শায়খুল ইসলাম আল্লামা তকি উসমানীর ওপর হামলা: ঘটনার পূর্বাপর
রোকন এনাম লোবান
বিচারপতি তকি উসমানী একজন বুযুর্গ মাওলানা, দরবেশ জ্ঞানি, বহুগ্রন্থের সুলেখক ও পৃথিবীখ্যাত আল্লামা। তাঁকে পুরো পৃথিবীতে শ্রদ্ধার সাথে সংবর্ধিত করা হয়। ইসলামি ফিকাহ তথা আইনের মতামতকে ফতওয়া বলা হয়। তকি উসমানী সাহেবের ফতোয়া দুনিয়াজুড়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অনারব দেশ ত বটেই আরবেও তাঁর ফতোয়ার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। দেওবন্দ ঘরানার মাওলানা হওয়া সত্ত্বেও তিনি অন্যান্য সিলসিলায়ও সম্মানিত।
তকি উসমানী সাহেবের চিন্তা ও কর্ম বহুলাংশে ভারসাম্যপূর্ণ। প্রান্তিকতা ও জোশমুক্ত মধ্যপন্থি ফিকরার আলিম হওয়ায় তিনি সবার মাঝে গ্রহণীয়তা পেয়েছেন।
পৃথিবীর প্রায় সকল ইসলামি ফিকাহ বোর্ডে তিনি সদস্য হিসেবে রয়েছেন। সবকটি ইসলামি অর্থনৈতিক বোর্ডে তিনি আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন।
ইসলামের অর্থনৈতিক প্রস্তাবনায় তাঁকে সৌরলোক ধরা হয়। তাঁর মোবারক মস্তিষ্ক ও প্রজ্ঞাবান কলম বেয়ে আধুনিক ইসলামি ব্যাংক প্রাগ্রসর হয়েছে।
তাঁকে শায়খুল ইসলাম অভিধায় নামকরণ করেছেন শ্রেষ্ঠ আলমিগোষ্ঠী।
ইংরেজি, আরবি ও উর্দু ভাষায় লিখতে ও বলতে তিনি চোস্ত পারঙ্গম। একশতের কাছাকাছি তাঁর মূল্যবান বই বহু ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে। আল্লাহ তাঁর হায়াতে সৃষ্টির বৃষ্টি বর্ষণ করুন। আমিন!
এক.
তিনি পাকিস্তানের বৃহত্তম শহর করাচিতে বাস করেন। জুমা পড়ান গুলশান-ই-ইকবাল মসজিদে। যথারীতি আজ স্বপরিবারে জুমার উদ্দেশ্যে গেছেন। আজ হজরত দুটি টাটা মডেলের কার-যোগে যাত্রা করেছেন।
তকি উসমানী সাহেবের সহধর্মিণী ও নাতি নাতনিরাও সাথে ছিলেন।
পথে দুটি মোটরসাইকেল হতে চারজন বন্দুকধারী বৃষ্টির মতো হামলা করেছে। তখন তকি উসমানী পরিবার ফ্লাইওভারে। রক্তক্ষয়ী হামলায় তকী উসমানীর দেহরক্ষী সনোবর খান শাহাদাতবরণ করেন। আরেকজন পুলিশ অফিসারও শহীদ হন। ড্রাইভার কৌশলে গাড়ি হামলাস্থল থেকে বেরিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। ড্রাইভার নিজে মারাত্মক জখম পেয়েছেন। গাড়ি দুটিও ক্ষতবিক্ষত।
হজরতের সহধর্মিণী সামান্য আহত হয়েছেন। নাতিরাও অল্প আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।আল্লাহর অশেষ রহমতে তকি উসমানী সাহেব আহতও হননি। আল-হামদু লিল্লাহ।
দুই.
পাকিস্তানের চৌকস প্রধানমন্ত্রী-সহ সবাই এই হামলার নিন্দা করেছেন, করে যাচ্ছেন।
এই হামলার সুযোগ কেন হল? পাকিস্তানের সকল প্রতিষ্ঠিত আলিমের সরকারি নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। সর্বশেষ-অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সাকিব নেসার সাহেব সকল আলিমের নিরাপত্তা উঠিয়ে নেন।
যার ফলশ্রুতিতে আক্রমণের সুযোগ অবারিত হল। কিছু দিন আগে সলিমুল্লাহ খান সাহেবকেও অনিরাপদ অবস্থায় শহীদ করা হয়।
তকি উসমানী সাহেবকেও শহীদ করার জন্যই এই কাপুরুষোচিত হামলা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
পাকিস্তান সরকারের অনতিবিলম্বে আলিমদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা জরুরি। নাহয়, শাহাদাতের এই মিছিল প্রলম্বিত হবে।
তিন.
পাকিস্তান এক ভয়াবহ জটিল দেশ। সম্ভাবনার আধার হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সংকটে আঁধার।
পাকিস্তানের সম্ভাবনা জটিল ভূ-রাজনৈতিক রাজনীতিতে তলিয়ে গেছে। আর্থিকভাবে রাষ্ট্রটি নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। ব্যবসায় বিবেচনায় রাষ্ট্রটি পিছনে হাঁটছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাশাস্ত্রে আজ আফ্রিকার সাথি একসময়ের সমৃদ্ধ পাকিস্তান।
ভারতের সাথে পাকিস্তানের ভয়াবহ দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখতে গিয়ে দুদেশই সমান তৎপর। ক্ষতি উভয়ের হলেও পাকিস্তানের জিরজিরে অর্থকাঠামো হওয়ার কারণথ ভারত।
ইজরাঈল ও যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত কারণে পাকিস্তানকে অন্ধ গলির অন্দরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানের সৃষ্ট জিহাদ তত্ত্ব পাকিস্তানের অনেক লাভ করেছে। ক্ষতির পরিমাণও প্রচুর।
জিহাদ তত্ত্ব দ্বারা একসময় যুক্তরাষ্ট্রও লাভবান হয়েছে। ভারত ও আফগানিস্তানকে আইএসআই জিহাদ তত্ত্ব দিয়ে তটস্থ রাখত। পরে এই জিহাদ তত্ত্ব ভারতও প্রয়োগ শুরু করে।
মগজ ধোলায় করে ইসলামের বিরুদ্ধে এই জিহাদ তত্ত্ব সবাই প্রয়োগ করেছে। সব প্রয়োগ হয়েছে পাকিস্তানে। এজন্য পাকিস্তানে আসল-জিহাদের সাথেসাথে অজগ্র তৈরিকৃত বানোয়াট জিহাদ সক্রিয়। যারা অজান্তে বাইরের শক্তির তাঁবেদার। ইসলামের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি এই অপজিহাদিরা করেছে।
পাকিস্তানে পাঁচ প্রকার তালেবান আছে। ভারতের কারখানায় তৈরি তালেবান। তারা পাকিস্তান সরকারের ক্ষতি করে। দুবাইয়ের পয়সা খাওয়া তালেবান। তারা বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা চাওয়া তালেবান। যুক্তরাষ্ট্রের তালেবান । তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অবচেতনে যুদ্ধ করে। ইজরাঈলের তৈরি তালেবান। তারা পাকিস্তানের ক্ষতিতে নিমজ্জিত। আর আফগান-ভিত্তিক মূল তালেবান। তাঁরা হক্বের পক্ষে কাজ করেন।
এজন্য তালেবানের নামে জুলুমি ঘটনা দেখে ভড়কে যাবেন না।
তকি উসমানী সাহেবকে হামলার দায় কোন তালেবান বা জিহাদিরা নিলে অবাক হব না। বুঝে নিতে হবে সেটি কোন্ প্রকারের তালেবান?
পাকিস্তানের শিআরাও মারাত্মক আগ্রাসী। তবে তাঁরা তকি উসমানী সাহেবকে আক্রমণ করার সম্ভাবণা ক্ষীণ। কারণ তকি উসমানী সাহেব সববিবেচনায় উদার ও সমঝদার সমঝোতাপন্থি। সব প্রকার রাজনীতি থেকে তকি উসমানী দূরত্ব বজায় রাখেন।
ব্যক্তিগত শত্রুতার সুযোগও নেই। যদিও ঈর্ষা ও হিংসা আলিমদের মাঝে থাকবে। সেটি আততায়ী হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য।
চার.
আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে তিনি বেঁচে গেছেন। আল-হামদু লিল্লাহ।
পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সময়ে সহিংসতা ও বর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। আল্লাহ করুন! সন্ত্রাসের মাত্রা একেবারে শূন্যে নেমে আসুক।
মাওলানা তকি উসমানী আরো সমুজ্জ্বল কাজের মাধ্যমে উজ্জীবিত থাকুন।
আরো বহুবসন্ত তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন! এই দুআ ও তামান্না।