কাশ্মীর সমস্যা: বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের নিরাপত্তা
খান শরীফুজ্জামান
কাশ্মীর। ২,২২,২৩৬ বর্গকিলোমিটারের ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত এই জনপদেবসবাস (২০১১) করে ১২.৫৫ মিলিয়ন মানুষ যা সম্প্রতি ভূ-নরকে পরিণত হয়েছে। এ বছর (২০০১৯) ১৪ ফেব্রুয়ারির কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় ‘সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের’ (সিআরপিএফ) গাড়িবহরে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে তার দায় স্বীকার করে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই মুহাম্মদ। জবাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের মাটিতে বিমান হামলা চালায় ভারত। পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে নিজেদের সীমানায় দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তান।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো পাল্টাপাল্টি বিমান হামলায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘাত বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে গত ৫ অগস্ট ২০১৯ জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ করে ভারত সরকার। জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়া হয়। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানের মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি করে আসছে পাকিস্তান।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী গত তিন দশকে তথা ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় ৯৫ হাজার ২৩৮ জন কাশ্মীরী স্বাধীনতাকামীকে হত্যা করেছে। এ সময়ে সাত হাজার ১২০ জনকে কারাবন্দি রাখা হয়েছে। কাশ্মীরি গ্লোবালের এক খবর বলছে, ১১ হাজার ১০৭ নারী ভারতীয় বাহিনীর নিগৃহের শিকার হয়েছেন। এক লাখ ৯ হাজার ১৯১টি আবাসিক ভবন ও স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। আট হাজার কাশ্মীরিকে কারা হেফাজতে নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি। কেবল চলতি বছরেই পিএইচডি গবেষক, প্রকৌশল বিদ্যার শিক্ষার্থীসহ ৩৫০ কাশ্মীরিকে হত্যা করেছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
আমরা যদি একটু পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব হিজরি প্রথম শতকের শেষ ভাগেই এ অঞ্চল ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসে। ৯৪ হিজরীতে বা ৭১২ খিস্টাব্দে মুসলিম জেনারেল মুহাম্মদ ইবনে কাসিম প্রথমে সিন্ধু এবং পরে হিন্দুস্থানের বেশ কিছু অংশ বিজয় করেন। মুসলিম বিশ্বের তৎকালীন খলীফা আল-মুত্তাসিম (খিলাফত আমল, ৮৩৩-৮৩৯)-এর তত্বাবধানে পর্যায়ক্রমে বর্তমানের ভারত, পাকিস্তান, কাশ্মীর ও বাংলাদেশের কিছু অংশে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ হিন্দু জমিদারদের শোষণ ও বৈষম্যমূলক শাসনের হাত হতে মুক্ত হতে ইসলাম গ্রহণ করে। শত বছর পরেও সেই ইসলামী ভূ-খণ্ডের কাশ্মীরিরা তাদের শত বছরের মাতৃভূমির অধিকার রক্ষায় আজও তারা একটি ইসলাম ভিত্তিক স্বনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
বস্তুত কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যার এক পক্ষে ছিল পাকিস্তান ও কাশ্মীরের মুসলিমরা ও অন্য পক্ষে ছিল ভারতীয় হিন্দু শাসক গোষ্ঠী। ১৯৪৭ সালের যুদ্ধের পর ভারত কাশ্মীরের ৬৫ শতাংশ, পাকিস্তান ৩০ শতাংশ ও চীন ৫ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়।
১৩ আগস্ট ১৯৪৭ কাশ্মীর সংক্রান্ত প্রথম রেজুলেশন গ্রহণ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। পাঁচ-সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয় যার ওপর শান্তি ফিরিয়ে আনা ও উভয় সরকারের সহযোগিতায় কাশ্মীরের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য ‘গণভোট’ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অর্পিত হয়। অবশেষে ১৯৪৯ সনের ১ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকরী হয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গণভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে রাজি হয়। গণভোটই কাশ্মীরের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে বলে সব তরফ থেকে আশস্ত করা হয় কিন্তু ভারত আকস্মিকভাবে যুদ্ধ বিরতি ভেঙ্গে দেয়। এরপর বারংবার চেষ্টা করেও ভারতীয়দের প্রতিরোধের কারণ কাশ্মীরের গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারেনি বরং ১৯৬৫ সালে জওহরলাল নেহেরু কাশ্মীরও ভারতীয় সেনা বাহিনীর বাড়তি ফৌজ প্রেরণ করে ভারতের দখল দায়িত্ব পাকা পোক্ত করার চেষ্টা করে। কাশ্মীরের সকল অফিস-আদালতে ভারতীয় পাতাকা টানানোর নির্দেশ দান করে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের আগের শাসকদের চেয়ে বেশি অনেক বেশি তৎপর ভূমিকা পালন করছেন। কাশ্মীর ইস্যুতে তিনি পাকিস্তানের জনগণ ও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও ভারতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। কাশ্মীর ইস্যুতে ইমরানের ভূমিকাতে তার ও তার দলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সম্প্রতি বিষয়টি তিনি জাতিসংঘে নিয়ে গেছেন, ফলে ৫০ টিরও বেশি দেশ কাশ্মীরে ভারতের অমানবিক আচরণ, ধর্ষণ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কাশ্মীর ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ও জাতিসংঘের ৭৪ তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণে কাশ্মীরিদের করুন অবস্থা তুলে ধরে পাকিস্তান তুলে ধরেন। যুক্তি ও বাস্তবতার নিরীখে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে একটি শান্তি প্রিয় জনগোষ্ঠিকে নির্যাতনের মুখে সর্বশান্ত করে বাধ্য করা হচ্ছে মুক্তির জন্য অস্ত্রধারণ করতে। আর অস্ত্র ধারণ করলেই তাদেরকে বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী। যা বিশ্বসম্প্রদায় ও মুসলিমবিশ্বের কাছে নিঃসন্দেহে একটি মানবিক ও আবেগী অবস্থান সৃষ্টি করেছে। কিছু শক্তিশালী দেশ কাশ্মীর ইস্যুতে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তুরস্কের রিসেপ তইপ এরদোয়ান, মালয়েশির প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ এবং চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই জম্মু-কাশ্মীর প্রসঙ্গে জাতিসংঘে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ জাতিসংঘে তার ভাষণে ওয়াং ই বলেন, ‘কাশ্মীর সমস্যা বহু দিন ধরেই অমীমাংসিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। জাতিসংঘে বা রাষ্ট্রপুঞ্জের দলিল, নিরাপত্তা পরিষদের নিয়মাবলি এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তি মেনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে এর সমাধান হওয়া উচিত। একতরফা পদক্ষেপে স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, এমন কিছু করা একেবারেই উচিত নয়। ভারত এবং পাকিস্তানের প্রতিবেশি রাষ্ট্র হওয়ার সুবাদে চীন এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান এবং দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীল সম্পর্ক দেখতে চায়।’
কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘে জোরালো বক্তব্য রাখেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মুহাম্মদ। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে মাহাথির বলেন, কাশ্মীর অঞ্চলটিকে জবরদখল করে রাখা হয়েছে। সেখানে হামলা করে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে। মাহাথির বলেন, কাশ্মীর বিষয়ে জাতিসংঘের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সেখানে হামলা করে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট দুই পক্ষকে সংযম প্রর্দনের আহবান করেন এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ২১ আগস্ট এক টুইটে বলেন, ‘আমরা আশা করব ভারত সরকার কাশ্মীরের মহান লোকদেও সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করবে এবং এই অঞ্চলে মুসলিমদের নির্যাতন হামলা বন্ধ করবে।’
তুরস্কের এরদোয়ান ও মালয়েশিয়ার মাহাথির প্রতিক্রিয়া দেখালেও ওআইসি ও আরবদেশগুলোর সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। মূলত ওআইসি বা সৌদিআরব এখন আর মুসলিমবিশ্বের আস্থা, আবেগ, নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রতিনিধিত্ব করে না। কাশ্মীর সমস্যাটি জাতিসংঘের সাধারণপরিষদে ও নিরাপত্তাপরিষদে তোলা ও কিছু দেশের সমর্থন পাওয়ায় কূটনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে পাকিস্তান কিছুটা এগিয়ে আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে এখন পর্যন্ত আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স কোনও দেশই পাকিস্তান বা কাশ্মীরিদের পাশে দাঁড়ায়নি।
পক্ষান্তরে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলকে ঘিরে ভারতের জনগণই বিভাজিত। ভারতের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ, সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী ও রানৈতিক দল তথা প্রধান বিরোধীদলও মোদির এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাশ্মীর ইস্যুতে আমেরিকার পরোক্ষ আর ইসরাইল ও রাশিয়ার প্রছন্ন সমর্থন পেয়ে আসছে ভারত। একবার ইসরাইলি নেতা বেঞ্জামিন শান (Benyameen Shan) মুখ ফসকে বলেই বসেন, ইসরাইল ও ইন্ডিয়া প্যালেস্টাইন ও কাশ্মীরে একই রকম হুমকীর সম্মুখীন যা হলো ইসলামী মৌলবাদ। আমরা জানি কীভাবে আরব এবং মুসলিমদের সামলাতে হয়। আর এ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা আমরা ইন্ডিয়ার সঙ্গে শেয়ার করতে যাচ্ছি।’
ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সামরিক সম্পর্ক অনেক দৃঢ়- তা সবার জানা। সম্প্রতি, বিশেষ করে বিজেপি সরকার আসার পর ভারত হয়েছে ইসরাইলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় বাজার। ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছরে দেশ দুটির অস্ত্র বাণিজ্য ছয় বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০১৮ সালেই ভারত সরকার ৭৭৭ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে ইসরাইলের একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে বিদ্যমান সামরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে যুক্তরাজ্যের দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘাতে বড় ভূমিকা রাখছে ইসরাইল’ শিরোনামে ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি মতামত লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক। এক বিশ্লেষণে তিনি তুলে ধরেন প্রায় ২, ৫০০ মাইল দূরে থেকে তেলআবিব কীভাবে সহযোগিতা করছে নতুন দিল্লিকে। লিখেন, পাকিস্তানের ভূখণ্ডের জইস-ই-মুহাম্মদ ‘সন্ত্রাসীদের’ ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর বোমা ফেলায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যে উল্লাস প্রকাশ করেছে সেই বোমাগুলো আসলে ইসরাইলের তৈরি রাফায়েল স্পাইস-২০০০ নামের ‘স্মার্ট বোমা’।
জিপিএস দ্বারা পরিচালিত সেই বোমাগুলো এসেছে ইসরাইল থেকে। ফিস্ক বলেন, ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের সখ্যতার কারণে ইসরাইল থেকে যেসব অস্ত্র ভারতে আসছে সম্প্রতি সেগুলোর কিছু ব্যবহার করা হয়েছে পাকিস্তানের ভেতরে থাকা ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, গণতন্ত্র ছাড়া কোনোভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এছাড়াও একজন ভারতীয় হিসেবে গর্বিত নন বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্বখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেনের কাছে প্রশ্ন ছিলো, আপনি কি মনে করেন- কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা সেই অঞ্চলে শান্তি এবং সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারবে? উত্তরে অমর্ত্য বলেন, ‘না, আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, কাশ্মীর একটি বিশেষ সমস্যাপ্রবণ অঞ্চল। কাশ্মীরের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমি মনে করি না যে, কাশ্মীরের জননেতাদের কথা না শুনেই আপনি সেখানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। সেখানে হাজার হাজার জননেতাকে আটকে রাখা হয়েছে। এটি হচ্ছে পুরনো উপনিবেশিক মানসিকতার অজুহাতমূলক বক্তব্য। এসব ধরপাকড়ের মাধ্যমে সেই উপনিবেশিক যুগে ফিরে যাওয়া হচ্ছে।’
২২ মার্চ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার আপফ্রন্ট অনুষ্ঠানে বিশ্বখ্যাত লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট অরুন্ধতী রায় ১৯৭১ সালে সংঘটিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার কথা তুলে ধরেছেন। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়ায় ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সামরিক যুদ্ধের প্রসঙ্গ উল্লেখ্য করে অরুন্ধতী প্রশ্ন তুলেছেন, গণহত্যার পাটাতনে দাঁড়িয়ে ভারতবাসী যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে নিজ দেশের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করে এবং তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্র গড়ার পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে কাশ্মীর প্রশ্নে তাদের অবস্থান আজ ভিন্ন কেন। ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘ভারতীয়রা যদি বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতের হস্তক্ষেপ [অর্থাৎ] তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ায় [যুক্ত] হওয়া সমর্থনযোগ্য… যেখানে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, সেখানে [ওই হস্তক্ষেপ] একেবারেই যথাযথ, তাহলে কাশ্মীর প্রশ্নে তাদের আজকের অবস্থানের ন্যয্যতা কী।’
DW.com-এর সাথে সাক্ষাৎকারে কাশ্মীরের ঘটনায় অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রভাব পড়বে ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা। রাজনীতি ও ইতিহাস বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এরইমধ্যে নানা মাধ্যমে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখানোর সাহস নেই। বাংলাদেশই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের পথ দেখিয়েছে, বাংলাদেশই মডেল কিন্তু সেই মডেল বাংলাদেশ নিজেই এখন উপস্থাপন করতে পারবে না।’ কাশ্মীরের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি হিন্দু মুসলমানের প্রশ্ন বা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে মূখ্য নয়, মূখ্য স্বাধীনতার প্রশ্নে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি সুন্দর সমাধানের মডেল। বাংলাদেশের মানুষ যেমন পাকিস্তানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তেমনি তারা ভারতের অন্যায়ও মেনে নেবে না। কারণ এদেশের মানুষ স্বাধীনচেতা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদকারী। সরকার চুপ থাকলেও সাধারণ মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাবেই।
অন্যদিকে কাশ্মীরে যা ঘটছে তার বড় কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে বলে মনে করেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ তিনি বলেন, ‘টুকটাক প্রতিক্রিয়া হবে যা বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পাহাড়ে এর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।’ কাশ্মীর ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন।
তাঁর মতে, ‘ভারতে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার কাজ হচ্ছে, অন্য কোনো সম্প্রদায় বা মাইনরিটিকে তারা সহ্য করতে পারছে না। লাদাখ নিয়েও ঝামেলা হবে চীনের সঙ্গে ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। একটা কিছু শুরু হলে সেটা হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের পর্যায়ে চলে যেতে পারে। কাশ্মীরে আরও কিছু মুসলমান নিধন হলে তার প্রভাব পাকিস্তান, আফগানিস্তানে পড়বে। আর এদিকটায় উত্তর প্রদেশ হয়ে বাংলাদেশেও চলে আসতে পারে।’
বাংলাদেশের মানুষ কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে বলে মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান। কাশ্মীর ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয় হতে পারে উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। আসামে মুসলামানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিলের যে প্রক্রিয়া চলছে তা যদি এখন মোদী সরকার আরও এগিয়ে নেয় তাহলে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।’
জাতিসংঘে ইমরান খানের কাশ্মীর সংক্রন্ত বক্তব্য নিয়ে এর পক্ষে-বিপক্ষে জনসাধারণের মধ্যে ও সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি বা মুসলিম জনগোষ্ঠির প্রতি আমাদের পররষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত, বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মাঝেই তার সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা আছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে এবং একই বছরে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে তিনি সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের জন্য শক্তি অপব্যবহার করতে দেখেছি, জনগণকে নিপীড়ন করতে দেখেছি। আমরা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অস্বীকার করতে দেখেছি। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে তাদের ঠেলে দিতেও দেখেছি। আর এসব অকথ্য যাতনার চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে আছেন আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা। আর এ জন্যই অতীতের তুলনায় আজ এই শক্তিকে প্রজ্ঞার সঙ্গে কাজে লাগানোর প্রয়োজন বেশি। ধ্বংস নয় সৃষ্টি, যুদ্ধ নয় শান্তি, দুর্ভোগ নয় মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যদি মহানবী (সা.) প্রচারিত মানবপ্রেম ও মানবমর্যাদার শাশ্বত মূল্যবোধ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারি, তা থেকে বর্তমানকালের সমস্যা সমাধানে মুসলিম জনসাধারণ সুস্পষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এসব মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে শান্তি ও ন্যায়বিচাররের ভিত্তিতে আমরা একটি নতুন আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারি। আরব ভাইদের ওপর যে নিারুণ অবিচার হয়েছে অবশ্যই তার অবসান ঘটতে হবে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরবভূমি অবশ্যই ছাড়তে হবে। আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে জেরুজালেমের ওপর। আল্লাহর কৃপায় আমরা এখন আমাদের সম্পদ ও শক্তি এমনভাবে সুসংহত করতে পারি, যাতে আমাদের সবার জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার অর্জন করা যায়। এই সাফল্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সম্ভাব্য সব প্রকার সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সবার যৌথ প্রচেষ্টা সফল করুন।’ বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মাঝে যেমন মানবতা ও মুসলিমবিশ্বের প্রতি দরদ দেখা যায় সে ধরনের দরদ, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ ইমরান খানের জাতিসংঘ ভাষণের মধ্যেও দেখা গেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত তথা ১৯৪৭ সালের রেজুলেশনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে, আন্তর্জাতিক সকল মানবাধিকার চুক্তিও নীতি লঙ্ঘন করে ভারত কাশ্মীরে জোর-জুলুম, নির্যাতন এবং দু্ই মাসব্যাপী কারফিউ দিয়ে অমানবিক দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। যদিও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে গণহত্যা, সাতদশকে ফিলিস্তিনি গণহত্যা, রোহিঙ্গা ও কাশ্মীরে গণহত্যা সবকালেই মুসলিম হত্যার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিষ্ক্রিয় বা নিরব দর্শকের ভূমিকা আবার কখনো কখনো রেফারির ভূমিকাও পালন করেছে। যেহেতু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ কাশ্মীরের মানুষের মতো প্রায় একই ধরনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল, তাই তারা কাশ্মীরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনকে বরাবর সমর্থন করে আসছে। ভারত সরকার এই বাস্তবতা মাথায় রেখে বাংলাদেশকে চাপে রাখার জন্য আসামে ১৯ লক্ষ মানুষকে তাদের ভারতীয় নাগরিকতার লিস্টে নাম না তুলে বাংলাদেশে পুশইন করার একটি ট্রাম কার্ড হাতে রেখেছে। জাতিসংঘ ঘোষিত বিশেষায়িত অঞ্চলকে উন্নয়নের নামে জোর করে সেনাবাহিনী দিয়ে দখল করে তার অধিবাসীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণহত্যা সকল আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিরও লঙ্ঘন ও ভারতের হীন মানসিকতার পরিচয়। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান-ভারতের দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন দানা বেধে উঠতে পারে এবং পাশ্ববর্তী দেশগুলোতেও রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সম্পূর্ণ দুই পরমানু শক্তিধর পাক-ভারত উত্তেজনায় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পরমানু শক্তিধর দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কাও রয়েছে।
কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, আরাকান, উইঘুর, যে দিকেই তাকাননা-কেন মুসলিম নির্যাতনের একই দৃশ্যই দেখা যায়। সবখানেই মুসিলিমদের ভূ-খণ্ড দখল করে নিচ্ছে সাম্রজ্যবাদীরা। ভূ-খণ্ডগুলোতে জনবিচ্ছিন্ন দালাল শাসকগোষ্ঠি বসিয়ে নানা রকম বিভাজন সৃষ্টি করে নষ্ট করছে মুসলিমদের ঐক্য ও সংহতিকে। মুসলিমবিশ্বের মানুষদেরকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ক্রমশই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে র্দুবল অবস্থার দিকে। আমাদেরকেও এ ব্যাপারে সর্তক থাকা প্রয়োজন। এমন অবস্থায় কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের পথ বুঝি একটাই- আরেকজন মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযান। চাই মুসলিমদের একজন অভিভাবক যিনি মুসলিমদের মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করবেন। যিনি মুসলিমদের মাঝে শক্তিশালী এক রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন। পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তিধর সেনাবাহিনীকে ইসলামের আর্দশে উদ্বুদ্ধ করবেন। যিনি সকল প্রকার কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাদের কাুশ্িমরি মুসলিম ভাই-বোনদেরকে তথা মুসলিমবিশ্বকে অপশক্তির করাল গ্রাস হতে মুক্ত করবেন। যার সরকার মুসলিমদের মাঝে ঐক্য ও সুশাসন কায়েম করবেন। আজ বঞ্চিত ও নির্যাতিত সকল মানুষের আকাঙ্ক্ষা-ইমরান কি পারবেন সেই বিন কাসিম বা সালহউদ্দিনের যোগ্য উত্তসূরি হয়ে উঠতে?
লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
PDF ফাইল…
[button link=”http://at.jamiahislamiahpatiya.com/wp-content/uploads/2019/11/November19.pdf”]ডাউনলোড করতে এখানে টাচ করুন বা ক্লিক করুন[/button]