ঢাবির মেধাবী শিক্ষার্থীর অভিভাবকের আর্তনাদ: আস্থা পুনরুদ্ধারে অপছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হোক
মুফতি আবদুল হক
সমসাময়িক প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সুদীর্ঘ একশ বছরে হাটি হাটি পা পা করে যা কিনা অর্জন করেছে, তা ইতিহাসের স্বর্ণালি পাতায় ভলিয়মকে ভলিয়ম শোভা পাচ্ছে নিঃসন্দেহে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন ও ৭০’র স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃত বিশ্ববিদ্যালয়টি, স্বর্ণালি ফোয়ারার ন্যায় উৎপাদন-প্রসব করেছে অজস্র সোনালি মানুষ ও মানবিক দৃষ্টিকোণে মূর্তমান বিশ্বাত্মা| পক্ষান্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক বিশ্বজোড়া নেতা, শিক্ষাবিদ ও বৈজ্ঞানিক প্রায়শ এ গৌরবদীপ্ত ভার্সিটির সূর্যসন্তান। যারা বিশ্ববাসীকে আদর্শ বিলিয়েছেন, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, পরোপকারিতা ও কল্যাণকামিতা শিক্ষা দিয়েছেন অকাতরে।
আমি কলেজ-ভার্সিটির পড়ুয়া না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স এরাবিকে ২০১৭ সালে ডিন্স অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত অতঃপর মাস্টার্সে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকারী মেধাবী শিক্ষার্থীর আল-হামদুলিস্নাহ সচেতন অভিভাবক। হিফজ ও কওমি মাদরাসার ভিত্তিতে গড়া ছেলেটি লেখা-পড়া ও নামায-কালাম ছাড়া তেমন কিছু চেনেনি। হঠাৎ ঢাবিতে এরাবিক অনার্স ভর্তি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করায় নেহাৎ অচেনা পরিবেশে আল্লাহর ওপর ভরসা করে অশ্রুনয়নে দোয়া করে দিয়েছিলাম ছেলেকে। বলেছিলাম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের স্বার্ণচূড়ায় গ্রহণ লাগতে পারে এমন কোন আচরণ করিসনে বাবা!
ঢাবির ২০১৪ হতে ২০১৯ সালের অবস্থা কম-বেশ সকলেরই জানা। যখন কিছু নির্লজ্জ ও ছাত্র নামের কলঙ্করা নানান টুংকু ছুতোয় সহকর্মি-ছোট ভাই কিংবা বড় ভাইদের উপর জুলম-নির্যাতনের স্টিমরুলার চালাত। উহ! হায়ানেরা এক ছাত্রকে পাও ভেঙে দিয়েছে! আরেকজনের মাথা ফেটে দিয়েছে! অন্যজনকে আধমরা করে কুকুরের মতো ফেলে রেখেছে! অমুক মেধাবী ছাত্রকে চোরের মতো বেধড়ক পেটাচ্ছে ইত্যাকার দুঃসংবাদ মিডিয়ায় শুনলে কলজে দুমড়ে-চুমড়ে যেত। তখন আল্লাহর কাছে সিজদায় গড়াগড়ি করতাম; আল্লাহ! এজাতির ভবিষ্যৎ কি? মানুষ গড়ার কারখানা কেন কসাইখানা? কিছু অবুঝ-অপরিপক্ষ ছেলেদেরকে যারা আস্কারা দিয়েছেন, বাংলার মাটিতে তাদের বিচার কখন হবে? ভার্সিটিগুলোর ললাটের এই অনভিপ্রেত চুনকালি কখন মুছবে? আমার দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কবে নাগাদ জ্ঞান-গরিমার পাল তুলে সৌর শক্তিতে অগ্রসর হবে? একটু সংবিৎ ফিরে পেলে মোবাইল অন করে ছেলেকে বলতাম, আব্বা! শেখানো হিফাযতের আমলগুলো সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত করিও। রাতে আয়াতুল কুরসী ও আমানার রাসূলু পড়িও। আব্বা! এত রাতে মোবাইল? তোমার চিন্তায় ঘুম আসছে না বলে কাঁদতে কাঁদতে ৮/১০ মিনিট পর দেখি মোবাইল অনই রয়ে গেছে। ছেলেও কাঁদছে আর বলছে, বাবা! ভার্সিটির জন্যে দোয়া করুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সবল ভাইদের জন্যে দোয়া করুন। তাহাজ্জুদের সময় ঘণিয়ে এলে তার মাকেও তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করতে বলতাম।
এমনিভাবে ছেলের অনার্স-মাস্টার্সের বছরগুলোতে প্রায় নির্ঘুমে কেটেছি। জানিনে ভার্সিটি পড়ুয়াদের কত মা-বাবা ও অভিভাবক বুকফাটা আহাজারীতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। লক্ষ লক্ষ জ্ঞাতি-স্বজন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর বিষাদে ছটফট করছে। তাদের প্রশ্ন: বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লক্ষ বাবা-মা আর দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষায় ছোরা চালিয়ে কতকাল নির্লজ্জতার গাড়ি হাঁকাবেন? মাছ পঁচা অপেক্ষা মানপঁচা কি অনেক তীব্র-অনেক তীড়্গ্ন নয়? দেশের গৌরবগাঁথা ভার্সিটির গাম্ভীর্যপূর্ণ আঁচলে যারা আগুন দিয়েছেন তাদের আবার চেয়ার কিসের? ভারতের সেই রেলমন্ত্রীর ইতিহাস কি মনে নেই?
এমনি নিদারুণ ব্যাকুলতা ও চঞ্চলতায় ছেলের অনার্স মাস্টার্স বছরগুলো পার করিয়ে কোন রকম হাঁপ ছেড়ে বসি। এবার ছেলে বলে যে, ঢাবিতে এমফিল করবে। তখন আমরা বাবা-মার অন্তরে নতুন করে শঙ্কা যোগ হলো। ছেলের মা বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম শুনতেই হায় পুত! তুই আবার মানুষ মারার যাতাকলে? কথাটি বলতেই একদম মুর্ছিতা। ডাক্তার-বৈদ্য এনে ঘণ্টা খানেক কসরতের পর তার মা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্ষীণস্বরে বললেন, বাবা! ওই ভার্সিটির কাছে ও আর যাসনে। অবশেষে ছেলেটি কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে হায়ার ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিকের সান্স পেলে আল্লাহর দরবারে সালাতুস শোকর আদায় করি।
ইনশাআল্লাহ আমার সাথে দেশের কোটি কোটি অভিভাবক একমত পোষণ করবেন নিঃসন্দেহে। আমাদের প্রশ্ন হলো, আদর্শ ও আলোকিত-বিদ্যান মানুষ গড়ার কারখানাকে মানুষ মারার কেন্দ্রে পরিণত করা হলো কেন? ভার্সিটিগুলোর ভাবমূর্তিকে পদদলিত করে দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্খাকে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কার স্বার্থে? বিশ্বের দরবারে স্বাদেশি ভার্সিটিগুলোর নাম সুনাম বিধ্বংসী দেশদ্রোহীদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়নি কেন? কেন বিশ্ববিদ্যাপিঠগুলোর প্রতি দেশি-বিদেশি অভিভাবকও ছাত্র-ছাত্রী বিতৃষ্ণায় ফেটে পড়ছে এবং বিদেশি ভার্সিটির প্রতি ধাবিত হচ্ছে? এসব কিছুর কি কোন প্রতিকার নেই? নাকি কবির সুরে তাল মিলিয়ে বলতে হয়, ‘ভার্সিটিগুলো চলছে উদ্ভট উটে সওয়ার হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হিমালয়সম ভাব মূর্তিকে (বিশ্লেষকদের মতে) যারা কতেক গুণ্ডা-মাস্তানদেরকে লেলিয়ে দিয়ে বিনষ্ট করেছেন তাদের বিরুদ্ধে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন টাকার মানহানি মামলা করা হয়নি কেন? কাজেই অভিভাবক মহলের প্রাণের দাবি:
- ঢাবিসহ সকল ভার্সিটিতে অসুস্থ ও অপছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হোক।
- ছাত্র-ছাত্রীদের সীট বণ্টন, নিয়ন্ত্রণ ইত্যদি দায়িত্বপালন, পূর্বের ন্যায় হল প্রভোষ্টদের স্কন্ধে অর্পণ করা হোক।
- ভর্সিটিসমূহের আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে দায়িত্বশীলগণকে আরও দায়িত্ব সচেতন করা হোক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনি প্রবাহের গতিরোধকারী কথিত ঊর্ধ্বতন চাপকে থোড়াই কেয়ার করা হোক।
- বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল কর্মচঞ্চলতা পুনরুদ্ধারে সহপাঠী দ্বারা সহপাঠীদের নির্লজ্জ শাসন-শোষণ ও জবরদসিত্মমূলক মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ ইত্যাদি নবজাহেলি প্রথা চিরতরে ক্লোজড করা হোক।
- অছাত্র অথবা পড়া লেখার পরিবেশ বিনষ্টকারী ছাত্র-ছাত্রীকে তদন্তপূর্বক বহিস্কার করা হোক। বছরে দুই-তিনবার এ শুদ্ধি অভিযান পরিচালানা করা হোক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও আদর্শের বিকাশে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রবণতা সৃষ্টি করা হোক।
- ভার্সিটিসমূহে আবরার ফাহাদদের সেই মর্মানিত্মক ঘটনা যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য বাড়তি কেয়ার নেওয়া হোক। যেন অবহেলার ফাঁক-ফোকরে এ ধরণের জাতি শিউরে উঠা কোন দুর্ঘটনায় অভিভাবক, সুধীমহল ও আপামর জনসাধারণে ড়্গোভ ধুমায়িত ও বিস্ফোরিত না হয়।
- দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষালয়ের কলঙ্ক লেপনকারী কুখ্যাত টর্চার সেল বন্ধে হাইকোর্টে রোল জারি করা হোক এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ও মদদ দানকারীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা হোক।
- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুষ্ঠু পরিবেশ এবং জবাবদেহিতার নিশ্চিত করার লক্ষে সর্বস্তরের নিয়োগ, দলীয় দৃষ্টিকোণ অপেক্ষা যোগ্যতা অভিজ্ঞতা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে করা হোক। এমনিভাবে দেশের উচ্চশিক্ষার বাহনগুলোকে জ্ঞানচর্চা ও মুক্তচিন্তার আধার এবং আলোকিত মানুষ গড়ার স্বর্ণালি ঝর্ণায় ঢেলে সাজানো হোক।