দেশব্যাপী ধর্ষণ ও বলাৎকার: নৈতিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের বিপর্যয়ের পরিণতি
বিগত ৬মাসের জাতীয় দৈনিক খুললে যে খবরটি সবচেয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও হতাশা তৈরি করে তা হলো ধর্ষণ ও বলাৎকারের বীভৎস ঘটনা পরম্পরা। দেশ যেন ধর্ষকামীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এক শ্রেণির শিক্ষক থেকে শুরু করে বাসের কন্ডাক্টর, ছাত্র থেকে শুরু করে সরকারী অফিসার সবাই এক কাতারে শামিল। বিকৃত যৌন উম্মাদনায় উন্মত্ত ও উন্মার্গ। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী কার্যালয়ে সর্বত্র ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কদের অবাধ বিচরণ। কোমলমতি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না যৌন সহিংসতার হাত থেকে। ৭০ ভাগ ঘটনা লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে প্রকাশ পায় না। ৩০ ভাগ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। অনেক বালক ও মেয়ে ধর্ষকদের হাতে প্রাণ হারান। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান মতে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৪হাজার ৩০৪জন। এর মধ্যে ৭৪০জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে (প্রথম আলো, ২৯ মার্চ ২০১৬)। অনেকে গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। বহুক্ষেত্রে মামলা হয় না। অনেক সময় আসামী জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে আরো ত্রাসের সৃষ্টি করে।
২০১৯ সালের সাড়ে ৩মাসে ৩৯৬ নারী, শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র মতে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনে মামলা হয়েছে ১হাজার ১৩৯টি এবং হত্যা মামলা হয়েছে ৩৫১টি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ এপ্রিল ২০১৯)। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়া মোট ৩৪৫টি ঘটনার মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩৫৬। এদের মধ্যে মারা গেছেন ২২ জন, আহত ৩৩৪ জন।
সমাজের সচেতন মানুষ ও অভিভাবকগণ অজানা শংকায় আতংকিত। কোন সময় মানুষরূপী হায়েনার হিংস্রথাবায় তাঁদের সন্তানের করুণ পরিণতি ঘটে। ছাত্র-ছাত্রীগণ যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের হাতে, সরকারী অফিসে কর্মকর্তাগণ যদি বসের হাতে এবং গণপরিবহনে যদি মহিলা যাত্রী ড্রাইভার-হেলপারের হাতে নিরাপদ না হয়, তাহলে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে, নৈরাজ্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। প্রতিশোধস্পৃহা থেকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
কেন এই পৈশাচিকতা? মানবচরিত্রের কেন এই বিপর্যয়? কেন মানুষের পাশবপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লো? ভাবতে হবে সবাইকে। সমাধানের পথ বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজের দায়িত্ব কম নয়। রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাও ব্যাপক। নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রশাসযন্ত্রের অবস্থান ভূক্তভোগীদের পক্ষে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে থাকতে হবে।
প্রথমত বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা বিচারহীনতারই নামান্তর। আইন সংশোধন করে ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। আসামী যাতে জামিন না পায় আইনে এমন বিধি সংযোজন করতে হবে। দেখা গেছে সাক্ষীর অভাবে বহু মামলা খারিজ হয়ে যায়। আসামিগণ সাক্ষীদের হুমকি দেয়ার ফলে তারা আর কোর্টে যেতে আগ্রহী হয় না। মহিলা আইনজীবি সমিতির জরিপে দেখা যায় ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামী খালাস পেয়ে যায়। নারীপক্ষ -এর গবেষণায় দেখা গেছে ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দেশের ৬টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা ৩হাজার ৬৭১টি মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র ৪জনের (যুগান্তর, ১০ এপ্রিল ২০১৮)। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে এই প্রবণতা হৃাস পাবে।
দ্বিতীয়ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, টকশো ও মত বিনিময় সভার আয়োজন করা যেতে পারে। সমাজের মানুষ সচেতন হলে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিপীড়ক সক্রিয় তা চিহ্নিত করা কঠিন হবে না।
তৃতীয়ত গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে সরকারী অফিসের যৌন নিপীড়কদের শাস্তির আওতায় আনা যেতে পারে। ভিক্টিমকে প্রটেকশন দিতে হবে।
চতুর্থত মানুষের মনে যাতে তাকওয়া ও খোদাভীতি তৈরি হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। ওলামা-মাশায়েখ, ইমাম-খতিব, বক্তা-ওয়ায়েযগণ এ বিষয়টিকে হাইলাইট করে জনমত গঠন করতে পারেন।
পঞ্চমত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ ও র্যাবকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। ধর্ষকামী মনকে পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিতে হবে। ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে। আল্লাহর ভয়, আইনের ভয় ও শাস্তির ভয়।
ষষ্টত নারীদের উগ্র পোষাক, মাদকের বিস্তার, পর্নোগ্রাফি ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসন ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীগণ।
ধর্ষণ, বলাৎকার ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাঁরা জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন আর যারা প্রাণে বেঁচে আছেন সমাজে তাঁরা কিভাবে থাকবেন? ধর্ষণের শিকার মেয়েদের বিয়ে দিতেও মা বাবাকে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। এটা সামাজিক বাস্তবতা।
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন