শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণরোধে দরদি মনের আকুতি: কতিপয় প্রস্তাবনা
মুফতী আবদুল হক
আদর্শ-আলোকিত মানুষ গড়ার কারখানা শিক্ষালয়ে সম্প্রতি ধর্ষণ, পাশবিক আচরণ, অপহরণ ও নৈতিক অবক্ষয় এবং ধর্ষণোত্তর মর্মান্তিক হত্যা, অমানবিক জুলুম-নির্যাতন অতীতের সকল রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। অপরাধ প্রবণতা ও যৌন নির্যাতন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবক্ষয় ও অশুচির ঢেউ আছড়ে পড়েছে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বত্রে। শিশু ধষণ, নির্যাতণ অতঃপর নির্মম হত্যার যেসব চিত্র সম্প্রতি ফুটে উঠেছে, তাতে দেশের মিডিয়া জগতকে লজ্জাবনত করেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের এক জরিফ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম ছয় মাসে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ৪১ শতাংশ হারে। ২০১৮ সালে শিক্ষদের মাধ্যমে নির্যাতিত হয়েছে ১২৯টি শিশু। শিক্ষকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৭ টি শিশু। শারিরীক ভাবে নির্যাতিত শিশুর সংখ্যা ৭০ টি। যৌন হয়রানির শিকার ৩৩ টি। ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়েছে ৭ জনের ওপর। জরীপের বাইরে আরও থাকতে পারে। ছাত্রী ধর্ষন এবং অপহরণের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে উদ্বেগ জনক হারে।
বস্তুত স্কুল, কলেজ-ভর্সিটির পবিত্র অঙ্গনকে অপবিত্রকারী, সন্তান-সন্ততিতুল্য ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি অশুভ-কুদৃষ্টি দানকারী বিদ্যা মীর জাফরদের তান্ডবে দেশ-জাতি আজ দিশে হারা-পাগলপারা। রাসুলের ঘর নামে খ্যাত মাদরাসার ইলমী পার্কে কতিপয় ইথরদের বিশ্বাস ঘাতকতায় ধার্মিক জনতা দস্তুর মতো তাজ্জব-বিস্ময়াপন্ন। শিশু শিক্ষা শিক্ষালয়ের কুসুম কাননে হিংস্র নরপিচাশদের শঙ্কায় পিতা-মাতা উহ! যারপর নাই প্রাণ উষ্টাগত-আল্লাহর কাছে সিজদাবনত। ফলশ্রুতিতে অভিভাবক মহল আজ উৎকণ্ঠার উত্থাল তরঙ্গে সতরাচ্ছে। জন সাধারণ দুশ্চিন্তার মহা সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে। আদুরে সন্তা-সন্ততিদের এ কাল বৈশাখী ও টর্নেডোর চোবলে মা-বাবা যারপর নাই হতভম্ব| তদুপুরি ছাত্রী অপহরণের উপর্যুপুরী ঘটনা কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে অবিভাবকদের মনে। হায়! যেখানে আলো সেখানে আধাঁর। যেখানে শান্তির সমাধান সেখানে অশান্তির দাবানল।
যেখানে নিরাপত্তার দুর্গ সেখানে প্রতিনিয়ত জীবণনাশের হুমকি। মানুষ যাবে কেথায়? বিদ্যালয় মাহা বিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের পিতা-মাতা কখন নেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস? কোমলমতি শিশুদের বাবা-মার অস্থির মনে কে শোনাবে শান্তির বাণী? কে মুছবে তাদের চোখের পানি? মাদরাসার ইলম পিয়াসুদের মাতা-পিতাকে কে দিতে পারবে একটুখানি প্রশান্তির অভয়? সরকারের একাধিক প্রশাসন না সরকার বাহাদুর স্বয়ং? কার জিমমায় অভিভাবকগণ ছেলে-মেয়ে ও নাতী-নাতনীকে নিরাপত্তাহীনতার অভয়ারণ্যে প্রেরণ করবে? এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত সেই প্রাচীন প্রথা; ঘরোয়া চৌহদ্দীর অভ্যন্তরে সীমিত পরিসরে শিক্ষা-দীক্ষার কার্যক্রম চালাতে হবে। তখন দেশের শিক্ষার হার সর্বনিম্নে তলিয়ে যাবে। আর শিক্ষালয় গুলোর সুরম্য দালান-ইমারতসমূহ ছেলে-মেয়েকে কবে নাগাদ কোলে নেবে-বুকে জড়াবে মৌন বোবা কান্নায় ক্রমান্বে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কেননা জাতি বিধ্বংসী এসিডর গতিধারা চলতে থাকলে বাঙ্গালী জাতি নিকট ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনের প্রতি আগ্রহ-উৎসাহ যে হারিয়ে ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
আমি একজন অসাম্প্রদায়িক দীনী নাগরিক হিসেবে দেশ জাতির কারিগর আদর্শ শিক্ষকগণের প্রতি সম্মানের চাঁদর বিছিয়ে দিই। কিন্তু শিক্ষক নামের কলঙ্ক ও হায়নাদের আচরণ দর্শনে যারপর নাই বিস্মিত হই। শিক্ষাঙ্গনের ভাব গাম্ভীর্য পূর্ণ পবিত্রতা বিনষ্টকারীদরে কদর্য স্বভাব শ্রবণে সংবিৎ হারিয়ে ফেলি। বিশেষত: নৈতিকতা ও সভ্যতার আধার মাদরাসায় কোন অবঞ্চিত ঘটনা বিস্ফোরিত হলে মনে হয় যেন মাথার ওপর আসমান ভেঙে পড়েছে। যে সব কুলাঙ্গার স্বীয় পঁচা স্বভাবের ধুমায়িত অনলে রাসুলের ঘরকে ভস্ম ও ছারখার করেছে, তারা হায়! তুচ্ছ কামভাবের বসবর্তী হয়ে নবীজির মডেল শিক্ষালয় সুফফায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হাজী শরীয়তুল্লাহ, শামসুল হক ফরিদপুরী, শাহ জালাল, শাহ পরান, খান জাহান আলী, মুফতী আমীমুল ইহসান, পীরজি, হাফেজ্জী, ড. শহীদুল্লাহ ও খতীব ওবাইদুল হকগণের কষ্টার্জিত ইসলামি তাহজীব-তামাদ্দুনের মার্যাদাপূর্ণ পাগড়ীকে ধুলোয় ধূসর করেছে। কোটি কোটি মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের মূলে আস্তার সংকট তৈরি করেছে। হায়! কাবাঘর থেকে কুফরি উদ্গীরণ হলে মুসলমানী থাকবে কোথায়?
নিম্নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিনেট, গভর্নিং বডি, পরিচালনা পর্ষদ ও শুরা কমিটির সদয় বিবেচনার সকাশে দরদী মনের আকুতি কতিপয় প্রস্তাবনা পেশ করা হলো:
- কোন দায়িত্বশীল বা শিক্ষক একলা অবস্থানে থেকে কোন ছাত্রী বা শিশু-কিশোরকে আহবান করলে তিনজনের সমভিব্যাহারে উপস্থিত হতে হবে। কদাচ একজনের উপস্থিতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে প্রতিবিধান করা যেতে পারে।
- কোন শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোন ছাত্রী বা শিশু-কিশোর কে কোথাও ভ্রমনে-বিচরণে নিতে পারবেনা। নচেৎ আইন লঙ্ঘনজনিত দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হোক।
- মহিলা মাদরাসার ছাত্রীরা পুরুষ শিক্ষকগণ থেকে অবশ্যই শরয়ী পর্দা অবলম্বন করতে হবে। পর্দা লঙ্ঘনকারিণীদেরকে আবশ্যিক শাস্তির আওতাভুক্ত করা হোক। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে নেকাব পরিহিতাবস্থায় পুরুষের সাথে নিস্প্রয়োজনীয় বৈঠক ইসলামি সংস্কৃতির পরিপন্থী।
- কোন ছাত্রী ও শিশু-কিশোর দ্বারা চুল টানা, গা টিপা ইত্যাদি দৈহিক সেবা গ্রহণ অমার্জনীয় অপরাধ বলে বিধান জারি করা হোক।
- আবাসিক প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের বিয়ে-শাদিসংক্রান্ত আলোচনা একদম নিষিদ্ধ বিষয় বলে আইন করা হোক।
- ছাত্রীদের ভদ্রতা বিবর্জিত পোষাক-আষাক এবং উসৃঙ্খল জীবন যাপন আবশ্যিকভাবে পরিত্যাগ করার বিধান করা হোক।
- প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ও লেখা-পড়ার সুষ্টু পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষে পড়া-লেখায় অমনোযোগী বিশেষত: মেয়েদের অধ্যবসায়ে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদেরকে সতর্কতার পর শাস্তির আওতাভুক্ত করা হোক।
- দায়িত্বশীল ও শিক্ষক মহোদয় গণকে সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান দৃষ্টি রাখতে হবে। কারো প্রতি সন্দেহযুক্ত দুর্বলতা (অতিমমতা) প্রতিষ্ঠান বহির্ভুত আচরণ হিসেবে গন্যকরা হোক।
- ক্লাসে ক্লাস প্রসঙ্গ এবং মাঝেমধ্যে নৈতিকতা-চরিত্র শোভা ও পড়া-লেখার প্রতি প্রেরণা দান ছাড়া অন্য কোন প্রকার আলোচনা নিষিদ্ধ করা হোক।
- ছাত্র-ছাত্রীদের সময়-জীবনকে আমানত মনে করতে হবে। তাদের সাথে পিতৃ ও পুত্র-কন্যাসুলভ আচরণ এবং স্নেহ-মায়া বিজড়িত শাসন করতে হবে। লেখা-পড়ায় প্রগ্রেজ করার পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী, চরিত্রবান ও সুনাগরিক হিসেবে গঠনে সচেষ্ট হতে হবে। কেননা পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে কোন সভ্যতা গড়ে উঠেছে এমনটি পাওয়া যাবেনা। কাজেই মূল্যবোধের সম্প্রসারণ-লালন ও অনুশীলন বাড়াতে হবে।
- ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অপহরণ থেকে সুরক্ষার সম্ভাব্য প্রচেষ্টা-পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অস্থির অভিভাবকদের ক্ষতস্থানে আস্তার প্রলেপ দেয়া হোক।
- শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, পাঠ অভ্যাস, সময়ানুবর্তিতা, উন্নত চরিত্র এবং ভালো রেজাল্টে পুরষ্কারের বিধান প্রতর্বতন করা হোক।
লেখক: মুহাদ্দিস আজিজুল উলুম মাদরাসা, রাজারকুল, রামু, কক্সবাজার