জামেয়া ওয়েবসাইট

রবিবার-৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি-৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাপ ও অপরাধ নিয়ে সেক্যুলার ও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক আলোচনা

পাপ অপরাধ নিয়ে সেক্যুলার ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক আলোচনা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক

[পাপ অপরাধের পার্থক্য প্রসঙ্গে একটা ফেইসবুক নোটের ওপর এটি একটি ঘরোয়া আলোচনা। পাপ অপরাধ, দুটো আলাদা ব্যাপার। পাপের বিচার করবেন স্রষ্টা। আর অপরাধের বিচার করবে মানুষ তথা মানুষের সংশ্লিষ্ট নানাবিধ প্রতিষ্ঠান। এই আলোচনাতে দেখানো হয়েছে, এটি হচ্ছে সেক্যুলার প্যারাডাইম উদ্ভূত ধারণা। ইসলামি প্যারাডাইমে পাপ অপরাধ স্বরূপগত অভিন্ন। সব অপরাধই পাপ। সব পাপই অপরাধ। তবে ইহকাল পরকালের ভাগাভাগি এবং কর্মসম্পাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তা হিসেবে মানুষ খোদার জুরিসডিকশান, এরিয়াগত স্বাতন্ত্র্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্পর্কের কারণে মানুষ কেবলমাত্র অপরাধের বিষয়েই কনসার্ন হয়, হতে পারে এবং হওয়া উচিত।]

পূর্বে প্রকাশের পর

তাহলে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় দায়দায়িত্ব পালন করতে পারবে, রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। রাষ্ট্র যদি তাদের কোনো ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে ইসলামটা সেখানে থাকবে কেন? এটি অহেতুক একটি লেজুড়ের মতো হয়ে পড়বে না? এটা একটা রিডানডেন্সি হলো না? যে জিনিসটা ছাড়াই আপনার সবকিছু চলে, সে জিনিসটা থাকার দরকারটা কি? তাই না?

তারমানে আমরা ইসলামিক প্যারাডাইম থেকে শিফট করে সেক্যুলার প্যারাডাইমে চলে আসলাম। অথচ প্রথমে আমরা স্বীকার করে নিয়েছিলাম, ইসলামিক প্যারাডাইম ও সেক্যুলার প্যারাডাইম আলাদা দুটি বিষয়। তাহলে প্রাচীনকালে বা মধ্যযুগে মুসলিম চিন্তাবিদ, ফকীহ ও মুসলিম দার্শনিকরা ইসলামি রাষ্ট্রের যে চিত্র, চরিত্র, প্রকল্প তৈরি করেছেন, সে অনুযায়ী কিন্তু রাষ্ট্র মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবেও নিয়ন্ত্রণ করবে, উদ্বুদ্ধ করবে। তবে সব বিষয়ে রাষ্ট্র তার নিজস্ব আইন নিয়ে হাজির হবে না এবং রাষ্ট্রের আইনও কিন্তু এক রকম নয়। যেমন- যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদানের বিভিন্ন মাত্রা আইনে দেওয়া থাকে। সে অনুযায়ী একজন বিচারক সর্বোচ্চ শাস্তিও দিতে পারেন, আবার সর্বনিম্ন শাস্তিও দিতে পারেন।

তাহলে নৈতিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে সেক্যুলার রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্র সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে না। যে বিষয়গুলোকে ফিক্স করে দেওয়া আছে, সেগুলোকে রাষ্ট্র সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করবে। ইসলামি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সে রকম। নৈতিকতার যে বিষয়গুলো মোর পারসোনাল, মোর মোরাল, সেগুলো হবে লেস লিগ্যাল, লেস লেজিসলেটিভ। এর আইনগত দিকটা যথাসম্ভব কম হবে। নৈতিকতা যেখানে বাড়বে, আইনগত ব্যাপার সেখানে কমবে। আর আইনগত বিষয় যেখানে যত বেশি বাড়তি হবে, নৈতিকতার অবকাশ সেখানে তত কমতে থাকবে। আইন যত শক্ত হবে, স্বাধীনতা তত সীমিত হবে। আর স্বাধীনতা বা বিকল্প বেছে নেয়ার ব্যাপার যত বেশি হবে, আইনটা তত ফ্লেক্সিবল হবে। এবং টোটালি ফ্রি একটা সিচুয়েশনে কিন্তু কোনো আইন থাকবে না। আর যেখানে আইন প্রয়োগযোগ্য সেখানে আইনের কোনো অন্যথা বা আদার অপশন হতে পারে না। আইনের প্রয়োগযোগ্যতা যেখানে বলবাৎ সেখানে আইন ছাড়া অন্য কোনো প্রসঙ্গ থাকবে না। Either you do it, or dont do it. If you do it, its OK. or, if you don’t do it, you will be punished এটিই হলো আইনের অভিন্ন ভাষা।

তাহলে মানুষের পাপ কাজ নিয়ে যখন ইসলামি রাষ্ট্র কনসার্ন হবে, তখন এসব বিষয়কে সে ধরনের ব্যাপার মনে করা হবে না, যেগুলোর জন্য শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। যেমন- ব্যভিচার বা জিনার নির্ধারিত শাস্তি আছে। চুরির একটা শাস্তি আছে। এখন কেউ চুরি করলো, কিন্তু ধরা পড়লো না, তখন কী হবে? রাষ্ট্র কাকে শাস্তি দেবে?

শ্রোতা: কাউকে দেবে না।

আমি: কাউকে দেবে না। তাই তো? কিন্তু অপরাধ তো সংঘটিত হয়েছে। সে ব্যাপারে রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা করছে? কোনো ব্যবস্থা করেনি। আসলে করতে পারেনি। মনে করেন, কেউ নিহত হলো। হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে কাকে শাস্তি দেবে? দেবে না। তাই না? কেন দেবে না? কারণ রাষ্ট্র দিতে পারছে না। তাহলে একটি অপরাধ হয়েছে, কিন্তু অপরাধটিকে রাষ্ট্র ট্রেস করতে পারেনি।

তেমনি পাপের বিষয়গুলোও, যেগুলো আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত, সেগুলো রাষ্ট্র ট্রেস করতে পারে না। হত্যা করাও একটা পাপ, মিথ্যা কথা বলাও একটি পাপ। এখন কিছু মিথ্যা কথা আছে, যেগুলো বললে চুক্তিভঙ্গ হয়। রাষ্ট্র সেগুলো ধরে থাকে। আবার কিছু মিথ্যা আছে, যেগুলো বলার মাধ্যমে চুক্তি ভঙ্গ হয় না, বা হলেও রাষ্ট্র তা ধরতে পারলো না, কিংবা, আমি যে মিথ্যা বলেছি, তা প্রমাণ করা গেলো না, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিন্তু ধরলো না। তাহলে মানুষের ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য ইতাদি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা আছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে পাপগুলোকে রাষ্ট্র আইডেন্টিফাই করতে পারে না, সেগুলোকে আমরা পাপ বলছি; আর যে পাপগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে, সেগুলোকে অপরাধ বলছি। তাহলে আদতে পাপ ও অপরাধের এই বাইনারিটা আর থাকে না।

শ্রোতা: সেক্যুলার প্যারাডাইমে যেমনটা বলা হয়, ধর্মটা হলো ব্যক্তিগত, আর রাষ্ট্রটা হলো সবার। তাহলে ইসলামি প্যারাডাইমে ফাইনালি ব্যাপারটা কী রকম দাঁড়ালো?

আমি: ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যাপারে যদি আমরা চিন্তা করি এটি হলো মুসলমানদের রাষ্ট্র। ইসলাম অনুসারীরাই সেখানে মূলত নাগরিক। বাকিরা হলো তাদের জিম্মি বা আশ্রিত, তারা  আসলে সমান নাগরিক অধিকার প্রাপ্ত নয়। ইসলামি রাষ্ট্রকে যদি আমরা এভাবে চিন্তা করি, তাহলে সেখানে ধর্ম আর ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে থাকছে না। এখানে রাষ্ট্রটাই হলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র।

শ্রোতা: মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় কি এমন ছিলো?

আমি: না। আমরা যদি মনে করি, ইসলামি রাষ্ট্রটা হলো মুসলমানদের রাষ্ট্র, তাহলে রাষ্ট্রের ধরন এক রকম হবে। আর যদি মনে করি, ইসলামি রাষ্ট্র হলো এমন রাষ্ট্র, যেটি শুধু মুসলমানদের নয়, তবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের রাষ্ট্র। তাহলেও সেটি এক ধরনের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হবে। আর আমরা যদি মনে করি, ইসলামি রাষ্ট্র শুধু মুসলমানদের রাষ্ট্র নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রও নয়। বরং ইসলামি রাষ্ট্র হলো এমন রাষ্ট্র, যেখানে  রাষ্ট্র সংক্রান্ত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। তাহলে এটি প্রথম দুই প্রকারের ধর্মীয় রাষ্ট্রের মতো হবে না। ধর্মীয় রাষ্ট্র যদি না হয়, তাহলে ধর্মীয় বনাম ধর্মনিরপেক্ষ, এহেন বাইনারির হিসেবে এটি এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই হবে।

এ জন্য এই কথাটা খুব প্রাসঙ্গিক, ইসলামি রাষ্ট্রের কিন্তু একক কোনো মডেল নেই, যেটি ফলো করলে তা ইসলামি রাষ্ট্র হবে। কথাটা সহজে বোঝানোর জন্য পোশাকের কথা বলা যেতে পারে। নারীদের পোশাক বা পুরুষদের পোশাক, যে ধরনেরই হোক না কেন, পোশাকের মৌলিক উদ্দেশ্য পূরণ হলেই হলো। তাহলে একজন পুরুষ হিসেবে আমি যদি শুধু একটা থ্রি-কোয়ার্টার পরে থাকতাম, তাহলেই বোধহয় ভালো হতো। নাকি?

শ্রোতা: না।

আমি: কেন নয়?

শ্রোতা: ওটা ইনডিসেন্ট।

আমি: কিন্তু ওটা তো রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করছে।

শ্রোতা: তা সত্ত্বেও সেটা ইনফরমাল।

আমি: ফরমাল রিকোয়ারমেন্ট তো সেটা ফিলাপ করছে। তাহলে সেটা ফরমাল হবে না কেন?

শ্রোতা: কিন্তু সমাজ সেটি মেনে নিচ্ছে না। মানে, ওভাবে!

আমি: সমাজের চিন্তাটা বাদ দেন, আমরা যদি আইডিয়েল চিন্তা করিু একজন পুরুষ মানুষ যদি কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে পোশাক পরে, আর বাদবাকি কোনো কিছু না পরে, তাহলে তো তার পোশাক পরার দায়িত্ব পালন হচ্ছে। আপনি এটাকে ইনফরমাল, ইনডিসেন্ট বলছেন কেন?

আচ্ছা, আমরা যদি নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে আসি, তাহলে আলোচনাটা আরো একটু সুন্দরভাবে করতে পারবো। নারীদের পোশাকের ক্ষেত্রে ঘরের বাইরে এক ধরনের রিকোয়ারমেন্ট, ঘরের ভেতর পারিবারিক পরিবেশে আরেক ধরনের রিকোয়ারমেন্ট। আবার যেখানে কোনো পুরুষ নেই, শুধু নারীরাই রয়েছে, সেখানে রিকোয়ারমেন্ট আরো শিথিল।

ইসলামি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি সে রকম। ইসলামি রাষ্ট্র এমন কোনো সিঙ্গেল এন্টিটি নয় যে, এই এই নিয়মকানুনগুলো সর্বোচ্চভাবে বজায় থাকলে সেটা ইসলামি রাষ্ট্র হবে, অন্যথায় নয়। এ প্রসঙ্গে আমরা আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করেছিলামু শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা নিয়ে। অর্থাৎ মহানবী (সা) মদীনায় হিজরত করার পর পরই যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে এমন অনেক নিয়মকানুন ছিলো না, যেগুলো পরে এসেছে। তৎসত্ত্বেও, সেটি কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্রই ছিলো।

তাহলে ইসলামি রাষ্ট্র শুধু মুসলমানদের রাষ্ট্র নয়। ইসলামি রাষ্ট্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট রাষ্ট্র নয়। ইসলামি রাষ্ট্র হলো সেটি, যেখানে ইসলামের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো প্রতিফলিত হয়। এখন ইসলামের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তো একটিমাত্র জিনিস নয় যে, এটি নিলাম, তাই ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে গেলো, কিংবা এটি নিলাম না, তাই এটি সম্পূর্ণ বাদ গেলো। ইসলামের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক নীতিমালাগুলো তো অনেক হায়ারার্কিকাল। হিজরতের পর মোহাম্মদ (সা) মদীনায় যে ১০ বছর বেঁচেছিলেন, সেই সময়টার কথা যদি বলি, প্রথম হিজরীর ইসলামি রাষ্ট্র, পঞ্চম হিজরীর ইসলামি রাষ্ট্র এবং দশম হিজরীর ইসলামি রাষ্ট্রের চেহারা কিন্তু এক নয়। তাই না? তাহলে কোন সময়কালটা আসলে ইসলামি রাষ্ট্র হবে?

এটি নিয়ে আমার একটি লেখা আছে, আপনি দেখেছেন হয়তোবা। আমি একটি স্কেল তৈরি করেছি।  সেই স্কেলে আমি দেখিয়েছি, যেখানে ইসলামের মূল বিষয়গুলোকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে বাধাবিঘ্নহীনভাবে মানা যায়, এবং সামাজিক বিষয়গুলোতে ইসলামের সবচেয়ে ভালো অপশনটা মানা না গেলেও লোয়েস্ট অপশন দিয়ে চলা যায়; সেটিকে যদি আমরা সিভিল ডেমোক্রেটিক স্টেট ধরি, যে স্টেটটা টলারেন্ট, ইনক্লুসিভ, ওইটাও এক ধরনের ইসলামি রাষ্ট্র। তবে এটি খুব লোয়ার লেভেলের ইসলামি রাষ্ট্র। যেমন, একজন পুরুষ হিসেবে আমি যদি শুধুমাত্র একটি থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে বসে থাকি, এটি আমার মিনিমাম রিকোয়ারমেন্টকে ফুলফিল করে, কিন্তু আমার জন্য এটি ডিসেন্ট হতো না। একইভাবে, ইসলামের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনগুলো যত ভালোভাবে পালন করা যাবে, এগুলো সমাজে যত ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে, সেই রাষ্ট্রটা তত উন্নতমানের ইসলামি রাষ্ট্র।

তাহলে ইসলামি রাষ্ট্র কিন্তু একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তবে এটি যে অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রচলিত রাষ্ট্রগুলোর সাথে এর একটি পার্থক্য হলো, মুসলমানরা ওই রাষ্ট্রে নাগরিক হিসেবে বসবাসের মাধ্যমে সবকিছু করবে আল্লাহর নিয়তে এবং যথাসম্ভব আল্লাহর ইবাদতের ফরমেটে। যথাসম্ভব বললাম এই জন্য যে, মনে করেন, যাকাত আদায়কারী কোনো প্রতিষ্ঠান ওই রাষ্ট্রে নেই। একটি সিভিল ডেমোক্র্যাটিক স্টেটের কথাই ধরেন। একটি ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র। মুসলমানরা সেখানে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দেবে, রাষ্ট্র তাতে বাধা দিচ্ছে না।

রাষ্ট্র যদি বলে, তুমি এভাবে হিসাব করে আড়াই শতাংশ কাউকে দিতে পারবে না, তাহলে তো এটি আর ইনক্লুসিভ, টলারেন্ট স্টেট হলো না। সেই তো এগ্রেসিভ একটি রাষ্ট্রই হলো। তুরস্কে বলেছে না যে, তুমি মাথায় কাপড় দিতে পারবে না। কেন, কেউ রোদ থেকে বাঁচার জন্যও তো মাথায় কাপড় দিতে পারে। অথবা, কেউ আল্লাহর ইবাদতের নিয়তে পর্দা করেছে, কিন্তু কেউ তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলতে পারে যে, এটি আমার পার্সোনাল লিবার্টি। এবং আই ফিল বেটার ইন দ্যাট। সেটা সে বলতেই পারে। এবং সেটি ইসলামের দৃষ্টিতেও কোনো সমস্যা নয়।

তাহলে যে নিয়মগুলো একজন মুসলমান সমাজে পালন করতে পারছে, সেগুলো সে করলো। এবং সবকিছুই সে ইবাদতের নিয়তে করলো। সমাজে যেগুলো খুব একটা স্ট্রাকচারাল ফরমেটে নেই, সেগুলো সে পার্সোনালি করলো, যথাসম্ভবভাবে করলো। তাহলে ইসলামি বিষয়গুলো ইসলাম ঠিক যেভাবে করতে বলেছে, ঠিক সেভাবে এগুলো মুসলমানরা যত বেশি পালন করতে পারবে, সেটি হচ্ছে তত বেশি ইসলামি রাষ্ট্র। কোনো একটি রাষ্ট্রে যদি মাত্র একজন মুসলমান থাকে এবং ইসলামের সকল নিয়মকে সে যদি স্বাধীনভাবে মানতে পারে, তাহলে সেটি ইসলামি রাষ্ট্র না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক মিসকনসেপ্ট আছে। দেখেন, কথাগুলো শুনে আপনিও অবাক হয়ে যাচ্ছেন যে, কথাগুলো কত র্যা ডিক্যাল! এবং আমার মতো লোক না বললে অন্যরা তো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখাতো যে, কী কথা বলছে!

আর একটি ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলমানরা যদি মেজরিটি হয়, তাহলে মাইনরিটিরা সেখানে মুসলমানদের সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। রাষ্ট্র অমুসিলমদের ওপর ধর্মীয় কর্তৃত্ব ফলাবে না। কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় বা নৈতিক মান বজায় রাখার চেষ্টা করবে। তাহলে ধর্মীয় মানটাও কিন্তু এক ধরনের নৈতিক মান। নৈতিকতার জন্য রাষ্ট্র শাস্তি দেবে না। কিন্তু নৈতিকতা গড়ে তোলার জন্য কি রাষ্ট্র কন্ট্রিবিউট করবে না? নৈতিকতা গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্র এক ধরনের মেকানিজম ফরম্যাট করবে না?

কথার কথা, বাচ্চাদেরকে স্কুলে আমরা কেন শেখাই? স্বাধীনভাবে কোনো কিছু শেখার যোগ্য নয় বলেই তো তারা বাচ্চা। এখন এই বাচ্চা বয়সে আমরা যদি তাদেরকে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিষয়গুলো না বলি, তাহলে বড় হয়ে সে কিন্তু সেগুলো অর্জন করতে ব্যর্থ হবে। ফলে সমাজে সে কন্ট্রিবিউট করতে পারবে না। সভ্য নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে না।

বাচ্চারা কি ধর্ম বুঝে, বিজ্ঞান বুঝে, বা অন্য কিছু? কিছুই বুঝে না। বিজ্ঞানের নিয়মগুলো ধর্মের নিয়মগুলোর মতোই কি সে মুখস্ত করে না? সে কি এগুলো টেস্ট করে করে দেখেছে? কথার কথা আরকি। তো, তাকে যদি ধর্ম শিক্ষা না দেওয়া যায়, তাহলে বিজ্ঞান শিক্ষা কেন দেওয়া হবে? আপনি মনে করছেন, বিজ্ঞানটা উপকারী, ধর্মটা অপকারী। এটা আপনার মনে করার বিষয়। আমি মনে করতে পারি, ধর্মটা উপকারী, একইসাথে বিজ্ঞানটাও উপকারী। ধর্মের পাশাপাশি বিজ্ঞানও থাকা উচিত, এটা আমি মনে করতে পারি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানরা মেজরিটি হলেও মাইনরিটিরা সমান অধিকার পাবে। ওই নাগরিকদেরকে নৈতিকভাবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্র চেষ্টা করবে। কিন্তু আমাদের সমাজে মূল গণ্ডগোলটা পাকিয়েছে এখানে যে, আমরা মুসলামান বিবেচনা করি আদমশুমারির গণনা দেখে, যারা মুসলিম নাম ধারণ করে, কিছু ইসলামি সংস্কৃতিও পালন করে, তাই তারা মুসলমান। কিন্তু ইসলাম তো আসলে সেই ধরনের বিষয় নয়। তাহলে কি মুসলিম রাষ্ট্রে খ্রিস্টানদের ব্যাপ্টিজম করার মতো!

শ্রোতা: ব্যাপ্টিজম মানে?

আমি: ব্যাপ্টিজম মানে হলো, একটু বড় হওয়ার পর একজন খ্রিস্টানকে গির্জায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তার মাথের চুল কামিয়ে দিয়ে মাথায় পবিত্র জল ঢালা হয়। এ সময় মন্ত্রপাঠ করা হয়। এর ফলে এখন থেকে সে খ্রিস্টান হয়ে গেলো। এই হলো ব্যাপ্টিজম।

তো, মুসলমানদের মধ্যে তো এ ধরনের কোনো ব্যাপ্টিজম নেই। তাহলে কি ইসলামি রাষ্ট্রের মধ্যে এমন একটি ব্যবস্থা থাকবে, যেখানে লোকজন ডিক্লারেশন দেবে যে, হ্যাঁ, আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম? আপনার কাছে কোনটা পজিবল মনে হয়? এগুলোর প্রত্যেকটাকেই আপনার কাছে পিকিউলার বলে মনে হবে। জন্মগতভাবে মুসলমানদেরকে মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক হচ্ছে না বলে যদি মনে করেন, তাহলে খ্রিস্টানদের মতো এক সময় কোথাও গিয়ে সে একটা ডিক্লারেশন দেবে, হ্যাঁ, এখন থেকে আমি মুসলমান, ইসলাম গ্রহণ করলাম। আপনি তাকে এই যুক্তিতে ধর্মীয় নৈতিকতা শেখানোর জন্য বাধ্য করবেন, যেহেতু সে ইসলামের অনুসারী। সে যদি ইসলামের অনুসারী হয়ে থাকে, তাহলে কেন সে ইসলামের অনুসরণ করবে না? কিন্তু সে কখন থেকে ইসলামের অনুসারী হলো? কখন সে বললো যে, হ্যাঁ, আমি এখন থেকে ইসলামের অনুসারী?

তাহলে, তার ঘোষণা দেওয়া যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, জন্মগত পরিচয়ও যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে গ্রহণযোগ্য পন্থা কী? আপনার কাছে কী মনে হয়?

আমার কাছে মনে হয়, ধর্মগ্রহণ করা বা না করার অবাধ স্বাধীনতা থাকা উচিত। কেউ যেন চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে, বা কোনো সুবিধা পাওয়ার জন্য, বা কোনো অসুবিধা থেকে বাঁচার জন্য ধর্মের অনুসারী না হয়। সেক্ষেত্রে ব্যাপ্টিজম বা রেজিস্ট্রেশন জাতীয় কিছু না করে বরং একটা সামাজিক আবহ বা সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। কেউ চাইলে এটি মানবে, বা কেউ চাইলে সেটি মানবে না। তবে যারা সেটি মানবে, রাষ্ট্র তাদেরকে সেটি মানার জন্য বাধ্য করবে। এখানে এসে দেখা যাচ্ছে, অপরাধ ও পাপের পার্থক্যটি আর থাকছে না।

সমস্যা হলো, রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্য করার অর্থকে আমরা ধরে নিচ্ছি, সৌদি আরবের মতো সবাই নামাযের সময় লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং পেটানো শুরু করবে। এই আর্টিকেলে যেটাকে বলা হয়েছে ‘মোরাল পুলিশিং’। আসলে ব্যাপারটা সে রকম নয়। রাষ্ট্র যে আমাদেরকে বাধ্য করে, সেটি কীভাবে করে? রাষ্ট্র আমাদেরকে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে যেতে বলে। আমরা তো বাম পাশ দিয়েও যাই। রাষ্ট্র আমাদেরকে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে বলে। আমরা তো রাস্তার ওপর দিয়েও হাঁটি। রাষ্ট্রের নিয়ম তো আমরা কতই ভঙ্গ করছি। এখন কেউ বলতে পারে, বাংলাদেশের মতো যেখানে আইনের বাস্তবায়ন নেই, সেখানে হয়তো আপনি তা করতে পারছেন। কিন্তু বাকি জায়গায় গেলে খবর আছে।

আসলে কোথাও কিন্তু রাষ্ট্র মানুষকে সর্বাংশে নিয়ন্ত্রণ করে না, করতে পারেও না, বা করতে চায়ও না। রাষ্ট্র যখন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তখন কিন্তু রাষ্ট্র বিচারকদেরকে বা যারা আইন প্রয়োগ করবে, তাদেরকে একাধিক অপশন দিয়ে রাখে। আমাদের দেশের আইনের কথাই ধরেন। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট অর্থাৎ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের একটি বিরাট স্বাধীনতা থাকে যে, তারা কীভাবে তা বাস্তবায়ন করবে। তাদেরকে একটি বিবেচনাবোধ বা স্বাধীনতা থাকে। আবার একটি ফরমাল শুনানির মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে গেলে, তখনও কিন্তু বিচারকের এক ধরনের বিশেষ ক্ষমতা থাকে। তাহলে রাষ্ট্র আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের মতো করে। রাষ্ট্রও তো সব অপরাধ ধরতে পারে না।

তাহলে মূল কথা হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ ও অপরাধের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। কিন্তু এইসব লেখার মধ্যে ওয়েস্টার্ন প্যারাডাইমের আলোকে যে রকম পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে, ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে আদতে পাপ ও অপরাধের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। সকল ভালো হচ্ছে পুণ্য, আর সকল খারাপ হচ্ছে পাপ। সকল পাপই হচ্ছে অপরাধ, আর সকল অপরাধই হচ্ছে পাপ। তবে আমরা যখন পাপ বলি, তখন আমরা সেই ধরনের অপরাধকে বুঝিয়ে থাকি যেটির বিচার শুধু আল্লাহ করবেন। আর অপরাধ বলতে বুঝিয়ে থাকি, যার বিচার বান্দাহগণও করতে পারে বা করে বা করার কথা। কিন্তু ওয়েস্টার্ন প্যারাডাইমে ‘পাপ’ নামক অপরাধকে নিছকই ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নামায, রোযা, হজ, যাকাত, বিয়েশাদিু সবকিছু যদি ব্যক্তিগত হয়, তাহলে ধর্মটাই থাকার দরকার কী?

আসল জিনিসটা হলো নৈতিকতা ও আইনের মধ্যকার ব্যাপারটি। নৈতিকতার সব বিষয় আইনে থাকে না। আর নৈতিকতা সংক্রান্ত ইসলামের ধারণা কিন্তু জগতের বিস্তৃতির সাথে সম্পর্কিত।

সেক্যুলার প্যারাডাইমে জগতটা হলো আমরা যতটুকু দেখি ততটুকু। এখানে জীবনটা হলো আমরা যতটুকু বেঁচে আছি ততটুকু। আর ইসলামি প্যারাডাইমে জগতের ধারণা হলো আল্লাহর সৃষ্টি অনেক বড়। আল্লাহ আমাদের জন্য অনেক মাখলুকাত তৈরি করে রেখেছেন। এবং এরমধ্যে মানুষ হলো সেরা। মানুষের এই জীবনটা হলো একটা কন্টিনিউশন। দুইটা প্যারাডাইমের মধ্যে ধারণাগত এ রকম বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তাই তাদের ‘প্রাইভেট-পাবলিক ডিস্টিংশনের’ ধারণাটি এখানে হুবহু প্রযোজ্য হবে না। এটা হলো মূল ব্যাপার।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on pinterest
Pinterest
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সর্বশেষ