ওলামায়ে কেরামের প্রতি খোলা চিঠি
মিযানুর রহমান জামীল
আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
হে জাতির জাগ্রত কর্ণধার
সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম!
মানুষ বরাবরই তার নিজের দিক পরিবর্তন করে চলেছে। একটি যন্ত্র প্রতিটি স্থানে সঠিক কেবলা নির্দেশ করছে। আমি এর ওপর আশ্বস্ত হলাম এবং তার নির্দেশ মোতাবেক নামাযও আদায় করলাম। এ ঘটনার দ্বারা আমার লজ্জাবোধও হলো আবার শিক্ষাও অর্জিত হলো যে, কেবলা নির্দেশক যন্ত্র কোন কিছুর পরোয়া করেনি, তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালনেও কোন প্রকার শিথিলতা প্রদর্শন করেনি। এতে আমার মনে হয় ওলামায়ে দীন প্রকৃত অর্থে দিকনির্ণয়ক যন্ত্রের মতো। তাদের মধ্যে এ যন্ত্রের মতো দৃঢ়তা আছে এবং থাকা আবশ্যক।
মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, ‘ওলামায়ে দীনের দায়িত্ব হলো তাওহীদের ব্যাপারে নিস্পৃহ ও পরিষ্কার কথা বলে দেওয়া, তবে তা হিকমতের সঙ্গে। কবি গালিবের এ কথার মতো যেন না হয়ে যায়, ‘বলে সে ভালো কথা কিন্তু মন্দভাবে।’ এ জন্য ভালো কথা ভালোভাবেই উপস্থাপন করা। কোন ফিতনার সূত্রপাত হলে ওলামায়ে কেরামের উচিত অধিক নম্র ভাষা ব্যবহার করা, হিকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বিকৃতি বা কোন প্রকার ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। এ কর্মপন্থা অবলম্বনের কারণেই আজ পর্যন্ত এই দীন অবিকৃতভাবে টিকে আছে, দুধ ও পানির মধ্যে কোন সংমিশ্রণ ঘটেনি। যার ধ্বংসের সাধ আছে সে সাধে ধ্বংসে পতিত হয়েছে, কিন্তু সে এর জন্য শরীয়ত ও শরীয়তের ধারকদের কোন অপবাদ দিতে পারবে না। গভীরভাবে অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে যদি ইতিহাস পাঠ করা হয় তাহলে জানা যাবে যে, এই উম্মতের মধ্যে এমন কোন যুগ অতিবাহিত হয়নি যে যুগে তারা সম্মিলিতভাবে কোনো গোমরাহির মধ্যে লিপ্ত হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে তো অনেকেই গোমরাহির শিকার হয়েছে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধভাবে গোটা উম্মাহ কোনদিন এমন পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়নি। হাদীস শরীফে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমার উম্মত সম্মিলিতভাবে কোন গোমরাহিতে স্থির থাকবে না।’ পক্ষান্তরে ইহুদি ধর্ম একদম শুরুর দিকেই বিকৃতির শিকার হয়েছে। এমনিভাবে খ্রিস্টবাদ তার শৈশবে ও সূচনা পর্বেই বিচ্যুতির যে ধারায় নিপতিত হয়েছিল সেখান থেকে শত শত বছর অতিবাহিত করে বর্তমান অবস্থায় এসে উপনিত হয়েছে। এজন্য কুরআন মজীদে নাসারাদের ‘দোয়াল্লীন’ শব্দে অভিহিত করেছে। তারা যেদিকেই চলবে বিভ্রান্ত হয়ে অন্য পথে ছিটকে পড়বে।’
সত্যের অতন্দ্র প্রহরী
শ্রদ্ধেয় ওলামায়ে বাংলাদেশ!
নদভী (রহ.) আরও বলেন, ‘ওলামায়ে কেরামের দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, তারা মুসলমানদেরকে জীবনের বাস্তবতা, রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তন এবং চাহিদা সম্পর্কে সচেতন করবে। তাদের চেষ্টা থাকবে মুসলিম সমাজের সম্পর্ক জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। কারণ দীন ও মুসলমানদের সম্পর্ক যদি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর খেয়ালি দুনিয়ায় জীবনযাপন করতে থাকে তাহলে দীনের আওয়াজ প্রভাবহীন হয়ে যাবে, তারা দাওয়াত ও ইসলাহের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারবে না। শুধু তাই নয়, দীনের ধারকদের এ রাজ্যে বসবাস করা মুশকিল হয়ে যাবে। ইতিহাস আমাদেরকে জানান দেয়, যেখানে ওলামায়ে কেরাম সবকিছু করছে কিন্তু জীবনের নিগূঢ় বাস্তবতা সম্পর্কে উম্মতকে সম্যক অবগত করেনি, এই পরিপার্শ্বে তাকে তার দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দেয়নি, একজন যোগ্য নাগরিক ও নেতৃত্বদানের যোগ্যতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়নি, সেখানে সেই রাষ্ট্র তাদেরকে এমনভাবে উগরে ফেলেছে যেমনভাবে অবৈধ লোকমা মুখ থেকে উগরে ফেলা হয়। কারণ তারা তাদের নিজস্ব অবস্থান বানিয়ে নিতে পারেনি। বর্তমান বিশ্বের মুসলমানেরা অভিজ্ঞ ও বাস্তবতাপ্রিয় নেতৃত্বের বড়ই মুখাপেক্ষী।
আপনি যদি মুসলিমদেরকে নিয়মিত তাহাজ্জুদগোজার বানান, সবাইকে মুত্তাকী-পরহেজগার বানিয়ে দেন কিন্তু পরিপার্শ্বের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক না থাকে, তারা জানে না রাষ্ট্র কোন দিকে যাচ্ছে; রাষ্ট্র অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, দুশ্চরিত্র ও অনৈতিকতার তুফান মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হচ্ছে-তাহলে ইতিহাস সাক্ষী, তখন শুধু তাহাজ্জুদ নয় পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করাও মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। যদি আপনি এই প্রতিবেশে দীনদারদের স্থান তৈরি না করেন, এমন একনিষ্ঠ যোগ্য নাগরিক তৈরি না করেন যারা রাষ্ট্রকে অসৎ পথ থেকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা ও সাধনা চালিয়ে যাবে, তাহলে স্মরণ রাখুন! ইবাদত ও দীনের নির্দেশসমূহ তো বিচ্ছিন্ন হবেই, এমন পরিস্থিতিও আসতে পারে মসজিদসমূহ টিকিয়ে রাখাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।’ যেমনি হয়েছিল স্পেনে।
মানবতার দিশারী
প্রিয় ওলামায়ে ইসলাম!
স্পেনের আগের নাম ছিল উন্দুলুস। পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী তার উন্দুলুস মে ছান্দ রোজ (স্পেনে কয়দিন) গ্রন্থেটিতে লিখেন, স্পেনে আমি যখন গাড়ি নিয়ে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চল অতিবাহিত হচ্ছি তখন ভেতরে ভেতরে, চূড়ায় চূড়ায়, পাহাড়ের পাদদেশে মসজিদের মতো সুন্দর সুন্দর মিনার দেখতে পাই। তাদের জিজ্ঞেস করলাম এখানে এতো মসজিদ! তারা উত্তর দিল, না হযরত! এগুলো এক সময় মসজিদ ছিল। এখন প্রতিটি মিনার এক একটি গির্জা। তিনি আরও বলেন, যে স্পেনের মাটিতে হাজার হাজার আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও মুসলিম বিজ্ঞানী ছিল সে স্পেনের মাটিতে বিমান থেকে নেমে যখন নামাযের জন্য বিমান বন্দরের এক কোনে দাঁড়ালাম তখন এয়ারপোর্টের সকল কর্মকর্তা অবাক হয়ে বলল, এ লোক এটা কী করছে? আফসোস! তারা জানেনা এটা যে মুসলমানদের নামায। অথচ একসময় আযানের সুরে দৈনিক পাঁচবার এ স্পেনের মাটি আন্দলিত হতো।
ইসলামি জাগরণের সম্মানিত আলেম সমাজ! তাই অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি। বাংলাদেশের মধ্যে শিক্ষা সংস্কৃতি আর সেবার নামে এমন একটি তুফান শুরু হয়েছে যার স্রোত আমাদের নিয়ে যেতে পারে এমন একটি গন্তব্যের দিকে যার শিকড় মধ্যপ্রাচ্যে মাথা তিব্বত মালভূমিতে। হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিসবাহ (রহ.) বলেছেন, যারা আমাদের অস্তিত্ব দেখতে নারাজ, তারা আবার আমাদের সেবা করবে! এ জন্য আলেমদের একটি সচেতন কাফেলা থাকা চাই যারা সর্বদা তীক্ষ্ম মেধার মাধ্যমে গোমরাহি আর ধর্মান্তরের তুফান থেকে রাডারের মতো নিয়ন্ত্রণ করবে গোটা জাতিকে। বেরিয়ে পড়বে বিশেষ একটি দাওয়াতের পয়গাম নিয়ে।
সম্পাদক, কলমসৈনিক, সহকারী সম্পাদক, মাসিক আর রাশাদ