জামেয়া ওয়েবসাইট

মঙ্গলবার-১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি-৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আফগানিস্তানে তালিবান আবার ফিরে আসছে!

আফগানিস্তানে তালিবান আবার ফিরে আসছে!

আফগানিস্তানে তালিবান আবার ফিরে আসছে!

ড. খালিদ হোসেন

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের তালেবানের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও সফলতা অর্জন করতে পারল না। গত ৫ সেপ্টেম্বর কাবুলের কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত কুটনৈতিক পাড়ায় গাড়িবোমা হামলায় একজন মার্কিন সেনাসহ ১২ জন প্রাণহানির ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শান্তি আলোচনা বাতিলের ঘোষণা দেন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে চুক্তি বাতিলের এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। যে কোন সময় আলাপ আলোচনা আবার শুরু হতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও’র কথায়ও এটা বুঝা যায়। তালিবান প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানিয়েছে ‘শান্তি আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুন্ন হবে, তাদের শান্তিবিরোধী অবস্থান বিশ্বের কাছে প্রকাশ পাবে, জীবন ও সম্পদহানি বৃদ্ধি পাবে।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শান্তি আলোচনা বাতিল করে কোন দূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ন্যাটোবাহিনী সমঝোতা চুক্তির পক্ষে। তালিবান যে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছে। অপরদিকে তালিবানরা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সমঝোতা চুক্তি না হলেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তাদের বেগ পেতে হবে না।

আসল কথা হলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে আন্তর্জাতিক জোটের প্রায় সাড়ে তিন হাজার সদস্যের প্রাণের বিনিময়েও আফগানিস্তানকে দখলে রাখা যাচ্ছে না। আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশ এলাকা তালিবানের নিয়ন্ত্রণে। জোটের অবস্থা এখন ‘ছেড়ে দেয় মা কেঁদে বাঁচি।’ সম্ভাব্য চুক্তির মূলনীতি হিসেবে ২০ সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ হাজার ৪০০ সেনা প্রত্যাহার করে নেবে এবং পাঁচটি ঘাঁটি ১৩৫ দিনের মধ্যে ছেড়ে দেবে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের নিযুক্ত আফগান বিষয়ক দূত জালমে খলিলজাদ ওই চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন। দীর্ঘ ১৮ বছরের যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে ২০১৮ সাল থেকে কাতারের রাজধানী দোহায় মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে ধারাবাহিক আলোচনা শুরু করেন তালেবান কর্মকর্তারা। গত সপ্তাহে সেখানে দুই পক্ষের নবম ধাপের আলোচনা শেষ হয়। এর আগে পাকিস্তানেও বৈঠক হয়েছে। ন্যাটো এই সমঝোতাকে স্বাগত জানায়। যুক্তরাষ্ট্র পর্যায়ক্রমে আফগানিস্তান থেকে প্রায় ১৪ হাজার পরিশ্রান্ত সেনাসদস্যকে স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী।

তালিবান যোদ্ধারা আলোচনা, সমঝোতা ও চুক্তির পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধও অব্যাহত রেখেছে। ওদিকে, খলিলজাদের এ সাক্ষাৎকার প্রচারের পরপরই আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের বিদেশি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য ব্যবহৃত একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে তালেবানের গাড়ি বোমা হামলায় অন্তত ১৬ জন নিহত হয়। আহত হয় শতাধিক মানুষ। কাবুলের দারুণ সুরক্ষিত ‘গ্রিন জোনের’ খুব কাছেই ওই হাউজিং কমপ্লেক্সের অবস্থান। এটা ছিল রাজধানীতে তালিবানদের শক্তির মহড়া।

২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন শুরুর পর আন্তর্জাতিক জোটের প্রায় সাড়ে তিন হাজার সদস্য নিহত হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্যই রয়েছে প্রায় দুই হাজার ৩০০ জন। তবে আফগানিস্তানের বেসামরিক, তালেবান ও সরকারি সেনার সংখ্যা নির্দিষ্ট করা কঠিন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসঙ্ঘের এক রিপোর্টে বলা হয় আফগান যুদ্ধে ৩২ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউট জানায়, এই যুদ্ধে ৫৮ হাজার নিরাপত্তা সদস্য ও প্রায় ৪২ হাজার বিদ্রোহী সেনা নিহত হয়েছে (নয়া দিগন্ত, সেপ্টেম্বর ২০১৯)।

১৮ বছর যাবত ন্যাটো ও মার্কিন সেনাবাহিনীর মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ, অব্যাহত তল্লাশি ও সাঁড়াশি অভিযান সত্ত্বেও আফগানিস্তানের শহরে-পাহাড়ে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তালিবান যোদ্ধারা সংগঠিত হচ্ছে। আগ্রাসী বাহিনী ও তাবেদার সরকারের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের আফগান জনগণ প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাবুল, কান্দাহার, গারদেজ, হেলমন্দ, লোগার, জালালাবাদ, খোস্ত, পাকতিয়া, জাবেল, ও কোনাড়সহ ৩৫টি প্রদেশে জোট বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র গেরিলা অভিযান তীব্রতর হয়েছে। তদমধ্যে ১৩টি প্রদেশের বিদেশি সৈন্যরা যুদ্ধ না করে ঘরে ফিরতে আগ্রহী। শহরে গ্রামে সর্বত্র তালিবানদের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীও সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের পক্ষে তালিবানদের ভয়ে নির্বিঘ্নে চলা-ফেরাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক অজানা আতঙ্ক ও মৃত্যুভীতি তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে সর্বক্ষণ।

আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমে কান্দাহার প্রদেশে ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হওয়ার সাত বছর পর ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন মদদপুষ্ট বাহিনীর ভয়ঙ্কর সামরিক অভিযানের ফলে তালিবান আন্দোলন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মার্কিন বাহিনী পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণাপুষ্ট হামিদ কারজায়ীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মসনদে বসালেও ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রণ করে তারাই। জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় জার্মানীর বনে অনুষ্ঠিত আন্ত:আফগান সম্মেলনে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার দলীল চুড়ান্ত হয়। সামরিক কর্মকর্তা ও সমর বিশ্লেষকগণ এই মর্মে প্রচারণায় নেমে পড়েন যে, ‘তালিবানের মৃত্যু হয়েছে।’ কিন্তু বিগত ১৮ বছরের ঘটনা প্রবাহ, গেরিলা অভিযান ও আত্মঘাতী বোমা হামলার ফলে এ কথা প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত যে, তালিবানের মৃত্যু হয়নি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের বিজয় উল্লাস ধীরে ধীরে কর্পুরের মতো উবে যাচ্ছে। ‘তালিবান হারিয়ে যাওয়া শক্তি’ এ মুহূর্তে এমনতর মন্তব্য করা বালখিল্যের নামান্তর। বিশাল আফগানিস্তানের বহু পার্বত্য উপত্যকায় এখন তালিবান শাসন চলছে। নিত্য নতুন ভূখণ্ড তাদের দখলে আসছে। সম্প্রতি তালিবানরা কাবুলের প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গজনী প্রদেশের আজরিস্তান জেলা সদর কামান ও রকেটের সাহায্যে দখল করে নেয়। ক্ষিপ্র ও প্রচণ্ড হামলার মুখে সরকারী পুলিশ ও সেনাবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

মূলত পরিবর্তিত পরিস্থিতির বাস্তবতা এবং মার্কিন ও তার মিত্র বাহিনীর আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমরাস্ত্রের প্রত্যক্ষ মোকাবেলায় না গিয়ে সাময়িক পশ্চাদপসরণকে তালিবানরা কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেন। এ কৌশল তালিবানদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং সুবিধাজনক সময়ে বিক্ষিপ্ত শক্তিকে পুনর্গঠিত করতে প্রভূত সাহায্য করে। দখলদার মার্কিন আক্রমণে তালিবানরা নিশ্চিহ্ন হয়নি। কয়েকহাজার যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন মাত্র। সংগ্রামরত যুদ্ধৃগণের বৃহত্তর অংশ টিকে রয়েছে এবং তাঁরা আফগান জনগণের মূল স্রোতধারার সাথে মিশে গেছেন। বহু তালিবান যোদ্ধা বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকার আফগান-পাকিস্তানের ২,৫০০ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে সহানুভূতিশীল পশতুন জনগোষ্ঠীর আশ্রয়প্রাপ্ত হন।

২০০২ সালের শুরুর দিকে তালিবান যোদ্ধারা কান্দাহার, হেলমন্দ ও জাবুল অঞ্চল হতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে বিভক্ত হয়ে গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। বহু ক্ষেত্রে তাঁরা সফল হন। ২০০৩-২০০৫ সালে তালিবানরা আত্মঘাতী বোমা হামলাকে সমর কৌশল হিসেবে অগ্রাধিকার প্রদান করেন। তালিবানদের মূল শিকড় আফগানিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত। সাধারণ জনগণের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তাঁরা আবার পুণর্গঠিত হওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন। তাঁদের পুণরুত্থানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ক্রিয়াশীল।

প্রথমত: মোল্লা ওমর ছিলেন আফগানিস্তানের ‘আমিরুল মুমিনীন’ বা সরকার প্রধান। তাঁর ইন্তেকালের পর উচ্চ পর্যায়ের বেশ ক’জন নেতা সাহসিকতার সাথে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়ায় তালিবান যোদ্ধাদের আস্থা, বিশ্বাস ও মনোবল বৃদ্ধি পায়। তালিবান যোদ্ধৃগণ চলমান পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে নির্দেশনা কাঠামো (Command Structure) পুনর্গঠিত করেন।

দ্বিতীয়ত: কারজায়ী ও আশরাফ গনির সরকারের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকর্তা এবং সমর নেতাদের বাড়াবাড়ির ফলে জনসমর্থন হ্রাস পেতে চলেছে।

তৃতীয়ত: চুরি, ডাকাতি, রাহাজানী, ছিনতাই ও সন্ত্রাস আফগানিস্তানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি জনগণকে হতাশায় ঠেলে দেয়। মানুষ আবার তালিবান শাসনামলের ‘নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা’ ফিরে পাবার জন্য আকুলি বিকুলি করছে।

চতুর্থত: যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোয়ালিশন বাহিনীর শক্তিশালী সমর কৌশল বিশেষত বিদ্রোহ দমনের নামে বেসামরিক এলাকায় নির্বিচারে ব্যাপক বিধ্বংসী বোমাবর্ষণ, হত্যাকাণ্ড, অপহরণ ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধারণ জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলছে।

পঞ্চমত: বিগত ১৮ বছর ধরে অন্তরবর্তীকালীন কারজায়ী-আশরাফ গনি সরকার আফগান জনগণের প্রতি যেসব ওয়াদা করে আসছে তার অধিকাংশও তাদের পক্ষে পূরণ সম্ভব হয়নি। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর উর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সাধারণ মানুষকে হতাশ করে দেয়। তাঁরা বিকল্প হিসেবে তালিবানদের পছন্দ করছেন।

প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারের জনসমর্থন ক্রমশ হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও তাঁরা আফগানিস্তানে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে চলেছে। কেবল অস্ত্রই তাঁদের শক্তি। এ কথা ঐতিহাসিক সত্য যে, আফগান জাতিকে স্থায়ীভাবে কেউ পরাজিত করতে পারেনি। আফগানিস্তান বড্ড দুর্ভেদ্য, আফগানরা এতই দুর্দমনীয় যে তাদের পদানত করা সাধ্যের বাইরে। আফগানিস্তানের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং দেশবাসীর প্রকৃতি ও রণকৌশল আলাদা। আফগান যুদ্ধফেরত জেনারেল রুসলান আউসেভ বলেন, ‘আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন বাহিনীকে রীতিমত নাকানী চুবানি খেতে হবে।’ আলেকজান্ডার দি গ্রেট, মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে আফগানিস্তান পদানত করতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের প্রত্যেককে লজ্জাজনক পরাভব মেনে নিতে হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত নেতা গর্ভাচেভের ভাষায় আফগানিস্তান হচ্ছে ‘রক্তাক্ত ক্ষত’ এবং শত বছর আগে একজন ব্রিটিশ ভাইসরয় মন্তব্য করেন আফগানিস্তান হচ্ছে ‘বিষাক্ত পানপাত্র’। East India Company-এর ব্রিটিশ রেজিমেন্টের জেনারেল এলফিনষ্টোনের অধীন ১৬ হাজার সৈন্যের লাশ রয়েছে আফগানিস্তানের মাটিতে। গিরিসঙ্কট ও পার্বত্য এলাকায় খোজাখুঁজি করলে এসব সৈন্যের হাড় গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া যাবে।

১৯৭৯-১৯৮৯ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন ১ লাখ ৪০ হাজার সেনাসদস্য নিয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা করে। পাহাড়ে-পর্বতে এবং গুরুত্বপূর্ণ Strategic Point-এ এক কোটি শক্তিশালী মাইন পুঁতে রাখে এবং ১৫ লাখ আফগান জনগণকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। এত কিছু করেও কমপক্ষে ১৫ হাজার সৈন্যের লাশ ফেলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়। ঠিক তদ্রুপ অথবা তার চাইতেও অধিক সংখ্যক সৈন্যের লাশ ফেলে মার্কিনীদেরও আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হতে পারে সময় বলে দেবে। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। স্বদেশি প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের সাথে ভাড়াটিয়া ও হানাদার বাহিনী বেশি দিন টিকতে পারেনি এবং পারে না ইতিহাসে এর প্রমাণ একটি নয় বহু। একটানা ১০ বছর বোমা বর্ষণ করে ৫০ হাজার মার্কিন সৈন্যের লাশের বিনিময়েও ভিয়েতনামকে পরাজিত করা আমেরিকার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ তিক্তস্মৃতি নিশ্চয় আফগানিস্তানে মার্কিনীদের ধাওয়া করছে। আফগানিস্তানেও ভিয়েতনামের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে- ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরা তো তাই বলে। পুরো একটি জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কেউ বিজয় বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। বর্তমানে তালিবান যোদ্ধাদের নিষ্ক্রিয় তথা পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে আফগান ন্যাশনাল পুলিশ বাহিনী, আফগান ন্যাশনাল সেনা বাহিনী এবং ৪৮ হাজার বিদেশি সৈন্য সহ এক লাখ সশস্ত্র সদস্য বিভিন্ন ফ্রন্টে সক্রিয় রয়েছে। তালিবান আক্রমণ হতে সরকারপন্থী গ্রাম্য সর্দারদের রক্ষার জন্য বিপুল সংখ্যক মিলিশিয়া তৎপর।

বর্তমান আফগান সরকার তালিবানদের সাথে আপোষ-মীমাংসায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তালিবান নেতাদের সাথে সমঝোতা করার বারবার প্রস্তাব দিচ্ছেন কিন্তু স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাগণ অনির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বহীন সরকারের সাথে কোন আলোচনায় রাজী হচ্ছেন না। আপোষ-মীমাংসা, আলোচনা ও সাধারণ ক্ষমার উদ্যোগ এখন পর্যন্ত কোন কার্যকর ফল বয়ে আনেনি। বিপুল সংখ্যক তালিবান যুদ্ধের মাধ্যমে দখলদার বাহিনীর অবসান ও বিজয় ছিনিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজায়ী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি সরকারকে সামনে রেখে আফগানিস্তানের হাজার বছরের লালিত উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তন করে ইউরোপীয় সভ্যতা ও নগ্নতার বিকাশ ঘটানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। পপির চাষ আবার শুরু হয়েছে পুরোদমে। পপি চাষ ও মাদক উৎপাদনের দিক দিয়ে আফগানিস্তান এখন শীর্ষে। ক্যাসিনো, নাইট ক্লাব ও মদের আসর বসছে নিয়মিত। ২৫০ চ্যানেলবিশিষ্ট ডিস পাওয়া যায় মাত্র ১০ হাজার টাকায়। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে মার্কিন সৈন্যরা যে দেশে ঢুকেছে যিনা ও ব্যভিচারের প্রচলন হয়েছে উদ্বেগজনক হারে। আফগানিস্তান সত্যিকার অর্থে আফগান জনগণ দ্বারা শাসিত হোক এবং আফগানিস্তানের মাটি আগ্রাসী বাহিনীর দখলমুক্ত হোক এটাই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আকুল কামনা।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গনি এমইএস ডিগ্রি কলেজ,

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ