নবধ্বনি: ঈদসংখ্যার মূল্যায়ন
নবধ্বনির সহকারী সম্পাদক ভাই জনাব হামমাদ রাগিবের সৌজন্যে নবধ্বনি ঈদসংখ্যা কুরিয়ার যোগে আমার কাছে আসে। হাতে নিয়ে পাতা উলটাতেই এর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি। নবধ্বনির প্রতিধ্বনি ধ্বনিত হলো হৃদয়ে। আমি নিজেও মাসিক আত-তাওহীদ নামক ৪৯ বছরের পুরণো একটি মাসিক ম্যাগাজিনের সম্পাদক। প্রতিদিন আমার কাছে দেশ বিদেশ থেকে বহু ম্যাগাজিন সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে আসে। প্যাকেট খুলে সূচি দেখে রেখে দেই। কিছু ম্যাগাজিন কাছে টানে। পড়ার জন্যে হৃদয়ে তাগিদ অনুভব করি। নবধ্বনির প্রচ্ছদ, মুদ্রণ, গেটআপ-সেটআপ মানানসই। কনটেন্টস নিউজপ্রিন্টে না হয়ে হোয়াইট পেপার হলে আরও বেশি যুৎসই ও আকর্ষণীয় হতো কিন্তু সেটা ব্যয়বহুল। সাদা নিউজপ্রিন্ট বাজারে পাওয়া যায়। এটা ব্যবহার করা যায় কি না কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারেন। অতিমূল্যবান লেখা সাধারণ নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত হলে বেশি দিন সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তার স্থায়িত্ব কম।
১৭৬ পৃষ্ঠার নবধ্বনি বিষয়বৈচিত্র্য, বর্ণনাশৈলীর স্বতন্ত্রতা ও ঐতিহ্যপ্রীতির অনুরাগ চোখে পড়ার মত। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সম্পাদনা পরিষদ ভিন্ন স্বাদ ও আমেজে নবধ্বনিকে নবচেতনায় সাজাবার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রতিটি পাতায় সম্পাদক জনাব তামিম রায়হান, নির্বাহী সম্পাদক জনাব সালাহুদ্দীন জাহাঙ্গীর, সহকারী সম্পাদক জনাব হামমাদ রাগিব ও নাজমুস সাকিব, প্রকাশনা ব্যবস্থাপক জনাব আসাদুল্লাহ খান ও সার্কুলেশন ব্যবস্থাপক জনাব মুহাম্মদ ইসহাক খানের দরদি মনের ছোঁয়া উপলব্ধি করা যায়। এটাকে বলা যায় টিমওয়ার্কের সফলতা।
নবধ্বনি ঈদসংখ্যায় বড় ছোট ৩০টি লেখা স্থান পেয়েছে। অধিকাংশ লেখাই মৌলিক। সীরাত সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সাক্ষাৎকার, ভ্রমণকাহিনী, প্রবাসজীবন, ছোটগল্প, মহাজীবন সব মিলিয়ে নবধ্বনির ঈদসংখ্যাটি সংগ্রহে রাখার মত ও সযত্নে সংরক্ষণযোগ্য। ইতিহাস ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্যের আবেদন বাসি ও পুরণো হওয়ার আশংকা থাকে না।
আমজাদ ইউনুস বিরচিত চট্টলায় ইসলামের আগমন, বিকাশ ও সমৃদ্ধি শীর্ষক লেখাটি মানসম্মত ও তথ্যনির্ভর। হযরত বায়েজিদ বিস্তামী কোনোদিন চট্টগ্রামে আসেননি। এখানে তাঁর কোনো সমাধি নেই। একথাটি তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন ইতিহাসবিদ হামিদুল্লাহ খানের উদ্ধৃতি দিয়ে। ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম তাঁর রচিত বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল) গ্রন্থে একই কথা উল্লেখ করেন (বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ. ৬৫)। সাহাবী হযরত সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস (রাযি.) আদৌ চীনে গিয়েছেন কি না। না কি গিয়ে ফিরে এসেছেন। সমসাময়িক ইতিহাসগ্রন্থে এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এটা ব্যাপক গবেষণার ব্যাপার ও প্রমাণ সাপেক্ষ। হযরত সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস (রাযি.)-এর কবর আছে মদীনার জান্নাতুল বাকিতে। চীনের ক্যান্টনে যে মসজিদ আছে সেটি তাঁর বাবা আবু ওয়াক্কাস (রাযি.) নির্মাণ করেন। মসজিদের ওপরে লেখা আছে ‘মসজিদ আবু ওয়াক্কাস’। ২০১৯ সালের এপ্রিলে আমি এই মসজিদ কমপ্লেক্স পরিদর্শন করি, নামায আদায় করি এবং কবর যিয়ারত করি। মসজিদ কমপ্লেক্সে যে সমাধি তার প্রবেশ পথে লেখা আছে ‘হযরত আবু ওয়াক্কাস (রাযি.)-এর কবর’। লেখক প্রবন্ধের শেষে তথ্যসূত্র দিয়েছেন ঢালাওভাবে। ইতিহাসনির্ভর নিবন্ধে ক্রমিক নম্বর দিয়ে তথ্যসূত্র উল্লেখ করতে হয়। সেটা দু’ভাবে করা যায়। প্রতিটি পাতার নিচে অথবা নিবন্ধের শেষে। খণ্ড, পৃষ্ঠা, মুদ্রণের সন, প্রকাশকের নাম থাকা জরুরি। এটা ইতিহাস বিষয়ক Research Methodology-এর অংশ।
সালাহুদ্দীন জাহাঙ্গীর লিখিত এখানে আমার পিতারা ঘুমায়, হামমাদ রাগিব রচিত আলেম সাংসদ ড. আবু রেজা নদভীর মুখোমুখি, নাবিলা আফরোজ লিখিত অটোমান রাজকীয় হারেম: বিস্ময়ভরা এক অন্দর মহল, ফাহাদ আবদুল্লাহর সাইয়েদ কুতুব: মহাকালের ধ্রুবতারা, ইফতেখার জামিলের আরমোগানে হেজাজ: ওমরার অসমাপ্ত সফরনামা, সুমাইয়া মারজান রচিত মোঘল হেরেমের জ্ঞানতাপসী, অবিশা জান্নাত লিখিত রণাঙ্গনের বীরাঙ্গনা, আবিদা সুলতানা উমামার বীরাঙ্গনা সাহাবিয়্যা বেশ সূখপাঠ্য এবং বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। নিবন্ধকারদের ধারণা স্বচ্ছ, মানস ঐতিহ্যসচেতন, বর্ণনারীতি অস্পষ্টতামুক্ত এবং উপস্থাপনায় মুন্সিয়ানার ছাপ লক্ষণীয়।
সালাহুদ্দীন জাহাঙ্গীরের আরেকটি গ্রন্থ আমার দেখার সুযোগ হয়েছে, হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল। আমি তাঁর লেখার একজন অনুরক্ত পাঠক। হামমাদ রাগিব বিভিন্ন অন অনলাইন নিউজ পোর্টালের পক্ষে আমার বহু সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। অনেক সময় সফরকালীন প্রাইভেট কারে, ওয়ায মাহফিলের আগে পরে অথবা কলেজে ক্লাশের ফাঁকে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। ব্যস্ততাজনিত কারণে মাইণ্ডের কনসেন্ট্রেশন ছিল না কিন্তু সাক্ষাৎকার প্রচারিত হলে দেখি আমার বিক্ষিপ্ত বক্তব্যগুলো দিয়ে তিনি কথামালা সাজিয়েছেন। তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা, শব্দের গাঁথুনি, বাক্য বিন্যাস ও বাককুশলতা আমাকে মুগ্ধ করে।
নবধ্বনি আরও সমৃদ্ধ হয়ে সামনে এগিয়ে যাক। বাংলাভাষায় ইসলামী সাহিত্য আরও ঋদ্ধ হোক এটাই আজকের কামনা। আমি নবধ্বনির ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন