জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্মীয় মহফিলে নতুন কুসংস্কার: সংশোধন জরুরি (বয়ানের ভিডিও)

ধর্মীয় মহফিলে নতুন কুসংস্কার: সংশোধন জরুরি

ধর্মীয় মহফিলে নতুন কুসংস্কার: সংশোধন জরুরি

আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ আবদুল হালীম বুখারী (দা. বা.)

[বিগত ৭-৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ জুমাবার শনিবার পটিয়া রেলস্টেশন চত্ত্বরে দু’দিনব্যাপী ইসলামী সম্মেলনে আল-জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার প্রধান পরিচালক, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ গবেষক আল্লামা মুফতি আবদুল হালিম বোখারী সাহেব হাফিযাহুল্লাহ ধর্মীয় মাহফিলে প্রচলিত বিদআত কুসংস্কার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিকনির্দশনামূলক আলোচনা পেশ করেন। বক্তৃতাটি গ্রন্থনা করেন আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার উস্তাদ মাওলানা সলিমুদ্দিন মাহদী কাছেমী (দা. বা.)। নিম্নে পাঠকদের জন্য তার চুম্বকাংশ উল্লেখ করা হলসম্পাদক]

 

نَحْمَدُهُ وَنُصَلِّيْ عَلَىٰ رَسُوْلِهِ الْكَرِيْمِ، أَمَّا بَعْدُ!

সম্মানিত উপস্থিতি! মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ اِذَا ذُكِرَ اللّٰهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَاِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ اٰيٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِيْمَانًا وَّعَلٰى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَۚۖ۰۰۲ الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنْفِقُوْنَؕ۰۰۳ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ حَقًّا١ؕ لَهُمْ دَرَجٰتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَ مَغْفِرَةٌ وَّ رِزْقٌ كَرِيْمٌۚ۰۰۴

‘নিশ্চয়ই মুমিন তারা, আল্লাহর নাম উচ্চারিত হলে যাদের হৃদয় বিগলিত হয়ে চমকে ওঠে, যখন তাদের নিকট আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় আর তারা কেবলমাত্র তাদের প্রভুর উপরেই ভরসা রাখে। যারা সালাত কায়েম করে এবং আমি যে জীবিকা তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে তারাই সত্যিকারের মুমিন। তাদের প্রভুর নিকট তাদের জন্য রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা।[1]

হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে,

عَنِ أَبِيْ نَجِيْحٍ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ h قَالَ: «وَعَظَنَا رَسُوْلُ اللهِ مَوْعِظَةً، وَجَلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ، وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ، فَقُلْنَا: يَا رَسُوْلَ اللهِ! كَأَنَّهَا مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ، فَأَوْصِنَا، قَالَ: أُوْصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، وَإِنْ تَأَمَّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَىٰ اخْتِلَافًا كَثِيْرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْـخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ، عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ» رَوَاهُ أَبُوْ دَاوُدَ, وَالتِّرْمِذِيُّ, وَقَالَ: حَدِيْثٌ حَسَنٌ صَحِيْحٌ.

‘হযরত ইরবাদ ইননে সারিয়া (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সারগর্ভ উপদেশ দিলেন। এতে হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হল, চোখে পানি চলে এলো। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! মনে হচ্ছে, এটি বিদায়ী ব্যক্তির উপদেশ। তাই আমাদের অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের আল্লাহকে ভয় করা যথাযথ আনুগত্যের অসিয়ত করছি। যদিও তোমাদের নিয়ন্ত্রণ কোন দাসের হাতে থাকে। আমার মৃত্যুর পর যে বেঁচে থাকবে সে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমার সুন্নত খোলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ আঁকড়ে ধরা। একেবারে দাঁত কামড়ে তা ধরে রাখ। সাবধান! তোমরা মনগড়া নতুন বিষয়গুলো (বিদআত) থেকে দূরে থাকবে। কেননা প্রত্যেকটা বিদআত ভ্রান্ত।’’[2]

কারো সামনে অর্যাচিত প্রশংসা করা বৈধ নয়

আমাদের প্রচলিত ধর্মীয় মাহফিলে বক্তাদের অর্যাচিত প্রশংসা করা হচ্ছে। বক্তার নাম ঘোষণার পূর্বে কয়েক মিনিট পর্যন্ত তার উপাধি ঘোষণা করা হয়। এটি অপছন্দনীয় কাজ, বরং শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি একটি গর্হিত কাজ। কারণ, অর্যাচিত প্রশংসার ফলে প্রশংসিত ব্যক্তি বিভ্রান্তে পতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই ইসলাম কারো সামনে প্রশংসা করাকে ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, কেউ যদি তোমার সামনে প্রসংশা করে তাহলে তুমি তার চেহরায় মাটি নিক্ষেপ করবে।

عَنْ هَمَّامِ بْنِ الْـحَارِثِ، أَنَّ رَجُلًا جَعَلَ يَمْدَحُ عُثْمَانَ، فَعَمِدَ الْـمِقْدَادُ فَجَثَا عَلَىٰ رُكْبَتَيْهِ، وَكَانَ رَجُلًا ضَخْمًا، فَجَعَلَ يَحْثُو فِي وَجْهِهِ الْـحَصْبَاءَ، فَقَالَ لَهُ عُثْمَانُ: مَا شَأْنُكَ؟ فَقَالَ: إِنَّ رَسُولَ اللهِ قَالَ: «إِذَا رَأَيْتُمُ الْـمَدَّاحِيْنَ، فَاحْثُوْا فِيْ وُجُوْهِهِمِ التُّرَابَ».

‘হযরত হাম্মাম ইবনুল হারিস (রহ.) থেকে বর্ণিত। একদিন এক লোক উসমান (রাযি.)-এর প্রশংসা করতে শুরু করলেন। তখন মিকদাদ (রাযি.) হাঁটুর ওপর ভর করে বসলেন, কারণ তিনি ছিলেন মোটা মানুষ। এরপর তিনি প্রশংসাকারীর মুখে মাটি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তখন উসমান (রাযি.) তাকে বললেন, হে মিকদাদ! তুমি কি করছ? উত্তরে তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অতিমাত্রায় প্রশংসাকারীদেরকে দেখলে তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করবে।’’[3]

কারণ কারো সামনে তার প্রশংসা করা হলে তার নফস মোটা হয়ে যায়। সে আত্মগৌরবে মেতে উঠে। তার মধ্যে অহংকার প্রবল হতে থাকে। অথচ আল্লাহ পাক বলেন,

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا۪ۙ۰۰۹ وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَاؕ۰۰۱۰

‘যে নিজের নফসকে শুদ্ধ করে, সে সফলকাম এবং যে নিজের নফসকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।[4]

সামনা-সামনি কারো প্রশংসা করা মানে তার নফসকে অপবিত্র করা। তাই আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তার চেহরায় মাটি নিক্ষেপ কর।’  এই যে ওয়াযের পূর্বে আমার সামনে নামের শুরুতে ‘হাকিমুল ইসলাম’ শায়খুল হাদিস, মুহতামিম, ‘উস্তাদুল আসাতিযা’ ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার করা হল, তা শরিয়তে নিষেধ করা হয়েছে। যেহেতু আমার সামনে এই ধরণের কিছু উপাধি উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আমি তার চেহরায় মাটি নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্যেই সমালোচনা করছি। কারণ মাটি দু’প্রকার। একটি হল প্রকৃত মাটি আর দ্বিতীয়টি হল রূপক মাটি। এই যে আমি উল্লিখিত প্রশংসাকে প্রত্যাখান করছি, অপছন্দ করছি এটিও এক প্রকার মাটি নিক্ষেপ করা।

তাবলীগ জামায়াতে বিভিন্ন আলোচকগণ আলোচনা করে থাকেন। উপাধি বলা তো দূরের কথা সেখানে নামও বলা হয় না। এই আলোচনা দ্বারা কি মানুষ হেদায়ত হয় না? তাহলে কেন দীনী মাহফিলে বক্তাদের এত উপাধি ঘোষণা করতে হবে? এটি আমাদের পূর্বসূরি আকাবিরগণ পছন্দ করতেন না। তাই এই নতুন কুসংস্কার থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।

 

সাহাবায়ে কেরামের নামের শুরুতে কোন উপাধি নেই!

সহীহ আল-বুখারী-মুসলিম ও সুনানে তিরমিযী-আবু দাউদ শরিফসহ সকল হাদিসগ্রন্থের বর্ণনাকারী বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম। তাঁদের নামের শুরুতে কোন উপাধি লেখা হয়নি। বুখারী শরিফের প্রথম হাদিসের বর্ণনাকারী হলেন হযরত ওমর ইবনুল খত্তাব (রাযি.)। ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর নামের শুরুতে কোন উপাধি উল্লেখ করেননি। আচ্ছা আমার নামের শুরুতে যদি দশ মিনিট পর্যন্ত উপাধি বলতে হয় তাহলে ওমর (রাযি.)-এর নামে শুরুতে কয় ঘণ্টা বলতে হবে? ওমরের নামের শুরুতে কি কিছু আছে? না, কোন উপাধি নেই। অথচ ওমর সেই ব্যক্তি যাঁর সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, আমার পরে কেউ নবী হলে হযরত ওমর নবী হতেন।

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ h، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : «لَوْ كَانَ نَبِيٌّ بَعْدِيْ لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الْـخَطَّابِ».

‘হযরত উকবা ইবনে আমির (রাযি.), আমি  রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার পরে কেউ নবী হলে হযরত ওমর নবী হতেন।’’[5]

এমন সার্টিফিকেট কি আমাদের আছে? না, আমাদের কারো জন্য এমন কোন সুসংবাদ নেই। হযরত ওমর (রাযি.) সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ওমর (রাযি.) যে রাস্তা দিয়ে চলেন শয়তান দূর থেকে দেখে অন্য রাস্তা অবলম্বন করে।’ শয়তান হযরত ওমর (রাযি.)-কে এমন ভয় পায়।  এদিকে হযরত ওমর (রাযি.) মদিনায় অবস্থান করছেন আর লন্ডনে এক শিশু দোলনায় কাঁদছে, কান্না বন্ধ হচ্ছে না। শিশুর মা তাকে বলল, কেঁদো না, কেঁদো না। হযরত ওমর আসছে! তৎক্ষণাৎ শিশুটির কান্না থেমে যায়! এমনই ছিল মানুষের অন্তরে হযরত ওমরের ভক্তি ও ভয় ।

چوں عمر شیدائے آن معشوق شد
حق وباطل چوں دل فاروق شد

‘ওমর যিনি সন্ত্রাসীদের গডফাদার ছিলেন, তিনি যখন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুহবত পেলেন তখন তিনি ওমরে ফারুক হয়ে গেলেন।

 

হযরত ওমর (রাযি.) মান-মর্যাদা

কুরআন শরিফে প্রায় বিশটি আয়াত হযরত ওমরের ইবারত-টেক্সসহ অবতরণ করা হয়েছে। তেমনি যেখানে সকল চিকিৎসা ব্যর্থ হয় সেখানেও হযরত ওমর (রাযি.) কারামত কাজ করছে। সম্রাট হেরাক্লিয়াসের মাথা ব্যথা শুরু হল। কোন ওষুধ কাজ করছে না। সকল ডাক্তার অকৃতকার্য হয়ে গেল। তখন হযরত ওমর (রাযি.) এক লোককে একটি টুপি নিয়ে হেরাক্লিয়াসের নিকট পাঠালেন। তাকে বলল, তুমি রোম সম্রাটকে বলবে, হযরত ওমর (রাযি.) শুনেছেন আপনার মাথা ব্যথা বন্ধ হচ্ছে না। তাই এই টুপিটি আপনার নিকট হাদিয়া পাঠিয়েছেন। এটি মাথায় দিলে মাথা ব্যথা বন্ধ হয়ে যাবে। মাথায় টুপি দেওয়ার সাথে সাথে মাথা ব্যথা বন্ধ হয়ে গেল! সুবহানাল্লাহ। এক সপ্তাহ ব্যবহার করার পর বড় বড় গবেষককে সম্রাট তলব করলেন। অতঃপর তাদেরকে বলেন, তোমরা কেউ আমাকে ভালো করতে পারলে না। অথচ এই টুপিটি মাথায় দেওয়ার পর মাথা ব্যথা বন্ধ হয়ে গেছে। দেখ তো এখানে কি ওষুধ আছে? তারা টুপির সেলাই খুলে তন্ন তন্ন করে দেখল। অতঃপর বলল, এখানে কোন ওষুধ নেই। একটি জিনিস লেখা আছে। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’। মূলত হযরত ওমরের হাতে ‘বিসমিল্লাহ’ লিখে টুপির ভেতরে দিয়েছে তাতে মাথা ব্যথা বন্ধ হয়ে গেছে।

কয়েকশ মাইল দূরে মুসলিম সেনাবাহিনী জিহাদ করার জন্য গেছেন। সারাদিন জিহাদ করে। রাত্রিবেলা একটি পাহাড়ের পাশে আশ্রয় নিলেন। হযরত ওমর (রাযি.) মদিনায় অবস্থান করছেন। তখন তো মোবাইল-ওয়্যারলেসের ব্যবস্থা ছিল না। এদিকে মুসলিম সৈন্যরা যে পাহাড়ের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন সে পাহাড়ের অপর পাশে অমুসলিম সৈন্যরা হামলা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। তারা পাহাড়ের ওপর উঠে মুসলিম বাহিনীর ওপর তীর নিক্ষেপ করবে। মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন হযরত সারিয়া। অমুসলিম বাহিনীর এই অপ-কৌশল সম্পর্কে সারিয়া জানেন না, মুসলিম সৈন্যদল জানেন না। আল্লাহ তায়ালাই হযরত ওমর (রাযি.)-এর সামনে সুদূরে থাকা জিহাদরত মুজাহিদ বাহিনীর অবস্থা পরিস্কার করে দিলেন, ফলে তিনি মদীনার মসজিদে জুমআর খুতবা দানকালেও যুদ্ধরত মুজাহিদদের সতর্ক করে বললেন, يَا سَارِيَةُ! الْـجَبَلَ অর্থাৎ হে সারিয়া! পাহাড়! এই কথা শুনে সুদূরে যুদ্ধরত মুজাহিদরা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে সেই যুদ্ধে বিজয় লাভ করে।

عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: وَجَّهَ عُمَرُ جَيْشًا وَأَمَّر عَلَيْهِم رَجُلًا يُدْعَىٰ بِسَارِيَة، فَبَيْنَا عُمَرُ يَخْطُبُ يَومًا يُنَادِيْ: يَا سَاريةُ الْـجَبَلَثَلاثًاثُمَّ قَدمَ رَسُوْلُ الْـجَيْشِ، فَسَأَلَهُ عُمَرُ، فَقَالَ: يَا أَميْرَ الْـمُؤْمنينَ لَقِينَا عَدُوَّنَا فَهَزَمَنَا، فَبَيْنَا نَحْنُ كَذلَكَ إِذ سَمِعنَا صَوْتًا يُنَادِيْ: يَا سَارِيَةُ: الْـجَبَلَثَلاثًافَأَسْنَدْنَا ظُهُوْرَنَا إِلَى الْـجَبَلِ فَهَزَمَهُمُ الله، فَقِيْلَ لِعُمَرَ: إِنَّكَ كُنْتَ تَصَيْحُ بِذَلِكَ.

‘হযরত ইবনে ওমর বর্ণনা করেন ওমর (রাযি.) একদিন সৈনবাহিনী প্রেরণ করেন এবং একজনকে তার আমীর নিযুক্ত করলেন… যাকে ডাকা হত সারিয়া নামে… অতঃপর একদিন হযরত ওমর (রাযি.) মসজিদে নববীতে জুমার খুতবা প্রদানকালে (يَا سَارِيَةُ! الْـجَبَلَ) ‘হে সারিয়া, পাহাড়, হে সারিয়া পাহাড়, হে সারিয়া পাহাড় এভাবে তিনবার উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠেন। যখন সেই সৈনবাহিনীর এক বার্তা বাহক এসে জিজ্ঞাসা করলো হে আমিরুল মোমিনিন! আমরা শত্রুর সম্মুখিন হলাম, যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো কিন্তু হঠাৎ একটা উচ্চৈঃস্বর শুনতে পেলাম ইয়া সারিয়া তিনবার এবং সেই কারণে আল্লাহ শত্রুকে পরাস্ত করেছেন। তিনি হযরত ওমর (রাযি.)-কে বলেন, নিশ্চয় আপনিই সেই আওয়াজ দিয়েছিলেন।[6]

এমনই ছিলেন হযরত ওমর (রাযি.)। বুখারী শরিফে তাঁর অনেক হাদিস রয়েছে। তার নামের শুরুতে কোন উপাধি নেই। আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে ক্রমান্নয়ে বেদাআত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ রাসুল (সা.) বেদাআত থেকে আমাদেরকে দূরে থাকতে বলেছেন।

حَدِيْثُ الْعِرْبَاضِ h، وَفِيْهِ قَوْلُهُ : «وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ، فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ».

‘বিদআত নতুন কাজ থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা, প্রত্যেক নতুন কাজ হল বিদআত আর প্রত্যেক বিদআত হল গোমরাহী।[7]

 

প্রকৃত ওয়াযের প্রভাব

ওয়ায দু’প্রকার। যথা-

এক. রুহানি ওয়ায, যা মুমিনের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করে। যা শুনে মানুষের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। যেমন-

عَنِ أَبِيْ نَجِيْحٍ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ h قَالَ: «وَعَظَنَا رَسُوْلُ اللهِ مَوْعِظَةً، وَجَلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ، وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ، فَقُلْنَا: يَا رَسُوْلَ اللهِ! كَأَنَّهَا مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ، فَأَوْصِنَا، قَالَ: أُوْصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، وَإِنْ تَأَمَّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَىٰ اخْتِلَافًا كَثِيْرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْـخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ، عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ» رَوَاهُ أَبُوْ دَاوُدَ, وَالتِّرْمِذِيُّ, وَقَالَ: حَدِيْثٌ حَسَنٌ صَحِيْحٌ.

হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া (রাযি.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) একদিন নামায পড়ালেন অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে বসলেন এবং খুবই হৃদয়াগ্রহী ওয়ায করলেন। এতে হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হল, চোখে পানি চলে এলো। কেউ বলল, হে আল্লাহর রাসুল! মনে হচ্ছে, এটি বিদায়ী ব্যক্তির উপদেশ। সুতরাং আমাদেরকে কি অসিয়ত করবেন? তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের আল্লাহকে ভয় করা যথাযথ আনুগত্যের অসিয়ত করছি। যদিও তোমাদের নিয়ন্ত্রণ কোন দাসের হাতে থাকে। আমার মৃত্যুর পর যে বেঁচে থাকবে সে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমার সুন্নত খুলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ আঁকড়ে ধরা। একেবারে দাঁত কামড়ে তা ধরে রাখ। সাবধান! তোমরা মনগড়া নতুন বিষয়গুলো (বিদাত) থেকে দূরে থাকবে। কেননা প্রত্যেকটা বেদাত ভ্রান্ত।’’[8]

দ্বিতীয় প্রকার ওয়ায হলো নফসানি ওয়ায। যা মূলত শ্রোতাদেরকে আনন্দ দেওয়ার জন্য করা হয়। ওয়ায যিনি করেন তিনি যেন মানুষের কাছ থেকে বাহবা-সুনাম অর্জন করেন। আর শ্রোতরাও যেন আনন্দ-উল্লাস করে নফসকে মোটা-তাজা করতে পারে। বক্তরা ময়দান গরম করবে আর শ্রোতারা আল্লাহু আকবরঠিক ঠিক বলে গর্জে উঠে। এটি কোথায় আছে? আমাকে প্রমাণ করে দেখাও। এগুলো হল লোক দেখানো প্রর্দশনী। এটি অবৈধ।

ফতওয়ায়ে আলমগীরী (যা আরবি-ফারসি মিশ্রিত ইবারত) বাদশাহ আলমগীর সংকলন করেছেন। সেখানে আছে,

مَنْ صَلَّىٰ برائے ہنگامہ  فَهُوَ آثِمٌ.

‘যে ব্যক্তি মাহফিল গরম করার জন্য দরুদ শরিফও পড়ে সে গোনাহগার।

সুতরাং এই নতুন কুসংস্কার থেকেও আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।

 

ওয়ায মাহফিলে ছবি উঠানো

ওয়ায মাহফিলে ছবি উঠানো নিষেধ। কারণ রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি আযাব হবে সেই ব্যক্তির ওপর যে ছবি উঠায়। সুতরাং কেউ ছবি উঠাবে না। আমরা ওয়ায করছি হেদায়তের জন্য। সেখান যদি ছবি উঠানো হয় তা দ্বারা কি হেদায়ত হবে, না গোমরাহী হবে? এখানে ভিডিও কেন করা হচ্ছে? এগুলো কি প্রর্দশনী?! (খুব ধমকের সাথেই হযরত কথাগুলো বলেছিলেন) এগুলো সব গুমরাহি। আমাদের মধ্যে নতুন নতুন বিদআত সৃষ্টি হচ্ছে। এমন বিদআত থেকে অবশ্যই আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে এবং সুন্নাতের ওপর অটল থাকতে হবে।

 

কওমি মাদরাসার মৌলিক চার ফাউন্ডেশন

আমাদের কওমি মাদরাসাগুলোর ভিত্তি-ফাউন্ডেশন হল চার জিনিসের ওপর।  যথা-

  1. তাওহীদে খালেস তথা একনিষ্ঠ একাত্ববাদে বিশ্বাস।
  2. ইত্তিবায়ে সুন্নাত তথা পরিপূর্ণ সুন্নাতের অনুসরণ।
  3. তা‘আল্লুক মা‘আল্লাহ তথা আল্লাহর সাথে সু-সম্পর্ক।
  4. ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ তথা ইসলামের বিজয় অর্জন।

কওমি মাদরাসার মৌলিক ভিত্তিগুলোর মধ্যে দুই b¤^i হল ‘ইত্তিবায়ে সুন্নাত’ তথা পরিপূর্ণ সুন্নাতের অনুসরণ। সুন্নাতের খেলাপ সামান্যতমও কোনো কাজ করা যাবে না। রাসুল (সা.) যা, যেভাবে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন সবগুলো সেভাবেই মেনে নিতে হবে। যেমনটি ¯^qs রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবায়ে কেরাম করেছিলেন। এখানে একটি শব্দও পরির্বতন করার কোন সুযোগ নেই। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) এক সাহাবীকে দুআ শেখাচ্ছেন, সাহাবী শুনছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ওয়া নব্বীইকা লাযী আরসালতা।’ সাহাবী মুখস্থ করার সময় বলেন, ‘ওয়া রাসুলিকা লাযী আরসালতা।’ তিনি মনে করলেন, নবীর চেয়ে রাসুল যেহেতু বড় তাই তাঁর শান বাড়ানোর জন্য ‘রাসুলিকা’ বললেন। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘না না, ওয়া নব্বীইকা লাযী আরসালতা। আমি যে রকম বলছি সেরকমই তোমাদেরকে বলতে হবে। আমি যেভাবে নামায পড়ি সেভাবেই তোমাদেরকে নামায পড়াতে হবে; «صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ أُصَلِّيْ»|

সেভাবে সাহাবায়ে কেরামকে রাসুল (সা.) প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তাঁরা তা সেভাবেই গ্রহণ করেছেন। তাই তাদের অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়েছে। এবং আল্লাহ তাদের তাকওয়ার পরীক্ষাও নিয়েছেন,

اُولٰٓىِٕكَ الَّذِيْنَ امْتَحَنَ اللّٰهُ قُلُوْبَهُمْ لِلتَّقْوٰىؕ ۰۰۳

‘আল্লাহ তাদের অন্তরের তাকওয়া পরীক্ষা করেছেন এবং তারা সকলই পাশ করেছেন।[9]

সেই ঘোষণা আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,

وَلٰكِنَّ اللّٰهَ حَبَّبَ اِلَيْكُمُ الْاِيْمَانَ وَزَيَّنَهٗ فِيْ قُلُوْبِكُمْ وَكَرَّهَ اِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوْقَ وَالْعِصْيَانَ١ؕ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الرّٰشِدُوْنَۙ۰۰۷ فَضْلًا مِّنَ اللّٰهِ وَنِعْمَةً١ؕ وَاللّٰهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ۰۰۸

‘কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর, পাপাচার নাফরমানীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী। এটা আল্লাহর কৃপা নিয়ামত আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।[10]

 

সাহাবায়ে কেরাম উম্মতের জন্য একমাত্র আদর্শ

যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তাই তাদেরকে আল্লাহ তাআলা পরর্বতী উম্মতের জন্য আদর্শ করেছেন।

যেমন কোনো স্কুলে একজন ছাত্র পাশ করেছে আরেকজন ফেল করেছে। যে ফেল করল তার অভিভাবক তাকে বলল, তুমি ওই পাশ করা ছাত্রটির ন্যায় মেহনত কর। তাকে আইডিয়াল বানাও। তেমনি রাসুলুল্লাহ (সা.) পরর্বতী উম্মতদের উদ্দেশ্যে বলেন,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ, قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ :  «إِنَّمَا أَصْحَابِيْ كَالنُّجُوْمِ, فَبِأَيِّهِمُ اقْتَدَيْتُمُ اهْتَدَيْتُمْ».

‘হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার এক একজন সাহাবী আসমানের এক একটা তারকার ন্যায়, তোমরা যাকেই অনুসরণ করবে, হেদায়েতের পথ পেয়ে যাবে।’’[11]

সমুদ্রে যখন জাহাজ চলে তখন কোনো দিকে যাবে দিশা পায়না। তখন তারা একটা একটা তারকা ঠিক করে। এই তারকা ফলো করলে আমেরিকা যাওয়া যাবে। এই তারকা ফলো করলে লন্ডন যাওয়া যাবে। আল্লাহ বলেন,

وَ بِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُوْنَ۰۰۱۶

‘আমি তারকা দিয়েছি রাস্তা দেখানোর জন্য।[12]

রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার সাহাবায়ে কেরাম হলো তারকার ন্যায়। যাকে অনুসরণ করবে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।’ তুমি যদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে চাও ওমর (রাযি.)-কে অনুসরণ কর। তুমি যদি আদর্শ প্রেসিডেন্ট হতে চাও আবু বাকার (রাযি.)-কে অনুসরণ কর। তুমি যদি দক্ষ মুফাসসিরে কুরআন হতে চাও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে (রাযি.) অনুসরণ কর। তুমি যদি আদর্শ মুহাদ্দিস হতে চাও আবু হুরায়রা (রাযি.)-কে অনুসরণ কর। তুমি যদি আদর্শ রাষ্ট্রদূত হতে চাও দিহইয়ায়ে কালবী (রাযি.)-কে অনুসরণ কর। আর তুমি যদি গোনাহ করে অনুসূচনা করতে চাও তহালে মায়েযে আসলামী (রাযি.)-কে অনুসরণ কর।

 

সুন্নাত না থাকলে বিদআত সৃষ্টি হবে

আমরা যদি ইত্তিবায়ে সুন্নাতের ওপর আমল না করি, মুরব্বিদের তরিকার ওপর অটল না থাকি তাহলে ক্রমান্নয়ে বিদআত বাড়তে থাকবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যামানায় মাহফিলের শুরুতে বেশি পরিমাণ টাকার বিনিময়ে কিরাআত পড়ার জন্য  কারী সাহেব হায়ার করে এনেছে? এমন কোন ঘটনা কি হাদিসে আছে? এটা তো প্রর্দশনী! প্রদর্শনী ইবাদত হয় না। ওয়ায-নসীহতের মাহফিল হল ইবাদতের মাহফিল। অতএব এমন ইবাদতকে বিদআত দিয়ে নষ্ট করা ঠিক হবে না। তাই, আমরা ভবিষ্যতে এমন বিদআত সম্পর্কে সতর্ক থাকব, ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তওফীক দান করুন।

 

নিষ্ঠার সাথে কুরআন তিলাওয়াতের আজব প্রভাব!

জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার আমার পূর্বের মুহতামিম ছিলেন আল্লামা নুরুল ইসলাম কদীম সাহেব (রহ.)। একদিন তিনি ইমাম সাহেব (রহ.)-এর অনুপস্থিতিতে ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন। তাঁর পিছনে নামায পড়ছেন জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আযীযুল হক (রহ.)। কদীম সাহেব (রহ.) নামায পড়ালেন। কিরাআত পড়েছেন খুবই নরমালভাবে আস্তে আস্তে। মুফতি সাহেব (রহ.) তিলাওয়াত শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে হৈত! বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। পরে তাঁকে বললেন, নুরুল ইসলাম! তুমি আগামীতে নামায পড়াবে না। আমরা সহ্য করতে পারবো না, সুবহানাল্লাহ।

কিরাআত যদি অন্তর থেকে হয় সেই কিরাআত মানুষকে আকৃষ্ট করে। হযরত ওমর (রাযি.) রাসুল (সা.)-কে হত্য করার জন্য যাচ্ছেন। চক্ষুদ্বয় লাল, হাতে তরবারি। কাবা ঘরের পাশে সকল কাফের বসা আছে। মুহাম্মদকে কিভাবে হত্যা করা যায়? (সা.)। ওমর বলেছেন, তোমরা কেউ বাপের ছেলে নও। তোমরা পারবে না। আমিই এখন হত্যা করে তার কল্লা নিয়ে আসবো। তরবারি হাতে নিয়ে পথ চলা আরম্ভ করলো। যেতে যেতে পথে একজনের সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করল, ওমর কোথায় যাচ্ছে? তখন ওমর (রাযি.) বলেন, আজকে মুহাম্মদের কল্লা নিয়ে আসবো। তখন তিনি বলেন, আগে নিজের ঘরের খবর নাও। তোমরা বোন ফাতেমা ও তোমার ভগ্নিপতিও তো মুসলামান হয়ে গেছে। তখন ওমর রাসুলের দিকে না গিয়ে তার বোনের বাড়িতে রওনা করল। ঘরে গিয়ে দেখেন একজন মুয়াল্লিম তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি সুরা তাহা তিলাওয়াত করছেন। ঘরে ঢুকেই সকলকে প্রহার করা আরম্ভ করে দিয়েছে। উস্তাদ এক কোণায় চলে গেলেন। বোন আর ভগ্নিপতিকে খুবই পিঠালেন। কিন্তু তোহা এর আওয়ায তার অন্তরে বিদ্ধ হয়ে গেল। যেমন গুলি যখন শরীরে ঢুকে তখন বুঝতে পারে না। ঢুকে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে প্রভাব বিস্তার করে। তেমনি তোহা যখন কানে প্রবেশ করেছে তা এমন এ্যাকশন করেছে বোনকে প্রহার করার পর বলছে, ফাতেমা! আমি প্রবেশ করার সময় একটি আওয়াজ শুনেছিলাম। সেটি আমাকে আরেকবার পাঠ করে শুনাও। বোন বলে, তুমি কাফের। এটি কাফের পড়তে পারে না। ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। তার পর পড়তে পারবে। তখন ওমর বলে, ইসলাম গ্রহণ করতে হলে কি করতে হবে? বোন বলে, গোসল করে রাসুলের দরবারে যাও। তারপর তোমাকে শুনাবো। এক তোহার ধাক্কায় ওমর মোমের মত গলে গেলেন। আগে ছিলেন পাথর আর এখন হয়ে গেছেন মোম।

دورنگی چھوڑکر یک رنگ ہو جا
سراسر موم ہو یا سنگ ہو جا

‘দুই রঙ্গ ভালো নয়, এক রঙ্গ ভালো। হয়ত মোম হয়ে যাও অথবা পাথর হয়ে যাও।

ওখান থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে গেলেন। রাসুল (সা.) তখন সাফা-মারওয়া পাহাড়ের পিছনে হযরত আরকম (রাযি.) এর ঘরে অবস্থান করছেন। এদিকে সাহাবায়ে  কেরাম ওমরকে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ওমর তো এখানে চলে আসছে। আপনি একটু সর্তক হোন। তখন রাসুল সা  বলেন তোমরা নিজেদের চিন্তা করো। আমি ঠিক আছি। তাকে আসতে দাও। ওমর প্রবেশ করার সাথে সাথেই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে ওমর! আর কতদিন সন্ত্রাস করবে? ওমর কিছু বলে না। চোখ থেকে অশ্রু নির্গত হচ্ছে। কোন কিছু বলে না। তরবারি অন্য দিকে নিক্ষেপ করে দুজানু হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে বসে গেলেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সারা জীবন সন্ত্রাস করেছি। এখন এসেছি, আমাকে একটু পবিত্র করে নেন। তখন রাসুল (সা.) তাঁকে কালিমা পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে নেন।

অতঃপর যেন হযরত ওমর (রাযি.) বলছেন,

جزاک اللہ کہ چشمم باز کردی
مرا با جان جاں ہمراز کردی

আল্লামা ইকবাল (রহ.) বলেন,

دل سے جو بات نکلتی ہے اثر رکھتی ہے
پر نہیں طاقت پرواز مگر رکھتی ہے

অতঃপর হযরত ওমর (রাযি.) বলেন, হুযুর এখন আমার কাজ কি? তখন রাসুল বলেন, ঈমান আনার পর এক নম্বর কাজ হল নামায পড়া। ওমর বলেন, হুযুর নামায কোথায় পড়তে হয়? তিনি বলেন, জামায়াতের সাথে কাবা ঘরের সামনে পড়তে হয়। আপনি পড়েন না যে? ঘরে কেন পড়েন? হুযুর বলেন, তোমাদের জন্য পারিনি। তখন ওমর (রাযি.) বলেন, এখন আপনাকে নিয়ে কাবা ঘরে প্রকাশ্যে নামায আদায় করব। দেখি কে কি বলে? আল্লাহু আকবর!

হযরত ওমর (রাযি.) আগে আগে চলছে আর রাসুল (সা.) সাহাবীদেরকে নিয়ে পিছনে আসছেন। ওই দিকে আবু জাহিলরা বসে বসে ওমরের অপেক্ষা করছে। আর যখন ওমরের সাথে রাসুল (সা.)-কে আসতে দেখলেন তখন বলল, এখন তো দেখি জীবিত ধরে নিয়ে আসছে। মধ্যখানে কি ঘটনা সংগঠিত হল তা তো তারা জানত না। অতঃপর কাবা ঘরের সামনে গিয়ে হযরত ওমর (রাযি.) বলেন, ওহে আবু জাহেল! উতবা, শায়বা! রাসুল (সা.)-কে নিয়ে আজ কা‘বা ঘরের সামনে নামায আদায় করব। কেউ যদি নিজের স্ত্রীকে বিধবা করতে চাও, ছেলেকে যদি এতিম বানাতে চাও তাহলে আসো ওমরের সাথে মোকাবেলা কর। আল্লাহু আকবার! সব ঠিক হয়ে গেছে। আকাশ পরিস্কার হয়ে গেল। জামায়াতে নামায আদায় করল। তারপর রাসুল (সা.) বলেন, এতদিন ওমর বিন খত্তাব ছিল আজ থেকে আমি তার নামকরণ করলাম উনি হলেন, ওমর ফারুক! সুবহানাল্লাহ।

چوں عمر شیدائے آن معشوق شد
حق وباطل چوں دل فاروق شد

 

রাসুলের প্রতি হযরত ওমর (রাযি.)-এর ভালবাসা

সেদিন ওমর গিয়েছিলেন রাসুল (সা.) কে হত্যা করার জন্য। আর যেদিন রাসুল (সা.) ইন্তিকাল করেন সেদিন তাঁর অবস্থা ছিল ভিন্ন। তিনি তরবারি নিয়ে রাস্তায় ঘুরাফেরা করছেন। বলছেন, যদি কেউ বলে আমার রাসুল (সা.) ইন্তিকাল করেছেন তাহলে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব! মনকে কোন রকম প্রবোধ দিতে পারছেনা। কেউ তাকে থামাতে পারছে না। অতঃপর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযি.) আসলেন। এবং কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করলেন।

وَمَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوْلٌ١ۚ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ١ؕ اَفَاۡىِٕنْ مَّاتَ اَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلٰۤى اَعْقَابِكُمْ١ؕ وَمَنْ يَّنْقَلِبْ عَلٰى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَّضُرَّ اللّٰهَ شَيْـًٔا١ؕ وَ سَيَجْزِي اللّٰهُ الشّٰكِرِيْنَ۰۰۱۴۴

‘না, মুহাম্মদ, একজন রাসুল ছাড়া আর কিছু নন; তাঁর আগে আরও অনেক রাসুল গত হয়েছেন। তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা তাঁকে যদি শহীদ করা হয় তবে কি তোমরা দীন থেকে উল্টো দিকে ফিরে যাবে? সাবধান, তোমাদের যে কেউ জাহেলিয়াতের দিকে আবার ফিরে যাবে সে আল্লাহর দীনের সামান্যতম ক্ষতি সাধনও করতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা অবশ্যই দৃঢ়চেতা কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে পুরষ্কৃত করবেন।[13]

আল্লাহ বলছেন, আমার রাসুল হলেন, নুরানী মানুষ। উনি যদি ইন্তিকাল করেন অথবা শহীদ হন তাহলে তোমরা কি কাফের হয়ে যাবে? এই আয়াত শোনামাত্র হযরত ওমর (রাযি.) থেমে গেলেন। তখন তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে এই আয়াত যেন এইমাত্র নাযিল হল। তখন তরবারি হাত থেকে পড়ে গেল। হযরত আবু বকর (সা.) এই আয়াত শুনেই হযরত ওমরের হৃদয় গলে গেল। এমনই ছিল রুহানি ওয়ায-নসীহত। যা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

الَّذِيْنَ اِذَا ذُكِرَ اللّٰهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَاِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ اٰيٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِيْمَانًا وَّعَلٰى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَۚۖ۰۰۲

‘আল্লাহর নাম উচ্চারিত হলে যাদের হৃদয় বিগলিত হয়ে চমকে ওঠে, যখন তাদের নিকট আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় আর তারা কেবলমাত্র তাদের প্রভুর উপরেই ভরসা রাখে।[14]

 

রুহানি ওয়ায-নসীহতের বৈশিষ্ট্য

রুহানি ওয়ায-নসীহতের বৈশিষ্ট্য হল তার মাধ্যমে মনের মধ্যে খোদাভীতি, আখেরাতের ফিকির ও জাহান্নামের চিন্তা আসতে হওয়া। আর কুরআনের তিলাওয়াত যখন করবে তখন ঈমান বৃদ্ধি পাবে। এখন বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলে বিভিন্ন ডিজাইনে কিরাআত পড়া হচ্ছে তা দ্বারা কি ঈমান বাড়ে না নফস খুশি হয়? তাহলে আমরা তো এই ধরণের বিদআত সৃষ্টির মাধ্যমে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাত থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। অথচ আমাদেরকে কওমি মাদরাসার ফাউন্ডেশন ইত্তিবায়ে সুন্নাতের ওপর অটল থাকতে হবে। নতুন নতুন কিছু আবিষ্কার করার চেষ্ট করব না। আমি আমাদের মাওলানা আকতার সাহেবকে ডেকে বলেছি। যেন আমাদের পূর্বসূরি আকাবিরের ন্যায় ওয়ায করেন। শ্রোতাদেরকে খুশি করা এবং ঠিক, ঠিক ধ্বনি দিয়ে মাঠ গরম করলে ওয়াযের মধ্যে রূহানিয়্যত থাকবে না। তাতে বক্তাদের নফসানিয়্যত তথা আত্ম-অহংকারের কারণ হয়ে যায়। আমি হযরত পটিয়ার মুফতি আযীযুল হক (রহ.)-এর অনেক ওয়ায শুনেছি। খতিবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ সাহেব (রহ.)-এর সাথে অনেক দিন কাটিয়েছি। তাঁদের ওয়ায আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই মানুষের মাঝে কান্নার রোল পড়ে যেত।

 

খতিবে আযম (রহ.)-এর আজব কাহিনী

সাতকানিয়া থানায় বারদোনা নামে একটি গ্রাম আছে। মাওলানা আমিনুল্লাহ সাহেব একটি মাহফিলের ইন্তিজাম করেন। সেখানে খতিবে আযম (রহ.)-কে দাওয়াত করা হয়েছে। আরো অন্য লাইনের কিছু আলেমদেরকেও দাওয়াত করা হয়েছে। তাঁরা প্রায় দশবারো জন ছিলেন। ওয়াযের পূর্বে তারা পরস্পর একে অপরকে বলতে লাগলেন, আমরা এশার পর ওয়ায আরম্ভ করব আর শেষরাত্রে তাঁকে (খতিবে আযমকে) ওয়াযের সুযোগ দেব। খতিবে আযম (রহ.) তাদের একথা শুনলেন। তাই মাওলানা আমিনুল্লাহ সাহেবকে ডেকে বলেন, ভাই, আমি এসেছি উত্তমবঙ্গ থেকে খুব ক্লান্ত। আমি এশার পর কিছু কথা বলব এরপর আপনার অন্য বক্তাগণ আলোচনা করবেন। অতঃপর হুযুর মঞ্চে গেলেন। খুতবা পাঠ করলেন। যেহেতু সে মাহফিলটি ছিল নবী দিবস উপলক্ষ্যে তাই তিনি বলেন, আজ আমি রাসুল (সা.)-এর মান-মর্যাদা নিয়ে কথা বলব। সেই বক্তাগণও মঞ্চে উপস্থিত হয়ে গেলেন ওয়ায শোনার জন্য। হুযুর আস্তে আস্তে ওয়ায আরম্ভ করলেন। মঞ্চে উপস্থিত বক্তগণ হা করে তাকিয়ে রইলেন। তাদের সময় চলে যাচ্ছে এটি তাদের খবর ছিল না। বলতে বলতে দেখা গেল মসজিদে মুয়াজ্জিনের ফজরের আযান দেওয়া আরম্ভ হয়ে গেছে। কিন্তু শ্রোতাদের মাঝে ঠিক, ঠিক এর কোন শোরগোল শোনা যায়নি। পরিশেষে হুযুর বলছেন আরো অনেক বক্তাগণ বাকি আছে আজকে আমি বলব না। না হয়, কথা এখনো শেষ হয়নি। আরেকদিন সুযোগ হলে বলব ইনশা আল্লাহ। তখন ওই বক্তাগণ দাঁড়িয়ে গেলেন। তারা বললেন, আমরা কেউ ওয়ায করবো না। বাকি কথা শেষ করতে হবে। তারপর ফজরের নামায পড়ে আবারো আরম্ভ করে সকাল ৮ টার সময় ওয়ায সমাপ্ত করেছেন। শ্রোতাদের মধ্যে কোন আওয়াজ ছিল না। শেখ সাদী (রহ.) বলেন,

اے مرغ سحر عشق زپروا نہ بیاموز
کاں سوخت را جاں شد وآواز نیامد

‘হে শেষরাত্রির মোরগ! (চিৎকারকারী) তুমি যদি ইশক-মুহাব্বত পতঙ্গ থেকে শেখ। পতঙ্গ বাতির ওপর লাফ দিয়ে জ্বলে যায় কিন্তু তার কোন আওয়াজ থাকে না।[15]

আর যারা আওয়াজ করে, আমি দেওয়ানবাগী, আমি সাঈদাবাদী, আমি আটরশি তাদের সম্পর্কে বলেন,

ایں مدعیاں در طلبش  از بے خبر اند
کاں را کہ خبر شد خبرش باز نیامد

‘যারা দাবি করে আমি আল্লাহকে দেখেছি, তাদের সাথে আরশে মুআল্লার কোন সম্পর্ক নেই। কেননা যারা সম্পর্কযুক্ত হয়েছে তাদের কোনো খবর আমরা আর পাইনি।[16]

 

প্রিয় মুসলিম ভাই বোনেরা!

আমরা যারা রাসুলের আশেক ও সুন্নাতের অনুসারী দাবি করি আমাদের সকলের চিন্তা করা উচিত প্রকৃতপক্ষে আমরা কতটুকু সুন্নাতের অনুসরণ করি? অবশ্যই এ সবকিছু কিয়ামতের দিন প্রমাণিত হবে! রাসুল (সা.) বলেন,

«مِنْ أَحَبَّ سُنَّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِيْ، وَمَنْ أَحَبَّنِيْ كَانَ مَعِيْ فِي الْـجَنَّةِ».

‘আমাকে মুহাব্বত করলে আমার সুন্নাতকে মুহাব্বত কর। আমার সুন্নাতকে মুহাব্বত করলে আমার সাথে বেহেশতে থাকতে পারবে।[17]

মাসনবী শরিফে একটি ঘটনা লেখা হয়েছে, বুখারী শরিফেও আছে। মিম্বার তৈরি হওয়ার পূর্বে রাসুল (সা.) একটি খেজুর গাছের খুঁটির ওপর হেলান দিয়ে জুমার খুতবা দিতেন। এক মহিলা তার ছেলে মিস্ত্রি ছিল। সে একটি মিম্বার তৈরি করে দিল। তখন রাসুল (সা.) ওই মিম্বারে খুতবা দিলেন। তখন মসজিদে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। মনে করা হল হয়ত কোনো সাহাবী কাঁদছেন। কিন্তু না, কোনো সাহাবী কাঁদছেন না। তাহলে কে কাঁদছে? দেখা গেল সে খেজুর গাছের খুঁটিই কাঁদছে।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ k: أَنَّ امْرَأَةً مِنَ الأَنْصَارِ قَالَتْ لِرَسُوْلِ اللهِ : يَا رَسُوْلَ اللهِ أَلَا أَجْعَلُ لَكَ شَيْئًا تَقْعُدُ عَلَيْهِ، فَإِنَّ لِيْ غُلاَمًا نَجَّارًا؟ قَالَ: «إِنْ شِئْتِ»، قَالَ: فَعَمِلَتْ لَهُ الْـمِنْبَرَ، فَلَمَّا كَانَ يَوْمُ الْـجُمُعَةِ قَعَدَ النَّبِيُّ عَلَى الْـمِنْبَرِ الَّذِيْ صُنِعَ، فَصَاحَتِ النَّخْلَةُ الَّتِيْ كَانَ يَخْطُبُ عِنْدَهَا، حَتَّىٰ كَادَتْ تَنْشَقُّ، فَنَزَلَ النَّبِيُّ حَتَّىٰ أَخَذَهَا، فَضَمَّهَا إِلَيْهِ، فَجَعَلَتْ تَئِنُّ أَنِينَ الصَّبِيِّ الَّذِيْ يُسَكَّتُ، حَتَّىٰ اسْتَقَرَّتْ، قَالَ: «بَكَتْ عَلَىٰ مَا كَانَتْ تَسْمَعُ مِنَ الذِّكْرِ».

‘হযরত জাবির ইবনে (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি খেজুর গাছের গুঁড়ি (খুঁটি) ছিল। নবী (সা.) খুতবা দানকালে দাঁড়িয়ে তাতে হেলান দিতেন। তারপর যখন (কাঠের) মিম্বার (তৈরি করে) রাখা হলো, তখন আমরা দশ মাসের গর্ভবতী উষ্ট্রীর শব্দের ন্যায় গুঁড়িটির (কান্নার) শব্দ শুনতে পেলাম। পরিশেষে নবী (সা.) (মিম্বার হতে) নেমে নিজ হাত তার ওপর রাখলে সে শান্ত হলো। অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যখন জুমুআর দিন এলো এবং নবী (সা.) মিম্বারের ওপর বসলেন, তখন খেজুরের যে গুঁড়ির পাশে তিনি খুতবা দিতেন, তা এমন উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠল যে, তা ফেটে যাবার উপক্রম হয়ে পড়ল! অপর বর্ণনায় আছে, ‘শিশুর মতো মিম্বার কেঁদে উঠল। সুতরাং নবী (সা.) (মিম্বার থেকে) নেমে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন সে সেই শিশুর মত কাঁদতে লাগল, যে শিশুকে (আদর করে) চুপ করানো হয় (তাকে চুপ করানো হলো এবং) পরিশেষে সে প্রকৃতিস্থ হলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এর কান্নার কারণ হচ্ছে এই যে, (কাছে থেকে) খুতবা শুনত (যা থেকে সে এখন বঞ্চিত হয়ে পড়েছে)।’’[18]

হুযুর (সা.) তার কাছে গেলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন সে বলল, আপনার বিরহের ব্যথা আমি সহ্য করতে পারছি না। তাই কাঁদছি। রাসুল (সা.) তাকে ভালবাসার প্রতিদান দিলেন। তাকে দুটি প্রস্তাবের একটি গ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হল:

  1. তোমাকে আমি এখান থেকে উঠিয়ে মাটিতে লাগিয়ে দেব। তাতে তুমি আবারো জীবিত হয়ে যাবে এবং কেয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকবে আর তোমার খেজুর মানুষ খাবে।
  2. তোমাকে আমি মানুষের মতো দাফন করব। কিয়ামতের দিবস তোমাকে আমার বগলে নিয়ে বেহেশতে চলে যাব। কোন প্রস্তাব তুমি ভালো মনে কর? সে দুই b¤^i প্রস্তাবটি গ্রহণ করল। কেয়ামত পর্যন্ত মানুষ আমার খেজুর খাবে তাতে আমার কি? আপনার সাথে যদি বেহেশতে যেতে পারি, আপনার সাথে থাকতে পারি এটিই আমার জন্য পরম সৌভাগ্য।

استن حنانہ از ہجر رسول
نالہ می زد ہمچو از باب عقول
حَنَّ جِذْعُ النَّخْلِ إِذْ حَلَّ بِهِ
مِنْ مُصَابِ الْـهجْرِ حُزْنٌ وَّخَبَلْ
ضَمَّهُ بِالصَّدْرِ فَاسْتَسْلىٰ بِهِ
كَصَبِيٍّ بِلَبَانٍ يُشْتَغَلْ
وَاَسَرَّ بِكَلَامٍ فَارْتَضَىٰ
كَوْنَهُ فِيْ الْـخُلْدِ غَرْسًا وَّامْتَثَلْ[19]

 

একটা খেজুর গাছের খুঁটি রাসুল (সা.)-কে মুহাব্বত করার কারণে রাসুল (সা.) বলছেন তুমি আমার সাথে বেহেশতে থাকবে। আর আমরা মানুষ হয়ে যদি রাসুল (সা.)-কে মুহাব্বত করি, রাসুলের সুন্নাতকে মুহাব্বত করি তাহলে নিশ্চয় নিশ্চয় আল্লাহ পাক আমাদেরকে রাসুলের সাথে বেহেশত নসীব করবেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে বিদআত থেকে বেঁচে সুন্নাতের ওপর আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।

সংকলন:

মুহাম্মদ সলিমুদ্দিন মাহদি কাসেমী

শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম


 

[১] আল-কুরআন, সুরা আল-আনফাল, ৮:২Ñ৪

[২] (ক) আন-নাওয়াওয়ী, আল-আরবাউন আন-নাওয়াবিয়া, দারুল মিনহাজ, বয়রুত, লেবনান (নতুন সংস্করণ: ১৪৩০ হি. = ২০০৯ খ্রি.), পৃ. ৮৯Ñ৯০, হাদীস: ২৮; (খ) আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ২০০Ñ২০১, হাদীস: ৪৬০৭; (গ) আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, মুস্তফা আলবাবী অ্যান্ড সন্স পাবলিশিং অ্যান্ড প্রিন্টিং গ্রুপ, কায়রো, মিসর, খ. ৫, পৃ. ৪৪, হাদীস: ২৬৭৬

[৩] মুসলিম, আস-সহীহ, দারু ইয়াহইয়ায়িত তুরাস আল-আরবী, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ২২৯৭, হাদীস: ৩০০২

[৪] আল-কুরআন, সুরা আশ-শামস, ৯১:৯Ñ১০

[৫] (ক) আহমদ ইবনে হাম্বল, আল-মুসনদ, মুআস্সিসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২১ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ২৮, পৃ. ৬২৪, হাদীস: ১৭৪০৫; (খ) আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, খ. ৫, পৃ. ৬১৯, হাদীস: ৩৬৮৬

[৬] (ক) আলী আল-মুত্তাকী, কনযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল, মুআস্সাসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান, খ. ১২, পৃ. ৫৭১Ñ৫৭২, হাদীস: ৩৫৭৮৮Ñ৩৫৭৮৯; (খ) আবু আবদুর রহমান আস-সুলামী, আল-আরবাউন ফিত তাসাওউফ, মজলিসু দায়িরাতিল মাআরিফ আল-উসমানিয়া হায়দারাবাদ, দাক্ষিণাত্য, ভারত (প্রথম সংস্করণ: ১৪০১ হি. = ১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ৩, হাদীস: ৫; (গ) আবু নুআইম আল-আসবাহানী, দালায়িলুন নুবুওয়াত, দারুন নাফায়িস, বয়রুত, লেবনান (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪০৬ হি. = ১৯৮৬ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ৫৭৯Ñ৫৮০, হাদীস: ৫২৫Ñ৫২৮

[৭] আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ২০০Ñ২০১, হাদীস: ৪৬০৭

[৮] (ক) আন-নাওয়াওয়ী, আল-আরবাউন আন-নাওয়াবিয়া, দারুল মিনহাজ, বয়রুত, লেবনান (নতুন সংস্করণ: ১৪৩০ হি. = ২০০৯ খ্রি.), পৃ. ৮৯Ñ৯০, হাদীস: ২৮; (খ) আবু দাউদ, আস-সুনান, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়া, বয়রুত, লেবনান, খ. ৪, পৃ. ২০০Ñ২০১, হাদীস: ৪৬০৭; (গ) আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, খ. ৫, পৃ. ৪৪, হাদীস: ২৬৭৬

[৯] আল-কুরআন, সুরা আল-হুজারাত, ৪৯:৩

[১০] আল-কুরআন, সুরা আল-হুজারাত, ৪৯:৭Ñ৮

[১১] ইবনে বাত্তাহ আল-উকবারী, আল-ইবানাতুল কুবরা = আল-ইবানাতু আন শারীয়াতিল ফিরকাতিন নাজিয়া ওয়া মুজানাবাতিল ফিরাকিল মাযমূমা, দারুর রায়া, রিয়াদ, সউদি আরব (দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৪১৫ হি. = ১৯৯৪ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৫৬৫, হাদীস: ৭০২

[১২] আল-কুরআন, সুরা আন-নাহল, ১৬:১৬

[১৩] আল-কুরআন, সুরা আলে ইমরান, ৩:১৪৪

[১৪] আল-কুরআন, সুরা আল-আনফাল, ৮:২

[১৫] শায়খ সা’দী, গুলিস্তাঁ, দানিশ, তেহরান, ইরান (প্রথম সংস্করণ: ১৩৭৪), পৃ. ৫

[১৬] শায়খ সা’দী, গুলিস্তাঁ, পৃ. ৫

[১৭] (ক) আল-বাগাওয়ী, মাসাবীহুস সুন্নাহ, দারুল মা’রিফা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৭ হি. = ১৯৮৭ খ্রি.), খ. ১, পৃ. ১৬২, হাদীস: ১৩৮; (খ) আত-তিরমিযী, আল-জামি‘উল কবীর = আস-সুনান, খ. ৫, পৃ. ৪৬, হাদীস: ২৬৭৮, হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত

[১৮] আল-বুখারী, আস-সহীহ, দারু তওকিন নাজাত, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪২২ হি. = ২০০১ খ্রি.), খ. ৩, পৃ. ৬১, হাদীস: ২০৯৫

[১৯] হাবীবুর রহমান উসমানী, লামিয়াতুল মু’জিযাত, এদারায়ে এশাআতে দীনিয়াত, আন্দরকল্লিা, চট্টগ্রাম (১৪১৭ হি. = ১৯৯৬ খ্রি.), পৃ. ৬১

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ