জামেয়া ওয়েবসাইট

শুক্রবার-২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল-জাযিরার সাথে ড.আহমদ রাইসুনীর সাক্ষাৎকার

আল-জাযিরার সাথে ড.আহমদ রাইসুনীর সাক্ষাৎকার

‘ইসলামে রাষ্ট্র লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম; মৌলিক উদ্দেশ্য নয়

[ড. আহমদ রাইসুনী বর্তমান মুসলিম স্কলার ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে যখন আরববসন্ত ফিকে হতে চলেছে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় বিপরীত স্রোত প্রবল, মিসরে ইখওয়ানের ব্যর্থতা, সিরিয়া-ইয়ামান-লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ এবং উত্তর আফ্রিকার আশপাশে আন্দেলন-প্রবণতা, উপরন্তু মিসর, আরব আমিরাত সউদি আরব-কর্তৃক প্রভাবশালী সংগঠনের সাবেক সদস্যদের সন্ত্রাসবাদী মদদদাতাদের কালো তালিকায় যুক্ত করা এবং কারো কারো বিরুদ্ধে বিচারিক পদ্ধতিতে মৃত্যুদ-াশের দাবি করার এমন মূহুর্তে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ড. আহমদের সাথে ইসলামিক শাসনব্যবস্থা এর বৈশিষ্ট্য এবং রাষ্ট্র শরীয়ত নিয়ে ইসলামপন্থিদের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে কথা বলেছে আল-জাযিরা।]

মুজাহিদুল ইসলাম

আল-জাযিরা: আপনি আপনার একটি প্রবন্ধে দাবি করেছেন যার সারমর্ম হলো, খিলাফত মাধ্যম ইসলামি শাসনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। অনেকে এটাকে আলী আবদুর রায্‌যাকের চিন্তার দিকেও সমন্ধিত করছে। তো এ ব্যপারে আসলে আপনি কী বলেন?

ড. আহমদ: আমি বলেছি, ইসলামে রাষ্ট্র লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম; মৌলিক উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মাধ্যম তো শরীয়তেরই অংশ। বরং এটা শরীয়তের অর্ধেক হতেও বেশি। রাষ্ট্র লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম হওয়া; মৌলিক না হওয়া নিয়ে শুধু তারাই বিতর্ক করে, যাদের পুঁজি অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা। দেখুন, ইমাম ইয্‌যুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম (রহ.) বলেন, ‘কোন সন্দেহ নেই, বিচারক ও গভর্নর নিয়োগ দেওয়া জনস্বার্থ রক্ষার মাধ্যম। আর বিচারক ও গভর্নরদের সহযোগী নিয়োগ দেওয়াও এ জনস্বার্থ রক্ষার মাধ্যম অর্জনের মাধ্যম।’

আর হ্যাঁ, আপনি হয়তো বলতে চান শায়খ আলী আবদুর রায্‌যাকের কথা! তিনি তো ইসলাম হতেই রাষ্ট্র ও রাজনীতি এবং বিচার ও শাসনব্যবস্থাকে বের করে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এগুলোর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তার কিতাবে যা আছে, তাই বলছি। তার ভেতরের আসল খবর তো আল্লাই ভালো জানেন।

আল-জাযিরা: ইসলামের সুনির্দিষ্ট ও সুষ্পষ্ট কাঠামো-কেন্দ্রিক কোন শাসনব্যবস্থা আছে বলে কি আপনি বিশ্বাস করেন?

ড. আহমদ: শাসনব্যবস্থা একটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিভাষা। শাসনব্যবস্থার কাঠামো, প্রশাসনের প্রত্যেক পদাধিকারীর করণীয় ও ক্ষমতা নির্ধারণ এবং প্রশাসনিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ও সম্পর্কের বিস্তারিত ধারণা; যেমন- শাসক ও সরকার-নির্ধারণের পদ্ধতি, জবাবদিহিতা ও মেয়াদ শেষ হওয়া ইত্যাদি যা আন্তর্জাতিক আইন ও সংবিধানে বিবৃত থাকে। এগুলো তো ক্রমশ পরিবর্তিত ও উন্নত হয়। সময়, কাল ও পাত্র অনুসারে এটার প্রয়োগ হয় এবং কখনো উপযোগী নতুন নাম বা প্রচলিত নাম দেওয়া হয়।এ অর্থে ইসলামে কোন শাসনব্যবস্থা নেই।

হ্যাঁ, কিছু সাধারণ নীতিমালা ও মূলনীতি অবশ্যই আছে, এটা মানতে হবে; যেমন, ইনসাফ ও শুরা এবং আল্লাহর আইন অনুযায়ী ফায়সালা ও শাসকদের জবাবদিহিতা ইত্যাদি। মুসলমানরা যুগে যুগে বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা এনেছে। তা প্রয়োগও করেছেন। তাতে ইসলামের অনেক কিছু ছিল; ছিলো ইসলামবিরোধীও কিছু। আবার কিছু কিছু তো ইসলামবিরোধীও নয় কিন্তু ইসলামের সুষ্পষ্ট নীতিমালার পরিপন্থীও নয়। আমাদেরকে শুধু ইসলামের মৌলিক বিবৃত ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।

আল-জাযিরা: মুসলমানরা যখন ক্ষমতায় ছিলো, তখন তারা তাদের অভিজ্ঞতার প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু বর্তমান জাতি রাষ্ট্রে কি শরীয়ত বাস্তবায়ন সম্ভব? যদি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে তো এর সমাধান কী? কোন ইসলামি দল ক্ষমতায় আসতে না আসতেই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সহায়তায় তাদের সামরিক অভূত্থানের মুখোমুখী হতে হয়!

ড. আহমদ: হ্যাঁ, প্রথমত, এটা বিভিন্ন ইসলামি দল ও আন্দেলন এবং এর রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, আপনি বলছেন, যদি বর্তমানে শরয়ী আইন বাস্তবায়ন সম্ভব না হয়, তো কী করণীয়? এর ফিকহী জবাব তো, যা করা সম্ভব নয়, তার আবশ্যকীয়তা আর থাকবে না। কারণ হাদীস শরীফে এসেছে, ‘আমি তোমাদের যে আদেশ দেই, তোমরা যতদূর পারো তা আদায় করো।’ এটা বিভিন্ন আয়াতের শিক্ষাতেও বিদ্যমান। তাছাড়া আমাদের একটি মৌলিক নীতি তো আছেই; অক্ষমতার ক্ষেত্রে আবশ্যকীয়তা আর থাকে না এবং বাধ্য হলে হারামের হুকুম রহিত হয়ে যায়। কেও কেও তাদের যে ব্যপারে আদেশ করা হয়নি, তারা তাতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। যাই হোক কল্পনাবিলাসী ও অসম্ভব আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে আমি ধীরে ধীরে বিচক্ষনতার সাথে শুধু সম্ভাবনার গন্ডির মধ্যে কাজে বিশ্বাসী।

আল-জাযিরা: আপনি হয়তো জেনে থাকবেন ওয়ায়িল হাল্লাক-রচিত ‘ইমপসিবল স্টেট’ গ্রন্থের কথা। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ইসলামিসরণ করা সম্ভব নয়। ইসলামি শাসনব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কাঠামোর পরিপন্থী। তো তার এ প্রস্তাববনার ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন?

ড. আহমদ: আসলে আমি এ বই পড়িনি। তবে আমি বলবো আব্বাসী, উমাইয়া ও উসমানী খিলাফতব্যবস্থার আদলে এখন খিলাফত অসম্ভব। তবে ইসলাম যে সুশাসন নিয়ে এসেছে, তার আলোকে অবশ্যই রাষ্ট্র এখনো পরিচালনা করা সম্ভব। তবে যুক্তিসঙ্গতা, অনুক্রম, নমনীয়তা এবং বাস্তবতার সাথেই তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ জন্য আপনার অনেক প্রতিপক্ষ হবে। তারা সকালসন্ধ্যা রেডিমেট রাষ্ট্র বলে আপনাদের বিরুদ্ধে বেরিয়ে পড়বে।

আল-জাযিরা: আসলে একটি রাষ্ট্রের এমন কী ছক আছে, যাতে ইসলাম সন্তুষ্ট হতে পারে? এটা কি শুধু শরীয়া অবলম্বনের নাম?

ড. আহমদ: আমি ইসলামের নামে বলছি না। তবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের ঐক্যমত্য হলো, খোলাফায়ে রাশিদীনদের রাষ্ট্রব্যবস্থা মুসলমানদের জন্য একটি অনুকরণীয় রাষ্ট্র। যেমন, ইনসাফ, স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা| তবে এখন যুগ বিবেচনায় কাঠামোগত পার্থক্য হতেই পারে। এক্ষেত্রে এমনভাবে গবেষণা ও পরামর্শ করতে হবে, যেভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উত্তমভাবে সম্পাদন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অমুসলিমদের থেকে কোন চিন্তা ও অভিজ্ঞতা নেওয়াতেও কোন দোষ নেই। বরং তা কাঙ্ক্ষিত, উত্তম ও মাসনুন।

আল-জাযিরা: একটি রাষ্ট্রের প্রধান অগ্রগন্যতা থাকে জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করা। তো বর্তমানে যদি কোন ইসলামি রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোন সংকট দেখা দেয়, সে সময়ের বিবেচনা কেমন হবে?

ড. আহমদ: জাতীয় নিরাপত্তা ও ধর্মীয় আইনের বক্তব্যের মধ্যে প্রকৃত পক্ষে কোন বিরোধ দেখা দিতে পারে না। ইসলামি আইনজ্ঞগণ সম্ভাব্য সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রেখেছেন। মৌলিক নীতিমালা রয়েছে। এগুলো প্রয়োগের পরে কোন কিছু সমাধানহীন থাকে না। এখানে ইমামুল হারামাইনের একটি চমৎকার বক্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, ‘শরীয়তের নীতিমালা নির্দেশ করে, শরীয়তের কোন বিষয় ফায়সালাহীনভাবে থাকে না।’

আল-জাযিরা: সম্প্রতি ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সাথে ইসলামপন্থিদের একধরনের খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে! মনে হচ্ছে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে এটা বর্তমান সংকটের প্রতিক্রিয়া! আপনিও কি তাই মনে করছেন?

ড. আহমদ: আমাদের কিছুকাল পূর্বের ইসলামপন্থি পূর্বসূরিগণ অন্যদের সাথে বিরোধিতা ও আলাদা থাকার ব্যপারে বেশ বাড়াবাড়ি করেছেন। যেন তারা দুটো আলাদা বাহু, যা কখনো মিলিত হতে পারে না। এটা ঠিক না। তবে বর্তমানে কিছু ইসলামপন্থি বিচ্ছিন্ন থাকায় পরিম-লকে সংকীর্ণ করে আনছেন। ঐক্যমত্যের জায়গাটাকে প্রশস্ত করছেন। এটা ভালো ব্যপার। আমাদের স্বীকার করতে হবে, আমরা যে যুগে আছি তাতে যেমন অনেক খারাবি রয়েছে, অনুরূপ তাতে অনেক কল্যাণও বিদ্যমান। আমাদেরকে উভয়টাকে একই সাথে দেখতে হবে। আমাদের আলেমগণ খুবই আস্থার সাথে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, শরীয়তের বিধিমালা কোনটি অপরিবর্তনীয় আর কোনটি পরিবর্তনীয়। তাই সবকিছুকে শরীয়ত, জ্ঞান এবং কল্যাণের মাপকাঠিতে মাপতে হবে। ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ার মানদে- নয়। না এটা অন্যদের সাথে মানিয়ে চলা; আর না এটা আমাদের ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য।

আল-জাযিরা: ইসলামে একটি রাষ্ট্রকে কোন স্বার্থগুলো দেখতে হবে। শুধু তার নাগরিকদের স্বার্থ নাকি মুসলিম উম্মাহের স্বার্থও দেখতে হবে? আর মুসলিম উম্মাহের স্বার্থ বলতেই বা কী বোঝায়?

ড. আহমদ: আপনারা সবকিছুকে জটিল করেন! সুস্পষ্ট বিষয়কে দুর্বোধ্য করবেন না। পূর্বে মানুষ বলতেন, ভালো জিনিসের পরিচয় দেওয়া লাগে না। কে না জানে? কিসে ইসলাম ও মুসলিমদের কল্যাণ? কোনটি ইনসাফ আর কোনটি জুলুম! আসল কথা হলো, যেই তার দেশের ও তার জনগণের সেবা করে এবং তাদের ইহজাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধনে কাজ করে, সেই ইসলাম ও মুসলমানদের সেবক। আর যারা তার দেশের ক্ষতি করে এবং তার জনগণের ওপর জুলুম করে, সেই সকল মুসলমানের ওপর অবিচার করলো। মুসলমানদের পশ্চাদপদতা ও দুর্দশার কারণ হলো। হ্যাঁ, উত্তম তো তারাই, যারা তাদের সেবা করেছে এবং উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। তারপর অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সাহায্য করেছে। এটা সাধ্যমত করা করণীয়।

আল-জাযিরা: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্বার্থ বলে কিছু আছে। প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ রাজনৈতিক স্বার্থকে বিবেচনায় রেখেই পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রের অনুসৃত কর্মপন্থা যদি মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী হয় তো এ রাষ্ট্রকে কি ইসলামি রাষ্ট্র বলা যায়?

ড. আহমদ: রাষ্ট্রকে তখনই ইসলামি রাষ্ট্র বলা হবে, যখন তার মূলনীতি ইসলামি হবে। এর ভিত্তিতেই শরীয়তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মুসলমানদের স্বার্থ নিশ্চিত করাই হবে রাজনৈতিক কৌশল। আর যার রাজনীতি ইসলামবিরোধী ও জুলুম-নির্যাতন এবং স্বৈরাচারিতাই হলো যার বৈশিষ্ট্য, নিশ্চিতভাবে তা ইসলামি রাষ্ট্র হতে পারে না। যদিও তার ফলকে কুরআন ও কালিমা লেখা থাকে!

আল-জাযিরা: বর্তমানে নতুন ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুফিইজমে বিশ্বাসী বেশ কিছু সংগঠন এসেছে। যেমন মাজলিসু হুকামায়িল মুসলিমীন ও মুনতাদা তা’যিযিল সালাম। এগুলো কতটা সফল হবে বলে মনে করেন?

ড. আহমদ: দেখুন! এগুলো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সুফিইজম নয়।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ