জামেয়া ওয়েবসাইট

শনিবার-৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলামের পূর্ণ অনুসরণেই রয়েছে মানবতার মুক্তি ও উন্নতি

ইসলামের পূর্ণ অনুসরণেই রয়েছে মানবতার মুক্তি উন্নতি

ড. খালিদ হোসেন

 

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام علىٰ خاتم الأنبياء والمرسلين وعلىٰ آله وأصحابه الطاهرين.

মাদরে ইলমি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক ইসলামি কনফারেন্সে উপস্থিত ওলামায়ে কেরাম, তালেবানে উলুমে নুবুওয়াত এবং দীনদার মুসলমান ভায়েরা! সর্বপ্রথম মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি যিনি আমাদেরকে এই রুহানী জলসায় উপস্থিত হওয়ার তাওফীক দান করেছেন। আল-হামদু লিল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে করীমে বলেন,

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِي السِّلْمِ كَآفَّةً١۪ وَّلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوٰتِ الشَّيْطٰنِ١ؕ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ۰۰۲۰۸

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনো। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’[1]

এ আয়াতের তাফসীরে আছে, রাসূল (সা.)-এর জমানায় কিছু ইহুদি আলেম মুসলমান হয়েছেন। যাদের মাঝে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাযি.) ও হযরত সালাবা (রাযি.)ও ছিলেন। ইহুদিদের নিকট শনিবার ইবাদতের দিন হওয়াই তারা শুক্রুবারের তুলনায় শনিবারে বেশি ইবাদত করতেন। এবং তারা এই বলে উটের গোস্ত খেতেন না যে, আল্লাহ তাআলা তো উটের গোস্ত খাওয়া ফরয করেননি। যেমন- আর অনেক সময় আমরা অনেক হালাল জিনিসও খাই না। তাদের এই যুক্তি আল্লাহর কাছে পছন্দ হয়নি। সাথে সাথে আয়াত নাযিল করলেন, ادْخُلُوْا فِي السِّلْمِ كَآفَّةً۪  ۰۰۲۰۸| মুসলমান যেহেতু হয়েছো, সুতরাং ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করো। অর্থাৎ ফরয ওয়াজিব মুস্তাহাব্বাত ও মানদুবাত সবকিছু নিয়ে আত্মসমর্পন করো।

মুসলমান যখন পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করে আল্লাহর সাহায্য তার জন্য অবধারিত হয়ে যায়। যেমন- আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন,

وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ۰۰۴۷

‘মুসলমান বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।’[2]

অন্য আয়াতে বলেন,

وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ  لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْاَرْضِ ۪ ۰۰۵۵

‘যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই জমিনের রাজত্ব দান করবেন।’[3]

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে পারিনি। ফলে জমিনের রাজত্ব দেওয়া হয়েছে, আমেরিকা-রাশিয়াকে এবং আমাদের গুনাহের কারণে আল্লাহর সাহায্য বন্ধ হয়ে গেছে। আজ মিয়ানমার, চীনের জিংজিয়াং প্রদেশ, ফিলিসিত্মন, সিরিয়া, লেবানন, আফগানিস্তান সর্বোপরি সারা বিশ্বে মুসলমানের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চলছে। কিন্ত আল্লাহর কোন সাহায্য নেই।

অতএব আমরা যদি গুনাহ ছেড়ে দিয়ে তাওবা করি, নেক কাজ করি এবং ঈমানকে নবায়ন করতে পারি। আমাদের নিকট আল্লাহর সাহায্য আসবে। এতে কোন সন্দেহ নাই। আল্লামা ড. ইকবাল চমৎকার বলেছেন,

آج بھی جوہوا براہیم کا ایماں پیدا
آدمی کو کر سکتی ہے انداز گلستاں پیدا

‘হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মতো ঈমানের পরিচয় যদি ২০১৯ সালের মুসলমান দিতে পারে। নব্য নমরুদ যদি ঈমানদারদের আগুনে ফেলে দেয় তা হয়ে যাবে ফুলের কানন।’

তাই আমাদের উচিৎ ঈমানের নবায়ন করা এবং নবীজির আদর্শ আদর্শবান হওয়া। কেননা তা প্রত্যেকটি সুন্নাতের পেছনে রয়েছে বড় হিকমত। যা আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে আমরা পরিস্কারভাবে জানতে পারি। উদাহরণস্বরূপ সেবা করা প্রসঙ্গে বিশ্বনবী ঘোষণা করেন,

«ارْحَمُوْا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ».

হিন্দুস্থানের বিখ্যাত আলেম আলতাফ হুসাইন হালী (রহ.) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘জমিনে দয়া করো! আসমানের মালিকের দয়া পাবে।’[4] বিশ্বনবী (সা.) দান প্রসঙ্গে আরও বলেন,

«إِنَّ الصَّدَقَةَ لَتُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ».

‘নিশ্চয় দান আল্লাহর রাগকে নিভিয়ে দেয়।’[5]

অন্য এক রিওয়াতে এসছে, মহানবী (সা.) তাঁর পুত-পবিত্র স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাযি.)-কে বললেন,

«يَا عَائِشَةُ، اسْتَتِرِي مِنَ النَّارِ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ».

‘হে আয়েশা! এক টুকরো খেজুর দান করে হলেও নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর।’[6]

  1. আমেরিকার মেশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসাল স্যাকলোজি ডিপার্মেন্টের প্রফেসর ড. স্যারা কানরাত গবেষণা করে বলেছেন যে, কোন মানুষ যখন আরেকজনকে সহযোগিতা করে অতঃপর সাহায্যপ্রাপ্ত লোকটি দুআ করে বলেন, আপনি আমার বাপের মতো বা ভাইয়ের মতো তখন আনন্দে সাহায্যকারীর পুরো শরীর থেকে একটি রস বের হয়। যার নাম ওগজি লেজিন হরমন। এটি শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেসব ক্যান্সারের কোষ রয়েছে, সেগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। সুবহানাল্লাহ!
  2. আমাদের ফরয বিধান রোযা। আমেরিকার ইউনিভাসিটির গবেষকরা এ রোযা নিয়ে গবেষণা করলেন। তারা চল্লিশটি বড় বড় ইদুর নিয়ে সবগুলিতে ক্যান্সারের ইঞ্জেকশন ঢুকিয়ে দেন। এর মধ্যে বিশটি ইদুরকে পৃথক করে সকালে বিকালে ও দুপুরের তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়। বাকি বিশটিকে সন্ধ্যা ও শেষ রাতে সাহরীর সময়ে খাবার দেওয়া হয়, দিনের বেলায় কোন খাবার দেওয়া হয় না। এক মাস পর দেখা গেল যেই বিশটিকে দিনের বেলায় খানা দেওয়া হয়েছিল সব মারা গেছে। অবশিষ্ট বিশটি যেগুলোকে সন্ধ্যা ও শেষ রাতে খাবার দেওয়া হয়েছিল সব বেঁচে আছে। অতঃপর বিজ্ঞানীরা জানালেন, যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত তারা যদি নফল রোযা রাখে তাদের এই রোযা হাই পাওয়ার ক্যামোর মতো কাজ করবে।
  3. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তিন জায়গায় প্রস্রাব পায়খানা করতে নিষেধ করেছেন। পানিতে, রাস্তায় ও গাছের নিচে। বিজ্ঞানীরা আজ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, পানিতে প্রস্রাব পায়খানা করলে পানি দূষিত হয়ে যায়। ফলে এ পানি থেকে কেউ ব্যবহার করলে তার শরীরে জীবাণু ছড়ায় অতঃপর সে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আর শরীরে তৈরি হয় সত্তরটা রোগ পানি থেকে আর রাস্তায় ও গাছতলায় প্রস্রাব পায়খানা করলে বাতাস জীবাণুযুক্ত হয়ে যায়, ফলে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়।
  4. বিশ্বনবী মাটিতে বসে খাবার খেতেন। চেয়ার টেবিলে খেতেন না। গত কিছুদিন আগে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, চেয়ারে বসে খাবার খাওয়ার চেয়ে মাটিতে বসে পা খুলে-বিছিয়ে খেলে হজম বেশি হয়। ফলে শরীর সুস্থ থাকে।
  5. রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা গাছ রোপণ করো। এ গাছের ফল মানুষ ও পশু-পাখিরা খাবে তা সাদকা হিসেবে তোমার আমলনামায় লেখা হভে। অন্য এক হাদীসে এসেছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘তুমি যদি মনে করো আগামীকাল কিয়ামত হবে। তার আলামত দেখা গেছে তখনও যদি তোমার হাতে গাছের চারা থাকে তা তুমি রোপন করে দাও।’

কিয়ামতের লক্ষণ দেখা যাওয়ার পরেও গাছ লাগানোর আদেশ দেওয়ার কারণ, গাছের সাথে মানুষের জীবন জড়িত। আজ বিজ্ঞানীদের তা বুঝে আসলো তাঁরা বলতে বাধ্য হলেন যে, পৃথিবীর আবহাওয়া বতমান যে তাপমাত্রায় রয়েছে মাত্র দেড় সেলসিয়াস তাপমাত্রা যদি বেড়ে যায়। হিমালয়ের (যেখানে এক সাগর পরিমাণ পানি বরফ হয়ে জমা আছে) এক তৃতীয়াংশ বরফ পানি হয়ে সমুদ্রে চলে আসবে। আর দুই সেলসিয়াস ডিগ্রি বাড়লে তার অর্ধেক বরফ পানি হয়ে যাবে। ফলে আশে পাশের আটটি দেশে প্রায় ৭০-৬০% পানির নিচে চলে যাবে। এবং এন্টারটিকা, সাইবেরিয়া ইত্যাদি বরফের দেশগুলি ডুবে যাবে। অতঃএব গাছপালা বেশি থাকলে তাপমাত্রা কম থাকবে। ফলে বরফ গলে যাবে না। এবং আমরা পিউর অক্সিজেন পাবো। আর আমাদের (ত্যাগকৃত নিশ্বাস) বিষাক্ত। তাই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পানি খাওয়ার সময় গ্লাসে নিশ্বাস ফেলতে নিষেধ করেছেন।

  1. রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা রোযার ইফতার খেজুর দিয়ে করো। আর খেজুর যদি পাওয়া না যায় পানি দিয়ে করো। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, তিন-চারটা খেজুর আর এক গ্লাস পানি দিয়ে ইফতার করল সারাদিনের সব ক্লানিত্ম মুহূর্তের ভেতর নিঃশেষ হয়ে যাবে। আল্লাহর নবীর প্রতিটি কথা বিজ্ঞানসম্মত। প্রতিটি কাজের পেছনে একেকটি রহস্য লোকায়িত।

অতঃএব আমরা আজও যদি আল্লাহর কাছে তাওবা করে ঈমানকে নবায়ন করতে পারি। বিশ্বনবী (সা.)-এর আদর্শে আদর্শবান হতে পারি। মুহূর্তের ভেতর আল্লাহর সাহায্য আসবেই। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বোঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

বক্তা: সাবেক প্রফেসর, ওমরগনি এমইএস কলেজ চট্টগ্রাম সম্পাদক, মাসিক আত-তাওহীদ

অনুলিখন

হাফেয মুহাম্মদ ফরহাদ

জামায়াতে দুওয়াম

আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম


[1] আল-কুরআন, সুরা আল-বাকারা, ২:২০৮

[2] আল-কুরআন, সুরা আর-রূম, ৩০:৪৭

[3] আল-কুরআন, সুরা আন-নুর, ২৪:৫৫

[4] আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৪, পৃ. ৩২৪, হাদীস: ১৯২৪

[5] আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, খ. ৩, পৃ. ৪৩, হাদীস: ৬৬৪

[6] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৪১, পৃ. ৪৯, হাদীস: ২৪৫০১

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ