শ্রমবাজারে ধস প্রবাসীদের উৎকণ্ঠা
মাহমুদুল হক আনসারী
বাংলাদেশ শ্রমশক্তি রফতানির এক কঠিন সময় পার করছে। নতুন শ্রমবাজার খুলছে না। দৈনন্দিন বৈদেশিক বাজার বন্ধ হচ্ছে। আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, লেবাননসহ এসব দেশে জনশক্তির রফতানি প্রায় বন্ধ বলা চলে। ওমান, কাতার, জর্ডানের মতো শ্রমবাজারে কর্মি পাঠানোর হার এখন আশঙ্কাজনক অবস্থানে আছে। ফলে কর্মি যাওয়ার পুরো চাপ ছিল সৌদি আরব, ওমান ও কাতারে। কিন্তু এই তিনটি দেশ পূর্বের মতো শ্রমিক নিতে পারছে না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে সেখানে গিয়ে প্রতারনার শিকার হওয়াসহ অনেক কারণেই শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসছে তারা।
বিগত ১০ মাসে শুধু সৌদি আরব থেকেই দেশে ফিরে এসেছে প্রায় ১৭ হাজার নারী ও পুরুষ গৃহকর্মি। প্রতিদিন আশঙ্কাজনকভাবে এসব দেশ থেকে প্রবাসী ফেরত আসা অব্যাহত আছে। এভাবে আরো অন্যান্য দেশ হতে আমাদের দেশের মূল্যবান জনশক্তি ফেরত আসছে। মধ্যপ্রাচ্যর দেশসমূহে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উৎকণ্ঠা ভুগতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে, যেসব কর্মি মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোতে গেছে, তারা কাজ না থাকা ফ্রি ভিসা নামে প্রতারনা, আকামা না দেয়াসহ নানা প্রকারের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
জানা যায়, সৌদি আরব ও মালয়শিয়াতেই ৫ লাখের অধিক শ্রমিক অবৈধ আইনে অমানবিক জীবন যাপন করছে। ভুক্তভোগী প্রবাসীদের পারিবারিক সূত্রমতে, জানা যায় সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবে এখন বাংলাদেশিদের ওপর ব্যাপক দরপাকড় চলছে। সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে শত শত শ্রমশক্তি খালি হাতে দেশে ফিরছে। বৈধ আকামাদারী প্রবাসী কর্মিদেরও দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে যে, এসব বিষয়ে দেখভাল করার জন্য যেন কেউ নেই। সৌদিতে পুলিশি হয়রানি বন্ধ এবং বৈধ আকামাদারী কর্মিদের আইনি সহায়তা দিতে না পারলে জনশক্তি রফতানিতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। গ্রেফতার হওয়া প্রবাসীদের অনেকের কাছে বৈধ আকামা থাকার পরও সৌদি পুলিশ তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে বলে তাদের পরিবার সূত্রে জানা যায়।
অসহায় প্রবাসীদের আইনি সহায়তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈধ কর্মিদের আউটপাস ইস্যু করে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া করে দিচ্ছে দূতাবাস। অভিযোগ আছে ওই দূতাবাস প্রবাসীদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা অধিকার আদায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। জেদ্দাস্থ সেইফ হোমে প্রায় ২১জন মহিলা কর্মি নিয়োগকর্তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে চরম হতাশা আর উৎকণ্ঠায় অমানবিক জীবন কাটাচ্ছে। মদিনা ও রিয়াদ সেইফ হোমেও শতাধিক মহিলা গৃহকর্মি নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় দেশে ফেরার প্রহর গুণছে। এসব মহিলা গৃহকর্মিরা নিয়োগ কর্তাদের কাছে বকেয়া বেতন ভাতাও পায়নি।
জানা যায়, লক্ষীপুর জেলার চরজালিয়া গ্রামের ফজল হক গাজীর বিধবা মেয়ে পারভিন আক্তার অর্থনৈতিক সাবলম্বী অর্জনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যায়। সৌদিওর তাবুকে এক সৌদি নিয়োগকর্তার বাড়িতে ২ মাস আগে আত্মহত্যা করে জীবন প্রদীপ শেষ করে দেয়। মৃত্যু পারভীনের বৃদ্ধ মা সবিরুননেসা মেয়ের লাশ এক নজর দেখার জন্য এখনো কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কিন্তু জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কন্সুলেটের অনুবাদক কাম আইন সরকারি আজিজ ফোরকান বলেন, পারভীন আক্তার আত্মহত্যা করেছে। এ মৃত্যুর কারণ কী ও কেন সঠিকভাবে তিনি নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারেননি।
এছাড়া মানিকগঞ্জের ফতেহপুর গ্রামের রুবেল হোসেনের স্ত্রী রোজিনা সৌদির তাবুকে কয়েক মাস আগে মৃত্যুবরণ করে। তার লাশ দেশে আসলেও কোনো প্রকারের ক্ষতিপূরণ সে পায় নি। জেদ্দাস্থ কন্সুলেট থেকেও কোনো সহায়তা ছিল না বলে জানা যায়। দীর্ঘ ৭ বছর যাবত সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রফতানি বন্ধ আছে। হাতেগোনা কয়েকজন গৃহকর্মি যাচ্ছে বলে জানা যায়।
সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরকালে সেদেশের কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপকালে বাংলাদেশ থেকে বেশি বেশি কর্মি নেয়ার অনুরোধ জানান। কুয়েতেও জনশক্তি রফতানি হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যর বাহরাইনে কর্মি নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ২০১৮ সনের সেপ্টেম্বর থেকে অনৈতিক সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে আছে। এছাড়া কাতারেও কর্মি নিয়োগের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।
জানা যায়, রাজকীয় সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের ঘোষিত ভিষণ ২০৩০ কর্মসূচির অধীনে শ্রমবাজারে শতভাগ স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি জ্বালানি খাতের ওপর অর্থনীতির নির্ভরতাও কমাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। সৌদি অর্থনীতির এই পালাবদলের বিচক্ষণ কারসাজিতে আটকা পড়ছে বাংলাদেশিরা। ফলে প্রতিনিয়ত কর্মসংস্থান হারাচ্ছে শত শত প্রবাসী জনগণ। নিয়োগকর্তার দেয়া অনুমতি পত্র আকামা হারিয়ে অনেকেই অবৈধ হয়ে যাচ্ছে সে দেশে। এরমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে প্রতিদিন প্রবাসীরা খালি হাতে দেশে ফিরছে।
সূত্রমতে, জ্বালানী খাত কেন্দ্রিক ও অভিবাসী শ্রম নির্ভর ও অর্থনীতির চাকা হঠাৎ ঘুরাতে গিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে সৌদি আরবের বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান খাত। বিশেষ করে নির্মাণ খাতের সৌদি কোম্পানীগুলো চরমভাবে আর্থিক সংকটে পড়েছে। সৌদি বিন লাদেন গ্রুপ, সৌদি ওগেরসহ বড় বড় নির্মাণ প্রতিষ্টান কর্মি প্রত্যাহার অব্যাহত রেখেছে। নির্মাণ ও সরবরাহ খাতের ছোট খাটো ঠিকাদারী প্রতিষ্টানগুলোও একই পথে চলছে। এসব কারণ বাংলাদেশি প্রবাসীরা চরমভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। প্রবাষী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আকামা সমস্যা সমাধানে প্রতিদিনই সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রবাসী কর্মিরা অভিযোগ করছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় যথাযথভাবে প্রবাসীদের পাশে আসছে না বলে জানা যায়। ফলে তাদের উৎকণ্ঠা হতাশা ও খালি হাতে দেশে ফেরা অব্যাহত আছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান আনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার ২৬৫ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই রফতানি হয়েছে ৪৭ হাজার ২৮৩ জন মহিলা গৃহকর্মিসহ মোট ২ লাখ ৬৮ হাজার ১১২ জন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছে ২ হাজার ৪০৩ জন মাত্র। কুয়েতে গেছে ৮হাজার ৬০৩জন। ওমানে ৫৩ হাজার ৯৮১ জন। কাতারে ৪৪ হাজার ৬৮৪ জন। মরিশাসে রফতানি হয়েছে ৫ হাজার ৬১০ জন।
এদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হওয়ার বিষয়ে ৬ নভেম্বর মালয়েশিয়ার পুত্রাযাজায় দুই দেশের মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা জানা যায়। যদি বৈঠক ফলপ্রসু হয় তাহলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য ফিরে আসতে পারে। বাংলাদেশ জনশক্তি রফতানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। এটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও জাতীয় রাজস্ব খাতে ব্যাপক অবদান রাখছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশি শ্রমশক্তি ব্যাপকভাবে অবদান রাখলেও তাদের কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা অধিকার প্রতিষ্টায় বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় অব্যাহতভাবে শ্রম রফতানিতে ধস নেমে আসছে। এ ধস পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু জনশক্তি রফতানির উত্তরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে সঠিক দিক নির্দেশনা খুবই মন্থর গতিতে চলছে। যার কারণে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে বাংলাদেশি শ্রমশক্তি খালি হাতে ফেরত আসছে, আর বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানি সংকোচিত হচ্ছে।
জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং দেশের জনশক্তিকে অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থান নিরাপদ ও বিপদমুক্ত রাখতে হবে। যেভাবে কর্মশক্তি বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আসছে সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য গভীরভাবে অসনী সংকেত ছাড়া কিছু নয়। যেকোনো মূল্যে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার ধরে রাখা ও নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করার দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়ার প্রত্যাশা করছে।