হযরতুল আল্লাম মাওলানা ইসমাইল আযীয (রহ.) আর নেই: সর্বত্র শোকের ছায়া
দক্ষিণ পূর্বএশিয়ার ঐতিহ্যবাহী দীনী বিদ্যাপীঠ, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আলম মুফতী আযীযুল হক (রহ.)-এর সুযোগ্য ছোট সাহেবজাদা, আযিযিয়া কাসিমুল উলুম দোহাজারী মাদরাসার মুহতামিম, এ জামিয়ার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা ইসমাঈল আযীয (রহ.) গত ৮ আগস্ট’১৯ (বৃহস্পতিবার), রাত ৩টায় চট্টগ্রাম সিএসসিআর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জরাগ্রস্ত এই দুনিয়াকে পেছনে ফেলে মাওলার দরবারে নিজকে সঁপে দিয়েছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন) ক্ষণজন্মা মুখলিস এ আলেমে দীনের মৃত্যুর সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লে সকলেই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। ইসলামের প্রচার প্রসার ও দীনী শিক্ষা বিস্তারে আজীবন নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাওয়া প্রচারবিমূখ এ বিদগ্ধ মনীষীর ইন্তেকালে আমরা শুধু একজন জ্ঞান সাধককে হারাইনি, হারিয়েছি একজন অভিভাবককে। এ শূন্যতা পূর্ণ হওয়ার নয়। হযরতের জানাজায় শরীক হতে এবং শেষ বারের মতো তাঁকে একনজর দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শিষ্য, আলিম ওলামা, ধর্মপ্রাণ তাওহীদী জনতা জামিয়া অভিমুখে পঙ্গপালের ন্যায় ছুটে আসেন। বৃষ্টির মাঝেও নামাযে জানাজায় তাওহীদী জনতার স্রোত ও তার জনপ্রিয়তা দেখে উপস্থিত লোকেরা আবাক হয়ে যান। এতে প্রমাণিত হয়, তিনি একজন কামেল বুযুর্গ ও নিভৃতচারী মোখলেস সাধক ছিলেন। ওই দিন দুপুর ২টায়, জামিয়া পটিয়ার মসজিদ সংলগ্ন মাঠে তার সুযোগ্য সন্তান, জামিয়া নানুপুর ওবায়দিয়ার কিরাআত বিভাগীয় প্রধান মাওলানা কারী ইজাজের ইমামতিতে জানাজার নামাযে অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁকে জামিয়ার মাকবারায়ে আজিজিতে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর। তিনি স্ত্রী, আলেমে দীন ৪ ছেলে, ২ মেয়ে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। জানাজাপূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জামিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও মুফতী আল্লামা শামসুদ্দিন জিয়া (দা. বা.) জামিয়ার সকল ছাত্র-শিক্ষকের পক্ষ থেকে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।
কুরবানী ছুটি উপলক্ষে ছাত্রদের প্রতি আল্লামা আবু তাহের নদভীর তারবিয়াতি বয়ান
৬ আগস্ট ১৯ (মঙ্গলবার) যুহরের পর, জামিয়ার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কুরবানীর ছুটি উপলক্ষে দিক-নির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ নসীহত পেশ করেন, জামিয়ার নায়েবে মুহতামিম, আল্লামা আবু তাহের নদভী (দা. বা.)। নসীহতের শুরুতে হুযুর বলেন, আমাদের মুরব্বিদের ক্লান্তিহীন মেহনত, সীমাহীন কুরবানীর কারণে আল্লাহর অশেষ রহমতের ওপর ভরসা করে (আমাদের) এ কওমি মাদরাসাগুলো টিকে আছে। এধারা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে আমাদেরকে ও মুরব্বিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। হুযুর কুরবানীর ছুটিতে, সময়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে, কুরবানীর ফাযায়েল ও মাসায়েল ভালোভাবে অধ্যয়ন করে মানুষকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে ছাত্রদের বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত-তাবলীগে সময় দেওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামায়াতের সাথে আদায়, মুরব্বিদের সালাম করা, সর্বোপরি সুন্দর চরিত্রের মাধ্যমে জাতির রোল মডেল হিসেবে নিজকে উপস্থাপন করতে জোর তাগিদ দিয়েছেন। মাদরাসা খোলার দিন সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়ে সবকের পাবন্দি করতে, সকল ছাত্রকে নেযাম মোতাবেক চলতে কঠোর নির্দেশ জারি করেন। পরিশেষে, তিনি জামিয়ার অসুস্থ মুরব্বিগণের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সকল ছাত্র ও দেশবাসীর নিকট বিশেষ দোয়ার আবেদন করেন।
মুশাআরা (কাব্যচর্চা) অনুষ্ঠান সম্পন্ন
১ আগস্ট ১৯ (বৃহস্পতিবার) জামিয়ার দারুল হাদীস মিলনায়তনে শুবায়ে মুশাআরার উদ্যোগে, জামিয়ার কাব্যচর্চা বিভাগীয় প্রধান, প্রখ্যাত আরবি সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট কবি, আল্লামা আবদুল জলিল কওকবের সভাপতিত্বে জামিয়ার সিনিয়র শিক্ষক আল্লামা জাফর সাদেক (দা. বা.)-এর সঞ্চালনায়, মুশাআরা (কাব্যচর্চা) অনুষ্ঠানসম্পন্ন হয়েছে। এ বছর মুশাআরার বিষয়বস্তু ছিল গজলিয়াত (গীতিকাব্য) অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, জামিয়ার প্রধানপরিচালক ও শায়খুল হাদীস, আল্লামা আবদুল হালীম বোখারী সাহেব (দা. বা.) অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনে পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহে গমনকারী আল্লামা বোখারীকে বিভিন্ন প্রকার গীতিকাব্য আবৃত্তি করে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানানো হয়। প্রধান অতিথির সংক্ষিপ্ত ভাষণে আল্লামা বোখারী বলেন, কাব্যচর্চা আমাদের জামিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট। আমাদের জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতী আযীযুল হক (রহ.) যুগশ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তিনি আরবি উরদুসহ বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য কাব্যরচনা করে গেছেন। তিনি আরও বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি কাব্যচর্চার মাধ্যমে আরবি বাংলা, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় ছাত্রদের দক্ষতা অর্জন করে নিজেকে যোগ্য আলেমে দীন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তিনি অত্যন্ত চমকপ্রদ ও ফলপ্রসু এরকম অনুষ্ঠান উপহার দিয়ে মুশাআরা ও আরবী সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য বিভাগীয় প্রধান আল্লামা আবদুল জলীল কওকবের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অনুষ্ঠানে জামিয়ার সকল শিক্ষক ও ছাত্রবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। জামিয়ার খ্যাতনামা কবি, আল্লামা ইউনুস, মুফতী বোরহান উদ্দিন, মাওলানা রহমতুল্লাহ সিপাহী, প্রমুখ স্বরচিত কাব্য অবৃতি করেন।
কুরবানীর মাসায়েল ও তাৎপর্য শীর্ষক বিতর্ক সেমিনার অনুষ্ঠিত
৩০ জুলাই’১৯ (মঙ্গলবার) জামিয়ার দারুল হাদীস মিলনায়তনে শু’বায়ে মুনাজারার ব্যবস্থাপনায় কুরবানীর মাসায়েল ও তাৎপর্য শীর্ষক বির্তক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন জামিয়ার তাফসীর ও মুনাজারা বিভাগীয় প্রধান আল্লামা রফীক আহমদ (দা. বা.)। প্রধান বিচরক ছিলেন, জামিয়ার সিনিয়র শিক্ষক, খ্যাতিমান বক্তা, আল্লামা আখতার হুসাইন আনোয়ারী (দা. বা.)। যুগোপযোগী অতিপ্রয়োজনীয় এ বিতর্ক সেমিনারে জামিয়ার শিক্ষার্থীগণ, আসাতিযায়ে কিরাম ও মেহমানবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষলগ্নে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বয়ানে আল্লামা আখতার হুসাইন (দা. বা.) বলেন, আমাদের ইলমুল হাল (সমসাময়িক) বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে কুরবানী হলো অন্যতম। তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করায় ছাত্রদের ধন্যবাদ জানান। এদিকে জামিয়া শর্টকোর্স বিভাগের উদ্যোগে একই বিষয়ে ৩১ জুলাই’১৯ বুধবার মুনাজারা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জামিয়ার বিশিষ্ট মুহাদ্দিস, মুআররিখে ইসলাম রহমতুল্লাহ কাওছার নেজামীর ইন্তেকাল, জামিয়ায় শোকের ছায়া
এশিয়া বিখ্যাত দীনী শিক্ষা নিকেতন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার বিশিষ্ট মুহাদ্দীস, যুগশ্রেষ্ট আলেমে দীন, বহু গ্রন্থপ্রণেতা বাংলাদেশ তাহফীযুল কুরআন সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল, ইত্তেহাদুল মাদারিস শিক্ষা বোর্ড এর প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আল্লামা রহমতুল্লাহ কাওছার নেজামী আর নেই। তিনি গত ১৩ অগাস্ট’১৯ (মঙ্গলবার) সকাল ৭টায় পটিয়া মাদরাসায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহী ওয়া ইলাইহি রাজিউন) সেই দিন বিকল ৫ টায় পটিয়া মাদরাসা প্রাঙ্গনে জামিয়ার সহকারী পরিচালক আল্লামা আবু তাহের নদভী (দা. বা.)-এর ইমামতিতে মরহুমের জানাযার নামায অনুষ্টিত হয়, মরহুমের জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য ছুটে আসেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তার অগনিত ছাত্র, ভক্ত-অনুরক্ত এবং সাধারণ মুসল্লী, এতে জানাযায় আরও উপস্থিত ছিলেন দেশের র্শীষ আলেমে দীনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর, তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। তিনি ছেলে মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। হযরত রহমাতুল্লাহ কাওছার নেজামী ১৯৪৭ সনে চট্টগ্রাম জেলার অন্তরগত মিরশ্বরাই থানার ওসমানপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বজলুস সোবহান (রহ.) ছিলেন কুতুবে জমান মুফতী আযীযুল হক (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলীফা, তিনি প্রাথমিক পড়া-লেখা নিজ গ্রামের স্বনামধন্য দীনী প্রতিষ্ঠান জামালপুর হাফিযিযা আযিযিয়া মাদরাসায় সমাপ্ত করেন, পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য এশিয়া বিখ্যাত দীনী শিক্ষানিকেতন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় ভর্তি হন, এবং ১৯৬৭সনে দাওরা সমাপ্ত করেন। পড়া লেখা শেষ করে তিনি শৈশবের মাদরাসায় খেদমতের মধ্য দিয়েই কর্ম জীবন শুরু করেন। পরে ১৯৭৭ সনে জামিয়া পটিয়ার তৎকালীন মহাপরিচলক শায়খুল আরব ওয়াল আজম হাজী ইউনুস (রহ.) ডাকে সাড়া দিয়ে জামিয়া পটিয়া চলে আসেন, তিনি হাদীস শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ তিরমিযী শরীফ, মিশকাত ২ খণ্ডসহ দরসে নেজামীর জটিল জটিল অসংখ্য কিতাবের দরস প্রদান করেন। তিনি জামিয়ার ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশ তাহফীযুল কুরআন সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল ও ইত্তেহাদুল মাদারিস শিক্ষা বোর্ডের প্রধান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন, এ মনীষীর লেখনীর প্রভাব ছিল অভাবনীয়, কর্ম জীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি রচনা করেন। বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ খিলাফতে রাশিদা, খিলাফতে বনু উমায়য়া তার অমর কীর্তি, এছাড়াও তিনি অসংখ্য কিতাবের অনুবাদ, সংকলন, সম্পাদনা করেন।
শায়খুল কুররা হযরত মাওলানা কারী আবদুল গনীর ইন্তিকালে জামিয়া প্রধানের শোক ও দোয়ায়ে মাগফিরাত
পটিয়া আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়ার সাবেক কিরআত বিভাগীয় প্রধান বাংলাদেশের বিশিষ্ট কারী হযরত মাওলানা কারী আবদুল গনি সাহেবের ইন্তেকালে জামিয়ার প্রধান পরিচালক শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল হালিম বুখারী (দা. বা.) তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। মরহুম কারী সাহেবের দারাজাত বুলন্দির জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে তিনি বিশেষ মুনাজাত করেন।
তথ্যসূত্র: আবদুর রহমান বিন ইউনুছ
জামিয়া প্রতিবেদক, মাসিক আত-তাওহীদ