সমকামিতার ভয়াবহ পরিণতি
যৌনচাহিদা মানবজাতি, জীবজন্তু ও পশু পাখির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। শারীরিক সুখ, মানসিক প্রশান্তি ও বংশ বিস্তারের জন্য এটা অপরিহার্য। এই চাহিদা চরিতার্থের জন্য রয়েছে বৈধ ও যৌক্তিক পন্থা। অস্বাভাবিক পথে যৌন চাহিদা মেটাতে গেলেই এটা সীমালঙ্ঘনের পর্যায়ে উপনীত হয়। বিপরীত লিঙ্গের সাথে বৈধপন্থায় মিলিত হওয়া পূণ্যের অন্তর্ভূক্ত। ইসলামের পরিভাষায় যা ‘নিকাহ’ নামে সমধিক পরিচিত। একই লিঙ্গের সাথে যৌনসংসর্গের কোন বিধি বা সুযোগ কোন ধর্মে নেই। অবৈধ যৌন মিলন, অনৈতিক যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার মতো অমানবিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ মানব জাতিকে হুশিয়ার করে দিয়েছেন। অশ্লীলতা, ব্যভিচার ও সমকামিতা থেকে বিরত থাকার জন্য মানবগোষ্ঠীর প্রতি রয়েছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কঠোর নির্দেশনা। হযরত রাসূল করীম (সা.) কিশোর-বালকদের চেহারার দিকে কুদৃষ্টিতে না থাকানোর নির্দেশ প্রদান করেন কারণ তাদের চেহারায় বেহেশতের হুরের দীপ্তি আছে। তিনি বলেন, আমার উম্মতের ব্যাপারে যেটা সবচেয়ে বড় ভয় করি, তাহলো লূত সমপ্রদায়ের অনুরূপ পাপাচার। আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক কওমে লূতের অপকর্মে লিপ্ত হবে। যখন এরূপ হতে দেখবে তখন তাদের ওপরও অনুরূপ আযাব আসার অপেক্ষা কর। লূত সমপ্রদায়ের মতো যারা সমকামিতায় লিপ্ত হবে তাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, ৪/৮০৬-৮০৬; শায়খ মাওলানা হাকীম আখতার, রূহ কি বিমারিয়াঁ, ১/১৯)
সমকামিতায় লিপ্ত হওয়ার কারণে একটি লোকালয়কে মহান আল্লাহ শাস্তি স্বরূপ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে বিধ্বস্ত করে দেন। ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানটি মধ্যপ্রাচ্যের জর্দান ও ইসরাঈলের মধ্যখানে অবস্থিত। আরবীতে স্থানটিকে ‘বাহরুল মাইয়িত’ ইংরেজিতে (Dead Sea) এবং বাংলাতে ‘মৃতসাগর’ বলা হয়। এটি মূলত একটি হৃদ। সমকামিতার কারণে শাস্তি হিসেবে এ জনপদটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়। এটি ৮০ কি.মি দৈর্ঘ এবং ১৮ কিলোমিটার প্রস্থ। এ সাগরটি ৩০৫ মিটার গভীর এবং আয়তন ১০২০ কি.মি প্রায়। এ সাগরের পানি অন্যান্য সাগরের চেয়ে ৭ গুণ বেশি লবনাক্ত। কোন প্রাণি এ পানিতে বাঁচতেও পারে না, জন্মাতেও পারে না। এতে কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্রকায় রোগ জীবানু (Microbe) ছাড়া কোন সামুদ্রিক মাছ নেই। জর্দান নদীর পানি এতে এসে পড়ে, সে পানির সাথে যেসব জলচর প্রাণীরা ভেসে আসে মৃত সাগরে পড়া মাত্র তা মরে যায়। মৃত সাগরের পানির আপেক্ষিক ঘনত্ব এত বেশি যে, হাত পা বেঁধে কোন প্রাণীকে ফেলে দিলেও ডোবা সম্ভব নয়। সাগরের প্রধান অংশে রয়েছে সোডিয়াম ক্ল্লোরাইড, ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম ক্ল্লোরাইড ও ম্যাগনেসিয়াম ব্রোমাইড। (Encyclopedia Encarta, Chapter-Dead Sea)
ঘটনাটি লূত (আ.) এর সময় সংঘটিত হয়। হযরত লূত (আ.) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত লূত (আ.)-কে সাদুম নামক শহরের সন্নিকটবর্তী এলাকায় নবী হিসেবে মনোনীত করেন। সাদুম ওই এলাকার রাজধানী ছিল। এলাকাটি ছিল প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক আকর্ষণীয়। এলাকার লোকজনের জীবন ছিল স্বাচ্ছন্দপূর্ণ, এলাকাবাসী এক পর্যায়ে অহংকারী, দুর্বিনীত ও অন্যায়কারী হয়ে উঠে। তারা বিভিন্ন ধরণের অন্যায়, নিন্দনীয় ও অশ্লীল কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। যৌন চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে তারা নারীদের পরিবর্তে পুরুষদের ব্যবহার করতে শুরু করে। দিন দিন সমকামিতার প্রবণতা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠে। তিনি বারেবারে এই গর্হিতকর্ম পরিত্যাগ করার উপদেশ প্রদান করেন। মেয়েদের বিয়ে করে স্বাভাবিক জীবন যাপনের তাগিদ দিতে থাকেন। কিন্ত তারা নবীর কথা শুনেনি। (তাফসীর ইবনে কসীর, ৪/৫৯-৬০)
কুরআনুল কারীমে অত্যন্ত চমৎকারভাবে এই ঘটনা বিধৃত হয়েছে, ‘আর আমি লূতকে পাঠিয়েছিলাম। সে তার সমপ্রদায়কে বলেছিল তোমরা এমন কুকর্ম করছ যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বেও কেউ করেনি। তোমরা তো কাম-তৃপ্তির জন্য নারী ছেড়ে পুরুষের নিকট গমন কর, তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী সমপ্রদায়।’ (আল-কুরআন, সূরা আল-আরাফ: ৮০-৮১)
মহানবী (সা.) বলেন, চার শ্রেণির মানুষ আছে যাদের সকাল হয় আল্লাহ তাআলার রাগান্বিত অবস্থায়, যাদের সন্ধ্যা হয় আল্লাহর অসন্তুষ্টির মধ্যে। (ক) যেসব পুরুষ পোষাকে ও শারীরিক গঠনে নারীর আকার ধারণ করে (খ) যেসব নারী পোষাকে ও শারীরিক গঠনে পুরুষের আকার ধারণ করে (গ) পশুর সাথে যারা যৌন সঙ্গম করে (ঘ) যারা বালকের সাথে সমকামিতায় লিপ্ত হয়। পুরুষ অপর পুরুষের সাথে যখন যৌনাচারে লিপ্ত হয় তখন আরশে কম্পন শুরু হয়; আসমান জমিনের ওপর ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়; ফেরেশতাগণ দৌঁড়ে এসে সূরা আল-ইখলাস জপতে জপতে আল্লাহ তাআলার সাহায্য কামনা করেন। যৌনকর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত এমন অবস্থা চলতে থাকে। (হাফিয শামসুদ্দিন যাহাবী, আল-কাবায়ের, পৃ. ৬৮)
কিশোর ও বালকদের চেহারা ও শরীরে দিকে যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে থাকানো, তাদের সাথে করমর্দন করা, স্পর্শ করা, ঘোরাফেরা করা, একান্তে সময় কাটানো এবং তাদের সাথে যৌনস্পৃহা চরিতার্থ করা হারাম। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.), শায়খ সুফিয়ান সাওরী (রহ.), শায়খ আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (রহ.) ও হাকিম আখতার (রহ.) এই ব্যাপারে কঠিন শব্দ উচ্চারণ করেন।
যথা সময়ে বিয়ে, তাওবা, তাকওয়া, খোদাভীতি ও বুযুর্গানে দীনের সান্নিধ্য সমকামিতার ভয়াবহতা থেকে আমরা বাঁচতে পারি। কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় আইন ও সামাজিক নিয়মকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকলেও খোদাভীতি, নৈতিকতা ও পরকালীন জবাবদিহিতা মানুষকে গর্হিত কাজ হতে বাধা দেয়।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন