কাশ্মীর: অবরুদ্ধ ভূ-স্বর্গে বিপন্ন মানবতা
ড. মুহাম্মদ সাদিক হুসাইন
হিমালয়-কন্যা কাশ্মীর। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। আল্লাহপ্রদত্ত অপূর্ব প্রাকৃতিক নান্দনিকতার দরুন বিশ্বময় ভূ-স্বর্গ হিসেবে পরিচিত। একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হবার সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে যে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে আসছিল এ-রাজ্যের সাধারণ জনগণ, ভারত সরকার এবার তা কেড়ে নিল। সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে। ৭০ বছর পিছনে চলে গেল ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর। এখন সেখানে শুধু অস্ত্রের ঝনঝনানি, বারুদের গন্ধ। বরফাচ্ছাদিত সাদা ও শুভ্র কাশ্মীরের গায়ে আবারো রক্তের দাগ।
কী আছে এসব অনুচ্ছেদে? এই ৩৭০ ও ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদের কারণে জম্মু ও কাশ্মীর অন্য যেকোন ভারতীয় রাজ্যের চেয়ে বেশি স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতো। এই ধারাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এর ভিত্তিতেই কাশ্মীর রাজ্য ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৭০ ভারতীয় রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়। এছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয়। কাশ্মীরের চাকরি এতদিন শুধু কাশ্মীরিরাই পেত, এখন থেকে আর পাবে না। একই পরিণতি হবে শিক্ষাবৃত্তি ও জমির মালিকানার ক্ষেত্রে। এতদিন বাইরের কেউ কাশ্মীরে জমি কিনতে পারত না, এখন সে বাঁধা উঠে গেল। সরকারের সমালোচকরা বলছেন, এখন বাইরের যে কেউ এসে জমি কিনে কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে বাস করতে পারবে। এটা কাশ্মীরের সংস্কৃতি এবং হিন্দু বসতি স্থাপনের মাধ্যমে জনসংখ্যা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা। তাই সাধারণ কাশ্মীরিদের মতে, সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে বিজেপি শাসিত ভারত সরকার কাশ্মীরিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
আগস্টের ৫ তারিখ ৩৭০ ও ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের রাষ্ট্রীয় ঘোষণার পর রাতারাতি কাশ্মীরে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য মোতায়েন করা হয়। পরে আরও দুইলক্ষ সেনা পাঠানো হয় সেখানে। কারফিউ জারি করা হয়। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় মোবাইল, ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের বা গুলমার্গ-পহেলগাম থেকে পর্যটকদের হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। এখন শুধু সেখানে সত্তর লক্ষ কাশ্মীরি জনগণ। মুসলিম অধ্যুষিত এ-জনপদটি কার্যত পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এখন। এই নিবন্ধ লেখা (১৭ আগস্ট) পর্যন্ত এভাবেই অবরুদ্ধ রয়েছে ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর। কী ঘটছে সেখানে?! এ-বিষয়ে পৃথিবী অন্ধকারে। দুনিয়ার মানুষ জানে না। ততটুকুই জানছে যতটুকু দিল্লি থেকে জানানো হচ্ছে।
জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতী ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহকে প্রথমে গৃহবন্দি, পরে আটক করা হয়। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ৪০০ জন শীর্ষস্থানীয় কাশ্মীরি নেতাদেরও। নিরুপায় হয়ে মেহবুবা মুফতীর কন্যা ইলতিজা জাভেদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে খোলা চিঠি লিখেছেন। ইলতিজা বলেন, ‘পশুর মতো খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে কাশ্মীরিদের। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের মানবাধিকার। এমনকি সংবাদমাধ্যমে মুখ খুললে তাকে ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দেওয়া হয়েছে। ’ আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই উপত্যকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করলেও এখনও পর্যন্ত সেখানে প্রবেশের অনুমতি পায়নি সংবাদমাধ্যম।
কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির সিনিয়র প্রফেসর ও শিক্ষাবিদ ড. হামিদা বানো বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘ভয়ে-আতঙ্কেআমরা তো হতবাক। গত কদিন ধরে কাশ্মীরিদের ওপর যে ধরনের মনস্তাত্ত্বিক স্ট্রেস ও ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে তাতে অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই ক্ষতি অপূরণীয়। কেনই বা বাড়তি দু’লক্ষ সৈন্য এল, কেনই বা তীর্থযাত্রী বা ট্যুরিস্টদের জোর করে বাসে তুলে সরিয়ে নেওয়া যাওয়া হলো, তার কোনও জবাবই পাচ্ছি না আমরা। শোকবিহ্বল কাশ্মীর যেন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রান্তরের চেহারা নিয়েছে, শ্রীনগর আজ খাঁ খাঁ করছে।’ (সূত্র: বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইট)
কাশ্মীরের অতীত ইতিহাস খুব সুখকর নয়। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে বহু মানুষের রক্ত ঝরেছে এ উপত্যাকায়। বহু মুসলিম নারীর ইজ্জত-আব্রু লুন্ঠিত হয়েছে এ ভূ-স্বর্গে। রক্ত ঝরেছে ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালে। মজলুম মানুষের আর্তনাদে ভারাক্রান্ত হয়েছে কাশ্মীরের আকাশ-বাতাস। বারবার। বহুবার। ঘটনার কিয়দাংশ মানুষ জানতে পেরেছে। অনেক রক্তঝরা কাহিনী তো অজানেই রয়েছে পৃথিবীবাসীর। বর্তমানেও কী ঘটছে সেখানে, কত মানুষ মারা যাচ্ছে? কত অবলা নারীর সম্মান লুন্ঠিত হচ্ছে? কত মা ও শিশু খুন হচ্ছে? কত ঘর জ্বলে-পুড়ে ছারখার হচ্ছে সেখানে?! পৃথিবীর মানুষ জানে না, জানতে দেওয়া হচ্ছে না। অতীতের রক্তাক্ত ইতিহাসের আয়নায় মানুষ শুধু অনুমান করছে। মধ্যপ্রাচ্যে যারা আছে তাদের স্বজনদের নিকট গোপনে পাঠানো ক্ষুধে বার্তা অথবা কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিন্ন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিক হয়ে যাওয়া কোনো কোনো ভয়েস ম্যাসেজ দ্বারা কিছুটা হয়তো আঁচ করা যায় ঘটনার ভয়াবহতা। একটি ভয়েস বার্তায় ভয়ার্ত এক কিশোরী আর্তনাদ করছে এভাবে, ‘মুসলিম ভাইয়েরা, আমাদেরকে বাঁচান..’ অতঃপর বুকফাটা কান্না, কলজে-ছেড়া কাহিনী। এসব বার্তার বাস্তবতা ও সত্যতা কতটুকু জানি না। তবে সেখানে কিছুটা যে ঘটছে, তা সহজেই অনুমেয়। অন্যথায়, কেন সেখানে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো মোবাইল, টেলিযোগাযোগ ও ইন্টানেট ব্যবস্থা? কেন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না সেখানে সংবাদকর্মীদের? আয়েশা জিয়া নামক এক নারী অনলাইনে জাতিসংঘে পিটিশন করেছেন, Stop killings in Kashmir শিরোনামে। তার পিটিশনটা হুবহু এখালে তুলে ধরা হলো: Innocent People everyday are brutally killed in Kashmir and no international organization is taking stand on it. Why every body is silent on this issue. They are targeted with pallet guns and use of cluster bombs are forbidden in war situation but it is openly used in Kashmir on children, on women and men. Isn’t this violation of international conventions. Forget that those people are Muslims, they are humans first. Please raise your voices in this regard. They have seen enough war situation and they have buried 1000’s dead bodies of their loved one’s. I know this is not much but, step has to be taken. (সূত্র: www.change.org/p/united-nations-stop-killings-in-kashmir)
অ্যামিনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মহাসচিব কুমি নাইডু বলেন, দশবছর পর আবারও কাশ্মীর ইস্যুটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উঠল। পরিষদের সব সদস্যের মনে রাখা উচিৎ, বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সব নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কাউকে অন্যায়ভাবে অবরুদ্ধ করে তার স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ বন্ধ করা যাবে না। ভারত সরকার কাশ্মীরে তাই করছে। কাশ্মীরে সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে কাশ্মীরে। তাই এ ইস্যুতে তিনি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান। (দৈনিক ইনকিলাব, ১৭ আগস্ট ২০১৯)
কাশ্মীরে গণহত্যার কাহিনী নতুন নয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীরের বর্ণনা মতে, আজাদ কাশ্মীরের সাবেক প্রধান সরদার মুহাম্মদ ইবরাহিম খান তাঁর বই দে কাশ্মীর সাগা-এ লিখেছেন, ‘কাশ্মীরে মুসলিম গণহত্যার পরিকল্পনা জুলাই ১৯৪৭ সালেই তৈরি হয়েছিল। পুঞ্জ ও গিলগিট বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ হওয়ায় আরএসএসকে উর্দি পরিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। তাদের মুসলমাদের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়া হয়। আরএসএস দুরগা বাহিনীর সাথে মিলে ২০ অক্টোবর ১৯৪৭ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৪৭ পর্যন্ত সোয়া দু’লাখ মুসলমানকে শহিদ করে। সেদিনটিকে স্মরণ করেই ৬ নভেম্বরে জম্মুতে শহিদ দিবস পালন করা হয়। এ সময় পূর্ব পাঞ্জাব থেকে আগত মুহাজিরদের ওপরও প্রচণ্ড অত্যাচার ও নিপীড়ন হয়। কিন্তু কাশ্মীরের মুসলমান ও সেখানকার মুসলিম নারীদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তা মানুষের কল্পনারও অতীত।’ হামিদ মীর বলেন, আমি কবরের লাশ উঠানোর পক্ষে নই। তবে নতুন প্রজন্মের জানা আবশ্যক ভারতবর্ষের মুসলমানদের স্বাধীনতা অর্জন করতে কি পরিমাণ রক্ত ও ত্যাগের প্রয়োজন হয়েছে। কতো জীবন দিতে হয়েছে স্বাধীন ভূ-খণ্ড লাভ করার জন্য। কতো নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে তা আমরা পেয়েছি তাও জানা প্রয়োজন।
আজাদ কাশ্মীরের সাবেক বিচারক মুহাম্মদ ইউসুফ সাররাফ তার কাশ্মীরিজ ফাইট ফর ফ্রিডম বইতে কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা লিখেছেন। তিনি জম্মুর মুসলমানের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন। তিনি তার বইয়ে আতা মুহাম্মদ নামক এক ব্যক্তির ঘটনা লিখেছেন। তিনি পেশায় মিস্ত্রি ছিলেন। তিনি জম্মুর মস্তগড়ে বাস করতেন। ঈদের দিন আতা মুহাম্মদ বুঝতে পারলেন হিন্দুরা তার তিন মেয়েকে অপহরণ করে ধর্ষণ করবে। তিনি মেয়েদেরকে নিজ হাতে হত্যা করলেন। যাতে তাদের ইজ্জত লুণ্ঠনের সুযোগ না পায়।
ইউসুফ সাররাফ লিখেন, জম্মু, কাঠুয়া, উদমপুর ও রিয়াসি এলাকায় দু’লাখ মুসলমান হত্যা করা হয়। ২৫ হাজারের বেশি মুসলিম নারীকে অপহরণ করা হয়। অপহৃত নারীদের হিন্দু ধর্মগ্রহণ করতে চাপ দেওয়া হতো। যে গ্রহণ করতো সে বেঁচে যেতো আর না হলে তাকে হত্যা করা হতো। মুসলিম নারীদের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রাখা হতো। কোথাও কোথাও তাদের আত্মীয়দের গোশত রান্না করে সামনে দিয়ে বলা হতো প্রিয় মানুষের গোশত ভাত দিয়ে খাও।
উল্লেখ্য, কাশ্মীর নিয়ে বিজেপি শাসিত ভারত সরকারের নিয়ত যে ঠিক নেই তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীরকেও নিজেদের বলে দাবি করে বসলেন। এতে ভারত-পাকিস্তান পরস্পর চিরবৈরি রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর প্রশ্নে এমনিতেই মতানৈক্য রয়েছে। সবসময় যুদ্ধ-যুদ্ধভাব। ভারতে সরকারের এ সিদ্ধান্তে পাকিস্তান সরকার রীতিমত ক্ষুব্ধ এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইতোমধ্যেই কড়া ভাষায় এর বিরোধিতা করেছেন। এর ফলে দুদেশের সম্পর্কে আরও কতটা অবনতি ঘটবে তা দেখার বিষয়। পাকিস্তান ইতিমধ্যে তার দেশ থেকে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং ভারত থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
শুধু তাই নয়; ভারত জম্মু ও কাশ্মীরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্রেব্রেনিকা মতো গণহত্যা ও জাতিগত নিধন চালাতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তান ঘোষিত ‘কালো দিবস’ উপলক্ষে টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় তিনি এ কথা বলেন। স্মর্তব্য, ১৯৮৫ সালের জুলাই মাসে স্রেব্রেনিকাতে ৮ হাজারের বেশি বসনিয়ান মুসলিমকে হত্যা করেছে বসনিয়ান সার্ববাহিনী। ডাচ সেনাদের উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে তাদের আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বসনিয়ার পশ্চিম অঞ্চল স্রেব্রেনিকাকে সার্ববাহনী ঘেরাও করেছিল, তারা নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ও ক্রোয়েটদের কাছ থেকে ওই অঞ্চলটি নিতে চেয়েছিল। কাশ্মীরে গণহত্যার আশঙ্কা করে ইমরান খান বলেন, বিশ্ব কি চুপ করে বসে কাশ্মীরে মুসলিম গণহত্যা দেখতে থাকবে? কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতিকে ভারতের গুজরাট ও বসনিয়ার স্রেব্রেনিকা গণহত্যারপূর্ব পরিস্থিতি বলে উল্লেখ করেন তিনি। টুইটবার্তায় বিশ্বশক্তির প্রতি প্রশ্ন রেখে ইমরান খান বলেন, কাশ্মীর নিয়ে নীরবতা পালন করে বিশ্ব কি গুজরাট ও স্রেব্রেনিকার মতো আরেকটি মুসলিম গণহত্যা দেখতে চায়? উল্লেখ্য, হিমালয় অঞ্চল কাশ্মীরকে ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশই পুরোটা দাবি করে আসছে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। এরপর এ অঞ্চলটি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৮, ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ তিনটি বড় যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে দুই বড় যুদ্ধ হয় কাশ্মীর নিয়ে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে, কাশ্মীর যখন অবরুদ্ধ এবং কাশ্মীরিরা যখন খাঁচায় বন্দি পাখির ন্যায় ছটপট করছে, তখন আটক প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। ভারতের সরকারি দল বিজেপির সঙ্গে কার কতটুকু সম্পর্ক তা নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে দুষছেন। জাতীয় ইস্যুতে নেতাদের এমন দোষারোপের রাজনীতি দেখে সাধারণ জনগণ হতাশ। একই চিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। কাশ্মীরের পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে যখন মুসলিম উম্মার সাধারণ সদস্যরা নিতান্ত উদ্বিগ্ন, ধর্মীয়ভাবে দারুন উত্তেজিত, তখন মুসলিমবিশ্বের নেতারা পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে উপসাগরীয় অঞ্চল-ভারত সম্পর্কীয় বিশেষজ্ঞ হাসান আল-হাসান বলেন, এই ধর্মীয় উত্তেজনা কাশ্মীরকে বিশ্বমুসলিম নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে সৌদিআরব, তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। তিনি বলেন, তুর্কি কাশ্মীরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ইরানিরাও তাই করছে। অতএব এটাই স্বাভাবিক যে সৌদিরাও একই চেষ্টা করবে। তারা তুরস্ক ও ইরানের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কাশ্মীর তাদের প্রভাবে থাকুক সে চেষ্টা করছে। এভাবে সেখানে চলছে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদ বাতিল বিজেপি সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। তবে এতদ্রুত যে তারা এ-কাজটি সেরে পেলবে, কাশ্মীরি জনগণ তা অনুধাবন করতে পারেনি। এটা কাশ্মীরের সংস্কৃতি এবং হিন্দু বসতি স্থাপনের মাধ্যমে জনসংখ্যা পাল্টে দেওয়ার অপচেষ্টা। যেহেতু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার কারণে সেখানে বাইরের কারো জমি কিনে বসতি করার সুযোগ ছিল না, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে সেই বাধা অপসারণ করল। সবচে উৎকন্ঠার বিষয় হচ্ছে, এর মাধ্যমে বর্তমান ভারত সরকার ইসরাইলের পথে হাটছে। ইসরাইল যেমন ফিলিস্তিনে দুনিয়া থেকে ইহুদিদের নিয়ে এসে সেখানে বসতি স্থাপন ও ইহুদি পুনর্বাস করেছে, আদি ফিলিস্তিনিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার প্রয়াস চালাচ্ছে, ঠিক একই কায়দায় এখানেও সারা ভারত থেকে হিন্দুদের নিয়ে পুনর্বাসন করবে ধীরে ধীরে। একসময় মূল কাশ্মীরি মুসলমানরা হয়ে যাবে সংখ্যালঘু।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এমন কৌশল বুমেরাং হতে পারে। সরকারের এমন দমন-নীতিতে পুরো কাশ্মীর এখন অগ্নিগর্ভা। কারফিউ চলায় কেউ বের হতে না পারলেও, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ছে সাধারণ জনগণ। তাদের স্বাধীনতার স্পৃহা জোরদার হচ্ছে ক্রমশ। তাদের দেখাদেখি এই গণজাগরণ ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে সেসব প্রদেশে যেগুলো পূর্ব থেকেই স্বাধীনতা লাভের জন্য মুখিয়ে আছে। সরকার যতই চেষ্টা করুক, স্বাধীনতাকামীদের কখনো দাবিয়ে রাখা যায় না। বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাত কোটিকে বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ আসলেই পারেনি দখলদার হানাদার বাহিনী। কাশ্মীরের বেলায়ও পারবে না। ইতোমধ্যে স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিলের প্রতিবাদে রাজধানী শ্রীনগরে শুক্রবার (১০ আগস্ট) হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভের এক ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে বিবিসি। দিল্লি তা অস্বীকার করেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, হাজার হাজার লোকের সেই বিক্ষোভে কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে। ওই বিক্ষোভে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও ছররা গুলিও নিক্ষেপ করে। ভিডিওতে গুলির শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে বিক্ষোভকারীদের ছোটাছুটি। বিক্ষোভকারীদের কারও হাতে কালো বা সবুজের ওপরে চাঁদতারা-আঁকা পতাকা, কারও হাতে ‘উই ওয়ান্ট ফ্রিডম’ লেখা পোস্টার। মানুষের গলাতেও শোনা যাচ্ছে স্বাধীনতার দাবিতে স্ল্লোগান। কয়েকজন এ ভিডিওতে বলছেন তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা চান। (সূত্র: ঢাকা ট্রিউবিউন, বাংলা অনলাইন পত্রিকা)
একই সুর ধ্বনিত হয়েছে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের মহসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো তাঁর এ বিজ্ঞপ্তি অত্যন্ত সুচিন্তিত ও ঈমানদীপ্ত। বিজ্ঞপ্তিতে অবরুদ্ধ কাশ্মীরের সহযোগিতায় বিশ্বমুসলিমকে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর সেই আহ্বান দিয়েই এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই।
কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার (১৬ আগস্ট) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাবুনগরী বলেন, কোনো অবস্থায় কাশ্মীরের মুসলমানদের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বলা যাবে না। স্বাধীনতাকামী কোনো মজলুম জাতি যদি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে, সেটি জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ হয় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি সুদান ও ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে পূর্ব তিমুরের জনগণ একটি গণভোটের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহকর্মীরা যুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ আগস্ট ২০১৯, অনলাইন সংস্করণ)
ওই বিজ্ঞপ্তিতে হেফাজত মহাসচিব আরও বলেন, যদি স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা জঙ্গি হয়, তা হলে আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারাও জঙ্গি হয়ে যাবে। অথচ তারা আমাদের প্রাণপ্রিয় মুক্তিকামী মহাপুরুষ, তারা কোনো অবস্থায় জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হতে পারে না। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর একটি হাদীসের সূত্র ধরে তিনি বলেন, ‘সমগ্র বিশ্ব মুসলিম এক দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মতো। চোখে ব্যথা হলে পুরো শরীরে ব্যথা অনুভব হয়। মাথায় আঘাত হলে পুরো শরীর জর্জরিত হয়।’ সুতরাং এ সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে কাশ্মীরের মজলুম স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের জালিম মোদি সরকারের অমানবিক জুলুম, নির্যাতন থেকে রক্ষা করার জন্য এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য বিশ্বের সব মুসলমান, বিশেষত আরব বিশ্বকে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ বাবুনগরী বলেন, জালিম মোদি সরকার কাশ্মীরের হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করছে এবং তাদের জানমাল, ইজ্জত-আব্রু লুণ্ঠন করছে। কাশ্মীরের একেকটি বালিকণা ফরিয়াদ করছে আরব বিশ্বের কাছে, যেন আরব বিশ্বের নেতৃত্বে সব মুসলিম দেশ এ অমানবিক আচরণ এবং নিষ্পেষণ ও নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষা করে। এবং কাশ্মীরের মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে।’