়ে করা যায়, সময় বাঁচে, অর্থের সাশ্রয় হয় এবং কাজও সুন্দর হয়। বিখ্যাত ব্যক্তিরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করতেন। অন্যেরা করে দিতে চাইলেও তা করতে দিতেন না। নিজের কাজ নিজে করার অনেক সুবিধা রয়েছে। নিজের কাজ নিজে করলে কাজটি নিজের মতো করে গুছিয়ে করা সম্ভব হয়। নিজের কাজ নিজে করলে দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না। এতে পরিবারের অন্য সদস্যদের বা আশেপাশের লোকজনের ওপর অতিরিক্ত কাজের ভার চেপে বসে না। কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জন্মে এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বেড়ে যায়। ফলে সঠিক সময়ে কাজ সুসম্পন্ন হয়। জীবন সুন্দর ও সুখময় হয়। নিজের কাজ নিজে করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন- তিনি মানুষের শ্রমের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: «إِنْ قَامَتِ السَّاعَةُ وَفِيْ يَدِ أَحَدِكُمْ فَسِيلَةٌ، فَإِنِ اسْتَطَاعَ أَنْ لَا تَقُومَ حَتَّىٰ يَغْرِسَهَا فَلْيَغْرِسْهَا».
‘হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘যদি তোমার হাতে একটি চারাগাছ থাকে এবং তুমি জানো যে কিছুক্ষণ পর তুমি মারা যাবে কিংবা কিছুক্ষণ পর কেয়ামত শুরু হয়ে যাবে, তারপরও তুমি সেটি রোপন করে মারা যাও।’’[12]
নিজের কাজ নিজে করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমনি গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি নিজে তা করিয়ে দেখিয়ে গেছেন।
জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে রাসূলুল্লাহ (সা.)
وَكَانَ ﷺ فِي بعض أَسْفَاره، فَأمر بإصلاح شاه، فَقَالَ رجل: يَا رَسُول الله! عَليّ ذَبحهَا، وَقَالَ آخر: عَليّ سلخها، وَقَالَ آخر: عَليّ طبخها، فَقَالَ ﷺ: «وَعلي جمع الْـحَطب»، فَقَالُوا: يَا رَسُول الله! نَحن نكفيك، فَقَالَ: «قد علمت أَنكُمْ تكفوني وَلَكِنِّي أكره أَن أتميز عَلَيْكُم فَإِن الله يكره من عَبده أَن يرَاهُ متميزا بَين أَصْحَابه»، وَقَامَ ﷺ وَجمع الْـحَطب.
‘একবার এক সফরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা নিজ নিজ বাহন থেকে নেমে পড়লেন। নিজেদের মালপত্র নামিয়ে রাখলেন নির্ধারিত স্থানে। তারপর সবাই মিলে ঠিক করলেন, একটি দুম্বা জবাই করে খাবার তৈরি করা হবে। একজন সাহাবী বললেন, দুম্বা জবাই করার দায়িত্ব আমার। আরেকজন বললেন, দুম্বার চামড়া ছাড়ানো ও গোশত কাটার দায়িত্ব আমি নিলাম। তৃতীয়জন বললেন, গোশত রান্না করার দায়িত্ব আমার। এভাবে সাহাবীরা নিজ নিজ দায়িত্ব ভাগ করে নিলেন। এসময় রাসূল (সা.) বললেন, ‘কাঠ কুড়িয়ে আনার দায়িত্ব আমার।’
রাসূলের কথা শুনে এক সাহাবী বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা উপস্থিত থাকতে আপনি কষ্ট করবেন কেন? আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা আনন্দের সাথে সমস্ত কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাবো। সাহাবীদের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি জানি এ কাজ তোমরা করে নিতে পারবে। কিন্তু মহান আল্লাহ ওই বান্দাকে কখনোই ভালবাসেন না, যে বন্ধুদের মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে। এ কথা বলে তিনি বনের দিকে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বালানি কাঠ ও খড়-কুটো নিয়ে ফিরে এলেন।’[13]
মাওলানা খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) নিজের কাজ নিজে করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কয়েক বছর যাবত তিনি প্যারালাইসেসে আক্রান্ত ছিলেন। এক পাশ অবশ হয়ে গিয়ে ছিল। ভালো করে হাঁটতে পারতেন না। স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারতেন না। এমন পরিস্থিতিতেও কেউ তাঁকে ধরে সাহায্য করতে গেলে তিনি হাউ মাউ করে ‘না’ করে দিতেন। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর প্রথমবার তাঁকে এভাবে হাঁটতে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পরেনি। তাঁর নিকটে গিয়ে ধরার চেষ্টা করি। তখন তিনি হাউ মাউ করে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ সতর্ক হলাম। মনে পড়লো এই লোকটি তো কখনো কারো সাহায্য গ্রহণ করেননি। আজ কেন করবেন? তাই তাড়িয়ে দিলেন। একটু দূরে গিয়ে আবেগাপস্নুত হয়ে মহাব্বতের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। অতঃপর সালাম বিনিময় করে বিদায় নিলাম। পরে যখনই হযরতকে দেখতাম, দূর থেকে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতাম। তিনি চলে যাওয়ার অপেক্ষা করতাম। কিন্তু তিনি বলতেন, চলে যাও, চলে যাও। আমার তো দেরী হবে। তোমরা কেন অযথা দাঁড়িয়ে থাকবে? আহ! কি আশ্চর্য অনুভূতিশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি!
হে করুণাময় খোদা! তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই, তোমার সান্নিধ্যে চলে গেছেন। তুমি তাঁকে জান্নাতি সেবক হুর-গিলমান দ্বারা উত্তম সেবার ব্যবস্থা করো, আমীন।
এক ওয়াক্ত নামাযও কাযা নেই!
মাওলানা খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) আল্লাহর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন। আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ একজন সফল মুমিন ছিলেন তিনি। কষ্ট করে মসজিদে যাতায়তের বিষয়টি যাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে তারা তাঁর ঈমানের পূর্ণতার ব্যাপারে সাক্ষী দিতে পারবে। তিনি প্যারালাইসেস অবস্থায়ও পা হেচড়ে হেচড়ে মসজিদে গমন করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
«إِذَا رَأَيْتُمُ الرَّجُلَ يَتَعَاهَدُ الْـمَسْجِدَ فَاشْهَدُوْا لَهُ بِالْإِيْمَانِ»، فَإِنَّ اللهَ تَعَالَىٰ يَقُوْلُ: [اِنَّمَا يَعْمُرُ مَسٰجِدَ اللّٰهِ مَنْ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ الْيَوْمِ الْاٰخِرِ وَاَقَامَ الصَّلٰوةَ وَاٰتَى الزَّكٰوةَ ۰۰۱۸] {التوبة: 18} الآيَةَ.
‘যখন তোমরা কাউকে মসজিদে যাতায়ত করতে দেখবে তাহলে তার ঈমানের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে পারবে। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর মসজিদ তারাই আবাদ করেন, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান আনেন এবং নামায ও যাকাত আদায় করেন।’[14]
বিগত কয়েক বছর যাবত মরণঘাতি পক্ষাঘাতে আক্রন্ত হওয়ার পরও তিনি কখনো নামায কাযা করেননি। বরং তৃতীয় তলার বাসা থেকে নেমে নীচ তলার মসজিদে এসে প্রায়শ জামায়াতের সাথে নামায আদায় করতেন। এ জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁকে পৃথিবী থেকে এমন অবস্থায় বিদায় নেয়ার সুযোগ দিছেন, যখন তাঁর যিম্মায় এক ওয়াক্ত নামাযও কাযা ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এক হাদীসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পাবন্দি করবেন আল্লাহ তাঁর কবরের আযাব মাফ করবেন এবং বিনাহিসেবে জান্নাত দান করবেন।’ আমাদের প্রিয় উস্তাদ হযরত মাওলানা খলীলুর রহমান মাদানী (রহ.) নামাযের খুবই পাবন্দি করতেন। তিনি পৃথিবী থেকে বিদায়কালে তাঁর যিম্মায় কোন নামায কাযা ছিল না। তাই আমাদের বিশ্বাস, আল্লাহ তাঁর কবরের আযাব ক্ষমা করে দেবেন এবং বিনা হিসেবে জান্নাত দান করবেন।
হে দয়াময় প্রভু! তুমি দয়া করে তার কবরের আযাব ক্ষমা করো এবং তাঁকে বিনাহিসাবে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করো, আমীন।
শিক্ষক, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
[1] আল-কুরআন, সুরা আন-নিসা, ৪:১২৫
[2] আবদুর রহমান আস-সা’দী, তাইসীরুল করীম আর-রহমান ফী তাফসীরি কালাম আল-মান্নান, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২০ হি. = ২০০০ খ্রি.), পৃ. ৩০৬
[3] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ১৮৫৫, হাদীস: ২৩৮৩, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[4] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ৫০, হাদীস: ১৪১, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[5] আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রæপ, কায়রো, মিসর, খ. ৪, পৃ. ৩৪৭, হাদীস: ১৯৭০
[6] আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ৩৪০, হাদীস: ১৯৫৬
[7] আল-কুরআন, সুরা আল-হজ, ২২:৩২
[8] আল-কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ৩:৯৬
[9] (ক) আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৩১, হাদীস: ৬৪৫; (খ) মুসলিম, আস-সহীহ, খ. ১, পৃ. ৪৫০, হাদীস: ৬৫০, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[10] আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, খ. ৪, পৃ. ৫৯৮, হাদীস: ২৩৯১, হযরত আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাযি.) ও হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[11] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৮, পৃ. ১৭৪, হাদীস: ৬৮৫৩
[12] আল-বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, দারুল বাশায়িরিল ইসলামিয়া, বয়রুত, লেবনান (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪০৯ হি. = ১৯৮৯ খ্রি.), পৃ. ১৬৮, হাদীস: ৪৭৯
[13] মুহিব্বুদ্দীন আত-তাবারী, খুলাসাতু সীয়ারি সাইয়িদিল বাশার, মাকতাবাতু নিযার মুস্তাফা আল-বায, মক্কা মুর্কারমা, সউদী আরব (প্রথম সংস্করণ: ১৪১৮ হি. = ১৯৯৭ খ্রি.), পৃ. ৭৮
[14] আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, খ. ৫, পৃ. ১২, হাদীস: ২৬১৭, হযরত আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত