জামেয়া ওয়েবসাইট

সোমবার-৯ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রাচীনকালের সিলেটি কয়েকজন আলেম লেখক

প্রাচীনকালের সিলেটি কয়েকজন আলেম লেখক

প্রাচীনকালের সিলেটি কয়েকজন আলেম লেখক

মাহফুয আহমদ

 

ইতিহাস মানুষকে সাহস যোগায়, প্রেরণা দেয়। আমাদের সমস্যা হলে, আমরা নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সংরক্ষণ করি না। সেগুলো স্মরণ রাখি না। সিলেটে অনেক প্রথিতযশা প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ আলেমের জন্ম হয়ে ছিল; যাদের সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম খুব কমই জানে। জানার তেমন কোনো ব্যবস্থাও নেই। কেননা পূর্ববর্তী ওই মনীষীদের কথা আমরা সেভাবেচর্চা করি না। অথচ এব্যাপারে আমাদেরকে আরও সতর্ক ও সচেতন হওয়া সময়ের দাবি। আজকের সংক্ষিপ্ত এই নিবন্ধে মাত্র কয়েকজন আলেমের উপাখ্যান পেশ করা হলো; যাদের রচিত গ্রন্থ শুধু বাংলা বা বঙ্গদেশেই নয়, ভারত উপমহাদেশ ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আরব-তুরস্ক পর্যন্ত যেগুলোর সংবাদ পৌঁছেছিলো। বরং চর্চিত ও পর্যালোচিত হচ্ছিলো। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, তাঁদের সম্পর্কে সরেজমিন থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলত বিভিন্ন বইয়ের উদ্ধৃতিতে কিছু বিক্ষিপ্ত তথ্য পেশ করা হলো। আল্লাহ চাহে তো এই লেখা প্রকাশের পর বিভিন্ন মহল থেকে আরও তথ্য সামনে এসে যেতে পারে। তবে স্মর্তব্য যে, দেশভাগের পূর্বে একটি বৃহৎ অঞ্চলকে সিলেট বলা হতো। দেশভাগের পর কিছু অংশ ভারতের অধীনে থেকে যায় আর বাকি অংশ বাংলাদেশের অধীনে সিলেট জেলা ও বিভাগ নামে পরিচিতি লাভ করে। সুতরাং আমাদের আলোচ্য ব্যক্তিগণ ওই বৃহত্তর সিলেটের যেমন হতে পারেন, তেমনি বর্তমান সিলেটের হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া উভয়ক্ষেত্রে একথা তো বলাই যায়, তারা ছিলেন সিলেটি। ইতিহাসবিদগণ সিলেটি নামেই তাঁদেরকে উল্লেখ করেছেন।

এক. আবদুল আলিম সিলেটি

গতদিন একটি কিতাব খুঁজতে গিয়ে অনলাইন সার্চ করলাম। কিং সাউদ ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে তা পেয়ে গেলাম। পাশাপাশি সন্ধান পেলাম দুর্লভ একটি আরবি বইয়ের। অবাক করার মতো বিষয় হলো, বইটির লেখকের নামের সঙ্গে ‘সিলেটি’ শব্দটিও সংযুক্ত! তা দেখে কৌতূহল বেড়ে গেলো। ডাউনলোড করে নিলাম বইটির পিডিএফ ভার্সন। অভিনিবেশ সহকারে একই বৈঠকে পড়ে ফেললাম পুরো বই। পড়ার সময় রীতিমতো প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য নোট করে রাখলাম। সেই নোটগুলোর আলোকে পাঠকদের সামনে বইও লেখকের সামান্য চিত্র তুলে ধরা হলো।

লেখক পরিচিতি: বইটি যে সিলেটি একজন আলেম লিখেছেন, তা তো একেবারে স্পষ্ট। তাঁর নাম: আবদুল আলিম। উপনাম: আবুল কাসিম। উপাধি: ইনআমুদ্দীন। তাঁর পিতাও একজন আলেম ছিলেন। পিতার নাম: শায়খ মাখদুম মুহাম্মদ হাদি। লেখক নিজের এবং পিতার নামের সঙ্গে ‘সিলেটি’ শব্দটি সযত্নে যুক্ত করেছেন। এ থেকে প্রতিভাত হয় যে, তাঁরা ছিলেন সিলেটের অধিবাসী। তবে সিলেটের ঠিক কোন অঞ্চলে ছিল তাঁদের বসবাস তা নিশ্চিতভাবে এখনই বলা যাচ্ছে না। তবেএরও আগে আমাদের বের করতে হবে, লেখক যে সিলেটের কথা উল্লেখ করেছেন সেটা স্বাধীন বাংলাদেশের সিলেটই কিনা? না এটি দেশভাগের পূর্বেকার বৃহত্তর সিলেট; যার পরিব্যাপ্তি ছিলো আসাম পর্যন্ত? বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক সূত্র থেকে বোধগম্য যে, সেটি বর্তমান সিলেট বিভাগ নয়, বরং প্রাচীনকালের সেই বৃহত্তর সিলেটের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে।

লেখকের জন্ম কিংবা মৃত্যুর তারিখ উল্লিখিত হয়নি এবং আপাতত তা বের করা যায়নি। তবে লেখক নিজ গ্রন্থে তাঁর সমকালীন যেসব ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন তা থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায় মাত্র। বলা যায়, তিনি ছিলেন তের শত শতাব্দী হিজরীর একজন আলেম। এই তথ্য বের করা যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে। যেমন- বইটি প্রকাশিত হয়েছে লেখকের জীবদ্দশায়। ছাপা হয় ১২৮৫ হিজরী সনে। অন্যদিকে লেখক তাঁর বইটি উৎসর্গ করেছেন তৎকালীন স্থানীয় রাজার নামে। রাজা ছিলেন নবাব তুরাব আলী খান সালার জং। এ নবাব হায়দারাবাদ ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজ্যপ্রধান ছিলেন ত্রিশ বছর মেয়াদের জন্য, ১৮৫৩ থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত। তার জন্ম হয় ১৮২৯ সালে ১৮৮৩ সালে তার মৃত্যু হয়।

উল্লেখ্য যে, আল্লামা আবদুল হাই লাখনবী  (রহ.)ও তাঁর একাধিক গ্রন্থ এ নবাবের নামেই উৎসর্গ করেছিলেন। যেমন- مقدمة الهداية ও مقدمة الرياعة প্রভৃতি আরবি গ্রন্থ। আর লাখনবী বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৯ বছর। তাঁর জন্ম হয় ১২৬৪ হিজরী সনে এবং ১৩০৪ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। সুতরাং আমাদের আলোচ্য বইয়ের লেখক ওই সময়কার একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন, অনায়াসেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আলোচিত এ গ্রন্থটি ছাড়াও লেখক আবদুল আলিম সিলেটি আরও কয়েকটি গ্রন্থ সংকলন করেছেন। কেননা আমার পঠিত বইয়ে তিনি স্বরচিত দুটি বইয়েরও উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এক. طغرىٰ في شرح الصغرىٰ, দুই. مقدمة العلوم في تحقيق المبادئ لزاكيات الفهوم|

গ্রন্থপরিচিতি

লেখক স্বীয় গ্রন্থের নাম দিয়েছেন, تمزيق الضلالة بتحقيق الهداية| মাঝারি সাইজের ৪২ পৃষ্ঠার এ বইটি ছেপেছে আল-মাতবাউন নাবাওয়ী। প্রথম ছাপা হয় ১২৮৫ হিজরীতে। নাম থেকেই বইয়ের বিষয়বস্তু অনুমেয়। হিদায়াযালালা বা সঠিক পথপ্রদর্শন এবং পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে বইটি রচিত। একটি ভূমিকা এবং দুটি অনুচ্ছেদে তিনি বইটি সাজিয়েছেন। এতে লেখক বিশদভাবে তুলে ধরেছেন হিদায়াযালালার অর্থ, ভাবার্থ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। সঠিক পথ লাভের উপকরণ এবং গুমরাহি বা পথভ্রষ্টতার কারণ ইত্যাকার কতগুলো পয়েন্ট সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর বিবরণে। এক্ষেত্রে লেখক কুরআন, হাদীস ও পূর্ববর্তী মনীষীদের লেখা গ্রন্থাদি থেকে প্রচুর উদ্ধৃতিও পেশ করেছেন।

ছোট্ট কলেবরের এই আরবি বইয়ের মাঝেমধ্যে একাধিক জায়গায় পার্শ্বটীকাও রয়েছে। সেগুলোর বেশিরভাগই স্বয়ং লেখক কর্তৃক সংযোজিত। আর কিছু জায়গায় টীকা লিখেছেন মুহাম্মদ শাহ হায়দারাবাদী নামীয় একজন আলেম। বইয়ে কয়েক স্থানে ফারসি শব্দ ও বাক্য চোখে পড়েছে। কখনো ফারসি কবিতাও উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ লেখক সমকালীন অপরাপর আলেমদের মত ও অভিমতের দালিলিক খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। আকায়েদ বিষয়ে তুলে ধরেছেন আশআরী ও মাতুরীদী আলেমগণের মত ও মতানৈক্য। উদ্ধৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাফতাযানীর শরহুল আকায়িদের নাম এসেছে একাধিক জায়গায়।

বইয়ের শেষদিকে প্রকাশকের কথাও রয়েছে। সেখানে প্রকাশক নিজের নাম লিখেছেন গোলাম নবী খান। শেষ কথায় এবং বইয়ের ফ্রন্ট কাভারে লেখকের সঙ্গে বেশ কয়েকটি অভিধা যোগ করা হয়েছে। যেমন- অনুসন্ধানী আলেম, সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞানী, ঐশীজ্ঞান এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের এক আঁধার, আলহাজ, আল্লামা, তরুণ বয়সেই ওয়ায, পাঠদান ও লেখালেখির ময়দানে খ্যাতি অর্জনকারী ইত্যাদি। আর বই সম্পর্কে বলা হয়েছে, কলেবর ছোট হলেও এটি একটি দুর্লভ, চমৎকার ও উপকারী গ্রন্থ।

লক্ষণীয় যে, লেখক তাঁর বইয়ে রচনার পুরনো রীতি অবলম্বন করেছেন। সে অনুযায়ী তিনি চেষ্টা করেছেন আরবি বাক্যগুলোর ছন্দমিল রক্ষা করতে। যদিও তা না করাই শ্রেয় ছিলো। মজার ব্যাপার হলো, লেখক আরবিতে মাশায়েখ শব্দটি শুদ্ধভাবে লিখেছেন। সাধারণত ওই সময়কার আলেমগণ শব্দটাকে ইয়া (مشايخ)-এর পরিবর্তে হামযা (مشائخ) দিয়ে লিখতেন; যা আরবি ব্যাকরণের দৃষ্টিতে ভুল! শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) যখন আল্লামা আবদুল হাই লাখনবী (রহ.)-এর الرفع والتكميل في الجرح والتعديل গ্রন্থের ওপর তা’লীক বা টীকা লিখেন, তখন এ বিষয়ের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। (দেখুন: পৃ. ৪৮)

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) তাঁর সময়কার আরেকজন সিলেটি আলেমের একটি আরবি কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। পাকিস্তানের আল্লামা আবদুর রশীদ নু’মানী (রহ.) কৃত الإمام ابن ماجه وكتابه السنن গ্রন্থের শেষদিকে (পৃ. ৩৯১) শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ একটি পরিশিষ্ট বৃদ্ধি করেছেন। সেখানে তিনি حوار مع الألباني   নামক একটি আরবি গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়েছেন। বইটির লেখকের নাম উল্লেখ করেছেন এভাবে, শায়খ শামিম মুহাম্মদ বাংলাদেশি সিলেটি। তিনি সিলেটি আলেমের লেখা এ গ্রন্থটির প্রশংসা করেছেন। অবশ্য বইটি তখনও পাণ্ডুলিপি আকারে ছিলো; শায়খ সেদিকেও ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু খোঁজ-খবর নিয়ে এখনো সেই শায়খ শামিম মুহাম্মদ সিলেটি সম্পর্কেও তেমন কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি!

দুই. আবদুল কাদির সিলেটি

বেশ কয়েকটি আরবি বইয়ে সিলেটি এ আলেম লেখকের আলোচনা এসেছে। সেসবের আলোকে তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য পেশ করা হলো।

আবদুল কাদির তাঁর নাম। পিতার নাম: মুহাম্মদ ইদরীস। বংশ পরম্পরা এভাবে বলা হয়েছে: আবদুল কাদির ইবনে মুহাম্মদ ইদরীস ইবনে মুহাম্মদ মাহমুদ ইবনে মুহাম্মদ কালিম। তাঁদের বংশসূত্র হযরত ওমর (রাযি.) পর্যন্ত পৌঁছে; এজন্য তাঁকে আল-উমরী বলা হয়। ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি হানাফী মাযহাব অনুসরণ করতেন বিধায় তাঁকে আল-হানাফী বলা হয়। আর জন্মসূত্রে সিলেটের বাসিন্দা ছিলেন হিসেবে তাঁকে সিলেটি বলা হয়।

ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত আরবি ইতিহাসবেত্তা আল্লামা আবদুল হাই আল-হাসানী (আল্লামা আবুল হাসান আলী নদবীর পিতা) বলেন,

الشيخ الفاضل: عبد القادر بن محمد إدريس بن محمد محمود بن محمد كليم العمري الحنفي السلهتي، أحد العلماء المشهورين بأرض بنغاله، ولد ونشأ ببلدة سلهت – بكسر السين المهملة وسكون اللام، آخرها تاء معجمة -، قرأ العلم على المولوي رمضان الله تلميذ القاضي فضل الرحمٰن، ثم تصدر للدرس والإفادة. له مصنفات كثيرة في الفقه والعقائد، منها: «الدر الأزهر في شرح الفقه الأكبر»، و«الفوائد القادرية في شرح العقائد النسفية»، و«الرد المعقول على النهج المقبول»، و«الجوامع القادرية».

‘বিশিষ্ট শায়খ আবদুল কাদির ছিলেন বাংলার প্রসিদ্ধ আলেমদের একজন। সিলেটে তাঁর জন্ম হয় এবং সেখানেতিনি বেড়ে ওঠেন। (এখানে লেখক আবদুল হাই আল-হাসানী সিলেট নামটিকে আরবিতে কীভাবে পড়া উচিত তাও লিখে দিয়েছেন।) মৌলবী রমযানুল্লাহর নিকট তিনি শিক্ষার্জন শুরু করেন। রমযানুল্লাহ ছিলেন কাযী ফযলুর রহমানের শিষ্য। লেখাপড়া সমাপ্তির পর তিনি পাঠদান এবং ফতওয়া প্রদানের কাজে ব্রত হন। ফিকহ আকায়িদ বিষয়ে তিনি প্রচুর বই লিখেছেন। যেমন- আদ-দুররুল আযহার ফী শারহিল ফিকহিল আকবার, আল-ফাওয়ায়িদুল কাদিরিয়া ফী শারহিল আকায়িদিন নাসাফিয়া, আর-রদ্দুল মা’কুল আলান নাহজিল মাকবুল, আল-জাওয়ামিউল কাদিরিয়া প্রভৃতি।[1]

উপর্যুক্ত অংশের টীকায় আল্লামা আবুল হাসান আলী নদবী (রহ.) বলেন, সিলেটি এ আলেমের মৃত্যু তারিখ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আমাদের নিকট পৌঁছায়নি।[2]

সাইয়েদ আবদুল হাই আল-হাসানী অন্যত্র এ সিলেটি আলেমের লেখা কিতাবগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেন। সেখান থেকে বোঝা যায়, কিতাবগুলো লেখক আরবিতে রচনা করেছিলেন।[3]

ঐতিহাসিকআল-হাসানীর সূত্রধরে বয়রুত ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. ইউসুফ আল-মারা’শালী শায়খ আবদুল কাদির সিলেটির জীবনী আলোচনা করেছেন। চৌদ্দশত শতাব্দী হিজারীর আলেমগণ নিয়ে লেখা তাঁর ওই বইয়ে তিনি সিলেটি আলেমের জন্ম বা মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করেননি। অবশ্য তাঁর বই থেকে এ ধারণা তো পাওয়া গেলোযে, এ সিলেটি আলেম চৌদ্দশত শতাব্দী হিজরীর শুরুর দিকের লোক ছিলেন।[4]

শায়খুল হাদীস মাওলানা ইমদাদুল হক হবিগঞ্জী হাফিযাহুল্লাহ বলেন,

الشيخ عبد القادر السلهتي وهو ابن مولانا إدريس السلهتي، وكان عالمًا جيدًا. له تصانيف كثيرة، يبلغ عددها إلى الواحد والأربعين، مثل: «الفوائد القادرية في شرح العقائد النسفية» و«الدر الأزهر في شرح الفقه الأكبر» وغيرهما.

শায়খ আবদুল কাদির সিলেটি হলেন মাওলানা ইদরীস সিলেটির ছেলে। তিনি ছিলেন একজন ভালো মানের আলেম। তাঁর রচিত প্রচুর গ্রন্থ রয়েছে; যেগুলোর সংখ্যা একচল্লিশ পর্যন্ত পৌঁছায়। যেমন- আল-ফাওয়ায়িদুল কাদিরিয়া ফী শারহিল আকায়িদিন নাসাফিয়া, আদ-দুররুল আযহার ফী শারহিল ফিকহিল আকবার প্রভৃতি। (হিদায়াতুস সারী ফী দিরাসাতিল বুখারী, ২/২৫৯)

তিন. আবদুর রহমান সিলেটি

আরব-অনারব বেশ কয়েকজন ইতিহাবিদের বইয়ে সিলেটি এ আলেমের কথা পাওয়া যায়। সেসবের আলোকে নিম্নে তাঁর সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য পেশ করা হলে।

আবদুর রহমান তাঁর নাম। পিতার নাম: মুহাম্মদ ইদরীস। বংশ পরম্পরা এভাবে বলা হয়েছে: আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইদরীস ইবনে মুহাম্মদ মাহমুদ ইবনে  মুহাম্মদ কালিম। তাঁদের বংশসূত্র হযরত ওমর (রা.) পর্যন্ত পৌঁছে; এজন্য তাঁকে আল-উমরী বলা হয়। ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি হানাফী মাযহাব অনুসরণ করতেন বিধায় তাঁকে আল-হানাফী বলা হয়। আরজন্মসূত্রে সিলেটের বাসিন্দা ছিলেন হিসেবে তাঁকে সিলেটি বলা হয়।

আল্লামা আবদুল হাই আল-হাসানী (রহ.) বলেন,

الشيخ العالم الفقيه: عبد الرحمٰن بن محمد إدريس بن محمد محمود بن محمد كليم العمري الحنفي السلهتي، أحد العلماء المشهورين بأرض بنغاله، ولد ونشأ ببلدة سلهت – بكسر السين المهملة وسكون اللام، آخرها تاء معجمة -، قرأ العلم على صنوه الأكبر عبد القادر، ثم تصدر للتصنيفوالتدريس. ومن مصنفاته: «أحسن العقائد» – رسالة بالأردية -، و«سيف الأبرار المسلول على الفجار» – رسالة بالفارسية -.

‘শায়খ জ্ঞানী ফকীহ আবদুর রহমান ছিলেন বাংলার প্রখ্যাত আলেমদের একজন। সিলেটে তাঁর জন্ম হয় এবং সেখানে লালিতপালিত হন। (এখানেও লেখক আবদুল হাই আল-হাসানী সিলেট নামটিকে আরবিতে কীভাবে পড়া উচিত তাও লিখে দিয়েছেন।) তিনি স্বীয় বড়ভাই আবদুল কাদির সিলেটি এর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর লেখালেখি পাঠদান কর্মে নিয়োজিত হন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে: আহসানুল আকায়িদ (উর্দু) এবং সাইফুল আবরারিল মাসলুল আলাল ফুজ্জার (ফারসি)।’[5]

উপর্যুক্ত অংশের টীকায় আল্লামা আবুল হাসান আলী নদবী (রহ.) বলেন, তাঁর মৃত্যুসন আমাদের জানা নেই। (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৭৪) আবদুল হাই আল-হাসানীর সূত্রধরে ড. ইউসুফ আল-মারা’শালীও তাঁর গ্রন্থে সিলেটি এ আলেমের কথা উল্লেখ করেছেন।[6]

আবদুর রহমান সিলেটি সংকলিত বই দুটোর কথা পাওয়া যায় উসতায মুহাম্মদ আহমদ আল-মিসবাহী আল-আ’যমীর একটি আরবি গ্রন্থে।[7]

গ্রন্থপর্যালোচনা

আরব-অনারবের অনেক স্বনামধন্য লেখক মৌলবী আবদুর রহমান সিলেটির লেখা ফারসিগ্রন্থ সাইফুল আবরারের পর্যালোচনা করেছেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইসমাইল পাশা (মৃত্যু: ১৩২৮ হিজরী, তাঁর জন্ম বাগদাদে হলেও শেষজীবনে তিনি তুরস্কে ছিলেন) বলেন,

«سيف الأبرار المسلول على الفجار»: تأليف محمد عبد الرحمن السلهتي الهندي الحنفي في رد مولوي نذير حسين، أوله: «الحمد لله الذي أوجب علينا متابعة سيد المرسلين …» إلخ. رسالة كبيرة فارسية مطبوعة بالهند.

‘সাইফুল আবরার: মুহাম্মদ আবদুর রহমান সিলেটি আল-হিন্দি আল-হানাফী এই বইটি নযির হোসাইন এর খণ্ডনে লিখেছেন। বইয়ের সূচনা করেছেন এভাবে, ‘সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের ওপরসাইয়েদুল মুরসালিনের অনুসরণ অবশ্যম্ভাবী করেছেন। এটি হিন্দুস্তানে প্রকাশিত একটি বৃহৎ ফারসিগ্রন্থ।[8]

আল্লামা আবদুল হাই আল-হাসানী (রহ.) ইজতিহাদ ও তাকলীদ বিষয়ে হিন্দুস্তানি আলেমগণ রচিত কিতাবসমূহের একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। সেখানে তিনি বলেন, মৌলবী আবদুর রহমান ইবনে ইদরীস সিলেটি সাইফুল আবরার নামে একটি গ্রন্থ সংকলক করেন। এতে লেখক ধর্মীয় বিষয়ে ব্যক্তি বিশেষ (ইমাম বা প্রাজ্ঞ ধর্মীয় পণ্ডিত)-এর তাকলীদ বা অনুসরণ যে ওয়াজিব বা অপরিহার্য তা প্রমাণ করেন।[9]

তবে আবদুল হাই আল-হাসানী অন্যত্র উপরিউক্ত গ্রন্থ সম্পর্কে কিছুটা বিশদ পর্যালোচনা করেছেন। তিনি লিখেন,

«سيف الأبرار المسلول على الفجار» رسالة بالفارسية، وهي في الرد على «ثبوت الحق الحقيق»، أثبت فيها وجوب تقليد الشخص المعين على الناس، وشنع فيها تشنيعا بالغا على السيد المحدث نذير حسين الدهلوي صاحب «ثبوت الحق الحقيق»، وعلى الشيخ الشهيد المجاهد الغازي في سبيل الله إسماعيل بن عبد الغني بن ولي الله العمري الدهلوي صاحب «تقوية الإيمان»، وكفر الشيخ الشهيد رحمه الله تعالىٰ.

‘সাইফুল আবরার আবদুর রহমান সিলেটির লেখা একটি ফারসি পুস্তক। এটি মূলত সুবূতুল হাক্কিল হাকীক বইয়ের খণ্ডনে লিখিত হয়। এতে লেখক লোকদের ওপর তাকলীদে শাখসী বা ব্যক্তি বিশেষের অনুসরণ অপরিহার্য বলে সাব্যস্ত করেছেন। সুবূতুল হাক্কিল হাকীক বইয়ের লেখক মুহাদ্দিস সাইয়েদ নযীর হুসাইন দেহলবী এবং তাকওয়িয়াতুল ঈমান গ্রন্থের লেখক আল্লাহর রাহে জিহাদকারী শহীদ ইসমাইল ইবনে আবদুল গনী ইবনে ওয়ালী উল্লাহ উমরী দেহলবী (রহ.) উভয়কে অসম্মানজনক দোষারোপ করেছেন। এমনকি তিনি ইসমাইল শহীদ রাহিমাহুল্লাহকে কাফির আখ্যায়িত করেছেন![10]

বই সম্পর্কে আবদুল হাই আল-হাসানীর বক্তব্য হুবহু উল্লেখ করেছেন ড. ইউসুফ আল-মারা’শালী তাঁর গ্রন্থে।[11]

আর আবদুল হাই আল-হাসানীর মন্তব্যের আলোকে ড. শামসুদ্দীন আস-সালাফী আল-আফগানী তার জুহুদু ওলামায়িল হানাফিয়া ফী ইবতালি আকাইদিল কুবুরিয়া (পৃ. ১৮০৩) গ্রন্থে নযীর হুসাইনের পক্ষ নিয়ে আবদুর রহমান সিলেটির খুব শক্ত প্রতিবাদ করেছেন।

যেহেতু আবদুর রহমান সিলেটির লেখা মূল ফারসি বইটি এখন দুর্লভ ও দুষ্প্রপ্য এবং আপাত অনুসন্ধানে তার কোনো হদিস মিলেনি সেজন্য বইটি পড়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করে নিজে থেকে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই। ফলে যেসব গ্রন্থে আমি এই সংক্রান্ত কিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি সেগুলো সুহৃদ পাঠকদের খেদমতে পেশ করলাম।

লেখক: আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন

 

[1] সাইয়েদ আবদুল হাই আল-হুসাইনী, নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি’ ওয়ান নাওয়াযির, দারু ইবনি হাযম, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২০ হি. = ১৯৯৯ খ্রি.), খ. ৮, পৃ. ১২৮৭Ñ১২৮৮

[2] সাইয়েদ আবদুল হাই আল-হুসাইনী, নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি’ ওয়ান নাওয়াযির, খ. ৮, পৃ. ১২৮৮

[3] সাইয়েদ আবদুল হাই আল-হুসাইনী, আস-সাকাফাতুল ইসলামিয়া ফিল হিন্দ = মা‘আরিফুল আওয়ারিফ ফী আনওয়ায়িল উলুম ওয়াল মা‘আরিফ, মুওয়াস্সাতু হিনদাওয়ী লিত-তা’লীম ওয়াস সাকাফা, কায়রো, মিসর (প্রথম সংস্করণ: ১৪৩৫ হি. = ২০১৪ খ্রি.), পৃ. ২০৬

[4] ড. ইউসুফ আল-মারা’শালী, নাসরুল জাওয়াহির ওয়াদ দুরার ফী ওলামায়িল কারনির রাবি’ আশার, দারুল মা’রিফা লিত-তাবাআ ওয়ান নাশর ওয়াত তাওযী’, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ২০০৬ হি. = ২০২৭ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৭৮৯Ñ৭৯০

[5] সাইয়েদ আবদুল হাই আল-হুসাইনী, নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি’ ওয়ান নাওয়াযির, খ. ৮, পৃ. ১২৭৩Ñ১২৭৪

[6] ড. ইউসুফ আল-মারা’শালী, নাসরুল জাওয়াহির ওয়াদ দুরার ফী ওলামায়িল কারনির রাবি’ আশার, খ. ১, পৃ. ৬৭৭

[7] মুহাম্মদ আহমদ আল-আ’যমী, হুদূসুল ফিতান ওয়া জিহাদু আ’য়ানিস সুনান, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ২০০৮ হি. = ২০২৯ খ্রি.), পৃ. ১৭৮

[8] ইসমাঈল পাশা আল-বাবানী, ঈযাহুল মাকনুন ফী ফিয যায়লি আলা কাশফিয যুনূন, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরাবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ৩৫

[9] সাইয়েদ আবদুল হাই আল-হুসাইনী, আস-সাকাফাতুল ইসলামিয়া ফিল হিন্দ = মা‘আরিফুল আওয়ারিফ ফী আনওয়ায়িল উলুম ওয়াল মা‘আরিফ, পৃ. ১১৯

[10] সাইয়েদ আবদুল হাই আল-হুসাইনী, নুযহাতুল খাওয়াতির ওয়া বাহজাতুল মাসামি’ ওয়ান নাওয়াযির, খ. ৮, পৃ. ১২৭৩Ñ১২৭৪

[11] ড. ইউসুফ আল-মারা’শালী, নাসরুল জাওয়াহির ওয়াদ দুরার ফী ওলামায়িল কারনির রাবি’ আশার, খ. ১, পৃ. ৬৭৭

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ