মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা
আনিস আলমগীর
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কখনও মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ছিলেন না। সিনেট সদস্য ছিলেন না। কখনও কোনও রাজ্যের গভর্নর নির্বাচিত হননি। মুখ্য পেশা ছিল তার আবাসন ব্যবসা। শূন্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আর বর্ণবাদী মানসিকতা নিয়ে তার মতো কেউ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন দ্বিতীয়টি নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অসীম ক্ষমতা। এমন শূন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ারের প্রেসিডেন্ট হওয়া সারা বিশ্বের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার।
ট্রাম্প আবার এমন লোক, যিনি যত্রতত্র প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান, নিজের অভিলাষ অনুসারে। অভিজ্ঞতা শূন্য এই লোকটি সর্বত্র ছড়ি ঘুরানোর কারণে বিশ্বব্যবস্থা এখন বিপর্যস্ত হওয়ার মুখে। ক’দিন আগে ট্রাম্প বলেছেন, কিডনি হার্টের অংশ। তারও আগে চাঁদকে বলেছেন মঙ্গলের উপগ্রহ। সুপার পাওয়ারের প্রেসিডেন্টের সাধারণ জ্ঞানের দৈন্যতা দেখে দুঃখবোধ হয়, আবার আতঙ্কিত হতে হয়্তকারণ কোথায় কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে বসেন তিনি। অসত্য কথা বলার ক্ষেত্রেও তার জুড়ি নেই।
গত শতাব্দীর চার দশকে আন্তর্জাতিক লেনদেনে মুদ্রা হিসাবে ডলার গৃহীত, কারণ তখন ডলার ছিল খুবই শক্তিশালী মুদ্রা। সুতরাং এলসির পেছনে যেকোনও একটা আমেরিকান ব্যাংকের এনডোর্সমেন্টের প্রয়োজন হয়। তার জন্য আমেরিকান ব্যাংককে কমিশন প্রদান করা হয়। এই কমিশন বাণিজ্যও আমেরিকার আয়ের বড় একটা সুযোগ। এই সুযোগ ভোগ করে বলে এখন কথায় কথায় অবরোধ আরোপের হুমকি প্রদান করে তারা।
উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া আর ইরানের ওপর আমেরিকা অবরোধ আরোপ করে বসে আছে দীর্ঘদিন। তুরস্ক নিজের আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্রয় করেছে, তাতে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অসন্তুষ্ট। আমেরিকা এখন বলছে তুরস্কের ওপর অবরোধ জারি হতে পারে। এসব আচরণের কারণে আমেরিকার প্রতি সারা বিশ্বের ক্ষোভের কোনও সীমা নেই।
রেজা শাহ পাহলভির সময় ইরান ছিল আমেরিকার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জাতীয়তাবাদী নেতা মুহাম্মদ মোসাদ্দেক এবং হোসাইন ফাতেমি প্রমুখের নেতৃত্বে গত শতাব্দীতে পাঁচ দশকের শুরুতে একবার সিংহাসনচ্যুত হয়েছিলেন রেজা শাহ। কিন্তু আমেরিকার সিআইএ ইরানি সামরিক বাহিনীর সহায়তায় জাতীয়তাবাদী মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটায়। প্রবীণ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আর ফতেমিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রেজা শাহ পাহলভিকে পুনরায় সিংহাসনে ফিরিয়ে আনে তারা।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবীদের হাতে রেজা শাহ পাহলভি পুনরায় ক্ষমতা হারান। আমেরিকার কোনও কৌশল সফল হয়নি। কারণ ইরানের সামরিক বাহিনীতে বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি মৌলিক পরিবর্তন এনেছিলেন। ইরানের সামরিক বাহিনীতে পুরনো কোনও অফিসার ছিল না এবং নবগঠিত ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ড করপস-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইরানের সেনাবাহিনীতে।
ইসলামিক বিপ্লবকে বিপর্যস্ত করার জন্য ইরাককে দিয়ে ইরান আক্রমণ করানো হয়েছিল। সম্মুখে এই যুদ্ধটা হয়েছিল ইরানের সঙ্গে ইরাকের। বাস্তবে এটি ছিল আমেরিকা আর সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ। দীর্ঘ ৮ বছর যুদ্ধ হয়েছিল। আমেরিকা আর সৌদি আরব অকাতরে ইরাকে অস্ত্র সরবরাহ করার পরও ইরানকে কাবু করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার ব্যাংকে ক্ষমতাচ্যুত শাহের নামে জমাকৃত অর্থ ইরান ফেরত চেয়েছিল। কিন্তু আমেরিকা অর্থ ফেরত দিতে গড়িমসি করলে ইরানের ছাত্রজনতা দীর্ঘ চারশ’ ৪৪ দিন তেহরানে আমেরিকান দূতাবাসের ৫২ জন মার্কিনি নাগরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিম্মি করে রেখেছিল। পরবর্তী সময়ে আলজেরিয়ার মধ্যস্থতায় আমেরিকা সেই অর্থ ফেরত দেয় এবং ইরান ৫২ জন জিম্মিকে প্রত্যর্পণ করে।
এসব কারণে গত চার দশক ধরে ইরান আর আমেরিকার মাঝে কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। পারস্য উপসাগরে এখন আমেরিকার দুটি বিমানবাহী রণতরী উপস্থিত। ব্রিটিশের একটি রণতরী উপস্থিত হয়েছে, অন্যটি পারস্য উপসাগরের পথে। জিব্রাল্টার প্রণালীতে ব্রিটিশরা ইরানের তেলবাহী একটি ট্যাংকার আটক করেছে। ট্যাংকারটি তেল নিয়ে সিরিয়া যাচ্ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পূর্বে সিরিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করেছিল। ট্যাংকার আটকের ঘটনা সিরিয়ার ওপর আরোপিত অবরোধ কার্যকরী করারই অংশ। ইরান ঘোষণা দিয়েছিল তারাও একটি তেলবাহী ট্যাংকার আটক করবে। কথামতো এরই মধ্যে ইরান ব্রিটিশের তেলের ট্যাংকার আটক করেছে।
ইরান বলেছে তারা যুদ্ধ করবে না, আমেরিকা বলেছে তারা যুদ্ধ চায় না। অথচ পারস্য উপসাগরে যুদ্ধের সব আয়োজন এখন প্রায় সম্পন্ন। ইরান বলেছে তাদের লক্ষ্য করে আমেরিকা একটা গুলি ছুড়লে ইরান আমেরিকার মিত্র রাষ্ট্র ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবে এবং সেই প্রস্তুতি তার রয়েছে। ইসরায়েল বলেছে আগামী দুই বছরের মধ্যে তারা ইরানকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে। ইরান এরই মধ্যে আমেরিকার একটি উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি মূল্যবান ড্রোন ভূপাতিত করেছে। আমেরিকা তার কোনও প্রতিশোধ এখনও নেয়নি।
ব্রিটিশরা পারস্য উপসাগরে উপস্থিত হয়েছে। তারা আমেরিকার উপগ্রহের মতো। ইরাক যুদ্ধেও তারা আমেরিকার অংশীদার ছিল। সুতরাং উভয়ে মিলে ইরানকে একটা শিক্ষা দেওয়ার যে মতলব নেয়, তাও নয়। ড্রোন ভূপাতিত করার পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ক্ষেপণাস্ত্র এস-৪০০ ইরানকে দিতে সম্মতির কথা জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি পাকা অবস্থায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছে।
তবে যুদ্ধ না লাগার আশঙ্কাও কম নেই। আমেরিকায় আগামী বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী। সুতরাং নির্বাচনের পূর্বে ট্রাম্প সহজে যুদ্ধে জড়িত হতে চাইবে বলে মনে হয় না। আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদ প্রস্তাব পাস করে রেখেছে, যুদ্ধের বিষয়ে কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হবে। এখন প্রযুক্তি এমন উন্নতর পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমেরিকার মূল ভূখণ্ডও মিসাইল আক্রমণের আওতায় এসে গেছে। সুতরাং আমেরিকা সহজে যুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সর্বোপরি আমেরিকা আর ইরানের আর্থিক অনটন রয়েছে। ফলে যুদ্ধ যেকোনও পক্ষ চায় না, এটা সহজে বোঝা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ঠুনকো বিষয়কে উপলক্ষ করেও যুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল অস্ট্রিয়ার যুবরাজ হত্যাকে কেন্দ্র করে। ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ড ইউরোপের রাজনীতিতে চূড়ান্ত সংকটের জন্ম দিয়েছিল। ফলে যুদ্ধ নিশ্চিত একথা যেমন বলা যায় না, অনিশ্চিত এ কথা বলাও কঠিন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত