নবীযুগে নগরপরিকল্পনা
মিযানুর রহমান জামীল
শহরনীতি এক মজবুত ও শৃঙ্খল নীতি। মানুষের কর্ম ও চরিত্র গঠনের স্থান। চিন্তা বিনির্মাণের ক্ষেত্র। শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা, উন্নত শিক্ষা ও সভ্যতার বিশেষ কেন্দ্র। শহুরী সভ্যতাই শহরবাসীদের স্বাচ্ছন্দতা ও সুস্থ দেহ-মন তৈরিতে সহায়ক। শহরনীতি নিরাপত্তা ঐক্যবদ্ধতার পরিবেশ গড়ে তোলে। সেখানের বাসিন্দাদের রাজনৈতিক সংগঠন এবং সামরিক শক্তিকে সুদৃঢ় করে। এই শহরনীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সেখানের বাসিন্দাদের জীবন যাপনের সমগ্রী সহজলভ্য করে দেয়। চিকিৎসা কেন্দ্র এবং সফল প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য এক দৃঢ় কর্মধারা প্রস্তুত করে। অন্যায়ভাবে কারো সহায়-সম্পত্তি ভোগ করার সুযোগ বন্ধ করে। পুলিশ ও প্রসাশনের মাধ্যমে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদীদের মূলোৎপাটন করে। রাসুল (সা.)-এর ইয়াসরিব হিজরতের পূর্বে সেখানের বাসিন্দারা রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন সঙ্গে বিভক্ত ছিলেন। এসব সংগঠন স্বাধীনভাবে নিজস্ব নিয়মে পরিচালিত ছিল। যা একদিকে গোত্রীয় স্বাধীনতার রূপ-রেখাকে তুলে ধরে, অন্য দিকে রাজনৈতিক বাড়াবাড়ি এবং এর দরুণ হত্যা-লড়াই সংঘাত এবং রক্তপাতের সুত্র সৃষ্টি করে। শান্তি, নিরাপত্তা, ঐক্যবদ্ধতা অকল্পনীয় ছিল। প্রতিটি গোত্র অন্য গোত্রের রক্তপিপাসু ছিল। গোত্রপ্রীতি এবং গোত্রীয় দ্বন্দ্বের কারণে পুরো ইয়াসরিব একটি রণক্ষেত্রের রূপ নিয়েছিল। সদা গৃহযুদ্ধ এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত লেগেই থাকতো। এমন এক ভয়াবহ ও জটিল পরিবেশে রাসুল (সা.) মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেন এবং নিজের বিচক্ষণতা ও কর্মকূশলের মাধ্যমে মদীনাকে আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও বহিরাগত ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন তৈরি করেন। তার মূল দফা ছিল ৩টি। যথা-
- মদীনায় শান্তি-নিরাপত্তার পরিবেশ নিশ্চিত করা।
- ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকা।
- বহিরাগত আক্রমণকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা।
এ সংগঠনের বদৌলতে মদীনায় যে গৃহযুদ্ধ এবং গোত্রসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে থাকতো এবং তাদের আত্মরক্ষা ও অর্থনৈতিক শক্তিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল, সেই দ্বন্দ্ব হ্রাস পেতে লাগলো। অন্যদিকে মদীনার গোত্রসমূহ একতাবদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি পারস্পরিক ঐক্যের কারণে বহিরাগত আক্রমণ থেকে রক্ষা পেল। যার অবশ্যম্ভাবী ফল এই দাঁড়ালো যে, প্রতিটি গোত্র-ধর্ম জীবন যাপনে স্বাধীনতা লাভ করলো। শান্তি নিরাপত্তার মনলোভা পরিবেশ তৈরি করলো। নতুন প্রজন্মকে শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত করার পথ সুগম হলো। ঐক্যবদ্ধ শক্তির মাধ্যমে সভ্যতা গঠনে তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলো। এটাই ছিল রাসুলের কর্মময় জীবন্ত অবদান। যা রাসুল (সা.) তাঁর দূরদর্শিতা এবং অসাভাবিক বিচক্ষণতা দ্বারা আঞ্জাম দিয়েছেন। হিজরত অবশ্যক হওয়ার পর মুহাজিরদের একটি বড় জামাত মদীনায় একত্রিত হয়। এমনকি মদীনার স্থানীয় বাসিন্দাদের তুলনায় মুহাজিরদের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। [বুখারী, হাদিস: ২২৬১]
স্বল্প জিনিস-পত্র নির্ভর জীবন থাকা-খাওয়া এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা একটি অতি জটিল এবং বড় সঙ্কটময় পরিস্থিতি ছিল। তদুপরি বিভিন্ন শ্রেণি, বংশ, গোত্র-বর্ণ এবং বিচিত্র সভ্যতা-সংস্কৃতির মানুষকে সামাজিক দিক থেকে এভাবে আপন করে নেওয়া যে, তাদের মধ্যে ভীনদেশি হওয়া ও পরবাসী হওয়ার অনুভূতিও আসতো না। সঙ্কীর্ণ কলনীর ঘনবসতির ভিড়াভিড়িতে যেই বিশৃঙ্খলা ও চারিত্রিক অধঃপতনের প্রবণতা থাকে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বাহ্যত কোনো সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু রাসুল (সা.) তার সীমাহীন অন্তর্দৃষ্টি এবং খোদাপ্রদত্ত বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা এমন এক সিটিপ্ল্যানিং (শহরনীতি) করেন যা সুদক্ষ সমাজবিদদের জন্যও বিশেষ মনযোগ ও অধ্যয়নের দাবি রাখে। উদাহরণস্বরূপ রাসুল (সা.) সেই জটিল পরিস্থিতির সমাধানের জন্য নিম্নক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এক. মুহাজিরীন সাহাবাগণ মক্কা মুয়াযযমা থেকে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছিলেন যাদের মধ্যে কয়েকজন ধনাঢ্য ও সচ্ছল ব্যক্তিও ছিলেন কিন্তু যেহেতু তারা মক্কার কাফেরদের থেকে লুকিয়ে হিজরত করেছিলেন তাই তারা নিজেদের সাথে কোনো আসবাব-পত্র নিয়ে আসতে পারেননি। রাসুল (সা.) সামাজিকভাবে তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য এই পদক্ষেপ নেন যে, আনসার এবং মুহাজিরদের মধ্যে তিনি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। তাই যখন মসজিদে নববী নির্মাণ সমাপ্ত হয় তখন হুযুর (সা.) আনসারদের ডাকার পর হযরত আনাস (রাযি.)-এর গৃহে সকল লোক একত্রিত হয়। মুহাজিরদের সংখ্যা ছিল ৪৫জন। হুযুর (সা.) আনসারদের সম্বোধন করে বললেন, এরা তোমাদের ভাই। অতঃপর মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে দুই দু’জনকে ডেকে বললেন, এ এবং তুমি ভাই ভাই। আনসার সাহাবী ঘরে গিয়ে তার প্রতিটি জিনিসের হিসাব নিলেন এবং মুহাজির ভাইকে বললেন, এর অর্ধেক আপনার আর অর্ধেক আমাদের। হযরত সাদ ইবনে রবী (রাযি.), যিনি হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাযি.)-এর ভাই নির্বাচিত হয়েছেন, তার দুইজন বিবি ছিলেন। হযরত আবদুর রহমান (রাযি.)-কে বললেন, আমি তাদের মধ্য হতে দু’জনের একজনকে তালাক দিয়ে দিচ্ছি আপনি তাকে বিবাহ করে নেন। কিন্তু তিনি সাথে সাথে বিয়ের বিষয়ে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। [সীরাতে ইবনে হিশাম, ২/১৫৭]
দুই. মুহাজির সাহাবাদের বসবাসের দ্বিতীয় এই ব্যবস্থা নেওয়া হলো যে, আনসার সাহাবিদের কাছে যেই পতিত জমিজমা ছিল তা মুহাজিরদের দেওয়া হলো। অথবা যার নিকট একাধিক বসবাসের গৃহ ছিল তা মুহাজিরদের দিয়ে দেওয়া হলো। সর্বপ্রথম হযরত হারেসা ইবনে নুমান (রাযি.) নিজের জমীন পেশ করলেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাযি.) সেখানে একটি দুর্গ নির্মান করলেন। হযরত ওসমান (রাযি.), হযরত মিকদাদ (রাযি.) ও হযরত ওবায়েদ (রাযি.)-কে আনসার সাহাবীগণ নিজেদের গৃহের পাশে জমীন দিয়েছিলেন। [মু’জামুল বুলদান, ২/২৮৯]
তিন. মুহাজির এবং আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে পারষ্পরিক স্বভাব ও রুচির মিলের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয় যা সামাজিক জীবনকে সুখময় এবং সফল করার গ্যারান্টি দেয়। যেমন হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ (রাযি.) যিনি জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০জন সাহাবীর একজন। তাঁর পিতা রাসুল (সা.)-এর আগমনের পূর্বে হযরত ইবরাহীম আ. এর ধর্মের অনুসারী ছিলেন। হযরত সাঈদ (রাযি.) তাঁরই কোলে প্রতিপালিত হন। তাই ইসলামের জ্যোতি তার হৃদয়কে অতিদ্রুত আলোকিত করে তোলে। ইসলামের বসন্ত হাওয়া তার মৃত হৃদয়কে সবুজ-শ্যামল ও তরতাজা করে তোলে। কেবল এটুকুই নয়; বরং সে প্রদীপ থেকে আরও বহু প্রদীপ ইসলামের আলোয় আলোকিত হতে থাকে। এই প্রস্ফূটিত কলিকে দেখে অন্যান্য কলিও ইসলামের বাগিচায় উজ্জীবিত হওয়ার দীপ্ত বাসনা লালন করতে থাকে। তাই তার সম্মানিত আম্মাজানও ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করেন। তারই উৎসাহে হযরত ওমর (রাযি.)ও ইসলাম গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হন। জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠত্বের ময়দানে তাকে নেতৃস্থানীয় সাহাবিদের মধ্যে গণ্য করা হয়ে থাকে। তার ভ্রাতৃত্ব হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.) এর সাথে কায়েম করা হয়। যাকে হযরত ওমর (রাযি.) মুসলমানদের নেতা বলতেন। নবুওয়াতি দরবারে সর্বপ্রথম লেখালেখির দায়িত্বে নিয়োজিত হন। কুরআন পাঠশাস্ত্রে তাকে ইমাম গণ্য করা হয়ে থাকে। [ইসাবায়ে যিকরে উবাই ইবনে কাব, ৩/১৭৭]
হযরত আবু হুযাইফা (রাযি.) যিনি উতবা ইবনে রবিয়ার পুত্র ছিলেন। আর উতবা ছিলেন কুরাইশদের প্রধান নেতা। হযরত আবু হুযাইফা (রাযি.)-এর সাথে হযরত আব্বাদ ইবনে বিশর (রাযি.)-এর ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দেয়া হয়, আর এই আব্বাদ ইবনে বিশর (রাযি.) আসহাল গোত্রের নেতা ছিলেন। হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রাযি.) যাকে রাসুল (সা.) উম্মতের বিশ্বস্ত ব্যক্তি উপাধিতে আখ্যায়িত করেছেন। যিনি একদিকে সিরিয়ার মতো অঞ্চলের বিজেতা ছিলেন, অন্যদিকে ইসলামের স্বার্থে এমন আড়ষ্ট ছিলেন যে পিতৃত্ব এবং পুত্রত্বের আকর্ষণ তাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারত না। যেমন বদরের যুদ্ধে যখন তার পিতা তার মোকাবেলায় সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন তিনি নির্ধিদায় নিজ পিতাকে ইসলামের স্বার্থে কুরবান করে দেন। তার ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক হযরত সাদ ইবনে মুআয (রাযি.)-এর সাথে করা হয়। যিনি আউস গোত্রের নেতা ছিলেন। ঈমানী সাহসিকতা এবং ইসলামের আকর্ষণে তিনি এতটাই মুগ্ধ ও নিবেদিত প্রাণ ছিলেন যে, দীন তার কাছে জীবনের চেয়েও বেশি দামি ছিল, এ জন্য তিনি বনু কুরাইজার ৪০০ মিত্রকে ইসলামের স্বার্থে কুরবান করে দিয়েছিলেন।
শহর ব্যবস্থাপনার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা। বর্তমান যুগে ধন-দৌলতের লালসা এবং অর্থ-সম্পদের উচ্চাকাংখা মানুষের উত্তম চরিত্রের বিনাশ ঘটিয়েছে এবং নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া, সহমর্মিতা প্রদর্শন, ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের মতো মূল্যবান জিনিস থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়ে গেছে। যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসকে গুদামজাত ও সিন্ডিকেট করে মার্কেটে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য এবং উৎপাদিত পণ্য জনসাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। অন্য দিকে ভালো-মন্দ জিনিসের সংমিশ্রণ এবং ত্রুটিযুক্ত পণ্যের সয়লাভের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যগত অবস্থা কঠিন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। খাঁটি এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার না জুটার কারণে মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে চলে যাচ্ছে। এছাড়া জোর-জবরদস্তি প্রতারণা ও ধোকা ব্যবসার এমন এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে যে, সরলমনা মানুষ এবং ব্যবসার মারপেচ সম্পর্কে অনবিজ্ঞ ব্যক্তিদের পক্ষে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা জটিল হয়ে পড়েছে। রাসুল (সা.) ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রয়-বিক্রয়ে ঘটে থাকা বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যে লোকদের ইসলামি নীতির আলোকে ব্যবসা করতে নির্দেশ প্রদান করতেন এবং ব্যবসায়ীদের সততা ও বিশ্বস্ততা এবং প্রাধান্য, সহমর্মিতার সুউচ্চ আখলাকে সজ্জিত হতে তাকিদ করতেন। ব্যবসায় খেয়ানত ধোকা মিথ্যা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা থেকে বিরত থাকাকে আবশ্যক করে দিয়েছেন। সম্পদ গুদামজাত করে এবং ধোকা দিয়ে ত্রুটিযুক্ত মাল বিক্রী করতে নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন,
«إِنَّ التُّجَّارَ يُبْعَثُوْنَ يَوْمَ القِيَامَةِ فُجَّارًا، إِلَّا مَنْ اتَّقَى اللهَ، وَبَرَّ، وَصَدَقَ».
‘… কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ী লোক পাপী হিসেবে উঠবে। তারা ব্যতীত যারা আল্লাহকে ভয় করেছে, সততা অবলম্বন করেছে এবং সত্য কথা বলেছে।’[1]
অন্য এক স্থানে বলেছেন
«ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَا يُزَكِّيهِمْ، وَلَـهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ: الْـمَنَّانُ بِمَا أَعْطَىٰ، وَالْـمُسْبِلُ إِزَارَهُ، وَالْـمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْـحَلِفِ الْكَاذِبِ».
‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা ৩ শ্রেণির লোকদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের প্রতি দয়ার নজরেও তাকাবেন না। না তাদেরকে পাপ থেকে মুক্ত করবেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্থি থাকবে। তারা হচ্ছে,
- কারো প্রতি অনুগ্রহ করে খোঁটা দানকারী।
- মিথ্যার শপথ করে জিনিস-পত্র বিক্রয়কারী এবং
- টাখনুর নিচে পোষাক পরিধানকারী।[2]
অন্য এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন,
«إِنَّ أَطْيَبَ الْكَسْبِ كَسْبُ التُّجَّارِ الَّذِيْنَ إِذَا حَدَّثُوْا لَـمْ يَكْذِبُوْا، وَإِذَا ائْتُمِنُوْا لَـمْ يَخُوْنُوْا، وَإِذَا وَعَدُوْا لَـمْ يُخْلِفُوْا، وَإِذَا اشْتَرُوْا لَـمْ يَذِمُّوْا، وَإِذَا بَاعُوْا لَـمْ يُطْرُوْا، وَإِذَا كَانَ عَلَيْهِمْ لَـمْ يَمْطُلُوْا، وَإِذَا كَانَ لَـهُمْ لَـمْ يُعَسِّرُوْا».
‘সর্বত্তম উপার্জন ব্যবসায়ীদের উপার্জন। শর্ত হচ্ছে,
- সে যখন বেচা-কেনা সম্পাদন করে মিথ্যে বলে না।
- যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তার খেয়ানত করে না।
- প্রতিশ্রুতি দিয়ে, খেলাফ করে না।
- যখন আসবাব ক্রয় করে তখন বিনাকারণে ত্রুটি বর্ণনা করে না।
- যখন জিনিস-পত্র বিক্রি করে তখন পণ্যের মাত্রাতিরিক্র প্রশংসা করে না।
- যখন তার ওপর কারও হক থাকে সেটা আদায়ের ক্ষেত্রে গড়িমসি করে না।
- যখন অন্যের ওপর তার কোনো হক থাকে তখন সেটার ব্যাপারে কঠরতা করে না।’[3]
অপর একটি হাদীসে আছে,
«مَنِ احْتَكَرَ عَلَى الْـمُسْلِمِيْنَ طَعَامَهُمْ، ضَرَبَهُ اللهُ بِالْـجُذَامِ وَالْإِفْلَاسِ»
‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের থেকে সম্পদকে আটকিয়ে গুদামজাত করে আল্লাহ তাআলা তাকে কুষ্ঠ রোগ এবং দারিদ্র্যতায় লিপ্ত করেন।’[4]
বাণিজ্যিক লেনদেনে স্বচ্ছতা তৈরির জন্য রাসুল (সা.) দ্বিতীয় যেই কর্মপদ্বক্ষেপ নিয়েছিলেন তা হলো তিনি স্বয়ং বাজারে গিয়ে সেই লেনদেনের দেখা-শোনা করতেন এবং ইসলাম ব্যবসার ক্ষেত্রে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছে তার ওপর লোকদের আমল করাতেন। যে ব্যক্তি বাধা-নিষেধ মানতো না তাকে শাস্তি প্রদান করতেন। যেমন- সহীহ আল-বুখারীর ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়ে রয়েছে
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ: «أَنَّهُمْ كَانُوْا يُضْرَبُوْنَ عَلَىٰ عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ إِذَا اشْتَرَوْا طَعَامًا جِزَافًا، أَنْ يَبِيعُوْهُ فِيْ مَكَانِهِمْ، حَتَّىٰ يُؤْوُوهُ إِلَىٰ رِحَالِـهِمْ».
‘হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)-এর যুগে আমি দেখেছি লোকেরা অনুমান আন্দাজ করে শস্য ক্রয় করতো। কিন্তু সেটিকে আপন গৃহে যারা স্থানান্তর করার পূর্বে বিক্রি করে দিত তাদেরকে এ অপরাধে শাস্থি দেওয়া হতো।’[5]
কখনও কখনও পরিস্থিতি যাচাইয়ের জন্য রাসুল (সা.) নিজেই বাজারে আগমন করতেন। একবার হুযুর (সা.) বাজার দিয়ে গমন করছিলেন, দেখতে পেলেন খাদ্য শস্যের একটি স্তুপ। তিনি সেই স্তুপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আর্দ্রতা অনুভব করলেন। দোকানদারকে বললেন, এটা কী? সে বলল, বৃষ্টির কারণে ভিজে গিয়েছে। তিনি বললেন, সেই ভিজা অংশকে উপরে কেন রাখলে না। যাকে সকলে দেখতে পায়। অতঃপর বললেন,
«مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا».
‘যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের (আদর্শের) অন্তর্ভুক্ত নয়।’[6]
কিছু লোকের স্বভাবে অবাধ্যতা ও হটকারিতার প্রাবল্য থাকে। নিয়ম ভঙ্গ করা এবং শহরের আইন-কানূনের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীনতা তাদের স্বভাব হয়ে থাকে। যার দরুণ সভ্যতা ও নীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অপরাধ এবং চারিত্রিক ত্রুটির পথ পেয়ে যায়। বাস্তবে অপরাধপ্রবণ লোকদের ওপর নজরদারির জন্য যেখানে সুশৃঙ্খল এবং দৃঢ়নীতির রূপায়ণ প্রয়োজন সেখানে অপরাধীদের সাজা প্রদানের জন্য দণ্ডবিধি ও ইনসাফের বাস্তবায়ন অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। যাতে নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ন্যায়সঙ্গত শাস্তির ভয়ে অবাধ্য ও অপরাধপ্রবণ লোকদের জন্য হাতকড়া এবং পায়ের বেড়ি সাব্যস্ত হয়। রাসুল (সা.)-এর যুগে এই উভয় বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখা হতো। তাই একদিকে যেমনিভাবে ব্যভিচার হত্যা চুরি এবং অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক ও সাহস ভেঙে দেওয়ার মতো শাস্তি নির্ধারিত ছিল। অন্যদিকে সেই শাস্তি প্রয়োগের বেলায় নীতি ও ইনসাফের পূর্ণ লক্ষ্য রাখা হতো। ধনী-গরীব উঁচু-নিচু শ্রেণির মাঝে শাস্তি প্রয়োগে পার্থক্য করা হতো না। এ কারণে যখন হযরত উসামা (রাযি.) মাখযুম গোত্রের এক মহিলা, যার জন্য চুরির অপরাধে হাত কাটার শাস্তি গৃহীত হয়েছিল, তার ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর দরবারে সুপারিশ করেছিলেন। তখন রাসুলের চেহারা মোবারক রাগে লাল হয়ে গিয়েছিল। সে সময় তিনি ঐতিহাসিক বাণী উচ্চারণ করেছিলেন,
«وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا».
‘আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদের বেটি ফাতেমাও চুরি করতো আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।’[7]
অপরাধীদের গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার জন্য হুযুর (সা.) হযরত যুবায়ের (রাযি.), হযরত আলী (রাযি.), হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রাযি.), হযরত মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রাযি.), হযরত আসেম ইবনে সাবেত (রাযি.) এবং হযরত যাহহাক ইবনে সুফিয়ান আল-কালবীকে নিয়োগ করেছিলেন। [যাদুল মাআদ, ২/২৯৪]
এই সেই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল যার মাধ্যমে রাসুল (সা.) পৃথিবীবাসীকে সজাগ করে দিয়েছিলেন যে, ইট পাথরের সুউচ্চ ভবনের মাঝে গলি ও বাজার বানিয়ে দেওয়ার নামই শহরনীতি নয়; বরং এমন কার্যকর ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি করাও অপরিহার্য, যা দৈহিক শান্তি ওআত্মিক উন্নতি বয়ে আনে। এবং এক উন্নত নতুন প্রজন্ম তৈরির জিম্মাদার হয়। সর্বশেষ আল্লাহর কাছে দুআ যে, আমাদেরকে রাসুল এর আদর্শ অনুপাতে জীবন গঠনের তাওফীক দান করুন এবং মুসলিম সমাজকে ইসলামি সভ্যতার যাত্রী বানিয়ে দেন। আমীন! সুম্মা আমীন!
[1] আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৩, পৃ. ৫০৭Ñ৫০৮, হাদীস: ১২১০
[2] আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৩৫, পৃ. ৩৮১, হাদীস: ২১৪৮১, হযরত আবু যর আল-গিফারী (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[3] আল-বায়হাকী, আল-আদাব, মুআস্সাসাতুল কুতুব আস-সাকাফিয়া, বয়রুত, লেবনান, পৃ. ৩১৮, হাদীস: ৭৮৭, হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[4] ইবনে মাজাহ, আস-সুনান, দারু ইয়াহইয়ায়িল কুতুব আল-আরাবিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ২, পৃ. ৭২৯, হাদীস: ২১৫৫, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[5] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৫, পৃ. ১৭৪, হাদীস: ৬৮৫২
[6] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ১, পৃ. ৯৯, হাদীস: ১০১, হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত
[7] আল-বুখারী, আস-সহীহ, খ. ৪, পৃ. ১৭৫, হাদীস: ৩৪৭৫